কঙ্গোতে
লুটের ‘কাহিনী’ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয় : সেখানে সংঘাতের ধরনটি
লোভনীয়। এ কারণে এ সংঘাত বিবদমান সব পক্ষের জন্যই লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি
করেছে। শত্রুরা, বৈরী পক্ষগুলো ব্যবসায়ের শরিক, খনিতে মজুর হিসেবে কাজ করতে
হয় বন্দিদের। শত্রুরা একই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অস্ত্র পায়, অস্ত্র
বেচাকেনার মধ্যস্থতাকারীরাও একই। ব্যবসা আড়াল করে ফেলেছে নিরাপত্তার
বিষয়গুলোকে। এ ব্যবসা-উদ্যোগে লোকসান হয় কেবল কঙ্গোর জনগণের।
ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সব পাঠকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে কঙ্গোয় লুটের সত্য। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের উপসংহারে আরো নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে : এ সংঘাতের ধরন লোভনীয়। তাই বিভিন্ন দেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডারদেরও এ সংঘাত দরকার। এর ফলে সম্পদ নাগালের মধ্যে আসে, এ কমান্ডাররা উপলব্ধি করেছেন যে, যুদ্ধ নিজেই নিজেকে চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই এ যুদ্ধ অপরাধীদের জাল তৈরি করেছে।
এতে বলা হয় : দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতারা কঙ্গোয় অবস্থানরত সেনাবাহিনীগুলোর সরকারগুলোকে বিভ্রান্তিকর ইঙ্গিত দিয়েছে। এসব উপসংহার স্পষ্টভাবে বলে দেয় কঙ্গোর সম্পদ লুটের সঙ্গে সংঘাতের সম্পর্ক, স্পষ্টভাবে বলে দেয় সম্পদ লুটের সঙ্গে কোন কোন পক্ষ জড়িত। এবং এ মন্তব্য পর্যবেক্ষণ করেন কোনো দলীয় বা কোনো দেশের পক্ষ অনুযায়ী দেশ নয়, তা করেন জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডার মধ্য দিয়ে কঙ্গোর খনিজ সামগ্রী আমদানি করে বিভিন্ন দেশের কোম্পানি। রুয়ান্ডার রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাওয়া আংশিক তথ্য থেকে দেখা যায় এসব কোম্পানি হচ্ছে নিম্নোক্ত দেশগুলোর : বেলজিয়াম, জার্মানি, রুয়ান্ডা, মালয়েশিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে অাঁতাত রয়েছে সরকারের সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের। এতে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাংকের, মন্ত্রণালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়। দেখা যায় যে, লুটের কাজে ব্যবহারের জন্য কোনো কোনো দেশ জাল মার্কিন ডলার ছাপে। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে রাজনৈতিক বৈধতা যোগায় কোনো কোনো উন্নত দেশ। এতে বিশ্বব্যাংকের নাম উল্লেখ করে ১৮৮ নম্বর প্যারাতে যা বলা হয় তার সারকথা দাঁড়ায় এটাই যে, এ লুটের কথা বিশ্বব্যাংক জানে, বিশ্বব্যাংক জানে এ লুট উগান্ডার ও রুয়ান্ডার অর্থনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ছিল নীরব।
মজার ব্যাপার হচ্ছে লুটের অর্থের বিপুল অংশ ব্যয় হয় অস্ত্র কেনায় এবং অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে লুটের কাজ দ্রুততর করা হয়। এ বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়। লুট থেকে পাওয়া অর্থের শেষ গন্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই গন্তব্য অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও অস্ত্র কোন কোন পন্থায় আসে? প্রতিবেদনে বলা হয় : এটা চলে তিনভাবে। এগুলো হলো : এক. সরাসরি অর্থ দিয়ে কেনা হয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম; দুই. বিনিময়; অর্থাৎ খনিজ সামগ্রীর বিনিময়ে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়; এবং তিন. যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা এটাও দেখেন যে, সংঘাতে জড়িত দেশগুলোর সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ, প্রকৃত খরচ তার চেয়ে বেশি। কিভাবে আসে এ অর্থ? উত্তর সহজ : লুট।
প্রতিবেদনটির আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে কঙ্গোর এ সংঘাতে লুটে জড়িত কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা। এ ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক নেতা নন; কিন্তু ঘটনার নায়ক বা নায়িকা। এদের একটি তালিকা পেশ করে প্রতিবেদনে বলা হয় : এ তালিকা পরিপূর্ণ নয়। লুটে ও সংঘাতে এ নায়ক-নায়িকাবৃন্দ সরাসরি জড়িত। এদের নাম মেজর জেনারেল সলিম সালেহ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস কাজিনি, কর্নেল টিকামানিয়ার, কর্নেল উতাফায়ার, জনাব খলিল, জনাব আবদুর রহমান এবং এমন আরো।
প্রতিবেদনে এদের কান্ডকারখানার কম-বেশি উল্লেখ করা হয়। মেজর জেনারেল সালেহ ও তার স্ত্রী কহোয়া উগান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বেআইনিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের মূল চরিত্র। সালেহ উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির ছোট ভাই বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তার ডান হাত ব্রি জে কাজিনি। তিনি রক্ষা করেন নিয়মবিসি ও তিবাসিমাকে। আর এ দু’জন রক্ষা করেন তার বাণিজ্য। সে বাণিজ্য হীরা, কাঠ, কফি, সোনার।
এভাবে একের পর এক বিবরণ পড়লে পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, তা রহস্য উপন্যাসকে যেন ম্লান করে দিচ্ছে।
এ প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে এক নারীর নাম। তিনি যেন নায়িকা। তিনি আজিজা কুলসুম গুলাম আলি। (বাংলায় আমরা হয়তো লিখতাম ‘গোলাম আলি’)। মিসেস গুলাম আলির কয়েকটি পাসপোর্ট। তিনি থাকেন কখনো বুকাভুতে, কখনো ব্রাসেলসে, কখনো বা নাইজেরিয়াতে। ব্যাপারটি নির্ভর করে তার কাজের ওপরে। এ মিসেস ইতিপূর্বে বুরুন্ডিতে গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বুরুন্ডিতে একদল ‘বিদ্রোহী’কে অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়েছিলেন। এর পরে, তিনি নতুন জোট গড়ে তোলেন রুয়ান্ডার সরকারের সঙ্গে, হয়ে ওঠেন কিগালি সরকারের বড় মিত্র। মিসেস গুলাম আলি রুয়ান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সোনা, কোলটান ও ক্যাসিটেরাইট ব্যবসায়ে জড়ান। এর আগে তিনি জড়িয়ে ছিলেন বুরুন্ডির হটুদের সুবিধার্তে অস্ত্র, সোনা ও গজদন্ড চোরাকারবারে। সিগারেট চোরাচালানেও তার নাম শোনা যায়। বেআইনি ব্যবসাকে তিনি আড়াল করতেন তার সিগারেট ফ্যাক্টরি দিয়ে। সে কারখানা আজ লাটে উঠেছে। কোলটান ব্যবসায়ে তার খদ্দেরদের মধ্য রয়েছে স্টার্ক, কোগেকম, সোগেম। বড় দুটি ব্যাংক তার আর্থিক লেনদেনের কিছুটা সামাল দেয়। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা কয়েকবার অনুরোধ জানালেও বেগম গুলাম আলি তাদের সঙ্গে দেখা দেখা করেননি। এ প্রতিবেদন রচনাকালে কোলটান রফতানি ব্যবসায়ের একচেটিয়া আয়োজনের প্রধান হয়ে ওঠেন তিনি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জাল নোটও তৈরি করেন। তিনি শুল্ক সংক্রান্ত কাগজপত্র জাল করেন। তিনি বলেছেন, ‘এ ব্যবসায়ে সবাই এটা করে।’ বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন কোলটান রফতানির কোম্পানিগুলোর মধ্যে জুয়াচুরি ব্যাপক।
এসব কর্মে এক শ্রেণীর ব্যাংকও যুক্ত। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে এদের নাম ও কাজের বিশদ বিবরণ রয়েছে। এতে জড়িত এক শ্রেণীর বিশাল কোম্পানি। এগুলো সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। এ লুটের কাজ সহজ করতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রশাসনিক কাঠামোও সাজানো হয় উপযুক্তভাবে। কখনো ভিন দেশের প্রশাসনিক প্রধানপদে আসীন করা হয় কঙ্গোর লোককে। তার কাজ হবে স্বদেশে লুটের কাজ সংগঠিত করা।
আর শ্রম? সে তো বিশ্বজনীন। শৃঙ্খলিত শ্রমকে নিয়োগ করা হয় পৃথবীর গভীর থেকে সম্পদ তুলে আনতে। শিশু শ্রমও রেহাই পায় না। লুট কতটুকু, কেমন পরিমাণ হয়? জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনেই উত্তর খোঁজা যাক। প্রতিবেদন বলেছে : ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৯৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশী সেনা দলগুলোর দখল করা কঙ্গোর এলাকাগুলো থেকে খনিজ সম্পদ, কৃষিজ ও বনজ সামগ্রী, গবাদিপশু লুটে নিঃশেষ করা হয়েছে; যাকে ইংরেজিতে অভিহিত করা হয়েছে ড্রেইনড অফ। বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা যে দেশই হোক, লুটের ধরন এক। একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য আসে খামার, গুদামে, কারখানায়, ব্যাংকে, তারা আদেশ দেয় দরোজা খুলে দিতে। সেনারা লুটের মাল তোলে গাড়ির পর গাড়িতে। লুটের মাল নিয়ে গাড়ির বহর চলে যায়। কঙ্গোর একটি অঞ্চলে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৯ সালে এপ্রিলের মধ্য ২০০০-৩০০০ টন ক্যাসিটেরাইট ও ১০০০-১৫০০ টন কোলটান লুটে নেওয়া হয়। সৈন্যদের পাহারায় বস্তা বস্তা অর্থ নেওয়া হয়।
দেখা যাচ্ছে, লুটের অাঁতাত অনেক বিস্তৃত, ব্যক্তি মালিক থেকে রাষ্ট্র, ‘বিদ্রোহী’ থেকে ব্যবসায়ী, সেনানায়ক থেকে অস্ত্র নির্মাতা, সবাই আছে এ কাজে মিলেমিশে। এরাই কি সব? এদের আড়ালে কি কেউ নেই। কোন সে সুতো, যা এদের সবাইকে বেঁধে রাখে এক সঙ্গে? সে কি ধনলিপ্সা, লোভ? সে কি ‘আরো আরো চাই, যত পাই, তত চাই?’ স্থানাভাবে সবের বিবরণে না গিয়ে কেবল কোলটানে কান্ডটাই দেখা যাক। এন্টয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ম্যারিজ ২০০২ সালে রাইজ অ্যান্ড ডিক্লাইন অব দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম বিষয়ে সম্মেলনে পেশ করেন প্লান্ডার, ক্রিমিনালাইজেশন অব দ্য স্টেট অ্যান্ড ডিক্লাইন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম : দ্য কেস অব ডি আর কঙ্গো শিরোনামে প্রবন্ধ। এতে তিনি ছক কেটে দেখান যে, খনি আর নদীর বুক থেকে মজুররা তুলে আনেন কোলটান। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সামরিক চক্রের হাত ঘুরে তা পেঁŠছায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এবং সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর হাতে। সেগুলো পেঁŠছে দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে। সেখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানার ভেতর দিয়ে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো নাম নিয়ে তা হাজির হয় সূক্ষ্ম প্রযুক্তির শিল্পে। এ সামগ্রী প্রক্রিয়ার কারখানা জগতে রয়েছে গোটা বিশেক কাজাখস্তানে, যুক্তরাষ্ট্রে, জার্মানিতে, চীনে, জাপানে। এগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি কারখানা বানাতে পারে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো। সে চারটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, জাপানে, জার্মানিতে, চীনে। আর সূক্ষ্ম প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলকাটেল কমপ্যাক, ডেল, এরিকসন, এইচপি, আইবিএম, নকিয়া, সিমেন্স, লুসেন্ট, মটোরোলা। বড় চেনা নাম এগুলো। এই চেনা নামের কোম্পানি সব কোটি কোটি খদ্দেরের কাছে পেঁŠছে দেয় মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গেম বা খেলার ডিজিটাল সামগ্রী।
এসবের মাঝে থাকে পরিবহন, ব্যাংক, রাজনীতি, বিধি, শুল্ক, বিশ্ব শক্তি। ডেনা মন্টেগু ২০০২ সালে স্টোলেন গুডস : কোলটান অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন দ্য ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : রোয়ান্ডা ও উগান্ডাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।
এসবে আরো মিশে থাকে : রক্ত। আরো থাকে : মেহনত, মজুরদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে নেওয়া মেহনত। আর সব শেষে থাকে মুনাফা। কতিপয়ের পকেটে, অ্যাকাউন্টে। সে কতিপয় প্রমোদতরীতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ থেকে দ্বীপে, ক্যারিবিয়ানের সূর্যাস্ত রং মেখে দেয় তাদের চোখে। কোলটানের রক্তাক্ত, নিষ্ঠুর, ‘সুন্দর’ যাত্রা!
কোলটান থেকে কে কত পায়? এ হিসাব করা প্রায় ধাঁধার উত্তর খোঁজার মতো। কারণ, তথ্যগত বিভ্রান্তি বেশি। একজন গবেষক এ সংক্রান্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে অনুমান করেছেন যে, স্থানীয় বেপারী ১০ ডলার পেলে রুয়ান্ডার ব্যবসায়ী পায় ২০০ ডলার, আর পাঁচ-ছয়জন খনিমজুরের একেকটি গ্রুপ পায় সপ্তাহে ৩০ ডলার। অর্থাৎ দিনে একজন পায় ১ ডলারের কম। আহরণের পরে ৩০ কিলোগ্রাম সামগ্রী বস্তায় ভরে হেঁটে হেঁটে তা নেওয়া হয় স্থানীয় ব্যবসায় কেন্দ্রে, গড়ে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে। সোনা, হীরা লুটের ঘটনা আরো নিষ্ঠুর। তবে লুটের ধরন একই। সে বিষয়ে আর আলোকপাত না করে আগামীতে দেখা যাবে আরো লোভনীয় ক্ষেত্রে কেমন ঘটনা ঘটে চলেছে।
ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সব পাঠকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে কঙ্গোয় লুটের সত্য। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের উপসংহারে আরো নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে : এ সংঘাতের ধরন লোভনীয়। তাই বিভিন্ন দেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডারদেরও এ সংঘাত দরকার। এর ফলে সম্পদ নাগালের মধ্যে আসে, এ কমান্ডাররা উপলব্ধি করেছেন যে, যুদ্ধ নিজেই নিজেকে চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই এ যুদ্ধ অপরাধীদের জাল তৈরি করেছে।
এতে বলা হয় : দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতারা কঙ্গোয় অবস্থানরত সেনাবাহিনীগুলোর সরকারগুলোকে বিভ্রান্তিকর ইঙ্গিত দিয়েছে। এসব উপসংহার স্পষ্টভাবে বলে দেয় কঙ্গোর সম্পদ লুটের সঙ্গে সংঘাতের সম্পর্ক, স্পষ্টভাবে বলে দেয় সম্পদ লুটের সঙ্গে কোন কোন পক্ষ জড়িত। এবং এ মন্তব্য পর্যবেক্ষণ করেন কোনো দলীয় বা কোনো দেশের পক্ষ অনুযায়ী দেশ নয়, তা করেন জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডার মধ্য দিয়ে কঙ্গোর খনিজ সামগ্রী আমদানি করে বিভিন্ন দেশের কোম্পানি। রুয়ান্ডার রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাওয়া আংশিক তথ্য থেকে দেখা যায় এসব কোম্পানি হচ্ছে নিম্নোক্ত দেশগুলোর : বেলজিয়াম, জার্মানি, রুয়ান্ডা, মালয়েশিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে অাঁতাত রয়েছে সরকারের সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের। এতে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাংকের, মন্ত্রণালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়। দেখা যায় যে, লুটের কাজে ব্যবহারের জন্য কোনো কোনো দেশ জাল মার্কিন ডলার ছাপে। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে রাজনৈতিক বৈধতা যোগায় কোনো কোনো উন্নত দেশ। এতে বিশ্বব্যাংকের নাম উল্লেখ করে ১৮৮ নম্বর প্যারাতে যা বলা হয় তার সারকথা দাঁড়ায় এটাই যে, এ লুটের কথা বিশ্বব্যাংক জানে, বিশ্বব্যাংক জানে এ লুট উগান্ডার ও রুয়ান্ডার অর্থনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ছিল নীরব।
মজার ব্যাপার হচ্ছে লুটের অর্থের বিপুল অংশ ব্যয় হয় অস্ত্র কেনায় এবং অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে লুটের কাজ দ্রুততর করা হয়। এ বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়। লুট থেকে পাওয়া অর্থের শেষ গন্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই গন্তব্য অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও অস্ত্র কোন কোন পন্থায় আসে? প্রতিবেদনে বলা হয় : এটা চলে তিনভাবে। এগুলো হলো : এক. সরাসরি অর্থ দিয়ে কেনা হয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম; দুই. বিনিময়; অর্থাৎ খনিজ সামগ্রীর বিনিময়ে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়; এবং তিন. যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা এটাও দেখেন যে, সংঘাতে জড়িত দেশগুলোর সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ, প্রকৃত খরচ তার চেয়ে বেশি। কিভাবে আসে এ অর্থ? উত্তর সহজ : লুট।
প্রতিবেদনটির আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে কঙ্গোর এ সংঘাতে লুটে জড়িত কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা। এ ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক নেতা নন; কিন্তু ঘটনার নায়ক বা নায়িকা। এদের একটি তালিকা পেশ করে প্রতিবেদনে বলা হয় : এ তালিকা পরিপূর্ণ নয়। লুটে ও সংঘাতে এ নায়ক-নায়িকাবৃন্দ সরাসরি জড়িত। এদের নাম মেজর জেনারেল সলিম সালেহ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস কাজিনি, কর্নেল টিকামানিয়ার, কর্নেল উতাফায়ার, জনাব খলিল, জনাব আবদুর রহমান এবং এমন আরো।
প্রতিবেদনে এদের কান্ডকারখানার কম-বেশি উল্লেখ করা হয়। মেজর জেনারেল সালেহ ও তার স্ত্রী কহোয়া উগান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বেআইনিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের মূল চরিত্র। সালেহ উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির ছোট ভাই বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তার ডান হাত ব্রি জে কাজিনি। তিনি রক্ষা করেন নিয়মবিসি ও তিবাসিমাকে। আর এ দু’জন রক্ষা করেন তার বাণিজ্য। সে বাণিজ্য হীরা, কাঠ, কফি, সোনার।
এভাবে একের পর এক বিবরণ পড়লে পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, তা রহস্য উপন্যাসকে যেন ম্লান করে দিচ্ছে।
এ প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে এক নারীর নাম। তিনি যেন নায়িকা। তিনি আজিজা কুলসুম গুলাম আলি। (বাংলায় আমরা হয়তো লিখতাম ‘গোলাম আলি’)। মিসেস গুলাম আলির কয়েকটি পাসপোর্ট। তিনি থাকেন কখনো বুকাভুতে, কখনো ব্রাসেলসে, কখনো বা নাইজেরিয়াতে। ব্যাপারটি নির্ভর করে তার কাজের ওপরে। এ মিসেস ইতিপূর্বে বুরুন্ডিতে গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বুরুন্ডিতে একদল ‘বিদ্রোহী’কে অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়েছিলেন। এর পরে, তিনি নতুন জোট গড়ে তোলেন রুয়ান্ডার সরকারের সঙ্গে, হয়ে ওঠেন কিগালি সরকারের বড় মিত্র। মিসেস গুলাম আলি রুয়ান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সোনা, কোলটান ও ক্যাসিটেরাইট ব্যবসায়ে জড়ান। এর আগে তিনি জড়িয়ে ছিলেন বুরুন্ডির হটুদের সুবিধার্তে অস্ত্র, সোনা ও গজদন্ড চোরাকারবারে। সিগারেট চোরাচালানেও তার নাম শোনা যায়। বেআইনি ব্যবসাকে তিনি আড়াল করতেন তার সিগারেট ফ্যাক্টরি দিয়ে। সে কারখানা আজ লাটে উঠেছে। কোলটান ব্যবসায়ে তার খদ্দেরদের মধ্য রয়েছে স্টার্ক, কোগেকম, সোগেম। বড় দুটি ব্যাংক তার আর্থিক লেনদেনের কিছুটা সামাল দেয়। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা কয়েকবার অনুরোধ জানালেও বেগম গুলাম আলি তাদের সঙ্গে দেখা দেখা করেননি। এ প্রতিবেদন রচনাকালে কোলটান রফতানি ব্যবসায়ের একচেটিয়া আয়োজনের প্রধান হয়ে ওঠেন তিনি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জাল নোটও তৈরি করেন। তিনি শুল্ক সংক্রান্ত কাগজপত্র জাল করেন। তিনি বলেছেন, ‘এ ব্যবসায়ে সবাই এটা করে।’ বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন কোলটান রফতানির কোম্পানিগুলোর মধ্যে জুয়াচুরি ব্যাপক।
এসব কর্মে এক শ্রেণীর ব্যাংকও যুক্ত। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে এদের নাম ও কাজের বিশদ বিবরণ রয়েছে। এতে জড়িত এক শ্রেণীর বিশাল কোম্পানি। এগুলো সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। এ লুটের কাজ সহজ করতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রশাসনিক কাঠামোও সাজানো হয় উপযুক্তভাবে। কখনো ভিন দেশের প্রশাসনিক প্রধানপদে আসীন করা হয় কঙ্গোর লোককে। তার কাজ হবে স্বদেশে লুটের কাজ সংগঠিত করা।
আর শ্রম? সে তো বিশ্বজনীন। শৃঙ্খলিত শ্রমকে নিয়োগ করা হয় পৃথবীর গভীর থেকে সম্পদ তুলে আনতে। শিশু শ্রমও রেহাই পায় না। লুট কতটুকু, কেমন পরিমাণ হয়? জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনেই উত্তর খোঁজা যাক। প্রতিবেদন বলেছে : ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৯৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশী সেনা দলগুলোর দখল করা কঙ্গোর এলাকাগুলো থেকে খনিজ সম্পদ, কৃষিজ ও বনজ সামগ্রী, গবাদিপশু লুটে নিঃশেষ করা হয়েছে; যাকে ইংরেজিতে অভিহিত করা হয়েছে ড্রেইনড অফ। বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা যে দেশই হোক, লুটের ধরন এক। একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য আসে খামার, গুদামে, কারখানায়, ব্যাংকে, তারা আদেশ দেয় দরোজা খুলে দিতে। সেনারা লুটের মাল তোলে গাড়ির পর গাড়িতে। লুটের মাল নিয়ে গাড়ির বহর চলে যায়। কঙ্গোর একটি অঞ্চলে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৯ সালে এপ্রিলের মধ্য ২০০০-৩০০০ টন ক্যাসিটেরাইট ও ১০০০-১৫০০ টন কোলটান লুটে নেওয়া হয়। সৈন্যদের পাহারায় বস্তা বস্তা অর্থ নেওয়া হয়।
দেখা যাচ্ছে, লুটের অাঁতাত অনেক বিস্তৃত, ব্যক্তি মালিক থেকে রাষ্ট্র, ‘বিদ্রোহী’ থেকে ব্যবসায়ী, সেনানায়ক থেকে অস্ত্র নির্মাতা, সবাই আছে এ কাজে মিলেমিশে। এরাই কি সব? এদের আড়ালে কি কেউ নেই। কোন সে সুতো, যা এদের সবাইকে বেঁধে রাখে এক সঙ্গে? সে কি ধনলিপ্সা, লোভ? সে কি ‘আরো আরো চাই, যত পাই, তত চাই?’ স্থানাভাবে সবের বিবরণে না গিয়ে কেবল কোলটানে কান্ডটাই দেখা যাক। এন্টয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ম্যারিজ ২০০২ সালে রাইজ অ্যান্ড ডিক্লাইন অব দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম বিষয়ে সম্মেলনে পেশ করেন প্লান্ডার, ক্রিমিনালাইজেশন অব দ্য স্টেট অ্যান্ড ডিক্লাইন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম : দ্য কেস অব ডি আর কঙ্গো শিরোনামে প্রবন্ধ। এতে তিনি ছক কেটে দেখান যে, খনি আর নদীর বুক থেকে মজুররা তুলে আনেন কোলটান। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সামরিক চক্রের হাত ঘুরে তা পেঁŠছায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এবং সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর হাতে। সেগুলো পেঁŠছে দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে। সেখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানার ভেতর দিয়ে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো নাম নিয়ে তা হাজির হয় সূক্ষ্ম প্রযুক্তির শিল্পে। এ সামগ্রী প্রক্রিয়ার কারখানা জগতে রয়েছে গোটা বিশেক কাজাখস্তানে, যুক্তরাষ্ট্রে, জার্মানিতে, চীনে, জাপানে। এগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি কারখানা বানাতে পারে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো। সে চারটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, জাপানে, জার্মানিতে, চীনে। আর সূক্ষ্ম প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলকাটেল কমপ্যাক, ডেল, এরিকসন, এইচপি, আইবিএম, নকিয়া, সিমেন্স, লুসেন্ট, মটোরোলা। বড় চেনা নাম এগুলো। এই চেনা নামের কোম্পানি সব কোটি কোটি খদ্দেরের কাছে পেঁŠছে দেয় মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গেম বা খেলার ডিজিটাল সামগ্রী।
এসবের মাঝে থাকে পরিবহন, ব্যাংক, রাজনীতি, বিধি, শুল্ক, বিশ্ব শক্তি। ডেনা মন্টেগু ২০০২ সালে স্টোলেন গুডস : কোলটান অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন দ্য ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : রোয়ান্ডা ও উগান্ডাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।
এসবে আরো মিশে থাকে : রক্ত। আরো থাকে : মেহনত, মজুরদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে নেওয়া মেহনত। আর সব শেষে থাকে মুনাফা। কতিপয়ের পকেটে, অ্যাকাউন্টে। সে কতিপয় প্রমোদতরীতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ থেকে দ্বীপে, ক্যারিবিয়ানের সূর্যাস্ত রং মেখে দেয় তাদের চোখে। কোলটানের রক্তাক্ত, নিষ্ঠুর, ‘সুন্দর’ যাত্রা!
কোলটান থেকে কে কত পায়? এ হিসাব করা প্রায় ধাঁধার উত্তর খোঁজার মতো। কারণ, তথ্যগত বিভ্রান্তি বেশি। একজন গবেষক এ সংক্রান্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে অনুমান করেছেন যে, স্থানীয় বেপারী ১০ ডলার পেলে রুয়ান্ডার ব্যবসায়ী পায় ২০০ ডলার, আর পাঁচ-ছয়জন খনিমজুরের একেকটি গ্রুপ পায় সপ্তাহে ৩০ ডলার। অর্থাৎ দিনে একজন পায় ১ ডলারের কম। আহরণের পরে ৩০ কিলোগ্রাম সামগ্রী বস্তায় ভরে হেঁটে হেঁটে তা নেওয়া হয় স্থানীয় ব্যবসায় কেন্দ্রে, গড়ে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে। সোনা, হীরা লুটের ঘটনা আরো নিষ্ঠুর। তবে লুটের ধরন একই। সে বিষয়ে আর আলোকপাত না করে আগামীতে দেখা যাবে আরো লোভনীয় ক্ষেত্রে কেমন ঘটনা ঘটে চলেছে।