লিবিয়ার ঘটনা ধারা দেখে মনে হয় তেল
যেন যাদুর ক্ষমতা রাখে; বোধ হয়, তেলের কারণে বন্ধু হয়ে যায় শত্রু, আর শত্রু
হয় বন্ধু অথবা, গত পরশুর শত্রু গতকাল হয়ে যায় বন্ধু, আবার আজ হয় শত্রু।
প্রকাশ হওয়া দলিলপত্র সে কথাই বলছে।
ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির গোয়েন্দা
বাহিনীর নানা কার্যালয় থেকে যে সব নথিপত্র পাওয়া গেছে, সেগুলোর কিছু কিছু
প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। এগুলো ছাড়া অন্যান্য দলিলও ফাঁস হয়েছে।
প্রকাশিত সে দলিলপত্র থেকে দেখা যায়, গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে আজকের
পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর গভীর বন্ধুত্ব ও ব্যাপক সহযোগিতার তথ্য।
অথচ এই গাদ্দাফিকেই পশ্চিমা দুনিয়ার
একজন প্রেসিডেন্ট অভিহিত করেছিলেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে। সে
ভাষা রাষ্ট্রনায়কোচিত কিনা তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতে পারে; তবে সে ভাষার
মধ্যে থাকা তীব্র ঘৃণা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। এই গাদ্দাফির
নেতৃত্বাধীন লিবিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলাফল এত ব্যাপক হয়ে
উঠেছিল যে, লিবিয়ার তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। নিষেধাজ্ঞার কারণে
তেল আহরণের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি কমে যায়, হ্রাস পায় তেল আহরণ
কাজে বিনিয়োগ। তেল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার অন্যান্য কারণও ছিল। যেমন তেল দ্রুত
ফুরিয়ে যাবে আশঙ্কা করে লিবিয়া সরকার তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছিল; ছিল
ব্যবস্থাপনার সমস্যা, ওপেকের নির্ধারিত কোটা। তবে নিষেধাজ্ঞার নিগড় এত
প্রবল হয়ে ওঠে যে, তেলজাত কোনো কোনো পণ্য লিবিয়াকেই আমদানি করতে হয়েছিল।
এমন একটি পণ্যের নাম গ্যাসোলিন। পরে, এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়,
গাদাফি আর ‘পাগলা কুকুর’ থাকেন না, তার সঙ্গে দেখা করতে যান মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস, গাদ্দাফির কাছে কন্ডোলিৎসা হয়ে ওঠেন
‘ডার্লিং’। গাদ্দাফির ফটো অ্যালবামের বান্ডিলে পাওয়া কন্ডোলিৎসার ছবিতে
তেমনই লেখা ছিল। গাদ্দাফির সঙ্গে দেখা করেন, বন্ধুত্বের করমর্দন করেন, আজ
গাদ্দাফিকে শত্রু গণ্য করেন এমন অনেক রাষ্ট্রনায়কই। এদের মধ্যে ছিলেন
ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী
বারলুসকোনি। আর জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে লিবিয়ার
তেলক্ষেত্রে পা দেওয়ার সুযোগ পায় ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) ও রয়্যাল ডাচ
শেল। ব্লেয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে বন্ধুত্বের সাক্ষাৎ শেষে আশা প্রকাশ করেছিলেন
সশস্ত্রবাহিনী, শিক্ষা ও তেল আহরণ ক্ষেত্রে দু’দেশের, লিবিয়ার ও
ব্রিটেনের, বন্ধন জোরদার হবে।
লিবিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাসের চুক্তি
করার বিষয় এবং লিবিয়ায় শেলের ব্যবসা নিয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রীরা ও ব্রিটেনের
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তারা তেল কোম্পানি শেলের সঙ্গে চার বছরেরও কম
সময়ের মধ্যে ১১ থেকে ২৬ বার আলোচনায় মিলিত হন। ব্রিটিশ মন্ত্রী ও কর্তারা
কমপক্ষে ১২ বার চেষ্টা করেন লিবিয়ার মন তুষ্ট করার। ব্রিটেনের পত্রিকা
অবজারভার বিভিন্ন দলিলপত্র পেয়েছে। সে দলিলপত্র থেকে এ তথ্য জানা যায়।
লিবিয়া ও মিসরে শেলের বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় জড়িত ছিলেন শ্রমিক দলীয় সরকারের
মন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড ও দলের সাবেক নেতা লর্ড কিনক। লিবিয়ায় ঢোকার
জন্য শেলকে মদদ যোগায় ব্রিটিশ সরকার। এ ঘটনা দেখেই একজন নেতৃস্থানীয়
মানবাধিকার কর্মী বলেছেন : গণতন্ত্র ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের রাস্তায়
রাখা হয় আর বড় কোম্পানির কর্তারা সহজে ঢুকে যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
একেবারে ওপরতলায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত বড় কোম্পানির স্বার্থ নয়,
জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা, ফাইল খুলে দেওয়া, সরকারি সিদ্ধান্ত
গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তেলওয়ালাদের প্রভাবের মাত্রা প্রকাশ করে দেওয়া।
উল্লেখ করা দরকার, লিবিয়ার ওপর থেকে
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরে পাশ্চাত্যের যে তেল কোম্পানিগুলো
সবার আগে লিবিয়ায় পা রাখে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে শেল, লিবিয়ার রাষ্ট্রীয়
মালিকানাধীন ইন্ধন কোম্পানির সঙ্গে শেলের দীর্ঘমেয়াদি শরিকানা গঠন করে
সম্পাদিত হয় লেনদেন। সে দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ। এটি সম্পাদিত হয় সে
সময়ে, যখন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার লিবিয়া সফর করছেন,
গ্রহণ করছেন গাদ্দাফির উষ্ণ আপ্যায়ন।
এরপরে বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে শেল কর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রীদের ও আমলাদের। সে সব বৈঠকের বিষয় ছিল লিবিয়ায় তেল বাণিজ্য।
অর্থাৎ, লিবিয়ার তেলের ভাগ নিতে তেল
কোম্পানিকে পশ্চিমা শক্তিধর সরকার যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি এরাও বন্ধুত্ব
করেছে আজ তাদেরই ধিকৃত গাদ্দাফির সঙ্গে।
নিউইয়র্ক টাইমস এ বছরের মার্চে জানায়,
লিবিয়ায় তেল ব্যবসা করার জন্য অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম ২০০৮ সালে সাইনিং
বোনাস বা চুক্তি স্বাক্ষর বোনাস হিসেবে লিবিয়া সরকারকে দিয়েছিল একশ’ কোটি
ডলার। চুক্তিটি ছিল ৩০ বছর মেয়াদি। এর আগের বছর কানাডার বিশাল তেল কোম্পানি
পেট্রো-কানাডা লিবিয়াকে দিয়েছিল একশ’ কোটি ডলার। এটাও ছিল ৩০ বছর মেয়াদি
চুক্তিসংশ্লিষ্ট। এ চুক্তি ছিল তেল অনুসন্ধান বিষয়ে। সংবাদপত্রের এ খবরে এই
অর্থ প্রদানকে ঘুষ হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন
অনুসারে বিদেশী কর্তাদের ঘুষ দেওয়া যায় না। তাই প্রদান করা এ অর্থকে
অভিহিত করা হয় পে অফ হিসেবে।
আবার, এ খবরেই বলা হয় : লিবিয়ার
বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে ক্ষতিগ্রস্তদের লিবিয়া ক্ষতিপূরণ দেবে বলে একটি
আইনের বিরুদ্ধে কয়েকটি বড় তেল কোম্পানি দেনদরবার করে। এসব কোম্পানির মধ্যে
ছিল অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম, এক্সনমবিল, এনাডারকো পেট্রোলিয়াম, শেভরন,
কনোকো-ফিলিপস, ম্যারাথন অয়েল, এসব কোম্পানি আমেরিকান পেট্রোলিয়াম
ইন্সটিটিউটের সদস্য। এ ইন্সটিটিউট হচ্ছে তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের একটি গ্রুপ।
তবে পরবর্তীকালে এক খবরে বলা হয়, অক্সিডেন্টাল বা পেট্রো-কানাডা অর্থ
প্রদান করেনি। অর্থাৎ এ খবর থেকে এটুকু স্পষ্ট হয় যে, লিবিয়ার তেল বাণিজ্য
বড় ধরনের আগ্রহের বিষয় ছিল, এ বাণিজ্য নিয়ে লেনদেনের ঘটনা থাকতে পারে এবং
লেনদেনের ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর বা শব্দের মারপ্যাঁচ থাকতে পারে।
কেবল ব্রিটিশ বা আমেরিকান কোম্পানি বা
স্বার্থের সঙ্গে লিবিয়ার ঘটনাবলী যুক্ত নয়, সেখানে অন্য দেশের তেল
কোম্পানির নানা ধরনের লেনদেন বা ‘বন্ধুত্বের’ খবর এখন প্রকাশিত। অর্থাৎ
লিবিয়ার আজকের ঘটনাবলীকে কেবল মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সংক্রান্ত মহান
প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত করে দেখাটা বিভ্রান্তিকর। কারণ সেখানে বর্তমান
গোলযোগ, ন্যাটো হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই মানবাধিকার
সংক্রান্ত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে লিবিয়ায় মানবাধিকারের প্রশংসা করা হয় এর
পর পরই শুরু হয় গোলযোগ ও যুদ্ধ। তখন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির মুখে সে
প্রতিবেদন প্রকাশ স্থগিত রাখা হয়। দেখা যাচ্ছে লিবিয়ার ঘটনাবলী সোজা একদিকে
প্রবাহিত হয়নি। তা নিয়েছে নানা দিক; উল্টোপাল্টা তার ধরন, সহজেই
বিভ্রান্তিকর। এ লেখার পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা কয়েকটি ঘটনা উল্টাপাল্টা,
আপাত বিভ্রান্তিকর ধরনটি স্পষ্ট করে তোলে।
ব্রিটেনের দৈনিক পত্রিকা দ্য
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ৭ সেপ্টেম্বর এক খবরে জানায় : অস্ত্র তৈরির জায়ান্ট বা
বিশাল মার্কিনী কোম্পানি জেনারেল ডায়নামিকয়ের ব্রিটিশ শাখা জেনারেল
ডায়নামিক ইউকে গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইউনিট খামিস ব্রিগেডের
ট্যাংক, গোলন্দাজ ইউনিট ও সাঁজোয়া যানে নতুন রেডিও ব্যবস্থা যোগ করছিল সে
সময়ে, যখন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন
ফেব্রুয়ারি মাস, এ কাজটি ছিল লিবিয়া সরকারের সঙ্গে ব্রিটেনের সরকারের
সম্পাদিত ৮ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের একটি অস্ত্র চুক্তির অংশ।
এ ঘটনা প্রসঙ্গেই পরিহাসের সুরে
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইমার্জেন্সি ডিরেক্টর পিটার
বেউকার্ট বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে অস্ত্র সংগ্রহকে সাবাশ দিতেই হয়।
এরই ফলে লিবিয়ার সেনাবাহিনীর কোনো কোনো এলিট ইউনিট এত সবল হতে পেরেছিল।
গাদ্দাফির সঙ্গে পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব
কত উষ্ণ ও গভীর ছিল, তারও উদাহরণ পাওয়া যায় ওই খবরে। এ সংবাদে বলা হয়,
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গাদ্দাফির দুই পুত্র খামিস ও সাদীকে ব্রিটেনের বিশেষ
কমান্ডো সেনাদের কাজের ভিআইপি প্রদর্শনী দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল। আজ, এ
ব্রিটিশ কমান্ডো দল, এসএএম এবং এমবিএস, লিবিয়ার মাটিতে গাদ্দাফিকে খুঁজে
বের করতে গাদ্দাফিবিরোধীদের সহায়তা করছে বলে ধারণা করা হয়। এ মন্তব্য ওই
পত্রিকার।
এ-ই হচ্ছে বন্ধুত্ব ও বৈরিতার মিলন!
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক
অলিভার স্প্রাগ বলেছেন, গাদ্দাফি সরকারকে অস্ত্রসজ্জিত করার কাজে ব্রিটেনের
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বিষয়ে দলিলপত্র দেখে তিনি সামান্য অবাক হননি। এ বছরের
গোড়ার দিকে জাতিসংঘ যখন লিবিয়ার ওপরে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সে সময়ের
আগে লিবিয়া ছিল ওই অঞ্চলে ব্রিটেনের সেরা অস্ত্র খরিদ্দারদের অন্যতম।
ব্রিটেনের সমরাস্ত্রের তালিকায় আছে, এমন যে কোনো অস্ত্রই কার্যত বিক্রি
করতে দিয়েছে ব্রিটেন সরকার।
এ ঘটনার, অস্ত্র বিক্রির, পরে লিবিয়ায়
ন্যাটোর যুদ্ধের ঘটনা আজ সবার জানা। গাদ্দাফির সঙ্গে বিশ্ব ব্যক্তিদের
বন্ধুত্বের নিদর্শন কেবল তেল ব্যবস্থা আর অস্ত্র বেচাকেনার মধ্যে সীমিত ছিল
না। গোয়েন্দা জগতে সে মৈত্রী ছিল প্রবল, সহযোগিতা ছিল সক্রিয়। এ গোয়েন্দা
মৈত্রীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, দু’দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই হাতে হাত
মিলিয়ে কাজ করেছে গাদ্দাফি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। লিবিয়ার
গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গোয়েন্দাবৃত্তির সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে
নানা দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সংক্রান্ত দলিলপত্রও এখন তথ্যমাধ্যম
প্রকাশ করেছে। এসব সহযোগিতার ঘটনা নিষ্ঠুরতায়-অমানবিকতায় পূর্ণ।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয় : লিবিয়ায় যে শাসককে আজ এত ধিকৃত হিসেবে
দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে মাত্র কমাস আগেও এত বন্ধুত্বের কারণ কি? এ
প্রশ্নের উত্তর তেল-গ্যাস। সেই সঙ্গে আছে ভূ রাজনীতির, ভূরণনীতির ‘খেলা’।
আজ গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অত্যাচার, নিপীড়নের যে অভিযোগ আনা
হচ্ছে কমাস আগেও এ কাজে অভিযোগকারী অনেক রাষ্ট্রই ছিল গাদ্দাফির সহযোগী,
মদদদাতা। তা হলে কি তেল-গ্যাস মুঠোবদ্ধ করার কাজে কোনো নীতি-নৈতিকতার
বিবেচনা থাকে না? নীতি-নৈতিকতা তো আছেই। ওই ধরনটিই হচ্ছে মুনাফার লোভের
নীতি-নৈতিকতা; এ নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে অন্য নীতি-নৈতিকতার মিল নেই।
সাম্রাজ্য অটুট রাখতে, অব্যাহত রাখতে মুনাফার প্রবাহ, এ নীতি-নৈতিকতাই
কার্যকর। তাই প্রভুরা এ নীতি-নৈতিকতাই অনুসরণ করেছেন।
গাদ্দাফিবিরোধীদের সম্পর্কে ব্রিটেনের
ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য যুগিয়েছ গাদ্দাফিকে। আল কায়দার
সঙ্গে যোগাযোগ আছে সন্দেহে গাদ্দাফিবিরোধীকে আশ্রয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চীন
থেকে হংকংয়ে এনে সপরিবারে বিমানে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপোলি। এ কাজে
সহযোগিতা করে ওই দুটি পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। একটি গোয়েন্দা সংস্থা
তো হংকং থেকে ত্রিপোলি যাত্রার বিমান ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল
লিবিয়া সরকারকে। আর সেই গাদ্দাফিবিরোধীকে ত্রিপোলি নিয়ে সপরিবারে কারাগারে
আটক রাখা হয় বছরের পর বছর। গাদ্দাফিবিরোধীর ওপর চলে নির্যাতন। এ নির্যাতন
যখন চালানো হয়, তখন পাশের কক্ষেই রাখা হয় তার গোটা পরিবারকে। এ পরিবারের
সর্বকনিষ্ঠ সদস্যা অর্থাৎ গাদ্দাফিবিরোধীর কন্যার মেয়ের বয়স তখন ছয় বছর।
নির্যাতনের এ কাহিনীটি আরো দীর্ঘ, আরো নিষ্ঠুর, আরো অমানবিক। এ
গাদ্দাফিবিরোধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওই দুটি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে
একটি সংস্থার কর্তারা আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাদ্দাফির গোয়েন্দা সংস্থার
কর্তাদের ৫৯টি প্রশ্ন লিখে পাঠান অপর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারা।
জিজ্ঞাসাবাদকালে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাটির কর্তাদের গাদ্দাফিবিরোধী
জানান, তার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে গাদ্দাফির গোয়েন্দা কর্তারা। কিন্তু এ
তথ্য জানানোর পরও তাকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেননি পশ্চিমা গোয়েন্দা
সংস্থাটির কর্তারা। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়েছে। এ
ধরনের সহযোগিতার ঘটনা অনেক। আজ তাই প্রশ্ন উঠেছে : মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়
নেবে কে? মানবাধিকার রক্ষার পবিত্র কর্তব্য কে পালন করছে।
ফাঁস হওয়া দলিল-দস্তাবেজ থেকে দেখা
যাচ্ছে : ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ওপর নজরদারি করতে লিবিয়া সরকারকে
অত্যন্ত আধুনিক সরঞ্জাম যোগান দিয়েছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার কয়েকটি কোম্পানি
এবং অন্ততপক্ষে একটি চীনা কোম্পানি। সহযোগিতার কি বিচিত্র বাস্তবতা! মত
প্রকাশের ও অবাধ যোগাযোগের অধিকার নিয়ে কথা বলা কার মুখে যে শোনায় ভালো, তা
সাধারণ মানুষের কাছে কি দুর্বোধ্য? গণতন্ত্রের পতাকা কার হাতে মানায় ভালো,
সে প্রশ্ন খুবই জটিল।
গাদ্দাফি পুত্র সাইফকে আজ খুঁজে
বেড়ানো হচ্ছে। অথচ ক’বছর আগে লন্ডনে এ সাইফের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল
ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থার সেই বিভাগটি, যে বিভাগের কাজ রাজপরিবারের
সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করা। এ খবর প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের
গার্ডিয়ান পত্রিকায়।
কে জবাব দেবে এ প্রশ্নের : কে সাধু,
কে দুর্বৃত্ত? এটাই বোধ হয় মুনাফার জগতের চেহারা-চরিত্র! তেল-গ্যাসের জগতের
চেহারা-চরিত্র, কাজ-কর্ম বোধ হয় আরো রহস্যময়, আরো নিষ্ঠুর, আরো অমানবিক,
আরো শঠতায় ভরা! তেল-গ্যাস কব্জা করার কতই না ছলনা!
আর, মৌলিক প্রশ্নগুলো তো রয়েই গেছে :
তেল-গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ কি কেবল দুর্ভোগ-দুর্দশাই ডেকে আনবে? এই
গাদ্দাফিই তো আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নিগড় শিথিল করতে
নিয়েছিলেন কয়েকটি বড় ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ, দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো
মানুষের লড়াইয়ে সমর্থন দিয়েছিলেন কার্যকরভাবে; অথচ এ গাদ্দাফিই আবার হাত
মেলালেন অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। এ-ই কি তেলের রাজনীতি? এর কি
বিকল্প নেই, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ বয়ে আনবে শান্তি-সম্প্রীতি?
No comments:
Post a Comment