কঙ্গো, আয়তনের দিক থেকে বিশাল এক দেশ,
বাংলাদেশের প্রায় ১৭ গুণ বড়। এ বিশাল দেশের দুর্দশার ইতিহাসও বিশাল। দীর্ঘ
সে ইতিহাস যেন দখল, লুট, গৃহযুদ্ধ, দুর্নীতি, আততায়ীর দীর্ঘ ছায়া,
অভ্যুত্থান, হানাহানি, আর এ সবের সঙ্গে থাকা মৃত্যুর মিছিল। দীর্ঘ সে
মিছিল। সেই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ বসতচ্যুত। মহামারীও যেন পাল্লা দেয় এসবের
সঙ্গে। তাই গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের পতাকায় রক্তিম লাল রেখা তার
দেশের নাগরিকদের রক্তকেই স্মরণ করে।
যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ আর এদের সঙ্গী অনাহার
ও ব্যাধি কেড়ে নিয়েছে অর্ধ কোটি বা ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল
রেসকিউ কমিটির ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে এ সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। এদের
প্রায় অর্ধেক হচ্ছে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু। এত মৃত্যুর অধিকাংশই ঘটেছে
বা ঘটানো হয়েছে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল অর্থাৎ মাত্র ৫ বছরের মধ্যে। বিবিসি
জানায়, সংঘাতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল হিসেবে গণতান্ত্রিক কঙ্গো
প্রজাতন্ত্রে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। দেশটির এ
সংঘাতে যত প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এত মৃত্যু আর
কোনো দেশে আর কোনো সংঘাতে ঘটেনি।
অথচ নয় লাখ পাঁচ হাজার বর্গমাইলের
বেশি এ দেশে রয়েছে বিপুল সম্পদ : হীরা, ইউরেনিয়াম, সোনা, তামা, কোবাল্ট,
দস্তা, কোলটান আর তেল ও গ্যাস। কোলটান ব্যবহৃত হয় মোবাইল ফোনে ও
ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীতে। কফিও উৎপাদিত ও রফতানি হয়। পশ্চিম ইউরোপের সমআয়তনের
এ দেশটির সম্পদ এত বেশি যে, তা-ই এদেশকে করে তুলতে পারে বিশ্বের অন্যতম
ধনী দেশ। এর মাটি উর্বর। এর রয়েছে অনেক পানি। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক
খবরে বলা হয় : দেশটির হীরা শিল্প বছরে ৮৭ কোটি ডলার আয় করে। সে শিল্প প্রায়
১০ লাখ খননকারীকে কাজ দিয়েছে। কিন্তু বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে তারা
জনপ্রতি দিনে আয় করে এক ডলারেরও কম। কি নির্মম লোভ খনি মালিকদের!
এই হীরা, ইউরেনিয়াম, সোনা, তেল ও
অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদই যেন দেশটি জুড়ে আয়োজন করেছে মুনাফাবাজদের
‘খেলা’। সে ‘খেলা’র নাম আজ আফ্রিকাজ ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়্যার, আফ্রিকার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আফ্রিকার ইতিহাসে বৃহত্তম যুদ্ধ ক্ষেত্রগুলোর অন্যতম হয়ে
ওঠে কঙ্গো, খুব সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ। এ বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডার
দেশটিতে যুগে যুগে ডেকে এনেছে অভিযাত্রী, দখলদার, সাম্রাজ্য বিস্তারকারী
রাজশক্তি, আধুনিক বেপারী, বহুজাতিক করপোরেশনকে। এদের চেহারা ছিল
সুন্দর-সভ্য। এদের সঙ্গে ছিল স্থানীয় দালালরা, মুৎসুদ্দিরা, যুদ্ধবাজরা। আর
ছিল দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকার। এরা সবাই মিলে দেশের জনসাধারণকে
বিভক্ত করল, জাতিগত, গোত্রগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করল, এ
প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পৌঁছে দিল বিদ্বেষ আর সংঘাতের পর্যায়ে। দশকের পর দশক
ধরে চলা লুট, দুর্নীতি, হানাহানি, ষড়যন্ত্র দেশটির অর্থনীতিকে করে ফেলল
স্থবির, পঙ্গু।
কঙ্গো ও তার আশপাশের নয়টি দেশ বসে আছে
এ পৃথিবীর সব চেয়ে ধনসমৃদ্ধ অংশে। অথচ ধন লোভী সাম্রাজ্যবিস্তার, মুনাফা
সন্ধানী কোম্পানির ষড়যন্ত্রের পরে ষড়যন্ত্রে, সংঘাতে দেশটির আবাদ ধ্বংস
হলো, কার্যত থেমে গেল বাণিজ্য, খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা,
শিক্ষ যোগান দেওয়া গেল না; এগুলো নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গড়ে উঠল
না অবকাঠামো। দেশটি হয়ে উঠল প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র দল-উপদলের রণক্ষেত্রে।
কখনো সরকারি বাহিনী আর বিদ্রোহীদের মধ্যে চলল লড়াই। একদিকে সরকারি
বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছে এঙ্গোলা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে আরেকদিকে
বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছে রুয়ান্ডা ও উগান্ডা। সব বিবাদের আড়ালে ছিল কঙ্গোর
প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর খেলা।
জাতিসংঘের একটি প্যানেল ২০০১ সালে
উল্লেখ করে : সোনা, হীরা, গাছের কাঠ, কোলটান, লুট করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধরত
পক্ষগুলো ইচ্ছে করে সংঘাত দীর্ঘায়িত করছে। এর আট বছর পরে ২০০৯ সালে জাতিসংঘ
নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের এক প্রতিবেদনে বলা হয় : বিদ্রোহীরা মানুষ হত্যা করছে,
লুট করছে প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ এরা রয়ে যাচ্ছে আইনের, বিচারের ধরাছোঁয়ার
বাইরে। এ বিদ্রোহীদের মদদ যোগাচ্ছে দুর্বৃত্তদের একটি আন্তর্জাতিক
নেটওয়ার্ক বা জাল। এ জাল ছড়িয়ে আছে গোটা আফ্রিকাজুড়ে, সেখান থেকে পশ্চিম
ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায়। পাঠকের মনে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে : সে জাল বোনে
কারা?
জাতিসংঘের ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে
দেশটির জনসংখ্যা ছয় কোটি ৭০ লাখ। সে দেশের পুরুষের গড় আয়ু ৪৭ বছর, আর
নারীদের ৫০। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুসারে, দেশটির রফতানি আয়ের
প্রায় অর্ধেক আসে হীরা থেকে; এর পরই অশোধিত তেল, প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
বাকিটুকু আসে কোবাল্ট, তামা, কফি ও অন্য পণ্য থেকে। দেশটির প্রবৃদ্ধি ২০০০
সালেও ছিল বিয়োগাত্মক। মাইনাস সাত শতাংশ। তা ২০০১ সালে কমে আসে মাইনাস
দুইয়ে। এর পরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ২০০২ সালে তা দাঁড়ায় ৪ শতাংশ; তা ২০০৩ ও
২০০৪ সালে আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে। দেশটির সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার
বেলজিয়াম, দেশটির সাবেক সাম্রাজ্যবাদী প্রভু দেশ। এর পরের স্থান
যুক্তরাষ্ট্রের। তারপর চীনের। এসব তথ্যের আড়ালে রয়ে গেছে নিষ্ঠুর সব সত্য।
বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব থেকে দেখা যায়
: গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ১৯৯০ সালে গড় আয়ু যা ছিল, সেটা ২০০৪
সালে হ্রাস পায়, শিশু মৃত্যুর হার থাকে একই, অথচ একই সময়ের ব্যবধানে চীন ও
যুক্তরাজ্যে গড় আয়ু বেড়েছে এবং শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। গণতান্ত্রিক
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে প্রবৃদ্ধি হার ২০০২ সাল থেকে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ কেবল
প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে দেশটির নাগরিকদের অবস্থা বুঝতে পারা যাবে না। যখন
প্রবৃদ্ধি হার বেড়ে চলেছে সে সময়ের আগে থেকে, ১৯৯৩ সাল থেকে, রুয়ান্ডার
সেনাবাহিনী ও এ সেনাবাহিনী সমর্থিত বিদ্রোহীরা কঙ্গোতে যে অপরাধ সংঘটিত
করেছে, তাকে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ
অবস্থা চলতে থাকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। তা হলে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, এমন
অবস্থায় প্রবৃদ্ধি বাড়ল কিভাবে? সহজে এর উত্তর দেওয়া যায়। তা হচ্ছে
প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানি বা পাচার হয়েছে বিপুল। সে সম্পদের দাম হিসেবে
প্রাপ্ত অর্থ দেশবাসী পেয়েছেন কিনা, সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে।
এ দেশটিতেই জাতিসংঘ পাঠিয়েছিল
শান্তিরক্ষা বাহিনী, জাতিসংঘের ইতিহাসে বৃহত্তম শান্তিরক্ষা কার্যক্রম।
কমপক্ষে ১০ বছর ধরে চলেছে সে কার্যক্রম। এক সময় কিছুদিন আগেও সে দেশে পুলিশ
খুঁজে পাওয়া যেত না। অথচ পুলিশ ছিল। তারা থাকত গরহাজির বা মাতাল অবস্থায়।
পাহাড়ে পাহাড়ে ছিল সশস্ত্র দল-উপদল। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সরকার গঠিত
হয়; তার আগে প্রণীত হয় সংবিধান। নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা
রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এসব নির্বাচন দেশটিতে বিনিয়োগের এবং সংঘটিতভাবে
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের পরিবেশ তৈরি করবে। এ আশা বিনিয়োগকারীদের, প্রাকৃতিক
সম্পদ আহরণকারীদের। এ ঘটনা ধারা আর আশার মধ্যে যে সম্পর্ক, তা অনেকের কাছে
নির্মম পরিহাস বলে মনে হতে পারে। লুট আগেও হতো। প্রাকৃতিক সম্পদ আগেও
অর্থকড়ি যোগাত কতিপয় লোককে; কিন্তু হানাহানি, রক্তারক্তির পরিবেশে বিনিয়োগ
যেমন স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ হয় না, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের কাজে তেমনি ঝুঁকি ও
খরচ থাকে বেশি। তাই বিনিয়োগ ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ সহজ-স্বচ্ছন্দ হয়
শান্তির পরিবেশে। তাই খুব দরকার ছিল সংবিধান সম্মত শাসনের, নির্বাচনের। তাই
বলে এ কথা মনে করার কারণ নেই যে, সংবিধান ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত
সরকার জনগণের দরকার নেই। বরং এ পরিবেশ জনগণকেও সুযোগ করে দেয় গণতান্ত্রিক
সংগ্রাম গড়ে তোলার, এগিয়ে নেওয়ার।
তবে বিনিয়োগকারী, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট
বা আইনসম্মতভাবে আহরণ করে অর্থশালীরা যে লাভবান হন, তার জন্য দাম দিতে হয়
জনসাধারণকে। সে দাম চড়া, খুব চড়া। সব দেশের মতো কঙ্গোর ইতিহাসও তাই বলে।
কেবল একটি বিষয়ই তা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট। সে বিষয়টি হচ্ছে ধর্ষণ।
কঙ্গোতে এত হানাহানি, যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা যেন মহামারির
রূপ নেয়। এগুলো চালিয়েছে সশস্ত্র দল-উপদল, সেনাবাহিনীর লোকেরা। কোনো কোনো
সশস্ত্র দল এ জন্য নারীদের ক্রীতদাসীর মতো করে রাখত।
এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে এ বছরই
ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয় : কঙ্গোয় ‘প্রায়
প্রতি মিনিটে’ একজন করে নারীকে ধর্ষণ করা হতো। সেখানে একজন নারীর ধর্ষিতা
হওয়ার আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১৩৪ গুণ বেশি। এসব হিসাব এ সংক্রান্ত
আগের হিসাবগুলোর চেয়ে ২৬ গুণ বেশি।
আমেরিকান জার্নাল অব পাবলিক হেলথে
প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে গবেষকরা জানান, ১২ মাসে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী
চার লাখের বশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় : প্রতিদিন এক হাজার
১শ’ জনের বেশি বা প্রতি পাঁচ মিনিটে চারজন। এ সীমাক্ষার আগে আরো কয়েকটি
সমীক্ষা চালানো হয়। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল জাতিসংঘ পরিচালিত সমীক্ষা। সে
সব সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০০৬-০৭ সালে ১২ মাসে ১৫ হাজার নারীকে ধর্ষণ করা
হয়।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনটি রচনা
করেন এমবার পিটারম্যান। তিনি সরকারি নথিতে থাকা তথ্য এবং জাতীয় পর্যায়ের
প্রতিচ্ছবি থাকে, এমন তথ্যই কেবল ব্যবহার করেছেন। তাই তিনি বলেছেন,
সাম্প্রতিক হিসাবও কম, খুব কম। এ হিসাব গুণতে পারেনি তাদের, যারা লজ্জার
কারণে তথ্য জানাননি; এ হিসাবের গণ্য হয়নি সে সব ঘটনা, যেগুলো ক্ষমতার কারণে
ফাঁস হয়নি; এ হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হননি বৃদ্ধারা বা একেবারে কম বয়সীরা।
নির্মমতা, বর্বরতা, অমানবিকতার চরিত্র ফুটে ওঠে কেবল এ তথ্যটুকুর মধ্য
দিয়েই। কোনো আদর্শ, কোনো রাজনীতি, কোনো শত্রুতার সূত্র, কোনো বৈরীতা এ
কাজকে সমর্থন করতে পারবে না। কারণ, তা সমর্থন করলে সে আদর্শ, সে রাজনীতি-
সে বৈরীতা হারাবে তার অবস্থান। অথচ লুট, সম্পদের লোভ কত নিষ্ঠুর, কত
অমানবিক হতে পারে যে, তার অনুসৃত কর্মধারা তৈরি করে এমনই অমানবিকতা,
মানবতার অপমান!
Thursday, September 29, 2011
Thursday, September 22, 2011
লিবিয়া : শত্রুতা মিত্রতার মাপকাঠি তেল (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১২)
লিবিয়ার ঘটনা ধারা দেখে মনে হয় তেল
যেন যাদুর ক্ষমতা রাখে; বোধ হয়, তেলের কারণে বন্ধু হয়ে যায় শত্রু, আর শত্রু
হয় বন্ধু অথবা, গত পরশুর শত্রু গতকাল হয়ে যায় বন্ধু, আবার আজ হয় শত্রু।
প্রকাশ হওয়া দলিলপত্র সে কথাই বলছে।
ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির গোয়েন্দা বাহিনীর নানা কার্যালয় থেকে যে সব নথিপত্র পাওয়া গেছে, সেগুলোর কিছু কিছু প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। এগুলো ছাড়া অন্যান্য দলিলও ফাঁস হয়েছে। প্রকাশিত সে দলিলপত্র থেকে দেখা যায়, গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে আজকের পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর গভীর বন্ধুত্ব ও ব্যাপক সহযোগিতার তথ্য।
অথচ এই গাদ্দাফিকেই পশ্চিমা দুনিয়ার একজন প্রেসিডেন্ট অভিহিত করেছিলেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে। সে ভাষা রাষ্ট্রনায়কোচিত কিনা তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতে পারে; তবে সে ভাষার মধ্যে থাকা তীব্র ঘৃণা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। এই গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলাফল এত ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে, লিবিয়ার তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল আহরণের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি কমে যায়, হ্রাস পায় তেল আহরণ কাজে বিনিয়োগ। তেল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার অন্যান্য কারণও ছিল। যেমন তেল দ্রুত ফুরিয়ে যাবে আশঙ্কা করে লিবিয়া সরকার তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছিল; ছিল ব্যবস্থাপনার সমস্যা, ওপেকের নির্ধারিত কোটা। তবে নিষেধাজ্ঞার নিগড় এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, তেলজাত কোনো কোনো পণ্য লিবিয়াকেই আমদানি করতে হয়েছিল। এমন একটি পণ্যের নাম গ্যাসোলিন। পরে, এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়, গাদাফি আর ‘পাগলা কুকুর’ থাকেন না, তার সঙ্গে দেখা করতে যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস, গাদ্দাফির কাছে কন্ডোলিৎসা হয়ে ওঠেন ‘ডার্লিং’। গাদ্দাফির ফটো অ্যালবামের বান্ডিলে পাওয়া কন্ডোলিৎসার ছবিতে তেমনই লেখা ছিল। গাদ্দাফির সঙ্গে দেখা করেন, বন্ধুত্বের করমর্দন করেন, আজ গাদ্দাফিকে শত্রু গণ্য করেন এমন অনেক রাষ্ট্রনায়কই। এদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনি। আর জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে লিবিয়ার তেলক্ষেত্রে পা দেওয়ার সুযোগ পায় ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) ও রয়্যাল ডাচ শেল। ব্লেয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে বন্ধুত্বের সাক্ষাৎ শেষে আশা প্রকাশ করেছিলেন সশস্ত্রবাহিনী, শিক্ষা ও তেল আহরণ ক্ষেত্রে দু’দেশের, লিবিয়ার ও ব্রিটেনের, বন্ধন জোরদার হবে।
লিবিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাসের চুক্তি করার বিষয় এবং লিবিয়ায় শেলের ব্যবসা নিয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রীরা ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তারা তেল কোম্পানি শেলের সঙ্গে চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১১ থেকে ২৬ বার আলোচনায় মিলিত হন। ব্রিটিশ মন্ত্রী ও কর্তারা কমপক্ষে ১২ বার চেষ্টা করেন লিবিয়ার মন তুষ্ট করার। ব্রিটেনের পত্রিকা অবজারভার বিভিন্ন দলিলপত্র পেয়েছে। সে দলিলপত্র থেকে এ তথ্য জানা যায়। লিবিয়া ও মিসরে শেলের বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় জড়িত ছিলেন শ্রমিক দলীয় সরকারের মন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড ও দলের সাবেক নেতা লর্ড কিনক। লিবিয়ায় ঢোকার জন্য শেলকে মদদ যোগায় ব্রিটিশ সরকার। এ ঘটনা দেখেই একজন নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার কর্মী বলেছেন : গণতন্ত্র ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের রাস্তায় রাখা হয় আর বড় কোম্পানির কর্তারা সহজে ঢুকে যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একেবারে ওপরতলায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত বড় কোম্পানির স্বার্থ নয়, জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা, ফাইল খুলে দেওয়া, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তেলওয়ালাদের প্রভাবের মাত্রা প্রকাশ করে দেওয়া।
উল্লেখ করা দরকার, লিবিয়ার ওপর থেকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরে পাশ্চাত্যের যে তেল কোম্পানিগুলো সবার আগে লিবিয়ায় পা রাখে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে শেল, লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইন্ধন কোম্পানির সঙ্গে শেলের দীর্ঘমেয়াদি শরিকানা গঠন করে সম্পাদিত হয় লেনদেন। সে দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ। এটি সম্পাদিত হয় সে সময়ে, যখন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার লিবিয়া সফর করছেন, গ্রহণ করছেন গাদ্দাফির উষ্ণ আপ্যায়ন।
এরপরে বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে শেল কর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রীদের ও আমলাদের। সে সব বৈঠকের বিষয় ছিল লিবিয়ায় তেল বাণিজ্য।
অর্থাৎ, লিবিয়ার তেলের ভাগ নিতে তেল কোম্পানিকে পশ্চিমা শক্তিধর সরকার যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি এরাও বন্ধুত্ব করেছে আজ তাদেরই ধিকৃত গাদ্দাফির সঙ্গে।
নিউইয়র্ক টাইমস এ বছরের মার্চে জানায়, লিবিয়ায় তেল ব্যবসা করার জন্য অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম ২০০৮ সালে সাইনিং বোনাস বা চুক্তি স্বাক্ষর বোনাস হিসেবে লিবিয়া সরকারকে দিয়েছিল একশ’ কোটি ডলার। চুক্তিটি ছিল ৩০ বছর মেয়াদি। এর আগের বছর কানাডার বিশাল তেল কোম্পানি পেট্রো-কানাডা লিবিয়াকে দিয়েছিল একশ’ কোটি ডলার। এটাও ছিল ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তিসংশ্লিষ্ট। এ চুক্তি ছিল তেল অনুসন্ধান বিষয়ে। সংবাদপত্রের এ খবরে এই অর্থ প্রদানকে ঘুষ হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন অনুসারে বিদেশী কর্তাদের ঘুষ দেওয়া যায় না। তাই প্রদান করা এ অর্থকে অভিহিত করা হয় পে অফ হিসেবে।
আবার, এ খবরেই বলা হয় : লিবিয়ার বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে ক্ষতিগ্রস্তদের লিবিয়া ক্ষতিপূরণ দেবে বলে একটি আইনের বিরুদ্ধে কয়েকটি বড় তেল কোম্পানি দেনদরবার করে। এসব কোম্পানির মধ্যে ছিল অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম, এক্সনমবিল, এনাডারকো পেট্রোলিয়াম, শেভরন, কনোকো-ফিলিপস, ম্যারাথন অয়েল, এসব কোম্পানি আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইন্সটিটিউটের সদস্য। এ ইন্সটিটিউট হচ্ছে তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের একটি গ্রুপ। তবে পরবর্তীকালে এক খবরে বলা হয়, অক্সিডেন্টাল বা পেট্রো-কানাডা অর্থ প্রদান করেনি। অর্থাৎ এ খবর থেকে এটুকু স্পষ্ট হয় যে, লিবিয়ার তেল বাণিজ্য বড় ধরনের আগ্রহের বিষয় ছিল, এ বাণিজ্য নিয়ে লেনদেনের ঘটনা থাকতে পারে এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর বা শব্দের মারপ্যাঁচ থাকতে পারে।
কেবল ব্রিটিশ বা আমেরিকান কোম্পানি বা স্বার্থের সঙ্গে লিবিয়ার ঘটনাবলী যুক্ত নয়, সেখানে অন্য দেশের তেল কোম্পানির নানা ধরনের লেনদেন বা ‘বন্ধুত্বের’ খবর এখন প্রকাশিত। অর্থাৎ লিবিয়ার আজকের ঘটনাবলীকে কেবল মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সংক্রান্ত মহান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত করে দেখাটা বিভ্রান্তিকর। কারণ সেখানে বর্তমান গোলযোগ, ন্যাটো হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে লিবিয়ায় মানবাধিকারের প্রশংসা করা হয় এর পর পরই শুরু হয় গোলযোগ ও যুদ্ধ। তখন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির মুখে সে প্রতিবেদন প্রকাশ স্থগিত রাখা হয়। দেখা যাচ্ছে লিবিয়ার ঘটনাবলী সোজা একদিকে প্রবাহিত হয়নি। তা নিয়েছে নানা দিক; উল্টোপাল্টা তার ধরন, সহজেই বিভ্রান্তিকর। এ লেখার পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা কয়েকটি ঘটনা উল্টাপাল্টা, আপাত বিভ্রান্তিকর ধরনটি স্পষ্ট করে তোলে।
ব্রিটেনের দৈনিক পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ৭ সেপ্টেম্বর এক খবরে জানায় : অস্ত্র তৈরির জায়ান্ট বা বিশাল মার্কিনী কোম্পানি জেনারেল ডায়নামিকয়ের ব্রিটিশ শাখা জেনারেল ডায়নামিক ইউকে গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইউনিট খামিস ব্রিগেডের ট্যাংক, গোলন্দাজ ইউনিট ও সাঁজোয়া যানে নতুন রেডিও ব্যবস্থা যোগ করছিল সে সময়ে, যখন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন ফেব্রুয়ারি মাস, এ কাজটি ছিল লিবিয়া সরকারের সঙ্গে ব্রিটেনের সরকারের সম্পাদিত ৮ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের একটি অস্ত্র চুক্তির অংশ।
এ ঘটনা প্রসঙ্গেই পরিহাসের সুরে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইমার্জেন্সি ডিরেক্টর পিটার বেউকার্ট বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে অস্ত্র সংগ্রহকে সাবাশ দিতেই হয়। এরই ফলে লিবিয়ার সেনাবাহিনীর কোনো কোনো এলিট ইউনিট এত সবল হতে পেরেছিল।
গাদ্দাফির সঙ্গে পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব কত উষ্ণ ও গভীর ছিল, তারও উদাহরণ পাওয়া যায় ওই খবরে। এ সংবাদে বলা হয়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গাদ্দাফির দুই পুত্র খামিস ও সাদীকে ব্রিটেনের বিশেষ কমান্ডো সেনাদের কাজের ভিআইপি প্রদর্শনী দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল। আজ, এ ব্রিটিশ কমান্ডো দল, এসএএম এবং এমবিএস, লিবিয়ার মাটিতে গাদ্দাফিকে খুঁজে বের করতে গাদ্দাফিবিরোধীদের সহায়তা করছে বলে ধারণা করা হয়। এ মন্তব্য ওই পত্রিকার।
এ-ই হচ্ছে বন্ধুত্ব ও বৈরিতার মিলন! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অলিভার স্প্রাগ বলেছেন, গাদ্দাফি সরকারকে অস্ত্রসজ্জিত করার কাজে ব্রিটেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বিষয়ে দলিলপত্র দেখে তিনি সামান্য অবাক হননি। এ বছরের গোড়ার দিকে জাতিসংঘ যখন লিবিয়ার ওপরে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সে সময়ের আগে লিবিয়া ছিল ওই অঞ্চলে ব্রিটেনের সেরা অস্ত্র খরিদ্দারদের অন্যতম। ব্রিটেনের সমরাস্ত্রের তালিকায় আছে, এমন যে কোনো অস্ত্রই কার্যত বিক্রি করতে দিয়েছে ব্রিটেন সরকার।
এ ঘটনার, অস্ত্র বিক্রির, পরে লিবিয়ায় ন্যাটোর যুদ্ধের ঘটনা আজ সবার জানা। গাদ্দাফির সঙ্গে বিশ্ব ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের নিদর্শন কেবল তেল ব্যবস্থা আর অস্ত্র বেচাকেনার মধ্যে সীমিত ছিল না। গোয়েন্দা জগতে সে মৈত্রী ছিল প্রবল, সহযোগিতা ছিল সক্রিয়। এ গোয়েন্দা মৈত্রীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, দু’দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে গাদ্দাফি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। লিবিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গোয়েন্দাবৃত্তির সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে নানা দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সংক্রান্ত দলিলপত্রও এখন তথ্যমাধ্যম প্রকাশ করেছে। এসব সহযোগিতার ঘটনা নিষ্ঠুরতায়-অমানবিকতায় পূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয় : লিবিয়ায় যে শাসককে আজ এত ধিকৃত হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে মাত্র কমাস আগেও এত বন্ধুত্বের কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর তেল-গ্যাস। সেই সঙ্গে আছে ভূ রাজনীতির, ভূরণনীতির ‘খেলা’। আজ গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অত্যাচার, নিপীড়নের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে কমাস আগেও এ কাজে অভিযোগকারী অনেক রাষ্ট্রই ছিল গাদ্দাফির সহযোগী, মদদদাতা। তা হলে কি তেল-গ্যাস মুঠোবদ্ধ করার কাজে কোনো নীতি-নৈতিকতার বিবেচনা থাকে না? নীতি-নৈতিকতা তো আছেই। ওই ধরনটিই হচ্ছে মুনাফার লোভের নীতি-নৈতিকতা; এ নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে অন্য নীতি-নৈতিকতার মিল নেই। সাম্রাজ্য অটুট রাখতে, অব্যাহত রাখতে মুনাফার প্রবাহ, এ নীতি-নৈতিকতাই কার্যকর। তাই প্রভুরা এ নীতি-নৈতিকতাই অনুসরণ করেছেন।
গাদ্দাফিবিরোধীদের সম্পর্কে ব্রিটেনের ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য যুগিয়েছ গাদ্দাফিকে। আল কায়দার সঙ্গে যোগাযোগ আছে সন্দেহে গাদ্দাফিবিরোধীকে আশ্রয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চীন থেকে হংকংয়ে এনে সপরিবারে বিমানে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপোলি। এ কাজে সহযোগিতা করে ওই দুটি পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তো হংকং থেকে ত্রিপোলি যাত্রার বিমান ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল লিবিয়া সরকারকে। আর সেই গাদ্দাফিবিরোধীকে ত্রিপোলি নিয়ে সপরিবারে কারাগারে আটক রাখা হয় বছরের পর বছর। গাদ্দাফিবিরোধীর ওপর চলে নির্যাতন। এ নির্যাতন যখন চালানো হয়, তখন পাশের কক্ষেই রাখা হয় তার গোটা পরিবারকে। এ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যা অর্থাৎ গাদ্দাফিবিরোধীর কন্যার মেয়ের বয়স তখন ছয় বছর। নির্যাতনের এ কাহিনীটি আরো দীর্ঘ, আরো নিষ্ঠুর, আরো অমানবিক। এ গাদ্দাফিবিরোধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওই দুটি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে একটি সংস্থার কর্তারা আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাদ্দাফির গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের ৫৯টি প্রশ্ন লিখে পাঠান অপর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদকালে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাটির কর্তাদের গাদ্দাফিবিরোধী জানান, তার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে গাদ্দাফির গোয়েন্দা কর্তারা। কিন্তু এ তথ্য জানানোর পরও তাকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেননি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাটির কর্তারা। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়েছে। এ ধরনের সহযোগিতার ঘটনা অনেক। আজ তাই প্রশ্ন উঠেছে : মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নেবে কে? মানবাধিকার রক্ষার পবিত্র কর্তব্য কে পালন করছে।
ফাঁস হওয়া দলিল-দস্তাবেজ থেকে দেখা যাচ্ছে : ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ওপর নজরদারি করতে লিবিয়া সরকারকে অত্যন্ত আধুনিক সরঞ্জাম যোগান দিয়েছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার কয়েকটি কোম্পানি এবং অন্ততপক্ষে একটি চীনা কোম্পানি। সহযোগিতার কি বিচিত্র বাস্তবতা! মত প্রকাশের ও অবাধ যোগাযোগের অধিকার নিয়ে কথা বলা কার মুখে যে শোনায় ভালো, তা সাধারণ মানুষের কাছে কি দুর্বোধ্য? গণতন্ত্রের পতাকা কার হাতে মানায় ভালো, সে প্রশ্ন খুবই জটিল।
গাদ্দাফি পুত্র সাইফকে আজ খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। অথচ ক’বছর আগে লন্ডনে এ সাইফের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থার সেই বিভাগটি, যে বিভাগের কাজ রাজপরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করা। এ খবর প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায়।
কে জবাব দেবে এ প্রশ্নের : কে সাধু, কে দুর্বৃত্ত? এটাই বোধ হয় মুনাফার জগতের চেহারা-চরিত্র! তেল-গ্যাসের জগতের চেহারা-চরিত্র, কাজ-কর্ম বোধ হয় আরো রহস্যময়, আরো নিষ্ঠুর, আরো অমানবিক, আরো শঠতায় ভরা! তেল-গ্যাস কব্জা করার কতই না ছলনা!
আর, মৌলিক প্রশ্নগুলো তো রয়েই গেছে : তেল-গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ কি কেবল দুর্ভোগ-দুর্দশাই ডেকে আনবে? এই গাদ্দাফিই তো আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নিগড় শিথিল করতে নিয়েছিলেন কয়েকটি বড় ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ, দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের লড়াইয়ে সমর্থন দিয়েছিলেন কার্যকরভাবে; অথচ এ গাদ্দাফিই আবার হাত মেলালেন অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। এ-ই কি তেলের রাজনীতি? এর কি বিকল্প নেই, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ বয়ে আনবে শান্তি-সম্প্রীতি?
ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির গোয়েন্দা বাহিনীর নানা কার্যালয় থেকে যে সব নথিপত্র পাওয়া গেছে, সেগুলোর কিছু কিছু প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। এগুলো ছাড়া অন্যান্য দলিলও ফাঁস হয়েছে। প্রকাশিত সে দলিলপত্র থেকে দেখা যায়, গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে আজকের পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর গভীর বন্ধুত্ব ও ব্যাপক সহযোগিতার তথ্য।
অথচ এই গাদ্দাফিকেই পশ্চিমা দুনিয়ার একজন প্রেসিডেন্ট অভিহিত করেছিলেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে। সে ভাষা রাষ্ট্রনায়কোচিত কিনা তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতে পারে; তবে সে ভাষার মধ্যে থাকা তীব্র ঘৃণা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। এই গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলাফল এত ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে, লিবিয়ার তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল আহরণের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি কমে যায়, হ্রাস পায় তেল আহরণ কাজে বিনিয়োগ। তেল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার অন্যান্য কারণও ছিল। যেমন তেল দ্রুত ফুরিয়ে যাবে আশঙ্কা করে লিবিয়া সরকার তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছিল; ছিল ব্যবস্থাপনার সমস্যা, ওপেকের নির্ধারিত কোটা। তবে নিষেধাজ্ঞার নিগড় এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, তেলজাত কোনো কোনো পণ্য লিবিয়াকেই আমদানি করতে হয়েছিল। এমন একটি পণ্যের নাম গ্যাসোলিন। পরে, এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়, গাদাফি আর ‘পাগলা কুকুর’ থাকেন না, তার সঙ্গে দেখা করতে যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস, গাদ্দাফির কাছে কন্ডোলিৎসা হয়ে ওঠেন ‘ডার্লিং’। গাদ্দাফির ফটো অ্যালবামের বান্ডিলে পাওয়া কন্ডোলিৎসার ছবিতে তেমনই লেখা ছিল। গাদ্দাফির সঙ্গে দেখা করেন, বন্ধুত্বের করমর্দন করেন, আজ গাদ্দাফিকে শত্রু গণ্য করেন এমন অনেক রাষ্ট্রনায়কই। এদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনি। আর জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে লিবিয়ার তেলক্ষেত্রে পা দেওয়ার সুযোগ পায় ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) ও রয়্যাল ডাচ শেল। ব্লেয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে বন্ধুত্বের সাক্ষাৎ শেষে আশা প্রকাশ করেছিলেন সশস্ত্রবাহিনী, শিক্ষা ও তেল আহরণ ক্ষেত্রে দু’দেশের, লিবিয়ার ও ব্রিটেনের, বন্ধন জোরদার হবে।
লিবিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাসের চুক্তি করার বিষয় এবং লিবিয়ায় শেলের ব্যবসা নিয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রীরা ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তারা তেল কোম্পানি শেলের সঙ্গে চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১১ থেকে ২৬ বার আলোচনায় মিলিত হন। ব্রিটিশ মন্ত্রী ও কর্তারা কমপক্ষে ১২ বার চেষ্টা করেন লিবিয়ার মন তুষ্ট করার। ব্রিটেনের পত্রিকা অবজারভার বিভিন্ন দলিলপত্র পেয়েছে। সে দলিলপত্র থেকে এ তথ্য জানা যায়। লিবিয়া ও মিসরে শেলের বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় জড়িত ছিলেন শ্রমিক দলীয় সরকারের মন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড ও দলের সাবেক নেতা লর্ড কিনক। লিবিয়ায় ঢোকার জন্য শেলকে মদদ যোগায় ব্রিটিশ সরকার। এ ঘটনা দেখেই একজন নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার কর্মী বলেছেন : গণতন্ত্র ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের রাস্তায় রাখা হয় আর বড় কোম্পানির কর্তারা সহজে ঢুকে যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একেবারে ওপরতলায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত বড় কোম্পানির স্বার্থ নয়, জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা, ফাইল খুলে দেওয়া, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তেলওয়ালাদের প্রভাবের মাত্রা প্রকাশ করে দেওয়া।
উল্লেখ করা দরকার, লিবিয়ার ওপর থেকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরে পাশ্চাত্যের যে তেল কোম্পানিগুলো সবার আগে লিবিয়ায় পা রাখে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে শেল, লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইন্ধন কোম্পানির সঙ্গে শেলের দীর্ঘমেয়াদি শরিকানা গঠন করে সম্পাদিত হয় লেনদেন। সে দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ। এটি সম্পাদিত হয় সে সময়ে, যখন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার লিবিয়া সফর করছেন, গ্রহণ করছেন গাদ্দাফির উষ্ণ আপ্যায়ন।
এরপরে বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে শেল কর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রীদের ও আমলাদের। সে সব বৈঠকের বিষয় ছিল লিবিয়ায় তেল বাণিজ্য।
অর্থাৎ, লিবিয়ার তেলের ভাগ নিতে তেল কোম্পানিকে পশ্চিমা শক্তিধর সরকার যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি এরাও বন্ধুত্ব করেছে আজ তাদেরই ধিকৃত গাদ্দাফির সঙ্গে।
নিউইয়র্ক টাইমস এ বছরের মার্চে জানায়, লিবিয়ায় তেল ব্যবসা করার জন্য অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম ২০০৮ সালে সাইনিং বোনাস বা চুক্তি স্বাক্ষর বোনাস হিসেবে লিবিয়া সরকারকে দিয়েছিল একশ’ কোটি ডলার। চুক্তিটি ছিল ৩০ বছর মেয়াদি। এর আগের বছর কানাডার বিশাল তেল কোম্পানি পেট্রো-কানাডা লিবিয়াকে দিয়েছিল একশ’ কোটি ডলার। এটাও ছিল ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তিসংশ্লিষ্ট। এ চুক্তি ছিল তেল অনুসন্ধান বিষয়ে। সংবাদপত্রের এ খবরে এই অর্থ প্রদানকে ঘুষ হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন অনুসারে বিদেশী কর্তাদের ঘুষ দেওয়া যায় না। তাই প্রদান করা এ অর্থকে অভিহিত করা হয় পে অফ হিসেবে।
আবার, এ খবরেই বলা হয় : লিবিয়ার বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে ক্ষতিগ্রস্তদের লিবিয়া ক্ষতিপূরণ দেবে বলে একটি আইনের বিরুদ্ধে কয়েকটি বড় তেল কোম্পানি দেনদরবার করে। এসব কোম্পানির মধ্যে ছিল অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম, এক্সনমবিল, এনাডারকো পেট্রোলিয়াম, শেভরন, কনোকো-ফিলিপস, ম্যারাথন অয়েল, এসব কোম্পানি আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইন্সটিটিউটের সদস্য। এ ইন্সটিটিউট হচ্ছে তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের একটি গ্রুপ। তবে পরবর্তীকালে এক খবরে বলা হয়, অক্সিডেন্টাল বা পেট্রো-কানাডা অর্থ প্রদান করেনি। অর্থাৎ এ খবর থেকে এটুকু স্পষ্ট হয় যে, লিবিয়ার তেল বাণিজ্য বড় ধরনের আগ্রহের বিষয় ছিল, এ বাণিজ্য নিয়ে লেনদেনের ঘটনা থাকতে পারে এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর বা শব্দের মারপ্যাঁচ থাকতে পারে।
কেবল ব্রিটিশ বা আমেরিকান কোম্পানি বা স্বার্থের সঙ্গে লিবিয়ার ঘটনাবলী যুক্ত নয়, সেখানে অন্য দেশের তেল কোম্পানির নানা ধরনের লেনদেন বা ‘বন্ধুত্বের’ খবর এখন প্রকাশিত। অর্থাৎ লিবিয়ার আজকের ঘটনাবলীকে কেবল মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সংক্রান্ত মহান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত করে দেখাটা বিভ্রান্তিকর। কারণ সেখানে বর্তমান গোলযোগ, ন্যাটো হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে লিবিয়ায় মানবাধিকারের প্রশংসা করা হয় এর পর পরই শুরু হয় গোলযোগ ও যুদ্ধ। তখন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির মুখে সে প্রতিবেদন প্রকাশ স্থগিত রাখা হয়। দেখা যাচ্ছে লিবিয়ার ঘটনাবলী সোজা একদিকে প্রবাহিত হয়নি। তা নিয়েছে নানা দিক; উল্টোপাল্টা তার ধরন, সহজেই বিভ্রান্তিকর। এ লেখার পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা কয়েকটি ঘটনা উল্টাপাল্টা, আপাত বিভ্রান্তিকর ধরনটি স্পষ্ট করে তোলে।
ব্রিটেনের দৈনিক পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ৭ সেপ্টেম্বর এক খবরে জানায় : অস্ত্র তৈরির জায়ান্ট বা বিশাল মার্কিনী কোম্পানি জেনারেল ডায়নামিকয়ের ব্রিটিশ শাখা জেনারেল ডায়নামিক ইউকে গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইউনিট খামিস ব্রিগেডের ট্যাংক, গোলন্দাজ ইউনিট ও সাঁজোয়া যানে নতুন রেডিও ব্যবস্থা যোগ করছিল সে সময়ে, যখন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন ফেব্রুয়ারি মাস, এ কাজটি ছিল লিবিয়া সরকারের সঙ্গে ব্রিটেনের সরকারের সম্পাদিত ৮ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের একটি অস্ত্র চুক্তির অংশ।
এ ঘটনা প্রসঙ্গেই পরিহাসের সুরে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইমার্জেন্সি ডিরেক্টর পিটার বেউকার্ট বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে অস্ত্র সংগ্রহকে সাবাশ দিতেই হয়। এরই ফলে লিবিয়ার সেনাবাহিনীর কোনো কোনো এলিট ইউনিট এত সবল হতে পেরেছিল।
গাদ্দাফির সঙ্গে পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব কত উষ্ণ ও গভীর ছিল, তারও উদাহরণ পাওয়া যায় ওই খবরে। এ সংবাদে বলা হয়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গাদ্দাফির দুই পুত্র খামিস ও সাদীকে ব্রিটেনের বিশেষ কমান্ডো সেনাদের কাজের ভিআইপি প্রদর্শনী দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল। আজ, এ ব্রিটিশ কমান্ডো দল, এসএএম এবং এমবিএস, লিবিয়ার মাটিতে গাদ্দাফিকে খুঁজে বের করতে গাদ্দাফিবিরোধীদের সহায়তা করছে বলে ধারণা করা হয়। এ মন্তব্য ওই পত্রিকার।
এ-ই হচ্ছে বন্ধুত্ব ও বৈরিতার মিলন! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অলিভার স্প্রাগ বলেছেন, গাদ্দাফি সরকারকে অস্ত্রসজ্জিত করার কাজে ব্রিটেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বিষয়ে দলিলপত্র দেখে তিনি সামান্য অবাক হননি। এ বছরের গোড়ার দিকে জাতিসংঘ যখন লিবিয়ার ওপরে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সে সময়ের আগে লিবিয়া ছিল ওই অঞ্চলে ব্রিটেনের সেরা অস্ত্র খরিদ্দারদের অন্যতম। ব্রিটেনের সমরাস্ত্রের তালিকায় আছে, এমন যে কোনো অস্ত্রই কার্যত বিক্রি করতে দিয়েছে ব্রিটেন সরকার।
এ ঘটনার, অস্ত্র বিক্রির, পরে লিবিয়ায় ন্যাটোর যুদ্ধের ঘটনা আজ সবার জানা। গাদ্দাফির সঙ্গে বিশ্ব ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের নিদর্শন কেবল তেল ব্যবস্থা আর অস্ত্র বেচাকেনার মধ্যে সীমিত ছিল না। গোয়েন্দা জগতে সে মৈত্রী ছিল প্রবল, সহযোগিতা ছিল সক্রিয়। এ গোয়েন্দা মৈত্রীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, দু’দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে গাদ্দাফি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। লিবিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গোয়েন্দাবৃত্তির সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে নানা দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সংক্রান্ত দলিলপত্রও এখন তথ্যমাধ্যম প্রকাশ করেছে। এসব সহযোগিতার ঘটনা নিষ্ঠুরতায়-অমানবিকতায় পূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয় : লিবিয়ায় যে শাসককে আজ এত ধিকৃত হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে মাত্র কমাস আগেও এত বন্ধুত্বের কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর তেল-গ্যাস। সেই সঙ্গে আছে ভূ রাজনীতির, ভূরণনীতির ‘খেলা’। আজ গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অত্যাচার, নিপীড়নের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে কমাস আগেও এ কাজে অভিযোগকারী অনেক রাষ্ট্রই ছিল গাদ্দাফির সহযোগী, মদদদাতা। তা হলে কি তেল-গ্যাস মুঠোবদ্ধ করার কাজে কোনো নীতি-নৈতিকতার বিবেচনা থাকে না? নীতি-নৈতিকতা তো আছেই। ওই ধরনটিই হচ্ছে মুনাফার লোভের নীতি-নৈতিকতা; এ নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে অন্য নীতি-নৈতিকতার মিল নেই। সাম্রাজ্য অটুট রাখতে, অব্যাহত রাখতে মুনাফার প্রবাহ, এ নীতি-নৈতিকতাই কার্যকর। তাই প্রভুরা এ নীতি-নৈতিকতাই অনুসরণ করেছেন।
গাদ্দাফিবিরোধীদের সম্পর্কে ব্রিটেনের ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য যুগিয়েছ গাদ্দাফিকে। আল কায়দার সঙ্গে যোগাযোগ আছে সন্দেহে গাদ্দাফিবিরোধীকে আশ্রয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চীন থেকে হংকংয়ে এনে সপরিবারে বিমানে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপোলি। এ কাজে সহযোগিতা করে ওই দুটি পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তো হংকং থেকে ত্রিপোলি যাত্রার বিমান ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল লিবিয়া সরকারকে। আর সেই গাদ্দাফিবিরোধীকে ত্রিপোলি নিয়ে সপরিবারে কারাগারে আটক রাখা হয় বছরের পর বছর। গাদ্দাফিবিরোধীর ওপর চলে নির্যাতন। এ নির্যাতন যখন চালানো হয়, তখন পাশের কক্ষেই রাখা হয় তার গোটা পরিবারকে। এ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যা অর্থাৎ গাদ্দাফিবিরোধীর কন্যার মেয়ের বয়স তখন ছয় বছর। নির্যাতনের এ কাহিনীটি আরো দীর্ঘ, আরো নিষ্ঠুর, আরো অমানবিক। এ গাদ্দাফিবিরোধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওই দুটি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে একটি সংস্থার কর্তারা আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাদ্দাফির গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের ৫৯টি প্রশ্ন লিখে পাঠান অপর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদকালে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাটির কর্তাদের গাদ্দাফিবিরোধী জানান, তার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে গাদ্দাফির গোয়েন্দা কর্তারা। কিন্তু এ তথ্য জানানোর পরও তাকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেননি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাটির কর্তারা। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়েছে। এ ধরনের সহযোগিতার ঘটনা অনেক। আজ তাই প্রশ্ন উঠেছে : মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নেবে কে? মানবাধিকার রক্ষার পবিত্র কর্তব্য কে পালন করছে।
ফাঁস হওয়া দলিল-দস্তাবেজ থেকে দেখা যাচ্ছে : ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ওপর নজরদারি করতে লিবিয়া সরকারকে অত্যন্ত আধুনিক সরঞ্জাম যোগান দিয়েছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার কয়েকটি কোম্পানি এবং অন্ততপক্ষে একটি চীনা কোম্পানি। সহযোগিতার কি বিচিত্র বাস্তবতা! মত প্রকাশের ও অবাধ যোগাযোগের অধিকার নিয়ে কথা বলা কার মুখে যে শোনায় ভালো, তা সাধারণ মানুষের কাছে কি দুর্বোধ্য? গণতন্ত্রের পতাকা কার হাতে মানায় ভালো, সে প্রশ্ন খুবই জটিল।
গাদ্দাফি পুত্র সাইফকে আজ খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। অথচ ক’বছর আগে লন্ডনে এ সাইফের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থার সেই বিভাগটি, যে বিভাগের কাজ রাজপরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করা। এ খবর প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায়।
কে জবাব দেবে এ প্রশ্নের : কে সাধু, কে দুর্বৃত্ত? এটাই বোধ হয় মুনাফার জগতের চেহারা-চরিত্র! তেল-গ্যাসের জগতের চেহারা-চরিত্র, কাজ-কর্ম বোধ হয় আরো রহস্যময়, আরো নিষ্ঠুর, আরো অমানবিক, আরো শঠতায় ভরা! তেল-গ্যাস কব্জা করার কতই না ছলনা!
আর, মৌলিক প্রশ্নগুলো তো রয়েই গেছে : তেল-গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ কি কেবল দুর্ভোগ-দুর্দশাই ডেকে আনবে? এই গাদ্দাফিই তো আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নিগড় শিথিল করতে নিয়েছিলেন কয়েকটি বড় ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ, দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের লড়াইয়ে সমর্থন দিয়েছিলেন কার্যকরভাবে; অথচ এ গাদ্দাফিই আবার হাত মেলালেন অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। এ-ই কি তেলের রাজনীতি? এর কি বিকল্প নেই, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ বয়ে আনবে শান্তি-সম্প্রীতি?
Thursday, September 15, 2011
লিবিয়া যুদ্ধ : তেলই যেখানে মুখ্য (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১১)
তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ লিবিয়ায় আজ রাজনীতির
দৃশ্যপট পাল্টেছে। এ পরিবর্তনের পেছনে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার
(ন্যাটো) সামরিক হস্তক্ষেপ এখন ওয়াকিবহাল মানুষের জানা। ব্রিটেনের
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বিবিসিকে লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে
সামরিক হামলায় তার দেশের সামরিক ভূমিকা পালনের কথা জানিয়েছেন। ফ্রান্সের লা
ফিগারো পত্রিকা লিবিয়ার ঘটনাবলীকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজির লড়াই হিসেবে
অভিহিত করেছে।
লিবিয়ায় এ যুদ্ধ কেন চালানো হলো সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে। ব্রিটেনের ইন্ডিপেন্ডেট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ‘যুদ্ধ-পরবর্তী লিবিয়ায় মুনাফার জন্য দৌড়ঝাঁপে’র খবর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে : লিবিয়ার পশ্চিমা কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য মহাউৎসব শুরু হতে পারে। ব্রিটেনের পত্রিকা ইকোনমিস্ট আভাস দেয় : ন্যাটোর লিবিয়া অভিযানে যে দেশ যতটুকু ভূমিকা পালন করেছে, যুদ্ধ-পরবর্তী পর্বে লুটের ভাগাভাগিতে তা ভূমিকা পালন করবে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয় : শত শত কোটি ডলারের তেল আহরণ ও নির্মাণ কাজের ভাগ নেওয়ার মতো অবস্থানে রয়েছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ইকোনমিস্টকে বলেন, লিবিয়ার এ ঘটনাবলীতে ন্যাটোর সম্পৃক্ত হওয়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে : এটা এখন আমাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের আগস্টের শেষ ভাগে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘দ্য স্ক্র্যাম্বল ফর একসেস টু লিবিয়াজ অয়েল ওয়েলথ বিগিনস’ ‘বাংলায় এর অর্থ হতে পারে লিবিয়ার তেল সম্পদ পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু’। এ খবরে বলা হয় : লিবিয়ার বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপোলির পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগেই ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, লিবিয়ায় ইতালির তেল কোম্পানি এনির ভূমিকা হবে সবার আগে। মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, লিবিয়ার তেলসম্পদ নাগালে পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এনি ছাড়াও ব্রিটেনের বিপি (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম), ফ্রান্সের টোটাল ও অস্ট্রিয়ার ওএমভি লিবিয়ায় সংঘাত শেষ হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে, তেমনই সম্ভাবনা রয়েছে। হেস, কনোকো-ফিলিপস, ম্যারাথনসহ বিভিন্ন মার্কিনি কোম্পানিও গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। ক্ষমতা নেওয়ার আগেই বিদ্রোহীরা বলেছে, তারা বন্ধু ও শত্রু সবার কথাই মনে রাখবে এবং সে অনুসারে আলোচনা করবে। বিদ্রোহীদের তেল কোম্পানি এগোকোর (এরাবিয়ান গালফ অয়েল কোম্পানি) মুখপাত্র বলেছেন, ইতালীয়, ফরাসি, ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কোম্পানিসমূহকে নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে রাশিয়া, চীন ও ব্রাজিলের সঙ্গে আমাদের কিছু রাজনৈতিক বোঝাপড়া রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এ খবরেই বলা হয়, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর জন্য গাদ্দাফি ছিলেন ঝামেলা বাধানোর শরিক। তিনি প্রায়ই ফি ও কর বাড়িয়ে দিতেন, জানাতেন নানা দাবি। সে তুলনায় ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নতুন সরকার হবে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য সহজে লেনদেন করার মতো শরিক। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অবাধ সুযোগ দিলে এসব তেল কোম্পানি লিবিয়ায় আরো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেলের খোঁজ পেতে পারে। গাদ্দাফি সরকার নানা বিধিনিষেধ জারি করত। ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি যখন লিবিয়ায় বিদ্রোহীদের নেতা জলিলকে পরামর্শ করার জন্য প্যারিসে আমন্ত্রণ জানান, তখনই ফ্রান্সের কাছে লিবিয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারা যায়।
কানাডার গ্লোব অ্যান্ড মেল পত্রিকার এ বিষয়ে একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ‘লিবিয়ায় তেল উৎপাদকরা কঠিন রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি।’ এ খবরে বলা হয় : বিদ্রোহী বাহিনী যদি গাদ্দাফি সরকারকে কাবু করতে না পারে, তা হলে কানাডার কোম্পানিগুলোর জন্য তা বিপর্যয়কর ফলাফল ডেকে আনবে। এটা বিশেষ করে এ কারণে যে, কানাডা গাদ্দাফিবিরোধী কথাবার্তা বাড়িয়েছে এবং গাদ্দাফির বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের অঙ্গীকার করেছে।
এসব খবর/বক্তব্য থেকে লিবিয়ায় ন্যাটোর যুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে তেলের কথা বাদ তো দেওয়া যায়ই না, বরং সেটাই স্পষ্টভাবে চোখে ধরা পড়ে। তবে তেলকে লিবিয়াযুদ্ধের একমাত্র কারণ হিসেবে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ তেল অন্য দেশেও আছে। সে সব দেশে ন্যাটো এখনো পর্যন্ত আক্রমণ চালায়নি।
আজ তেলের জন্য ন্যাটো লিবিয়ায় যুদ্ধ চালালেও এবং বিভিন্ন তেল কোম্পানি এ যুদ্ধে মদদ দিলেও এসব তেল কোম্পানি গাদ্দাফির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ব্যবসা করেছে গাদ্দাফিবিরোধীদের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত। এমনকি লিবিয়ায় ন্যাটোর যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো কোনো কোম্পানি দ্বিধায় ছিল যে, কোন পক্ষকে সমর্থন যোগাবে। আবার কোনো কোনো তেল কোম্পানি গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে সে সময়ও সহযোগিতা করছিল। যেমন মার্চের প্রায় মধ্য ভাগে রয়টার্সের এক খবরে বলা হয় : গাদ্দাফির তেল কোম্পানি ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের (এনওসি) সঙ্গে বিপির চুক্তিগুলো এখনো বহাল আছে বলে বিপি ঘোষণা করেছে। এর একদিন আগে ইতালির তেল কোম্পানি এনি জানায়, এনওসির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চলছে। এমনকি গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্যও এনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে সক্রিয়ভাবে দেনদরবার করে।
অর্থাৎ তেল কোম্পানি বা তেল ব্যবসায়ীদের কাছে তেলই প্রধান বিষয়, গাদ্দাফি বা গাদ্দাফিবিরোধী বা এদের নানা স্লোগান প্রধান বিষয় নয়। এ কারণেই এসব তেল কোম্পানি, এদের পক্ষে নানা রাষ্ট্রের সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য কোম্পানি গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। বন্ধুত্বের সে কাহিনী আগামীতে। তবে তার আগে দেখে নেওয়া যাক লিবিয়ার যে তেল নিয়ে এত কান্ড, সে তেলের অবস্থা। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে লিবিয়ার রয়েছে তেলের সবচেয়ে বেশি প্রমাণিত মজুদ। সেখানে তেল খননের কাজ সফলভাবে প্রথমবারের মতো সম্পন্ন হয় ১৯৫৯ সালে। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার তেল পাইপ বসানোর পরে লিবিয়া তেল রফতানি শুরু করে ১৯৬১ সালে। তেল উৎপাদন ১৯৬৯ সালের মধ্যে দিনে ৩০ লাখ ব্যারেলের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর অন্যতম লিবিয়া রাতারাতি হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ।
কর্নেল গাদ্দাফির নেতৃত্বে একদল সেনা কর্মকর্তা ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তারা ক্ষমতাচ্যুত করেন রাজা ইদ্রিসকে। সে সময় গাদ্দাফির বয়স ৩০-এর কম। গাদ্দাফি সমাজতন্ত্র, আরব ভাবধারা, ইসলাম ধর্ম মিলিয়ে একটি নিজস্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভাবনা স্বদেশে প্রয়োগের চেষ্টা করেন। ফলে দেখা দেয় এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। তিনি ১৯৬৯ সালে সব ব্যাংক জাতীয়করণ করেন; ১৯৭০ সালে জাতীয়করণ করেন তেলশিল্প। সব বিদেশী সৈন্য ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। এর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিও। তিনি আরব ঐক্যের পক্ষে দাঁড়ান, মিসর, সুদান ও তিউনিসিয়ার সঙ্গে লিবিয়াকে একীভূত করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এসব পরিকল্পনার কোনোটিই বাস্তবের মুখ দেখেনি। আরব দেশগুলো ১৯৭৩ সালে যে তেল যুদ্ধ চালায় সে প্রয়াসে গাদ্দাফির নেতৃত্বে লিবিয়া সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। লিবিয়া ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে স্নায়ুযুদ্ধকালীন, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের। কয়েকটি সংগ্রামী বা বিপ্লবী সংগঠনকে গাদ্দাফি মদদ দেন। তবে তার মদদদান পদ্ধতি ও সংগঠন বাছাই সুচিন্তিত ছিল না। ফলে দেখা গেছে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন চরম দক্ষিণপন্থী, পশ্চাৎমুখী ধারণাসজ্জিত শক্তিকে। কখনো তার কাজ প্রকৃতপক্ষে সাহায্য করেছে তারই কথিত প্রতিপক্ষ শিবিরের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে।
এদিকে তেলের উৎপাদন কমতে থাকে তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থার (ওপেক) অন্যতম সদস্য দেশ লিবিয়ার। লিবিয়ার তেলশিল্প গাদ্দাফি আমলে ছিল প্রধানত সে দেশের ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের (এনওসি) ও এর কয়েকটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির আওতাধীন। এগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। লিবিয়ার রফতানি আয়ের ৯৫ শতাংশ যোগাতো তেল। সরকারি রাজস্বের ৭৫ শতাংশ আসতো তেল থেকে।
লিবিয়ার প্রাপ্ত তেলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে সালফারের অনুপাত কম। এ কারণে এ তেলকে বলা হয় ‘সুইট’ বা ‘মিষ্টি’ তেল। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে লিবীয় তেলকে ভালো মানের তেল হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ এ তেল শোধন করে ভালো মানের গ্যাসোলিন ও অন্যান্য জাতের তেল পাওয়া যায়, যা পরিবেশকর্মীদের পছন্দ, যানবাহনের জন্যও ভালো। লিবিয়ার তেল আরেকটি দিক থেকে সুবিধাজনক। এখান থেকে তেল নেওয়ার জন্য সুয়েজ খাল পেরোতে হয় না বা উন্তমাশা অন্তরীপ ঘুরতেও হয় না। ভূমধ্যসাগরের এক তীর থেকে তেল নিয়ে অন্য তীরে, ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে ও ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে তেল শোধনাগারে পৌঁছে দিলেই হয়। ফলে ‘কাজটি’ তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক; তাই লাভজনক।
লিবিয়ায় বিপুল পরিমাণ তেল ছাড়াও রয়েছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস। এ গ্যাসের অধিকাংশই এখনো আহরণের কাজই শুরু হয়নি। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রমাণিত মজুদ ২০০৭ সালের হিসাব অনুসারে ছিল প্রায় ৫৩ টিসিএফ। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের ২০০৮ সালের ইন্ধন জরিপ অনুসারে বলা যায়, ২০০৭ সালের শেষ নাগাদ লিবিয়ায় ছিল ৪১,৪৬৪ বিলিয়ন (শত কোটিতে এক বিলিয়ন) ব্যারেল তেল। এ পরিমাণ সে সময় বিশ্বের তেল মজুদের ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
তেল ও গ্যাস ছাড়াও লিবিয়ায় রয়েছে লোহা, জিপসাম, চুনাপাথর, সিমেন্ট পাথর, লবণ, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত পাথর, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেট পাথর, সোডিয়াম কার্বনেট, সালফার ইত্যাদি। ওয়াদি আশ শাতিতে লোহা আকর মজুদকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম লোহা আকর মজুদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে এ লোহা আকরের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া এটি আহরণ ও পরিবহনের অর্থনৈতিক দিকটিও সমস্যাপূর্ণ। এ কারণে এটি আহরিত হচ্ছিল না। এ লোহা আহরণ ও ব্যবহারের জন্য একটি রেলপথ নির্মাণ ও ইস্পাত কারখানা স্থাপন প্রক্রিয়াধীন ছিল।
এবার নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ কথাটি : লিবিয়ায় ন্যাটো আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে লিবীয় তেলের ওপরে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আর এ তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার দেশটিতে এমন সরকার থাকা, যে সরকার হবে এ কাজের সহায়ক – বাধ্য, অনুগত। গাদ্দাফিবিরোধীরা ইতোমধ্যেই সে প্রমাণ দিয়েছেন। লিবিয়ায় ন্যাটো এ আক্রমণের আরো কয়েকটি কারণ রয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করা হলো না; কারণ সেগুলো এ লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।
লিবিয়ায় এ যুদ্ধ কেন চালানো হলো সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে। ব্রিটেনের ইন্ডিপেন্ডেট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ‘যুদ্ধ-পরবর্তী লিবিয়ায় মুনাফার জন্য দৌড়ঝাঁপে’র খবর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে : লিবিয়ার পশ্চিমা কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য মহাউৎসব শুরু হতে পারে। ব্রিটেনের পত্রিকা ইকোনমিস্ট আভাস দেয় : ন্যাটোর লিবিয়া অভিযানে যে দেশ যতটুকু ভূমিকা পালন করেছে, যুদ্ধ-পরবর্তী পর্বে লুটের ভাগাভাগিতে তা ভূমিকা পালন করবে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয় : শত শত কোটি ডলারের তেল আহরণ ও নির্মাণ কাজের ভাগ নেওয়ার মতো অবস্থানে রয়েছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ইকোনমিস্টকে বলেন, লিবিয়ার এ ঘটনাবলীতে ন্যাটোর সম্পৃক্ত হওয়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে : এটা এখন আমাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের আগস্টের শেষ ভাগে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘দ্য স্ক্র্যাম্বল ফর একসেস টু লিবিয়াজ অয়েল ওয়েলথ বিগিনস’ ‘বাংলায় এর অর্থ হতে পারে লিবিয়ার তেল সম্পদ পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু’। এ খবরে বলা হয় : লিবিয়ার বিদ্রোহীরা রাজধানী ত্রিপোলির পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগেই ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, লিবিয়ায় ইতালির তেল কোম্পানি এনির ভূমিকা হবে সবার আগে। মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, লিবিয়ার তেলসম্পদ নাগালে পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এনি ছাড়াও ব্রিটেনের বিপি (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম), ফ্রান্সের টোটাল ও অস্ট্রিয়ার ওএমভি লিবিয়ায় সংঘাত শেষ হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে, তেমনই সম্ভাবনা রয়েছে। হেস, কনোকো-ফিলিপস, ম্যারাথনসহ বিভিন্ন মার্কিনি কোম্পানিও গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। ক্ষমতা নেওয়ার আগেই বিদ্রোহীরা বলেছে, তারা বন্ধু ও শত্রু সবার কথাই মনে রাখবে এবং সে অনুসারে আলোচনা করবে। বিদ্রোহীদের তেল কোম্পানি এগোকোর (এরাবিয়ান গালফ অয়েল কোম্পানি) মুখপাত্র বলেছেন, ইতালীয়, ফরাসি, ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কোম্পানিসমূহকে নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে রাশিয়া, চীন ও ব্রাজিলের সঙ্গে আমাদের কিছু রাজনৈতিক বোঝাপড়া রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এ খবরেই বলা হয়, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর জন্য গাদ্দাফি ছিলেন ঝামেলা বাধানোর শরিক। তিনি প্রায়ই ফি ও কর বাড়িয়ে দিতেন, জানাতেন নানা দাবি। সে তুলনায় ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নতুন সরকার হবে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য সহজে লেনদেন করার মতো শরিক। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অবাধ সুযোগ দিলে এসব তেল কোম্পানি লিবিয়ায় আরো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেলের খোঁজ পেতে পারে। গাদ্দাফি সরকার নানা বিধিনিষেধ জারি করত। ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি যখন লিবিয়ায় বিদ্রোহীদের নেতা জলিলকে পরামর্শ করার জন্য প্যারিসে আমন্ত্রণ জানান, তখনই ফ্রান্সের কাছে লিবিয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারা যায়।
কানাডার গ্লোব অ্যান্ড মেল পত্রিকার এ বিষয়ে একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ‘লিবিয়ায় তেল উৎপাদকরা কঠিন রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি।’ এ খবরে বলা হয় : বিদ্রোহী বাহিনী যদি গাদ্দাফি সরকারকে কাবু করতে না পারে, তা হলে কানাডার কোম্পানিগুলোর জন্য তা বিপর্যয়কর ফলাফল ডেকে আনবে। এটা বিশেষ করে এ কারণে যে, কানাডা গাদ্দাফিবিরোধী কথাবার্তা বাড়িয়েছে এবং গাদ্দাফির বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের অঙ্গীকার করেছে।
এসব খবর/বক্তব্য থেকে লিবিয়ায় ন্যাটোর যুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে তেলের কথা বাদ তো দেওয়া যায়ই না, বরং সেটাই স্পষ্টভাবে চোখে ধরা পড়ে। তবে তেলকে লিবিয়াযুদ্ধের একমাত্র কারণ হিসেবে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ তেল অন্য দেশেও আছে। সে সব দেশে ন্যাটো এখনো পর্যন্ত আক্রমণ চালায়নি।
আজ তেলের জন্য ন্যাটো লিবিয়ায় যুদ্ধ চালালেও এবং বিভিন্ন তেল কোম্পানি এ যুদ্ধে মদদ দিলেও এসব তেল কোম্পানি গাদ্দাফির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ব্যবসা করেছে গাদ্দাফিবিরোধীদের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত। এমনকি লিবিয়ায় ন্যাটোর যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো কোনো কোম্পানি দ্বিধায় ছিল যে, কোন পক্ষকে সমর্থন যোগাবে। আবার কোনো কোনো তেল কোম্পানি গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে সে সময়ও সহযোগিতা করছিল। যেমন মার্চের প্রায় মধ্য ভাগে রয়টার্সের এক খবরে বলা হয় : গাদ্দাফির তেল কোম্পানি ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের (এনওসি) সঙ্গে বিপির চুক্তিগুলো এখনো বহাল আছে বলে বিপি ঘোষণা করেছে। এর একদিন আগে ইতালির তেল কোম্পানি এনি জানায়, এনওসির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চলছে। এমনকি গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্যও এনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে সক্রিয়ভাবে দেনদরবার করে।
অর্থাৎ তেল কোম্পানি বা তেল ব্যবসায়ীদের কাছে তেলই প্রধান বিষয়, গাদ্দাফি বা গাদ্দাফিবিরোধী বা এদের নানা স্লোগান প্রধান বিষয় নয়। এ কারণেই এসব তেল কোম্পানি, এদের পক্ষে নানা রাষ্ট্রের সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য কোম্পানি গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। বন্ধুত্বের সে কাহিনী আগামীতে। তবে তার আগে দেখে নেওয়া যাক লিবিয়ার যে তেল নিয়ে এত কান্ড, সে তেলের অবস্থা। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে লিবিয়ার রয়েছে তেলের সবচেয়ে বেশি প্রমাণিত মজুদ। সেখানে তেল খননের কাজ সফলভাবে প্রথমবারের মতো সম্পন্ন হয় ১৯৫৯ সালে। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার তেল পাইপ বসানোর পরে লিবিয়া তেল রফতানি শুরু করে ১৯৬১ সালে। তেল উৎপাদন ১৯৬৯ সালের মধ্যে দিনে ৩০ লাখ ব্যারেলের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর অন্যতম লিবিয়া রাতারাতি হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ।
কর্নেল গাদ্দাফির নেতৃত্বে একদল সেনা কর্মকর্তা ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তারা ক্ষমতাচ্যুত করেন রাজা ইদ্রিসকে। সে সময় গাদ্দাফির বয়স ৩০-এর কম। গাদ্দাফি সমাজতন্ত্র, আরব ভাবধারা, ইসলাম ধর্ম মিলিয়ে একটি নিজস্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভাবনা স্বদেশে প্রয়োগের চেষ্টা করেন। ফলে দেখা দেয় এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। তিনি ১৯৬৯ সালে সব ব্যাংক জাতীয়করণ করেন; ১৯৭০ সালে জাতীয়করণ করেন তেলশিল্প। সব বিদেশী সৈন্য ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। এর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিও। তিনি আরব ঐক্যের পক্ষে দাঁড়ান, মিসর, সুদান ও তিউনিসিয়ার সঙ্গে লিবিয়াকে একীভূত করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এসব পরিকল্পনার কোনোটিই বাস্তবের মুখ দেখেনি। আরব দেশগুলো ১৯৭৩ সালে যে তেল যুদ্ধ চালায় সে প্রয়াসে গাদ্দাফির নেতৃত্বে লিবিয়া সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। লিবিয়া ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে স্নায়ুযুদ্ধকালীন, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের। কয়েকটি সংগ্রামী বা বিপ্লবী সংগঠনকে গাদ্দাফি মদদ দেন। তবে তার মদদদান পদ্ধতি ও সংগঠন বাছাই সুচিন্তিত ছিল না। ফলে দেখা গেছে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন চরম দক্ষিণপন্থী, পশ্চাৎমুখী ধারণাসজ্জিত শক্তিকে। কখনো তার কাজ প্রকৃতপক্ষে সাহায্য করেছে তারই কথিত প্রতিপক্ষ শিবিরের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে।
এদিকে তেলের উৎপাদন কমতে থাকে তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থার (ওপেক) অন্যতম সদস্য দেশ লিবিয়ার। লিবিয়ার তেলশিল্প গাদ্দাফি আমলে ছিল প্রধানত সে দেশের ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের (এনওসি) ও এর কয়েকটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির আওতাধীন। এগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। লিবিয়ার রফতানি আয়ের ৯৫ শতাংশ যোগাতো তেল। সরকারি রাজস্বের ৭৫ শতাংশ আসতো তেল থেকে।
লিবিয়ার প্রাপ্ত তেলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে সালফারের অনুপাত কম। এ কারণে এ তেলকে বলা হয় ‘সুইট’ বা ‘মিষ্টি’ তেল। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে লিবীয় তেলকে ভালো মানের তেল হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ এ তেল শোধন করে ভালো মানের গ্যাসোলিন ও অন্যান্য জাতের তেল পাওয়া যায়, যা পরিবেশকর্মীদের পছন্দ, যানবাহনের জন্যও ভালো। লিবিয়ার তেল আরেকটি দিক থেকে সুবিধাজনক। এখান থেকে তেল নেওয়ার জন্য সুয়েজ খাল পেরোতে হয় না বা উন্তমাশা অন্তরীপ ঘুরতেও হয় না। ভূমধ্যসাগরের এক তীর থেকে তেল নিয়ে অন্য তীরে, ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে ও ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে তেল শোধনাগারে পৌঁছে দিলেই হয়। ফলে ‘কাজটি’ তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক; তাই লাভজনক।
লিবিয়ায় বিপুল পরিমাণ তেল ছাড়াও রয়েছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস। এ গ্যাসের অধিকাংশই এখনো আহরণের কাজই শুরু হয়নি। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রমাণিত মজুদ ২০০৭ সালের হিসাব অনুসারে ছিল প্রায় ৫৩ টিসিএফ। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের ২০০৮ সালের ইন্ধন জরিপ অনুসারে বলা যায়, ২০০৭ সালের শেষ নাগাদ লিবিয়ায় ছিল ৪১,৪৬৪ বিলিয়ন (শত কোটিতে এক বিলিয়ন) ব্যারেল তেল। এ পরিমাণ সে সময় বিশ্বের তেল মজুদের ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
তেল ও গ্যাস ছাড়াও লিবিয়ায় রয়েছে লোহা, জিপসাম, চুনাপাথর, সিমেন্ট পাথর, লবণ, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত পাথর, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেট পাথর, সোডিয়াম কার্বনেট, সালফার ইত্যাদি। ওয়াদি আশ শাতিতে লোহা আকর মজুদকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম লোহা আকর মজুদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে এ লোহা আকরের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া এটি আহরণ ও পরিবহনের অর্থনৈতিক দিকটিও সমস্যাপূর্ণ। এ কারণে এটি আহরিত হচ্ছিল না। এ লোহা আহরণ ও ব্যবহারের জন্য একটি রেলপথ নির্মাণ ও ইস্পাত কারখানা স্থাপন প্রক্রিয়াধীন ছিল।
এবার নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ কথাটি : লিবিয়ায় ন্যাটো আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে লিবীয় তেলের ওপরে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আর এ তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার দেশটিতে এমন সরকার থাকা, যে সরকার হবে এ কাজের সহায়ক – বাধ্য, অনুগত। গাদ্দাফিবিরোধীরা ইতোমধ্যেই সে প্রমাণ দিয়েছেন। লিবিয়ায় ন্যাটো এ আক্রমণের আরো কয়েকটি কারণ রয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করা হলো না; কারণ সেগুলো এ লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।
Thursday, September 8, 2011
লিবিয়ায় আক্রমণ কেন? (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১০)
লিবিয়ার যুদ্ধের খবর কারো অজানা নয়। এ
যুদ্ধের বিভীষিকা আর ভয়াবহতার খবর ও ছবি সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়, টিভির
পর্দায়। এ বিবরণ আবার দেওয়ার দরকার পড়ে না। লিবিয়ার এ যুদ্ধ চালাচ্ছে উত্তর
আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা বা ন্যাটো নামের সামরিক জোট। মূলধারার সংবাদ
মাধ্যমের বহু খবরে, তথ্যে, ছবিতে ন্যাটো নেতাদের ভাষ্যে, বক্তব্যে, দাবিতে এ
নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। অনেক তথ্য আড়াল করে, অনেক তথ্য বিকৃত করে,
তথ্য অতিরঞ্জন করে বানোয়াট তথ্য প্রচার করে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের বিপুল
অংশ লিবিয়ায় ন্যাটোর চালানো যুদ্ধকে দেখাতে চাচ্ছে ‘গণতন্ত্রের লড়াই’,
‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ হিসেবে। কিন্তু এত কিছুর পরেও সত্য প্রকাশিত হচ্ছে। সে
সত্য বলছে লিবিয়ায় যুদ্ধ চালাচ্ছে ন্যাটো।
ন্যাটো কেন এ যুদ্ধ করছে আর এ যুদ্ধের ধরন-ধারণ-চরিত্র কেমন- কি, তা বুঝতে পারা সহজ হবে নিচে উল্লেখ করা তথ্যগুলোর দিকে খেয়াল দিলে। এসব তথ্য যথাসম্ভব সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১. ইন্ধন বিষয়ক সাময়িকী পেট্রোলিয়াম ইকোনমিস্ট এ বছরের ২৭ এপ্রিল একটি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম হিসেবে লেখে : দ্য ওয়ার ফর লিবিয়াজ অয়েল অর্থাৎ লিবিয়ার তেলের জন্য যুদ্ধ। এ সংবাদ প্রতিবেদনটি পাঠান ডেরেক ব্রোয়ার, গাদ্দাফিবিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চল থেকে।
২. রাশিয়া টুডেতে ২ এপ্রিল ২০১১ তারিখে সাংবাদিক সুসান লিনডরের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল : ওয়ার ফর লিবিয়ান অয়েল প্ল্যানড লং এগো, নো ওয়ান কেয়ারস এবাউট পিপল অর্থাৎ লিবিয়ার তেলের জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা অাঁটা হয়েছে বহু আগে, জনগণের কথা কেউ ভাবে না।
সাংবাদিক লরেন নানা দেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি মনে করেন না যে, মানবিক কারণে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। তার যুক্তি : মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ করা হলে, লিবীয় জনগণের কথা ভাবা হলে, এ হানাহানি অনেক আগে থেমে যেত।
৩. রাশিয়া টুডেতেই ৪ এপ্রিল আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল : ইললিগ্যাল ওয়ার ইন লিবিয়া ইজ সিআইএ রান, মিডিয়া শিলস কভার ফর ওবামা! হুইসব্লোয়ার সুসান লিনডর, লিবিয়ার বেআইনি যুদ্ধ সিআইএ চালাচ্ছে, ওবামাকে আড়াল করছে সংবাদ মাধ্যম, তথ্য ফাঁস করছেন সুসান লিনডর।
এভাবে আরো সংবাদ-প্রতিবেদনের উল্লেখ করা যায়, যেগুলোতে একই ধরনের তথ্য, যুক্তি ও বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত খবরের কাগজ টেলিগ্রাফে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে কেউই বলবেন না যে, তা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বা যুক্তরাজ্যবিরোধী বা ন্যাটোবিরোধীদের দ্বারা রচিত। এ পত্রিকার ২২ আগস্ট ২০১১ তারিখের সংখ্যায় গর্ডন রেনার, টমাস হার্ডিং ও ডানকান গার্ডহ্যামের লেখা সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম লিবিয়া : সিক্রেট রোল প্লেড বাই ব্রিটেন ক্রিয়েটিং পাথ টু দ্য ফল অব ত্রিপোলি, লিবিয়া : গোপনে ব্রিটেনের ভূমিকা ত্রিপোলি পতনের পথ রচনা করছে। উল্লেখ করতে হয় যে, সংবাদ-প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরে বিষয়টি আর গোপন থাকেনি।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় : সামরিক ও গোয়েন্দা কর্তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধীদের সাহায্য করছেন। রাজধানী ত্রিপোলিতে সমন্বিতভাবে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের এ সাহায্য অনুযায়ী রাজকীয় বিমান বাহিনী অর্থাৎ ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ২০ আগস্ট সকালে আক্রমণ জোরদার করে। এটি ছিল আগেভাগে করা পরিকল্পনার অংশ। গাদ্দাফিবিরোধীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতে এ বিমান হামলা জোরদার করা হয়।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় : গাদ্দাফিবিরোধীদের ঘাঁটি বেনগাজিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্তারা গাদ্দাফিবিরোধী জোটের করা রণপরিকল্পনা আরো ধারালো বা ঘষামাজা করেন। এ পরিকল্পনার ব্যাপারে ১০ সপ্তাহ বা আড়াই মাস আগে মতৈক্য হয়। ব্রিটিশ বিশ্লেষকরা গাদ্দাফিবিরোধী নেতাদের অবিরাম রণকৌশলগত হালনাগাদ বুদ্ধি-পরামর্শ দেন। এ পরামর্শের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ত্রিপোলির ভেতরে নতুন করে ব্যাপক লোকজনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা। সেটাই হবে বিদ্রোহী লড়িয়েদের ত্রিপোলির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা। ত্রিপোলিতে গাদ্দাফিবিরোধী লোকেরা মাথা চাড়া দেয় ২০ আগস্ট রাতে। আর রাজধানী ত্রিপোলি দখলের লড়াইয়ের প্রথম পর্ব শুরু হয় এর কয়েক ঘণ্টা আগে, ইংরেজ বিমান বাহিনীর টর্নেডো জিআরফোর বিমানের হামলার মধ্য দিয়ে। এগুলো হামলা চালায় ত্রিপোলির দক্ষিণ-পশ্চিমে যোগাযোগের প্রধান স্থাপনাগুলোতে। ওইদিন সকালে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে এমনভাবে পরিচালিত বোমা পেভওয়ে ফোর ফেলা হয় একটি গোয়েন্দা কেন্দ্রে। এর পরে বিমান আক্রমণ চালানো হয় ট্যাংকের ওপরে, কামানে, কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল বা নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনায়। এদিকে ত্রিপোলির ভেতরে গাদ্দাফিবিরোধীদের সংকেত দেওয়া হয় মাথাচাড়া দেওয়ার জন্য। সংকেত ছিল গাদ্দাফিবিরোধী জোট প্রধান জলিলের একটি বক্তৃতা সম্প্রচার করা। জলিলের বক্তৃতাটি সম্প্রচার করে কাতারে স্থাপিত টিভি কেন্দ্র লিবিয়া টিভি। এটি সম্প্রচারিত হয় ওইদিন বিকেলে। রাত ৮টা নাগাদ একদল গাদ্দাফিবিরোধীদের লড়িয়ে সুযোগ বুঝে নগর কেন্দ্রে বেন নবি মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নেয়, মসজিদের মাইকে তারা স্লোগান দেয়, শুরু হয় অপারেশন মারমেড ডন (এ পর্যায়ের সাংকেতিক নাম)।
এতে বলা হয়, এর আগে ত্রিপোলির ৩০ মাইল দূরে লড়াইতে গাদ্দাফি ত্রিপোলি থেকে সৈন্য পাঠান। হয় তো গাদ্দাফির পরিকল্পনা ছিল সে যুদ্ধ শেষ হলে সেনাদের আবার বিন্যস্ত করা হবে, সজ্জিত করা হবে অস্ত্রে, যেমন প্রতিটি বড় লড়াইয়ের পরে তিনি করেছেন। কিন্তু সে লড়াইতে ব্যস্ত থাকার সময়েই ইংরেজ বিমানবাহিনীর টর্নেডো ও টাইফুন বিমানগুলো ত্রিপোলিতে আগে থেকে বাছাই করে রাখা লক্ষ্যবস্ত্তগুলোতে একের পর এক আঘাত করে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। ইংরেজ বিমান বাহিনীর ও সঙ্গী দেশগুলোর বিমান বাহিনীর বিমানগুলো ২১ আগস্ট ত্রিপোলিতে ৪৬ বার আঘাত হানে (অর্থাৎ প্রায় প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর চলে এ বিমান হামলা)। এসব হামলায় ব্যবহার করা হয় ভূমিতে আক্রমণ চালানোর ক্ষেপণাস্ত্র ব্রিমস্টোন। এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বেসামরিক এলাকায় অবিশ্বাস্য নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে। গাদ্দাফির বাংকারের ওপরে রাতভর আঘাত হানে বিমান। টর্নেডো বিমানগুলোতে যে উন্নত ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা রয়েছে তা দিয়ে বিমান উড্ডয়ন অবস্থায়ই লক্ষ্যবস্ত্ত চিহ্নিত করে আঘাত হানতে পারে। এ ব্যবস্থাকে বলে ডায়নামিক টার্গেটিং। গাদ্দাফির কয়েকটি নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল ফাঁকা স্কুলভবনে বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে। সেগুলোতে আঘাত হানা হয়। ফলে সৈন্যদের নির্দেশনা দেওয়ার সামর্থ্য নষ্ট হয়ে যায়।
টেলিগ্রাফেরই খবরে বলা হয়, ব্রিটেন গাদ্দাফিবিরোধীদের সাজসরঞ্জামে সজ্জিত করেছে। এ খবরের সত্যতা সমর্থন করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। এসব সাজসরঞ্জামের মধ্যে ছিল টেলিযোগাযোগের উন্নত সরঞ্জাম, গোলাগুলি থেকে দেহ রক্ষায় ১ হাজার সেট বর্ম, রাতে অন্ধকারে দেখার ক্ষমতাবিশিষ্ট চশমা। গাদ্দাফিবিরোধীদের হাত থেকে ত্রিপোলি রক্ষার জন্য গাদ্দাফি একের পর এক আহবান জানান রাজধানীবাসীর প্রতি। বেতার ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বেতারে তার সে কণ্ঠস্বর শোনা যায় ভাঙা ভাঙা, মাঝে থাকে অন্যান্য শব্দ। তিনি নিজের কোনো ভিডিও ছবিও দেখাতে পারেননি। এর ফল দাঁড়ায় : গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধে হার হয়েছে ভেবে অনেক সৈন্য যেখানে ছিল সেখানেই রণপোশাক ছেড়ে সরে যায়। এ খবরও ইংরেজ পত্রিকা টেলিগ্রাফের। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার সরকারি বাসভবনে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসেন। আর বাসভবনের সামনে এসে সাংবাদিকদের কাছে লিবিয়ায় ঘটনাধারার জন্য রাজকীয় বিমান বাহিনীর বৈমানিকদের ‘অবিশ্বাস্য সাহসিকতা, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠা’র প্রশংসা করেন। তিনি বলেন : ‘এটা আমাদের বিপ্লব নয়। তবে আমরা পালন করেছি আমাদের ভূমিকা। সে জন্য আমরা গর্ববোধ করতে পারি।’ কোন অস্ত্রের বিপরীতে কোন অস্ত্র, কোন রণসজ্জার মোকাবিলায় কোন রণসজ্জা, কত সমর শক্তির বিপরীতে কত সমর শক্তি, সে বিচার পাঠক করবেন। সাহসিকতার তুলনা-প্রশংসা ইত্যাদিও পাঠক বিবেচনা করবেন। আর পাঠক বুঝবেন কেমন সে বিপ্লব, যাতে গর্ববোধ নিয়ে অংশ নেয় এ মহাশক্তিধররা একসঙ্গে জোটবেধে। সে কি বিপ্লব, নাকি স্বার্থ হাসিলের যুদ্ধ, যার গায়ে লেবেল মারা মানবিক হস্তক্ষেপ।
এ মহাশক্তিধরদের মদদের খবর আসে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির মাধ্যমে। বিবিসির ৪ জুন, ২০১১ তারিখে লিবিয়ার পশ্চিামাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের তৎপরতা বিষয়ক খবরে বলা হয় : এলাকার আকাশে ন্যাটোর বিমানগুলো চক্কর দিচ্ছে। সে শব্দ কানে আসে বিবিসি সংবাদদাতার। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, ন্যাটো হামলা চালানোয় আমরা খুব খুশি। বিবিসির সংবাদদাতা জানান : আইন সেজালাতে গাদ্দাফি বাহিনীর অবস্থানে ন্যাটো বিমানগুলো হামলা চালিয়েছে। সেখানকার এক বাসিন্দা বিবিসি সংবাদদাতাকে বলেন : আমরা নির্ভর করি আমাদের সাহস আর ন্যাটোর ওপরে। পাঠকের বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কার ওপরে ভর করে কার সাহস! আর ন্যাটোর উন্নত অস্ত্র বহরের বিবরণ সংক্ষেপে বলার নয়। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর যে গোয়েন্দা বিমান লিবিয়ার আকাশে চক্কর দিয়ে দিয়ে সদাসর্বদা নজর রেখেছে, তথ্য সংগ্রহ করেছে, তাতে চড়ে লিবিয়ার আকাশে ঘুরে বিবরণ দিয়েছেন বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংবাদদাতা ক্যারোলিন উইয়্যাট। সেনটিন্যাল আরওয়ান নামের এ বিমানের রাডার সরঞ্জাম কয়েক মিনিটে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা স্ক্যান করতে পারে, অর্থাৎ তন্ন তন্ন করে দেখে নিতে পারে। ভূমধ্যসাগরের ওপর তীরে সাইপ্রাস থেকে যাত্রা করে এ বিমান লিবিয়ার আকাশে পৌঁছায় কয়েক ঘণ্টায়। তার পরে প্রায় সাত মাইল ওপর থেকে রাডারের সাহায্যে ছবি তোলা হয় এ ধরনের পাঁচটি বিমান, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদির জন্য যুক্তরাজ্যের করদাতাদের ১০ বছরে খরচ হয়েছে ১ বিলিয়ন বা ১শ’ কোটি পাউন্ড। এ একটি তথ্যই দেখিয়ে দেয় যুদ্ধের বিশাল আয়োজন, বিপুল ব্যয়।
বিবিসিরই ২২ আগস্ট ২০১১ তারিখের খবরে বলা হয়, বিমান হামলা জোরদার করার ফলে নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ মজুদখানা, বিশেষ করে বাব আল আজিজিয়া নামের প্রেসিডেন্ট বাসভবন চত্বর ধ্বংস হওয়ার খবর ন্যাটো সমর্থন করেছে। কেবল যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র নয়, ফ্রান্সও গাদ্দাফিবিরোধীদের সশস্ত্র করে তোলে। বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা জনাথন মারকাসের ২৯ জুন ২০১১ তারিখের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় : লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে নফুসা পার্বত্য অঞ্চলে গাবিদের অস্ত্র যোগাচ্ছে ফরাসি সামরিক বাহিনী। প্যারাশুটের সাহায্যে বিমান থেকে গাদ্দাফিবিরোধীদের অবস্থানে ফেলা হচ্ছে অস্ত্র। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এসল্ট রাইফেল, মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার। লা ফিগারো পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় : হয়তো ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মিলানও দেওয়া হচ্ছে তাদের। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের অস্ত্র দিচ্ছে কাতার এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। এ ধরনের কিছু অস্ত্র আবার বিমানে করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের কাছে।
পাঠক হয়তো অবাক হচ্ছেন, অস্ত্রশস্ত্রের এ ‘কারবারে’ ফ্রান্সের নাম শুনে। কারণ কোনো কোনো পাঠক হয়তো ভাবছেন, এ দেশটিই কতো দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প-নাটক, নাচে কতোই সহায়তা যোগায়, এ দেশটির বেসামরিক সেরা পদকে ভূষিত করা হয় সত্যজিৎ রায়কে। এখানে সে বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে সংক্ষেপ উত্তর হবে : একেই বলে রাজনীতি! আর রাজনীতির গোড়া হচ্ছে অর্থনীতি। তবে আমাদের দেশের কোনো কোনো কলাম লেখক আক্ষেপের সুরে লিখে ফেলেন অর্থনীতির মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেছে। তারা বোঝাতে চান, এ দুটো আলাদা। তেমনভাবে দেখলেই ঘটনা বুঝতে সমস্যা হয়। যাই হোক, ফিরে যাই লিবিয়ার ন্যাটোর চালানো যুদ্ধের প্রসঙ্গে। ন্যাটোর লিবিয়া যুদ্ধের মোট খরচের হিসাব এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি। এ নিয়ে ভবিষ্যতে মজার মজার খবর বেরুবে বলে ধারণা করা যায়।
তবে বিবিসি ২৭ জুন ২০১১ তারিখে জানায়, লিবিয়ায় সামরিক অভিযানে মার্চ থেকে যুক্তরাজ্যের খরচ হয়েছে ২৬ কোটি পাউন্ড। এ খরচের মধ্যে ছিল বিমান, ইত্যাদির সার্ভিসিং, জ্বালানি, ক্রু ও প্রশিক্ষণ, অবচয়, ইত্যাদি। পার্লামেন্ট, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ইত্যাদি সূত্রের বরাত দিয়ে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে অপারেশনাল খরচ ধরা হয়েছে ১২ কোটি পাউন্ড। এ খরচের মধ্যে রয়েছে ইটালিতে ১২টি টর্নেডো ও ছয়টি টাইফুন জঙ্গি বিমান ও সেগুলোর বৈমানিক এবং অন্যান্য কর্মী ও ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাখার খরচ। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ডুবোজাহাজ ট্রায়াম্প থেকে ১৫টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে লিবিয়ায়। সেখানে ইংরেজ বিমান সেনারা ছুড়েছে শত শত পেডওয়ে ও ব্রিমস্টোনসহ নানা ধরনের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র। একটি ব্রিমস্টোন ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ১ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড, একটি স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ৭৮ লাখ ৯০ হাজার পাউন্ড, একটি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ৮ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১১ লাখ পাউন্ড। একটি পেভওয়ে গাইডেড বোমার দাম ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড, ট্রায়াম্প ডুবোজাহাজের প্রতিদিনের অপারেশন বা পরিচালন ব্যয় ২ লাখ পাউন্ড, রণতরী কাম্বারল্যান্ডের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ ৯০ হাজার পাউন্ড, টাইফুন যুদ্ধ বিমানের উড্ডয়নকালীন প্রতি ঘণ্টার খরচ ৭০ হাজার পাউন্ড, অ্যাপাচে হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে ৪২ হাজার পাউন্ড, টর্নেডো যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার পাউন্ড, ডিসি ১০ বিমানের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার পাউন্ড, সেন্ট্রি বিমানের ক্ষেত্রে ৩৩ হাজার পাউন্ড, সেন্টিনেল বিমানের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার পাউন্ড।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা যায়, কেন এত যুদ্ধ, কেন এত খরচ। আরো অনেক দেশেও তো গণতন্ত্রের সংকট রয়েছে, চলছে নিপীড়ন। অনেক জায়গাতেই আছে মানবিক সংকট। সে সব দেশে এ ধরনের কোনো হামলা করেনি ন্যাটো বা ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ। তা হলে লিবিয়ায় কেন তা করা হলো? অথচ লিবিয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সুসম্পর্ক ছিল। সে তথ্যও ফাঁস করেছে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা। এ ব্যাপারে তথ্যসমৃদ্ধ বইও প্রকাশিত হয়েছে। ইতালির সঙ্গে গাদ্দাফির ছিল সুসম্পর্ক। ইতালির কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অর্থ যোগান দিয়েছিলেন গাদ্দাফি। এমন তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপে বেআইনিভাবে মানুষ যাতে না ঢুকতে পারে সে চেষ্টা চালায় ইউরোপের দেশগুলো। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে ইতালি। আর ইতালির এ কাজে সহযোগী ছিলেন গাদ্দাফি। বেআইনিভাবে ইতালিগামী মানুষকে আটক করার কাজে ইতালির সহযোগী হয়ে ওঠেন গাদ্দাফি। লিবিয়ার ভেতরে বিরোধীদের ওপর নজরদারি করতে এবং বিরোধীদের দমন-পীড়ন চালাতে যন্ত্রপাতি দিয়ে গাদ্দাফিকে সাহায্য করেছে পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ। তাহলে আজ এসব দেশ গাদ্দাফির প্রতি অসন্তুষ্ট কেন?
ঘটনাবলী খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, লিবিয়ায় ন্যাটোর সাম্প্রতিক হামলার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। এ কারণগুলোর একটি হচ্ছে লিবিয়ার তেল, যা এ লেখার গোড়ার দিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। লিবিয়ায় তেলের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই আজকের এ যুদ্ধের অন্যতম কারণ।
ন্যাটো কেন এ যুদ্ধ করছে আর এ যুদ্ধের ধরন-ধারণ-চরিত্র কেমন- কি, তা বুঝতে পারা সহজ হবে নিচে উল্লেখ করা তথ্যগুলোর দিকে খেয়াল দিলে। এসব তথ্য যথাসম্ভব সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১. ইন্ধন বিষয়ক সাময়িকী পেট্রোলিয়াম ইকোনমিস্ট এ বছরের ২৭ এপ্রিল একটি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম হিসেবে লেখে : দ্য ওয়ার ফর লিবিয়াজ অয়েল অর্থাৎ লিবিয়ার তেলের জন্য যুদ্ধ। এ সংবাদ প্রতিবেদনটি পাঠান ডেরেক ব্রোয়ার, গাদ্দাফিবিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চল থেকে।
২. রাশিয়া টুডেতে ২ এপ্রিল ২০১১ তারিখে সাংবাদিক সুসান লিনডরের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল : ওয়ার ফর লিবিয়ান অয়েল প্ল্যানড লং এগো, নো ওয়ান কেয়ারস এবাউট পিপল অর্থাৎ লিবিয়ার তেলের জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা অাঁটা হয়েছে বহু আগে, জনগণের কথা কেউ ভাবে না।
সাংবাদিক লরেন নানা দেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি মনে করেন না যে, মানবিক কারণে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। তার যুক্তি : মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ করা হলে, লিবীয় জনগণের কথা ভাবা হলে, এ হানাহানি অনেক আগে থেমে যেত।
৩. রাশিয়া টুডেতেই ৪ এপ্রিল আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল : ইললিগ্যাল ওয়ার ইন লিবিয়া ইজ সিআইএ রান, মিডিয়া শিলস কভার ফর ওবামা! হুইসব্লোয়ার সুসান লিনডর, লিবিয়ার বেআইনি যুদ্ধ সিআইএ চালাচ্ছে, ওবামাকে আড়াল করছে সংবাদ মাধ্যম, তথ্য ফাঁস করছেন সুসান লিনডর।
এভাবে আরো সংবাদ-প্রতিবেদনের উল্লেখ করা যায়, যেগুলোতে একই ধরনের তথ্য, যুক্তি ও বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত খবরের কাগজ টেলিগ্রাফে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে কেউই বলবেন না যে, তা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বা যুক্তরাজ্যবিরোধী বা ন্যাটোবিরোধীদের দ্বারা রচিত। এ পত্রিকার ২২ আগস্ট ২০১১ তারিখের সংখ্যায় গর্ডন রেনার, টমাস হার্ডিং ও ডানকান গার্ডহ্যামের লেখা সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম লিবিয়া : সিক্রেট রোল প্লেড বাই ব্রিটেন ক্রিয়েটিং পাথ টু দ্য ফল অব ত্রিপোলি, লিবিয়া : গোপনে ব্রিটেনের ভূমিকা ত্রিপোলি পতনের পথ রচনা করছে। উল্লেখ করতে হয় যে, সংবাদ-প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরে বিষয়টি আর গোপন থাকেনি।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় : সামরিক ও গোয়েন্দা কর্তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধীদের সাহায্য করছেন। রাজধানী ত্রিপোলিতে সমন্বিতভাবে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের এ সাহায্য অনুযায়ী রাজকীয় বিমান বাহিনী অর্থাৎ ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ২০ আগস্ট সকালে আক্রমণ জোরদার করে। এটি ছিল আগেভাগে করা পরিকল্পনার অংশ। গাদ্দাফিবিরোধীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতে এ বিমান হামলা জোরদার করা হয়।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় : গাদ্দাফিবিরোধীদের ঘাঁটি বেনগাজিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্তারা গাদ্দাফিবিরোধী জোটের করা রণপরিকল্পনা আরো ধারালো বা ঘষামাজা করেন। এ পরিকল্পনার ব্যাপারে ১০ সপ্তাহ বা আড়াই মাস আগে মতৈক্য হয়। ব্রিটিশ বিশ্লেষকরা গাদ্দাফিবিরোধী নেতাদের অবিরাম রণকৌশলগত হালনাগাদ বুদ্ধি-পরামর্শ দেন। এ পরামর্শের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ত্রিপোলির ভেতরে নতুন করে ব্যাপক লোকজনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা। সেটাই হবে বিদ্রোহী লড়িয়েদের ত্রিপোলির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা। ত্রিপোলিতে গাদ্দাফিবিরোধী লোকেরা মাথা চাড়া দেয় ২০ আগস্ট রাতে। আর রাজধানী ত্রিপোলি দখলের লড়াইয়ের প্রথম পর্ব শুরু হয় এর কয়েক ঘণ্টা আগে, ইংরেজ বিমান বাহিনীর টর্নেডো জিআরফোর বিমানের হামলার মধ্য দিয়ে। এগুলো হামলা চালায় ত্রিপোলির দক্ষিণ-পশ্চিমে যোগাযোগের প্রধান স্থাপনাগুলোতে। ওইদিন সকালে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে এমনভাবে পরিচালিত বোমা পেভওয়ে ফোর ফেলা হয় একটি গোয়েন্দা কেন্দ্রে। এর পরে বিমান আক্রমণ চালানো হয় ট্যাংকের ওপরে, কামানে, কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল বা নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনায়। এদিকে ত্রিপোলির ভেতরে গাদ্দাফিবিরোধীদের সংকেত দেওয়া হয় মাথাচাড়া দেওয়ার জন্য। সংকেত ছিল গাদ্দাফিবিরোধী জোট প্রধান জলিলের একটি বক্তৃতা সম্প্রচার করা। জলিলের বক্তৃতাটি সম্প্রচার করে কাতারে স্থাপিত টিভি কেন্দ্র লিবিয়া টিভি। এটি সম্প্রচারিত হয় ওইদিন বিকেলে। রাত ৮টা নাগাদ একদল গাদ্দাফিবিরোধীদের লড়িয়ে সুযোগ বুঝে নগর কেন্দ্রে বেন নবি মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নেয়, মসজিদের মাইকে তারা স্লোগান দেয়, শুরু হয় অপারেশন মারমেড ডন (এ পর্যায়ের সাংকেতিক নাম)।
এতে বলা হয়, এর আগে ত্রিপোলির ৩০ মাইল দূরে লড়াইতে গাদ্দাফি ত্রিপোলি থেকে সৈন্য পাঠান। হয় তো গাদ্দাফির পরিকল্পনা ছিল সে যুদ্ধ শেষ হলে সেনাদের আবার বিন্যস্ত করা হবে, সজ্জিত করা হবে অস্ত্রে, যেমন প্রতিটি বড় লড়াইয়ের পরে তিনি করেছেন। কিন্তু সে লড়াইতে ব্যস্ত থাকার সময়েই ইংরেজ বিমানবাহিনীর টর্নেডো ও টাইফুন বিমানগুলো ত্রিপোলিতে আগে থেকে বাছাই করে রাখা লক্ষ্যবস্ত্তগুলোতে একের পর এক আঘাত করে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। ইংরেজ বিমান বাহিনীর ও সঙ্গী দেশগুলোর বিমান বাহিনীর বিমানগুলো ২১ আগস্ট ত্রিপোলিতে ৪৬ বার আঘাত হানে (অর্থাৎ প্রায় প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর চলে এ বিমান হামলা)। এসব হামলায় ব্যবহার করা হয় ভূমিতে আক্রমণ চালানোর ক্ষেপণাস্ত্র ব্রিমস্টোন। এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বেসামরিক এলাকায় অবিশ্বাস্য নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে। গাদ্দাফির বাংকারের ওপরে রাতভর আঘাত হানে বিমান। টর্নেডো বিমানগুলোতে যে উন্নত ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা রয়েছে তা দিয়ে বিমান উড্ডয়ন অবস্থায়ই লক্ষ্যবস্ত্ত চিহ্নিত করে আঘাত হানতে পারে। এ ব্যবস্থাকে বলে ডায়নামিক টার্গেটিং। গাদ্দাফির কয়েকটি নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল ফাঁকা স্কুলভবনে বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে। সেগুলোতে আঘাত হানা হয়। ফলে সৈন্যদের নির্দেশনা দেওয়ার সামর্থ্য নষ্ট হয়ে যায়।
টেলিগ্রাফেরই খবরে বলা হয়, ব্রিটেন গাদ্দাফিবিরোধীদের সাজসরঞ্জামে সজ্জিত করেছে। এ খবরের সত্যতা সমর্থন করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। এসব সাজসরঞ্জামের মধ্যে ছিল টেলিযোগাযোগের উন্নত সরঞ্জাম, গোলাগুলি থেকে দেহ রক্ষায় ১ হাজার সেট বর্ম, রাতে অন্ধকারে দেখার ক্ষমতাবিশিষ্ট চশমা। গাদ্দাফিবিরোধীদের হাত থেকে ত্রিপোলি রক্ষার জন্য গাদ্দাফি একের পর এক আহবান জানান রাজধানীবাসীর প্রতি। বেতার ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বেতারে তার সে কণ্ঠস্বর শোনা যায় ভাঙা ভাঙা, মাঝে থাকে অন্যান্য শব্দ। তিনি নিজের কোনো ভিডিও ছবিও দেখাতে পারেননি। এর ফল দাঁড়ায় : গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধে হার হয়েছে ভেবে অনেক সৈন্য যেখানে ছিল সেখানেই রণপোশাক ছেড়ে সরে যায়। এ খবরও ইংরেজ পত্রিকা টেলিগ্রাফের। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার সরকারি বাসভবনে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসেন। আর বাসভবনের সামনে এসে সাংবাদিকদের কাছে লিবিয়ায় ঘটনাধারার জন্য রাজকীয় বিমান বাহিনীর বৈমানিকদের ‘অবিশ্বাস্য সাহসিকতা, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠা’র প্রশংসা করেন। তিনি বলেন : ‘এটা আমাদের বিপ্লব নয়। তবে আমরা পালন করেছি আমাদের ভূমিকা। সে জন্য আমরা গর্ববোধ করতে পারি।’ কোন অস্ত্রের বিপরীতে কোন অস্ত্র, কোন রণসজ্জার মোকাবিলায় কোন রণসজ্জা, কত সমর শক্তির বিপরীতে কত সমর শক্তি, সে বিচার পাঠক করবেন। সাহসিকতার তুলনা-প্রশংসা ইত্যাদিও পাঠক বিবেচনা করবেন। আর পাঠক বুঝবেন কেমন সে বিপ্লব, যাতে গর্ববোধ নিয়ে অংশ নেয় এ মহাশক্তিধররা একসঙ্গে জোটবেধে। সে কি বিপ্লব, নাকি স্বার্থ হাসিলের যুদ্ধ, যার গায়ে লেবেল মারা মানবিক হস্তক্ষেপ।
এ মহাশক্তিধরদের মদদের খবর আসে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির মাধ্যমে। বিবিসির ৪ জুন, ২০১১ তারিখে লিবিয়ার পশ্চিামাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের তৎপরতা বিষয়ক খবরে বলা হয় : এলাকার আকাশে ন্যাটোর বিমানগুলো চক্কর দিচ্ছে। সে শব্দ কানে আসে বিবিসি সংবাদদাতার। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, ন্যাটো হামলা চালানোয় আমরা খুব খুশি। বিবিসির সংবাদদাতা জানান : আইন সেজালাতে গাদ্দাফি বাহিনীর অবস্থানে ন্যাটো বিমানগুলো হামলা চালিয়েছে। সেখানকার এক বাসিন্দা বিবিসি সংবাদদাতাকে বলেন : আমরা নির্ভর করি আমাদের সাহস আর ন্যাটোর ওপরে। পাঠকের বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কার ওপরে ভর করে কার সাহস! আর ন্যাটোর উন্নত অস্ত্র বহরের বিবরণ সংক্ষেপে বলার নয়। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর যে গোয়েন্দা বিমান লিবিয়ার আকাশে চক্কর দিয়ে দিয়ে সদাসর্বদা নজর রেখেছে, তথ্য সংগ্রহ করেছে, তাতে চড়ে লিবিয়ার আকাশে ঘুরে বিবরণ দিয়েছেন বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংবাদদাতা ক্যারোলিন উইয়্যাট। সেনটিন্যাল আরওয়ান নামের এ বিমানের রাডার সরঞ্জাম কয়েক মিনিটে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা স্ক্যান করতে পারে, অর্থাৎ তন্ন তন্ন করে দেখে নিতে পারে। ভূমধ্যসাগরের ওপর তীরে সাইপ্রাস থেকে যাত্রা করে এ বিমান লিবিয়ার আকাশে পৌঁছায় কয়েক ঘণ্টায়। তার পরে প্রায় সাত মাইল ওপর থেকে রাডারের সাহায্যে ছবি তোলা হয় এ ধরনের পাঁচটি বিমান, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদির জন্য যুক্তরাজ্যের করদাতাদের ১০ বছরে খরচ হয়েছে ১ বিলিয়ন বা ১শ’ কোটি পাউন্ড। এ একটি তথ্যই দেখিয়ে দেয় যুদ্ধের বিশাল আয়োজন, বিপুল ব্যয়।
বিবিসিরই ২২ আগস্ট ২০১১ তারিখের খবরে বলা হয়, বিমান হামলা জোরদার করার ফলে নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ মজুদখানা, বিশেষ করে বাব আল আজিজিয়া নামের প্রেসিডেন্ট বাসভবন চত্বর ধ্বংস হওয়ার খবর ন্যাটো সমর্থন করেছে। কেবল যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র নয়, ফ্রান্সও গাদ্দাফিবিরোধীদের সশস্ত্র করে তোলে। বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা জনাথন মারকাসের ২৯ জুন ২০১১ তারিখের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় : লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে নফুসা পার্বত্য অঞ্চলে গাবিদের অস্ত্র যোগাচ্ছে ফরাসি সামরিক বাহিনী। প্যারাশুটের সাহায্যে বিমান থেকে গাদ্দাফিবিরোধীদের অবস্থানে ফেলা হচ্ছে অস্ত্র। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এসল্ট রাইফেল, মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার। লা ফিগারো পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় : হয়তো ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মিলানও দেওয়া হচ্ছে তাদের। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের অস্ত্র দিচ্ছে কাতার এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। এ ধরনের কিছু অস্ত্র আবার বিমানে করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের কাছে।
পাঠক হয়তো অবাক হচ্ছেন, অস্ত্রশস্ত্রের এ ‘কারবারে’ ফ্রান্সের নাম শুনে। কারণ কোনো কোনো পাঠক হয়তো ভাবছেন, এ দেশটিই কতো দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প-নাটক, নাচে কতোই সহায়তা যোগায়, এ দেশটির বেসামরিক সেরা পদকে ভূষিত করা হয় সত্যজিৎ রায়কে। এখানে সে বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে সংক্ষেপ উত্তর হবে : একেই বলে রাজনীতি! আর রাজনীতির গোড়া হচ্ছে অর্থনীতি। তবে আমাদের দেশের কোনো কোনো কলাম লেখক আক্ষেপের সুরে লিখে ফেলেন অর্থনীতির মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেছে। তারা বোঝাতে চান, এ দুটো আলাদা। তেমনভাবে দেখলেই ঘটনা বুঝতে সমস্যা হয়। যাই হোক, ফিরে যাই লিবিয়ার ন্যাটোর চালানো যুদ্ধের প্রসঙ্গে। ন্যাটোর লিবিয়া যুদ্ধের মোট খরচের হিসাব এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি। এ নিয়ে ভবিষ্যতে মজার মজার খবর বেরুবে বলে ধারণা করা যায়।
তবে বিবিসি ২৭ জুন ২০১১ তারিখে জানায়, লিবিয়ায় সামরিক অভিযানে মার্চ থেকে যুক্তরাজ্যের খরচ হয়েছে ২৬ কোটি পাউন্ড। এ খরচের মধ্যে ছিল বিমান, ইত্যাদির সার্ভিসিং, জ্বালানি, ক্রু ও প্রশিক্ষণ, অবচয়, ইত্যাদি। পার্লামেন্ট, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ইত্যাদি সূত্রের বরাত দিয়ে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে অপারেশনাল খরচ ধরা হয়েছে ১২ কোটি পাউন্ড। এ খরচের মধ্যে রয়েছে ইটালিতে ১২টি টর্নেডো ও ছয়টি টাইফুন জঙ্গি বিমান ও সেগুলোর বৈমানিক এবং অন্যান্য কর্মী ও ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাখার খরচ। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ডুবোজাহাজ ট্রায়াম্প থেকে ১৫টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে লিবিয়ায়। সেখানে ইংরেজ বিমান সেনারা ছুড়েছে শত শত পেডওয়ে ও ব্রিমস্টোনসহ নানা ধরনের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র। একটি ব্রিমস্টোন ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ১ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড, একটি স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ৭৮ লাখ ৯০ হাজার পাউন্ড, একটি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ৮ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১১ লাখ পাউন্ড। একটি পেভওয়ে গাইডেড বোমার দাম ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড, ট্রায়াম্প ডুবোজাহাজের প্রতিদিনের অপারেশন বা পরিচালন ব্যয় ২ লাখ পাউন্ড, রণতরী কাম্বারল্যান্ডের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ ৯০ হাজার পাউন্ড, টাইফুন যুদ্ধ বিমানের উড্ডয়নকালীন প্রতি ঘণ্টার খরচ ৭০ হাজার পাউন্ড, অ্যাপাচে হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে ৪২ হাজার পাউন্ড, টর্নেডো যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার পাউন্ড, ডিসি ১০ বিমানের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার পাউন্ড, সেন্ট্রি বিমানের ক্ষেত্রে ৩৩ হাজার পাউন্ড, সেন্টিনেল বিমানের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার পাউন্ড।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা যায়, কেন এত যুদ্ধ, কেন এত খরচ। আরো অনেক দেশেও তো গণতন্ত্রের সংকট রয়েছে, চলছে নিপীড়ন। অনেক জায়গাতেই আছে মানবিক সংকট। সে সব দেশে এ ধরনের কোনো হামলা করেনি ন্যাটো বা ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ। তা হলে লিবিয়ায় কেন তা করা হলো? অথচ লিবিয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সুসম্পর্ক ছিল। সে তথ্যও ফাঁস করেছে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা। এ ব্যাপারে তথ্যসমৃদ্ধ বইও প্রকাশিত হয়েছে। ইতালির সঙ্গে গাদ্দাফির ছিল সুসম্পর্ক। ইতালির কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অর্থ যোগান দিয়েছিলেন গাদ্দাফি। এমন তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপে বেআইনিভাবে মানুষ যাতে না ঢুকতে পারে সে চেষ্টা চালায় ইউরোপের দেশগুলো। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে ইতালি। আর ইতালির এ কাজে সহযোগী ছিলেন গাদ্দাফি। বেআইনিভাবে ইতালিগামী মানুষকে আটক করার কাজে ইতালির সহযোগী হয়ে ওঠেন গাদ্দাফি। লিবিয়ার ভেতরে বিরোধীদের ওপর নজরদারি করতে এবং বিরোধীদের দমন-পীড়ন চালাতে যন্ত্রপাতি দিয়ে গাদ্দাফিকে সাহায্য করেছে পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ। তাহলে আজ এসব দেশ গাদ্দাফির প্রতি অসন্তুষ্ট কেন?
ঘটনাবলী খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, লিবিয়ায় ন্যাটোর সাম্প্রতিক হামলার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। এ কারণগুলোর একটি হচ্ছে লিবিয়ার তেল, যা এ লেখার গোড়ার দিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। লিবিয়ায় তেলের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই আজকের এ যুদ্ধের অন্যতম কারণ।
Labels:
আফ্রিকা,
তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে,
লিবিয়া,
লিবিয়া সংকট
Subscribe to:
Posts (Atom)