Sunday, November 1, 2009

খুদে কর্জের খাতক

মাইক্রো ক্রেডিটের বা খুদে কর্জের বাজার বড়। এ বাজার বর্ধমান। রোজই তা বেড়ে চলেছে। কেবল বাংলাদেশে নয়; আলবেনিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে, মহাদেশের পর মহাদেশে; বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কেন্দ্র থেকে প্রান্তে, সর্বত্র খুদে কর্জের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে। কার্ল মার্কস লিখেছিলেন : টাকা জন্ম দিচ্ছে টাকা। এ কথা ধার নিয়ে বলা যায়: খুদে কর্জের টাকা বাড়িয়ে চলেছে খুদে কর্জের টাকা। ‘খুদে কর্জ...গত দশকে দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র তা পৌঁচেছে কোটি কোটি মানুষের কাছে, তাদের কর্জ দেয়া হয়েছে শত শত কোটি ডলার’ (ডিকটার : ২০০৭)। মাইক্রো ক্রেডিট সামিট ক্যামপেন বলছে, খুদে কর্জের জালের মধ্যে আছে প্রায় ১০ কোটি গরীব পরিবার। আর এ খুদে কর্জ আন্দোলনের ল্য হচ্ছে ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ এ দুনিয়ার সবচেয়ে গরীব সাড়ে ১৭ কোটি পরিবারের, বিশেষ করে, এসব পরিবারের নারীদের কাছে খুদে কর্জ পৌঁছে দেয়া নিশ্চিত করতে কাজ করে যাওয়া। এসব সংখ্যাই বলে দেয় যে, খুদে কর্জের বিষয়টি হেলাফেলা করার নয়, ভাসা ভাসাভাবে দেখার নয়, বিচ্ছিন্ন-অসংলগ্ন মন্তব্য করার নয়। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে আছে দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষের জীবন। বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে কারণে, তা হচ্ছে, খুদে কর্জের কোটি কোটি খাতক এখনো খুদে কর্জের আসল চেহারাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।


খুদে কর্জের প্রসঙ্গটি বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায় এবং সেটা করা দরকারও। অর্থনীতির মূল ধারা খুদে কর্জ নিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনা করেছে ও করছে। খুদে কর্জের সমালোচনার ধারাটিও কয়েকটি দিক তুলে ধরছে। দুটি ধারাতেই আলোচনার বিষয় হিসেবে কখনো কখনো কয়েকটি অভিন্নতা রয়েছে, অভিন্নতা রয়েছে সমালোচনায়, সমালোচনার যুক্তিতে ও সুরে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সুদের হার; গরীবদের মধ্যে একেবারে গরিবদের খুদে কর্জ না পাওয়া; খুদে কর্জ পেয়ে গরিবী অবস্থা কাটাতে পেরেছেন, এমন খাতকদের হার; ইত্যাদি। যে দিক থেকে যেভাবেই আলোচনা হোক, ধনী-গরীব নির্বিশেষে দেশে দেশে খুদে কর্জ নামে যে ‘নাটক’ মঞ্চস্থ হচ্ছে, তার প্রধান চরিত্র খাতক; এসব আলোচনা-সমালোচনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও খাতককে ঘিরেই। কেবল যে প্রশ্নটি আলোচনা হয় না, তা হচ্ছে : গরীব খাতক১ কিভাবে তৈরী করেন খুদে কর্জ শোধের টাকা, যার মধ্যে থাকে আসল, সুদ, জামানত, বীমার প্রিমিয়াম, কর্জ আদায়ের খরচ? আলোচনা যেভাবেই হোক এবং যে দিকটিই অনালোচিত থাকুক, এই খাতক হচ্ছেন পণ্যের মূর্ত রূপ, খুদে কর্জ বাজারে পুঁজি আকৃষ্ট বা প্রলুব্ধ হওয়ার প্রধান উপাদান এবং এ বাজারে পুঁজি সস্তা দরে পায় খাতকেই। খুদে কর্জের খাতক, সার্বিকভাবে, গরীব এবং গরীবকেই শিকার বানিয়েছে খুদে কর্জ। নিজের শ্রম শক্তি দিয়ে খুদে কর্জের গরীব খাতকই পণ্য বানান, তৈরী করেন উদ্বৃত্ত মূল্য আর এই গোটা ক্রিয়াটিতে খুদে কর্জে লগ্নি-করা পুঁজির সাময়িকভাবে আপাতত কোনোই ঝুঁকি নেই। যথাসম্ভব চড়া হারে মুনাফা করতে খুদে কর্জে লগ্নি করা পুঁজি খাতককে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করে, আর এ কর্জ বাজারে খাতক নিজেই পণ্য হয়ে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় একেকটি ধাপে নিজে রূপান্তরিত হন। এর মধ্য দিয়ে খাতকের ও তার খানা সদস্যদের কেশ যায় বেড়ে। কারণ, তাদেরকে প্রতিটি ধাপে যোগাতে ও বৃদ্ধি করতে হয় উদ্বৃত্ত শ্রম; যা করতে গিয়ে সংকুচিত করতে হয় প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়। এ প্রবন্ধে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে, যা একঘেঁয়ে মনে হতে পারে।

কর্জের টাকা হাতে পাওয়ার আগেই
অথবা
চাকা ঘোরার আগেই চাকা ঘোরে

সাধারণত, পুঁজি লগ্নি হওয়ার পরে সেখান থেকে মুনাফা আসতে একটি নির্দিষ্ট সময় দরকার হয়। দেশে বা বিদেশে, কোনো পণ্য প্রস্তুতে বা খনি থেকে আকরিক দ্রব্য আহরণে, অবকাঠামো তৈরী বা পরিবহন চালু বা সেবা খাতে, যেখানে-যে েত্েরই হোক; তুলনামূলকভাবে বেশি বা কম সময়, যেটাই হোক, বিনিয়োগ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য হাতিয়ে নিতে কিছু সময় পার হয়। কিন্তু খুদে কর্জ বাজারে পুঁজি লগ্নি হয়ে খাতকের হাতে পৌঁছানোর আগেই খুদে কর্জ পুঁজি নিয়ে নেয় ভবিষ্যতে তৈরি হবে যে উদ্বৃত্ত মূল্য, তার কিয়দংশ। কর্জ দেয়ার সময় খাতকের কাছ থেকে কেটে রাখা হয় প্রথম কিস্তির টাকা। এই প্রথম কিস্তির মধ্যে থাকে আসলের একাংশ, সুদের একাংশ, ঋণ বীমার প্রিমিয়ামের একাংশ, জামানতের একাংশ, আদায় খরচের একাংশ।
ধরা যাক, একজন খাতককে ৫০ টাকা কর্জ দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। সেই সাথে এটাও সাব্যস্ত হলো যে, প্রতি সপ্তাহে ১ টাকা করে ৫২ সপ্তাহে ৫২ টাকা ফেরত দেবেন খাতক। বাড়তি ২ টাকা হলো কর্জদাতা অভিহিত ‘সার্ভিস’ চার্জ। তাহলে, খাতককে ৫০ টাকা খাটিয়ে বা বিনিয়োগ করে ৫২ টাকা বানাতে হবে। খাতককে কর্জের টাকা দেয়ার সময় প্রথম কিস্তির ১ টাকা কেটে রাখা হলো। খাতক হাতে পেলেন ৪৯ টাকা। এ অবস্থায় তাকে ৪৯ টাকা খাটিয়ে দিতে হবে ৫১ টাকা।
প্রথম কিস্তি হিসেবে কেটে রাখা ১ টাকার মধ্যে রয়েছে সুদ, যা খাতক কর্জের টাকা খাটিয়ে তৈরী করতেন; রয়েছে কর্জ আদায়ের খরচ, যা তখনো শুরু হয় নি। কিন্তু তিনি সুদ দেয়ার জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করার আগেই দিতে হলো খুদে কর্জের মহাজনকে। কর্জদাতা মহাজন-সংগঠনের হিসাব খাতায় খাতকের নামে কর্জ হিসাবে লেখা হলো ৫০ টাকা, পরিশোধ হিসাবে লেখা হলো ১ টাকা, খাতক হাতে পেলেন ৪৯ টাকা। তিনি ৪৯ টাকা হাতে পেয়ে মাথায় নিলেন ৫০ টাকার ঋণভার আর পরিশোধ করার দায়ভার দাঁড়ালো তার ৫১ টাকা। ফলে, ৫০ টাকা খাটিয়ে যে মেহনত যোগ করলে তিনি ৫২ টাকা বানাতে পারতেন, তাকে তার চেয়ে বেশি মেহনত যোগ করতে হবে, কারণ তার হাতে তখন ৪৯ টাকা। এর অর্থ দাঁড়াবে, খাতককে উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় বাড়িয়ে দিতে হবে, যার জন্য কমাতে হবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়। আর এর প্রভাব পড়বে খাতকের এবং খাতকের ওপর নির্ভরশীল খানার সদস্যদের দেহ-মনে, তারা আরো নিঃশেষিত হবেন।
যদি ধরা হয়, এক হাজার খাতককে ৫০ টাকা করে ৫০ হাজার টাকা একদিনে কর্জ দেয়া হয়; তাহলে খাতকরা পান ৪৯ হাজার টাকা। আর মহাজন-সংগঠনের হাতে ফিরে আসা এক হাজার টাকা আবার লগ্নি হয় আরো কয়েকজন খাতকের কাছে এবং সেখানেও একই চক্র ঘোরে। অথচ, এই এক হাজার টাকা ওইসব খাতকের যারা পেয়েছেন ৪৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ, খাতকদের কর্জের টাকা, যা তারা পেয়েছেন ‘মৌলিক’ বা ‘মানব’ ‘অধিকার’ হিসেবে কথিত ‘অধিকার বলে’ এবং কথিত ‘অধিকার বলে’ কাগজপত্রে ওই অর্থের ওই সময়ের ব্যবহারের অধিকারী হয়েছিলেন। অর্থাৎ, লগ্নির ঝুঁকি ছাড়াই এক হাজার টাকা ফেরত এসে পুনঃলগ্নি হলো কর্জদাতা কর্তৃক এবং প্রকৃত অর্থে এই এক হাজার টাকা কর্জ দেয়ার পরে এক সপ্তাহ পর্যন্ত খাতকদের কাছে, অর্থ বা উৎপাদন উপকরণ বা যন্ত্র বা পণ্যরূপে, থাকার কথা। কিন্তু, খাতকরা এ অর্থ বা এ অর্থ দিয়ে কেনা কাঁচামাল বা তা দিয়ে তৈরী পণ্যের মুখ দেখলেন না। অর্থাৎ, পণ্য তৈরীর বা সেবা দেয়ার চাকা ঘোরার আগেই সুদাসল, ইত্যাদি পরিশোধের চাকা ঘুরলো এবং কর্জদাতার ঘরে তা জমা হয়ে আবারো ঘুরলো এবং প্রতিবারেই বয়ে আনলো সুদ, ইত্যাদি।
যদি এমন খাতকের সংখ্যা এক লাখ হয়? যদি হয় ১০ লাখ? যদি কর্জের অর্থের পরিমাণ হয় ১ কোটি টাকা বা ১০ কোটি টাকা বা শত কোটি টাকা? যদি এমন চাকা ঘোরে এক দিনের বদলে তিন শ দিন বা তিন হাজার দিন। ঘুরতে-থাকা চাকা টাকা বয়ে আনতেই থাকবে? রূপকথার গল্প মনে হতেই পারে কারো কাছে।
আলোচনা রূপকথার মতো যাতে না শোনায়, তাই ‘মর্তে’ ফেরা যাক। বাংলাদেশে খুদে কর্জে লগ্নি করছে, এমন বেশ কিছু সংগঠনের একটি মঞ্চ বা জোট হচ্ছে ক্রেডিট এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিডিএফ)। এদের ২০০৫ সালের একটি প্রকাশনা থেকে জানা যায়, গ্রামীণ ব্যাংক গঠনের পর থেকে এ প্রকাশনায় তথ্য প্রদান করার সময় পর্যন্ত যে খুদে কর্জ দিয়েছে, তার পুঞ্জিভূত পরিমাণ ২১৭,৩১৩.৯ মিলিয়ন (১০ লাখে এক মিলিয়ন) টাকা (সিডিএফ : ২০০৫)। এ সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের খাতকের সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ ৫৯ হাজার ছয় শ ৩২ জন। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার তিন শ ৮৩ জন। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের খুদে কর্জ বিস্তৃত ছিল ৪৮ হাজার চার শ ৭২টি গ্রামে (ঐ)। এখন এসব সংখ্যা আরো বেড়েছে। সিডিএফের কাছে ২০০৪ সালে তথ্য দিয়েছিল খুদে কর্জে লগ্নিকারী ৭২১টি প্রতিষ্ঠান।২ এদের খুদে কর্জ দেয়া অর্থের পরিমাণ ২০০৪ সালে ছিল ৩৩৮,৬৩৫.৬৫ মিলিয়ন টাকা। এ ধরনের ৭২০টি প্রতিষ্ঠান ২০০৩ সালে দেয় ২৬৯,৪৭২.০৯ মিলিয়ন টাকা এবং ২০০০ সালে এ ধরনের ৫৮৫টি প্রতিষ্ঠান দেয় ১২৫,৬০৭.৬১ মিলিয়ন টাকা। এবার পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে খুদে কর্জের খাতকদের কাছ থেকে চাকা ঘোরার আগে চাকা ঘুরিয়ে কত টাকা নিয়ে আবার তা চাকা ঘোরার কলে ঢুকিয়ে ঘোরানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এ চাকা ঘুরছেই। আর চাকা ঘোরাচ্ছে খুদে কর্জের পুঁজি, চাকার সাথে বাধা আছেন খাতক। এখন, খাতকদের কাছ থেকে এভাবে ‘হাতিয়ে’ নেয়া অর্থের পরিমাণ এবং তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ পাঠকের প েঅনুমান করা সহজ।
এেত্ের টাকার পরিমাণের চেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে খাতকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার পদ্ধতি।
উল্লেখ করা দরকার যে, সকল খুদে কর্জ প্রতিষ্ঠান উল্লেখিত পদ্ধতিতে ঋণ দেয় না। উল্লেখিত পদ্ধতির চেয়ে ‘শিথিল’ বা ‘নমনীয়’ পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান, আবার ‘কঠোর’ পদ্ধতি অনুসরণকারী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ‘জটিলতর’ পদ্ধতিও অনুসরণ করে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। ‘জটিলতর’ পদ্ধতির েত্ের কয়েকটি ব্যবস্থাকে একীভূত করা হয়। বিষয়টি বিচার-বিবেচনাকালে দু’একটি বা ব্যতিক্রমী পদ্ধতির উদাহরণ দেয়া হলে, তা হবে অমূলক। কারণ, একটি পদ্ধতি বিবেচনাকালে গড়টিই বিবেচ্য। বরং, খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, খাতকের কাছ থেকে এভাবে অর্থ নেয়ার পদ্ধতি অনেক েত্ের ‘জটিলতরে’রও অধিক; যার অর্থ দাঁড়ায় খাতকের ও খাতকের ওপর নির্ভরশীল নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের অধিকতর বঞ্চনা।
খাতককে প্রকৃতপ ে৪৯ টাকা পেয়ে শোধ করতে হয় ৫২ টাকা। এর মধ্যে তিনি কর্জের অর্থ হাতে পেয়ে খাতক হওয়ার আগেই তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয় ১ টাকা আর বাকি ৫১ টাকা তিনি শোধ করেন তার রূপান্তর প্রক্রিয়ার পরবর্তী পর্যায়ে। এই অতিরিক্ত অর্থ আসে তাঁর মেহনত থেকে, যা উদ্বৃত্ত শ্রম-শক্তি। এই ৪৯ টাকা দিয়ে পরবর্তী কিস্তি শোধের দিনের মধ্যে কিস্তির টাকা, অর্থাৎ ১ টাকা তুলে আনতে তাকে উৎপাদন, ইত্যাদি করতে হয় কিস্তি শোধের দিনের সাথে তাল মিলিয়ে। এর অর্থ দাঁড়ায়, তার কেবল কাজের গতি নয়, দেহ ধারণের প্রয়োজনীয় কাজগুলো, পরিবার বা খানার আনুষঙ্গিক কাজগুলো, ঘুম, বিশ্রাম, গতি, পর্যায়ক্রম, ইত্যাদিও নির্ধারিত হয় কিস্তি শোধের দিনের সাথে তাল মিলিয়ে। যদি তৈরী পণ্যটি বিপণনের বিষয়টি গণ্য করা হয়, তাহলে সময়ের এ চাপ আরো বেড়ে যায়। কেননা, খাতককে পণ্যটি তৈরী করে বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করতে হবে কিস্তি শোধের আগে। যদি পণ্যটি একবারে বা একদিনে বা এক হাটে বিক্রি না হয়, তাহলে সে চাপ যায় আরো বেড়ে। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া পড়ে খাতকের পণ্য উৎপাদন গতিতে আর এর ফলে গোটা জীবনে, খানায় বা পরিবারে। শিল্পকারখানায় মজুরের কাজের গতি নির্ধারণ করে যন্ত্র আর যন্ত্রের গতি নির্ধারণ করে মালিক। ুদে কর্জের েত্ের খাতকের কাজের গতি নির্ধারণ করে কর্জ শোধের সময়সূচি, অর্থাৎ খুদে কর্জদাতা। কারখানার মজুরের সারা দিনের সময়সূচী নির্ধারিত হয় কারখানার সময়সূচী বা কাজের পালা দিয়ে। খুদে কর্জ খাতকের সারা দিন কেবল নয়, কর্জ শোধ করা পর্যন্ত সকল কাজের সময় ও সূচী নির্ধারিত হয় কর্জ শোধের সূচী দিয়ে।
কর্জের ৫০ টাকার স্থলে ৪৯ টাকার যে হিসাব এর আগে উল্লেখিত হয়েছে, সেটাও আংশিক, প্রাথমিক ও ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত হিসাব দেখানোর প্রথম ধাপ হিসাবে বলা হয়েছে ৪৯ টাকা। প্রকৃত হিসাবে এ অর্থ আরো কমে যায়। কর্জের অর্থ আনতে যাওয়া, কর্জের কিস্তি শোধে পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে যাওয়া, কর্জ নেয়ার আগে গ্রুপ গঠন ও প্রাথমিক সভাগুলোতে যাওয়ার সময় ও উপস্থিতিকাল, এসব করতে গিয়ে খানায় উৎপাদন ও অন্যান্য কাজ সরিয়ে বা স্থগিত রাখা, কিস্তি পরিশোধকালে সভায় উপস্থিতিকাল, ইত্যাদি যোগ করে সেই যোগফলের অর্থমূল্য ৪৯ টাকা থেকে বিয়োগ করলে দেখা যাবে খাতকের কর্জ প্রাপ্তির পরিমাণ দাঁড়ায়, ধরা যাক, ৪৯ টাকার কম এবং সেই অর্থ দিয়ে তাকে শোধ করতে হবে ৫২ টাকা। এর অর্থ : উদ্বৃত্ত শ্রম সময় বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় শ্রম সময় কমিয়ে আনা এবং এর ফল খাতক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের দেহ য়। কারখানার মজুরকেও এই ক্রমবর্ধমান চাপে পড়তে হয় না। যদি, কোনো কারণে খাতকের উৎপাদিত পণ্যটি৩ বিক্রি না হয়, তাহলে অবস্থা আরো মারাত্মক ও রূঢ় হয়ে ওঠে।
পঞ্চাশ টাকার স্থলে ৪৯ টাকা দিয়ে এবং ১ টাকা রেখে দিয়ে যে আত্মসাৎ কর্মটি সম্পন্ন হয়, সেটি সম্পন্ন হয় খাতক যখন খাতক হন নি, সে সময়ে; আর আত্মসাৎ করা এই ১ টাকায় রয়েছে খাতক পণ্য তৈরীর মজুর হিসাবে ভবিষ্যতে যে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করবেন, তার একাংশ। কারখানার মজুর কারখানায় ঢুকে কলের চাকা ঘোরানোর আগেই তার উদ্বৃত্ত শ্রম শক্তি আত্মসাৎ করার সুযোগ নেই। কিন্তু খুদে কর্জের খাতকের েত্ের সে কাজটি হয়ে যাচ্ছে পদ্ধতিটির ‘গুণে’। খুদে কর্জের খাতকের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করা হচ্ছে খাতক নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীলদের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম সময় খরচ করে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সংগ্রহের আগেই। খেয়াল রাখতে হবে, এই খাতক গরিব, এই খাতক গরিবী অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কর্জকে ‘মৌলিক মানবাধিকার’ গণ্য করে খুদে কর্জ নিতে গিয়েছিলেন। শেকস্‌পীয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকের কুসীদজীবী তার সুদাসল আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছিল একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে। কিন্তু, গরিবী হটানোর ‘মমতায়’ মাইক্রো ক্রেডিটের েত্ের সেই অপোকাল নেই।

কর্জ নেয়ার আগেই জামানত, বীমা, খাতককে নিয়ন্ত্রণ

কোনো গরীব ব্যক্তি খুদে কর্জ নেয়ার আগে গ্রুপে সংগঠিত হন; কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরে সভায় অংশ নেন এবং অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেন গ্রুপের তহবিলে। এই তহবিলটি ভবিষ্যতে দেয় খুদে কর্জের কিয়দংশের জামানত, খেলাপি ঋণের নিরাপত্তা, কর্জ আদায়ের খরচ, প্রশাসনিক খরচ, বীমার প্রিমিয়াম, ইত্যাদি। এ তথ্যটি খুদে কর্জ সমর্থক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের কয়েকটি লেখায় আলোচিত হয়েছে।৪
এসব আলোচনায় যা প্রায় অনুল্লেখিত থাকে, সেটা হচ্ছে, গরীব ভবিষ্যৎ-খাতকদের তিলে তিলে সঞ্চিত এই অর্থ খুদে কর্জদাতা প্রতিষ্ঠান লগ্নি করতে থাকে। এ বিষয়টি আলোচনার আগে গ্রুপ গঠনের প্রসঙ্গটি দেখা যাক।
গ্রুপ গঠন এবং গ্রুপে নিয়মিত অংশগ্রহণের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে খুদে কর্জদাতা কয়েকটি কাজ করে। এগুলো হলো : ১. ভবিষ্যৎ খাতকের ঋণ ব্যবহার ও পরিশোধ সংক্রান্ত বিশ্বস্ততা, আনুগত্য ও যোগ্যতা যাচাই; ২. ভাবী-খাতককে কর্জদাতা সংগঠনের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা, যা হচ্ছে খাতককে ‘যথাযথ ও বিশ্বস্ত’ আচরণ করায় অভ্যস্ত করে তোলা। লগ্নির অর্থ নিরাপদ করার জন্য এটা সহায়ক হয়। এ ছাড়া ‘ভালো খাতক হিসাবে প্রশিণ দিলে কর্জদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্জ ব্যবস্থাপনা খরচ কমে যায়’ (হিউম ও মসলে : ১৯৯৬)। খুদে কর্জের সমর্থক-প্রচারকরা বলে বেড়ান যে, খুদে কর্জ নিতে গরীবকে কোনো জামানত দিতে হয় না, কিছু লাগে না, গরীব হলেই খুদে কর্জ পাওয়া যায়, ইত্যাকার ধরনের কথা। তাদের এসব কথা কতোটুকু সত্য, তা পাঠকরা এখন বুঝতে পারেন।
আর খাতককে কর্জদাতার শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা প্রসঙ্গে অনেক আগে লেখা একটি বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে হয়। জি এম বেল নামে জনৈক স্কট ব্যাংক পরিচালকের লেখা দি ফিলোসফি অব জয়েন্ট স্টক ব্যাংকিং বইটি ১৮৪০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের কয়েকটি বাক্য মার্কস তাঁর পুঁজি বইয়ের ৩য় খণ্ডে ৩৩ অধ্যায়ের শেষে উদ্ধৃত করেছেন। মার্কস উদ্ধৃত বেলের এ বইয়ের বাক্য ক’টি হচ্ছে :

ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো...নৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।...ব্যাংকারের সজাগ আর তিরস্কারভরা চোখ কতবারই ত’ তরুণ কারিগরকে পানমত্ত অমিতব্যয়ী বন্ধুদের সঙ্গ থেকে দূরে রেখেছে। তাই নয় কি?...তার ইয়ারদের টিটকারীর চেয়ে কি তার ব্যাংকারের ভ্রূকুটি তার ওপর বেশি প্রভাব ফেলে নি? প্রতারণা করেছে বা সামান্য ভুল তথ্য দিয়েছে বলে দায়ী হয়ে ব্যাংকারের সন্দেহ তৈরি হতে পারে ভেবে সে কি ভয়ে কেঁপে ওঠে নি? যাজকের চেয়ে ব্যাংকারের দরদ মাখা পরামর্শের দাম কি তার কাছে বেশি নয়? [ এ অংশের বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের ]

খুদে কর্জের কারবারিরা খাতকদের গ্রুপ গঠন করে খাতকদের জীবনে এই ‘শৃঙ্খলা’ আনেন এবং তা আনেন খাতকের জীবন উন্নত করার জন্য নয়, তা আনেন লগ্নির টাকা নিরাপদ করতে, লগ্নি থেকে ফেরতপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। গ্রামীণ ব্যাংকের ষোলো সিদ্ধান্তের ১ নম্বর ও ১৫ নম্বরে৫ এবং গ্রামীণ ব্যাংক বিধিমালায় এই শৃঙ্খলার কথাই বলা হয়েছে। কেবল গ্রামীণ ব্যাংক নয়, খুদে কর্জদাতা অন্যান্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠান/প্রকল্প/ কর্মসূচিও এ থেকে ব্যতিক্রম নয়। এই শৃঙ্খলা হচ্ছে ‘ভাল’ খাতক হওয়ার শৃঙ্খলা। আর ‘ভাল’ খাতক অর্থ হচ্ছে সময় ও প্রতিশ্রুতি অনুসারে সুদাসল বিনা বাক্যে পরিশোধ করা, কর্জদাতার সাথে, অর্থাৎ, খুদে কর্জে লগ্নি করা পুঁজির সাথে উদ্ধত বা দুর্বিনীত আচরণ না করা।
গ্রুপে সংগঠিত হয়ে প্রাথমিক বা গ্রুপ তহবিলে সঞ্চয়ের আরেকটি দিক রয়েছে, যা মূল ধারা বা সমালোচনার ধারা আলোচনা করে না। বলা হয়ে থাকে, গ্রুপ তহবিলে সঞ্চয় থেকে গ্রুপ সদস্য সুদ পান। খুদে কর্জের খাতক যেমন কর্জের জন্য সুদ দেন, সেভাবে গ্রুপ তহবিলে সঞ্চিত অর্থের সুদও পান। বাস্তবে কি ঘটে, তা দেখার আগে তথ্যের দিকে তাকানো যাক। সিডিএফের উপরোক্ত প্রকাশনার পৃষ্ঠা ৮১ থেকে পৃ. ১৬৯য়ে যে তথ্য রয়েছে, সেখান থেকে দেখা যায়, দুই সুদের হারের তারতম্য অনেক। একেবারে সংেেপ: খাতক বেশী হারে সুদ দেন, গ্রুপ সদস্য হিসেবে পান কম হারে। ব্যতিক্রমের েত্ের সর্বত্র যা ঘটে, এ েত্েরও তাই; একেবারে কম, নগণ্য, হাতে গোনা। সে কারণেই সেগুলো ব্যতিক্রম, সে কারণেই সেগুলো অগণ্য। এ ছাড়া দুই সুদ হিসাবও করা হয় দুই পদ্ধতিতে।৬ ফলে, পার্থক্য হয়ে ওঠে বিপুল।
গ্রুপ তহবিলের সুদের হার, সুদ হিসাবের পদ্ধতিতে যা-ই থাকুক; এ তহবিল গ্রুপ সদস্যরা ফেরত চাইলেই ফেরত পান না; অনেক েত্ের, আদৌ ফেরত পান না। এ তথ্য বিভিন্ন গবেষণায়/সমীায় পাওয়া গেছে এবং তা একাধিক গবেষণাপত্র/সমীা প্রতিবেদন/ বইতে উল্লেখিত হয়েছে। নিচে কেবল একটি উদ্ধৃত করা হলো।

[ গ্রামীণ ] ব্যাংক সদস্যরা জানান যে, গ্রুপ তহবিল তাদের দরকার মত পাওয়া যায় না।... যদিও [জরুরি তহবিল] দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকায়, কিন্তু আজ [উল্লেখিত গবেষণাকাল] পর্যন্ত তা থেকে টাকা দেয়া হয়েছে ন্যূনতম। ফলে, সদস্যরা এ তহবিলটি পছন্দ করেন না। তাঁরা মনে করেন যে, এটা হচ্ছে কর্জ নেয়ার খরচ, যার নামটুকু ভিন্ন। (ফাগলেসাঙ এবং চ্যান্ডলার : ১৯৯৩)।

গ্রুপে সংগঠিত ভাবী-খাতকদের সঞ্চয়ের নাম ভিন্ন ভিন্ন হলেও সার বিষয়টি দাঁড়ায় একই : ভাবী-খাতকদের কাছ থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে নেয়া, যা জামানত, কর্জ হিসাবে ভবিষ্যতে দেয় অর্থের বীমার প্রিমিয়াম, ইত্যাদি হিসাবে কাজ করে এবং একই সঙ্গে তা লগ্নি হয়ে বয়ে আনে মুনাফা। প্রশ্ন আসতে পারে যে, এ ধরনের সঞ্চয়ের পরিমাণ কত? সিডিএফের উপরোক্ত প্রকাশনায় এ বিষয়ে যে তথ্য রয়েছে, তা ন্বিরূপ (ছক-১) :



ছক-১
পুঞ্জিভূত সঞ্চয়

বিষয় সাল: মিলিয়ন টাকা (তথ্যদাতা খুদে কর্জের সংগঠনের সংখ্যা)
পুঞ্জিভূত সঞ্চয় জমা ২০০৪ : ৫৩,২৫৮.২৮ (৭২১) ২০০৩ : ৪২,৫০২.৯৪ (৭২০)
২০০২ : ৩২,০৩৬.১৬ (৬৫৬) ২০০১ : ২৪,২৫২.২৯ (৬২৯)
২০০০ : ১৭,৮৩৩.৮৬ (৫৮৫)
সূত্র : সিডিএফ : ২০০৫

এই ছকের তথ্যই বলে দেয় বাস্তবতা। ঘূর্ণায়মান বা পুনঃপুন ঋণ তহবিলের দিকে তাকালে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। সিডিএফের এই প্রকাশনাই জানাচ্ছে, ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিলের মধ্যে সদস্যদের সঞ্চয়ের পরিমাণ, যা নিচে ছক-২য়ে দেয়া হলো :

ছক-২
ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিলের উৎস (আংশিক)

ঘূর্ণায়মান ঋণ মোট ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিলের % : সাল (তথ্যদাতা খুদে কর্জের
তহবিলের উৎস সংগঠনের সংখ্যা)
সদস্যদের সঞ্চয় ২৮.৫০% : ২০০৪ ২৮.৫% : ২০০৩ ২৬.৯% : ২০০২ ২৪.১% : ২০০১
(৭২১) (৭২০) (৬৫৬) (৬২৯)
সার্ভিস চার্জ ২৩.৬৯% : ২০০৪ ২৩.৮% : ২০০৩ ১৭.৮% : ২০০২ ১৬.৮% : ২০০১
(৭২১) (৭২০) (৬৫৬) (৬২৯)
সংগঠনের নিজ
তহবিল ৪.৩৮% : ২০০৪ ৩.৭% : ২০০৩ ৫.৯% : ২০০২ ৩.৩% : ২০০১
(৭২১) (৭২০) (৬৫৬) (৬২৯)
সূত্র : ঐ

এই ছকের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিলে সদস্যদের অর্থ, তাদের সঞ্চয়, তাদের দেয়া সার্ভিস চার্জ, যার মধ্যে সুদ রয়েছে, অর্ধেকের বেশী। এ জন্যই বলা যায়, মাছ ভাজা হয়ে মাছেরই কিছুটা তেল দিয়ে। [ এ সংক্রান্ত আরো তথ্য প্রকাশিতব্য বইতে পাওয়া যাবে। ]
সদস্যদের সঞ্চিত অর্থের পরিমাণের চেয়ে কয়েকটি বড় প্রশ্ন, মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে : ১. খাতকের কাছ থেকে নেয়া সুদ এবং গ্রুপ সদস্যকে দেয়া সুদ কি একই পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়? সিডিএফের উপরোক্ত প্রকাশনার তথ্য বলছে, না, অধিকাংশ েত্ের দুই হার, দুই পদ্ধতি এবং গ্রুপ সদস্যকে দেয়া সুদের েত্ের অনুসৃত পদ্ধতিতে দেয় হার হয় কম। দুই সুদের হারের পার্থক্য আরো বেড়ে যায় সুদ গণনা পদ্ধতির পার্থক্যের কারণে এবং তা যায় সঞ্চয়কারী ও খাতকের প্রতিকূলে। ২. সঞ্চিত অর্থ ব্যবহার বা বিনিয়োগ বা লগ্নির েত্ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ কি গ্রুপ সদস্যের রয়েছে? বাস্তবতাই বলে দেয় যে, এ প্রশ্নের উত্তরও ‘না’। ৩. খাতককে দেয়া কর্জের বীমা থাকলে গ্রুপ সদস্যের কাছ থেকে নেয়া সঞ্চয় তহবিলের বীমা রয়েছে কি এবং থাকলে, সঞ্চয়কারী সেই বীমার সুবিধা পান কি? ৪. এসব েত্ের সঞ্চয়কারীদের কাছে স্বচ্ছতা ও সঞ্চয়কারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ কতটুকু?
এসব প্রশ্নের মুখে খুদে কর্জদাতারা চমৎকার সব জবাব দেবেন বলে নিশ্চিত ধারণা করা যায়। কিন্তু, সিডিএফের উক্ত প্রকাশনাটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তথ্যাবলী, বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য, বাস্তব সব অভিজ্ঞতা ওইসব চমৎকার জবাব বাতিল করে দেয়।
খেয়াল রাখা দরকার যে, খাতকের েত্ের এসব ঘটনা ঘটছে খাতক কর্জ নিয়ে বাড়ি যাওয়া বা বাজারে গিয়ে উৎপাদনের উপকরণ/ সামগ্রী/ সরঞ্জাম/ যন্ত্র কেনার আগেই। খাতকের রূপান্তর ঘটতে থাকে উপরোক্ত ক্রয় কাজ শুরু হওয়া থেকে।

খাতক হয়ে ওঠেন উৎপাদন উপকরণের মালিক, উৎপাদনকারী

কর্জের অর্থ নিয়ে বাজারে গিয়ে খাতক কেনেন মুড়ি তৈরীর জন্য ধান বা কড়াই বা ডিম পাড়া মুরগী বা দুধ দেয়া গরু বা সুতো, রঙ বা ঝুড়ি তৈরীর বাঁশ বা রিকশা-ভ্যান, ইত্যাদি। এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এসবের মালিক। তাকে কর্জের পরবর্তী বা দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধের সময়ের আগেই সংগ্রহ করতে হয় কিস্তির অর্থ। যদি দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পরিশোধের আগে তিনি পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে কিস্তি হিসাবে দেয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে এক চিত্র, আর না পারলে অন্য চিত্র।
এমন হতে পারে যে, খাতক কিস্তি শোধের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করলেন, তা বিক্রি করে কিস্তির অর্থ আসে নি বা সেই পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হলেও কিস্তি পরিশোধের মতো অর্থ আসার উপযুক্ত পরিমাণ পণ্য বিক্রি হয় নি, বা বাজারে পণ্যটির দাম কমে যাওয়ায় খাতক পণ্যটি বিক্রি করা থেকে বিরত থেকেছেন, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনা৭ ঘটতে পারে। ঘটনা বা দুর্ঘটনা, উৎপাদন বা বাজার পরিস্থিতি যা-ই ঘটুক, খাতককে কর্জের দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধ করতেই হবে।
এমন অবস্থায় উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির মালিক খাতক কি করেন? তাঁর করণীয় থাকে কয়েকটি, যেগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায় : ১. ‘স্বাভাবিক’ এবং ২. ‘অস্বাভাবিক’।
‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে খাতক নিজের ও নিজ খানা/ পরিবার সদস্যদের খোরাকি, ইত্যাদি কমিয়ে আনেন বা পণ্য উৎপাদক মজুর হিসাবে নিজের ও এ উৎপাদনে নিয়োজিত খানা/ পরিবার সদস্যের প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় সংকুচিত করেন, প্রসারিত করেন উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় বা উৎপাদন উপকরণের/ সামগ্রীর/ সরঞ্জামের অন্য মালিকের কাছে নিজের ও/ বা খানা/ পরিবারের অন্য সদস্যের শ্রম বিক্রি করেন। শেষোক্ত েত্ের খাতক ও / বা খানা/ পরিবার সদস্যরা প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ে উৎপাদিত মূল্যের একাংশ সরিয়ে নেন কিস্তি পরিশোধে, যার অর্থ প্রথমত, খাতক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের আরো বঞ্চনা; এবং দ্বিতীয়ত ও মূলত, প্রয়োজনীয় শ্রম সময়ের থেকেও নিষ্কাশন, যেটা কারখানা মজুরের েত্ের ঘটে না এবং যা আরো নির্মম। যে পন্থা বা ‘কৌশল’ই গ্রহণ করা হোক না কেন, তাতে খাতক ও তার ওপর নির্ভরশীলদের দেহ- ‘মনে’র আরো য় ঘটে।
‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে খাতক দ্বারস্থ হন কোনো মহাজনের বা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বা অন্য খাতকের বা কর্জদাতা অন্য সংগঠনের। আত্মীয় বা বন্ধু বিনা সুদে কর্জ দিলেও অন্যান্য েত্ের তা ঘটে না এবং বাস্তবতা হচ্ছে যে, সচরাচর গরীব খাতকের আত্মীয় বা বন্ধুর আর্থিক সামর্থ্যও গরীব খাতকের মতো; ফলে কর্জ দেয়ার সামর্থ্য তাদের নেই বা অতিসীমিত। এ ধারায় খাতকের কর্জ যায় বেড়ে। এমনকি এক পর্যায়ে খাতক খেলাপি হয়ে পড়লে একই কর্জদাতা খেলাপি খাতককে আরো বেশী কর্জ দিয়ে আগের কর্জের অর্থ উশুল করে অবশিষ্ট টাকা খাতককে দেন। তখন খাতককে পড়তে হয় আরো দুরবস্থায়। ধরা যাক, খাতক প্রথমে এক হাজার টাকা কর্জ নিলেন। খেলাপি হলে তাঁর নামে বরাদ্দ হলো দু হাজার টাকার নতুন কর্জ। আগের এক হাজার টাকা আদায় করে তিনি হাতে পেলেন এক হাজার টাকা। (প্রকৃতপ,ে তিনি এক হাজার টাকা পাবেন না, পাবেন কিছু কম।) খাতককে এক হাজার টাকা, যদি ধরা হয় যে, তিনি এক হাজার টাকাই পেয়েছেন, ‘খাটিয়ে’ শোধ করতে হবে দু হাজার টাকার কর্জ; যার অর্থ, আরো মেহনত, আরো উদ্বৃত্ত শ্রম যোগ করা, আরো বঞ্চনা, আরো য়। খাতক হয়ে পড়েন ঋণ-দাস। ঋণ তাঁর জীবনযাত্রা, জীবনের কর্মসূচী, চলাচল, সময় নিয়ন্ত্রণ করে। ঋণের এই দাসত্ব শৃঙ্খল কেবল খাতক নয়, খাতকের ওপর নির্ভরশীল খানা/পরিবার সদস্যদের ওপরও চেপে বসে। এঁদের ভাবনা-চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ঋণ, গোটা মাথা আচ্ছন্ন করে রাখে ঋণ। রূপান্তর প্রক্রিয়ায় খাতকের এ অবস্থা ঘটে।
খাতক যখন খুদে কর্জের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির স্বাধীন মালিক হিসাবে নিজ বাসায়/খানায় এসে পৌঁছান, তখন থেকে তাঁর ওপর অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব চেপে বসে, যেসব দায়িত্ব সাধারণত কারখানা মজুরের ঘাড়ের ওপর চাপে না। এ দায়িত্বগুলো হচ্ছে উৎপাদন উপকরণ ইত্যাদি রণাবেণ, মেরামত, বদল, ইত্যাদি এবং এসবের সাথে যুক্ত খরচের ব্যবস্থা করা। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে : প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় বা উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় যুক্ত করা, যা অবস্থার/উৎপাদন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে। এই শ্রম-সময় যে কেবল খাতক দেন, তা নয়। খাতকের স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা বা শ্বশুর-শাশুড়ি এবং খাতকের ওপর নির্ভরশীলরাও দিয়ে থাকেন।
উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির ‘গৌরবময়’ মালিকানা খাতকের সাথে যুক্ত হওয়ার সাথে আরেকটি জটিল হিসাবও যুক্ত। কোনো কারখানা মালিক পণ্য উৎপাদনের জন্য উৎপাদন প্রাঙ্গণ, ছাউনি, আলো, পানি, ইত্যাদির ব্যবস্থা করে এবং তারপরে নিয়োগ করে মজুর। এসব ব্যবস্থা করার জন্য কারখানা মালিককে অর্থ খরচ করতে হয়। কিন্তু খুদে কর্জের খাতককে এসবের ব্যবস্থা করতে হয় নিজেকে; এসবের জন্য খরচ করতে হয় নিজেকে; এবং এ ধরনের খরচগুলো মূলত যায় খাতকের নিজের বা তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের কাছ থেকে নগদ অর্থে বা বস্তু আকারে বা মেহনত রূপে।
এর অর্থ, খুদে কর্জের খাতককে স্থির পুঁজি ও পরিবর্তনশীল পুঁজি, দুটোরই ব্যবস্থা রাখতে হয়, যা ঋণ হিসাবে দেয়া অর্থের মধ্যে সবসময় থাকে না। এর অর্থ খাতক ও/বা তার ওপর নির্ভরশীলদের শ্রম-সময় যুক্ত করা এবং অবশেষে কর্জদাতা কর্তৃক আত্মসাৎ করা।
খুদে কর্জদাতা কখনো কখনো উপরোক্ত বিষয়গুলোর খরচ দেয়। সেটা নির্ভর করে, কোন কাজে কর্জ দেয়া হলো, তার ওপর। সে েত্ের হিসাবটি হবে অন্যভাবে। এবং তাতে ঘটনা খাতকের প্রতিকূলে যায়।
খুদে কর্জের সাহায্যে উৎপাদনের জন্য খাতককে নিজ আঙ্গিনার ও/বা ঘরের একাংশ ব্যবহার করতে হয়, ইত্যাদি। এর নির্মাণ, রণাবেণ ব্যয়, খাজনা মেটাতে হয় খাতককে। এর অর্থ যা হয়, সেটা এখন আর পুনরাবৃত্তি করা দরকার পড়ে না।
খাতক যখন কর্জের অর্থে পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল, ইত্যাদি সংগ্রহ করেন, এ উদ্দেশ্যে গুণগত মান ও মূল্যগত পার্থক্য, সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করেন, এসব পরিবহন করে আনেন, এসব নিরাপদে পরিবহনের ব্যবস্থা করেন, তখন এসবের পুরো দায় চাপে খাতকের ওপর, যিনি স্বাধীন উৎপাদনকারী হতে চলেছেন এবং একই সাথে বাধা পড়তে চলেছেন ঋণ-দাস হিসাবে। কারখানা মজুরকে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। এসব নিয়ে ‘মাথা ঘামানোর’, এসব সম্পন্ন করার সাথেও শ্রম-সময় যুক্ত। এটাও যায় খাতকের প্রতিকূলে।

উৎপাদনকারী-খাতক হয়ে পড়েন মজুরী-দাস

খুদে কর্জের খাতক উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির স্বাধীন মালিক থেকে রূপান্তরিত হন উৎপাদনকারীতে এবং উৎপাদনকারী হিসাবে কাজ শুরু করার সাথে সাথে তাঁর রূপান্তর ঘটে মজুরি-দাসে। সময় মতো কিস্তি শোধে, ৪৯ টাকা বা আরো কম অর্থ হাতে পেয়ে ৫২ টাকা বা আরো বেশী শোধ করার জন্য খাতককে যুক্ত হতে হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং কেবল খাতক নন, এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে হয় খাতকের ওপর নির্ভরশীলদের, বয়স নির্বিশেষে। এটা করতে গিয়ে তাঁদের জীবন ধারণসূচী, সময় ব্যবহার, কাজের গতি, ইত্যাদি আবর্তিত হয় কিস্তি পরিশোধের সময়সূচীকে কেন্দ্র করে। তখন আর ৮ ঘণ্টা কাজ, কেবল সকাল-বিকাল কাজ, অনুকূল আবহাওয়ায় কাজ, প্রাপ্তবয়স্কের কাজ, ইত্যাদি বিষয় বিবেচনাধীন থাকে না। তখন তাঁরা মজুরী-দাস হিসাবে কাজ করতে থাকেন কিস্তি পরিশোধের সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট কিস্তির অর্থ সংগ্রহের উপযুক্ত পণ্য উৎপাদন, বিপণন, ইত্যাদি ল্যে, এবং এ জন্য তাঁদেরকে ক্রমাগত প্রসারিত করতে হয় উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় ও সংকুচিত করতে হয় প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন খাতক এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীলরা। মজুরী-দাসত্বের শৃঙ্খল চেপে বসে সবার গলায়।
যদি এর সাথে ‘সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভরশীল ঘটনাবলী’, অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবহাওয়ার হের-ফের, ইত্যাদি এবং ‘মানুষের কার্যাবলী’, অর্থাৎ, বাজার পরিস্থিতি, ইত্যাদি যুক্ত করা হয়, তাহলে খাতক ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের, অর্থাৎ, রূপান্তরিত পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন মজুরী-দাসদের অবস্থা হয়ে ওঠে আরো শোচনীয়। কারখানা মালিক সপ্তাহভিত্তিতে মজুরি দিলে সে মজুরকে, এক সপ্তাহের জন্য, প্রকৃতপ,ে মজুরের এক সপ্তাহের শ্রম কিনে নেয়। কিন্তু, খুদে কর্জের খাতকের ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের পূর্ণ বা খণ্ডকালীন শ্রম খুদে কর্জদাতা কিনে নেয় ৫২ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় বা কর্জ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত। ঋণ-দাসের অবস্থা দাঁড়ায় এমনই।

খাতক এবার হয়ে ওঠেন স্বাধীন ব্যবসায়ী

খাতক রূপান্তরিত হয়ে মজুরী-দাস থেকে হন স্বাধীন ব্যবসায়ী, যখন তিনি উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বাজারে যান। বাজারে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হন তাঁরই মতো অন্যান্য খাতক-পণ্য উৎপাদনকারী-ব্যবসায়ীর এবং অন্যদের সাথে। ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি যখন পণ্য নিয়ে বাজারে যান, তখনও যুক্ত হয় তাঁর বা তাঁর খানা/ পরিবারের অন্য কারো শ্রম অথবা তাঁরা উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ দেন অন্য কাউকে পণ্য পরিবহনে। এসব গিয়ে যুক্ত হয় কর্জদাতার কাছে বা উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎকারী অন্যকারো কাছে। সেটাও খুদে কর্জদাতা হতে পারে। স্বাধীন ব্যবসায়ী হিসাবে খাতককে মোকাবিলা করতে হয় বাজার, যা আজ বিশ্বায়িত পুঁজির কব্জায়। এই ধাক্কা সামলানোর খেসারত দিতে হয় খাতককে এবং সেই খেসারত দেয়ার পরে হাতে-আসা অর্থের একাংশ তুলে দিতে হয় কর্জদাতাকে কিস্তি পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। কিন্তু, যদি বাজার বা আবহাওয়া বা খাতকের স্বাস্থ্য বা অন্যকোনো পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকে? তখন হয়ত, অর্থের একাংশ নয়, পুরোটা এবং অন্য কোথাও থেকে এনে যোগ করতে হয় অর্থ, কর্জ পরিশোধে। এমন হলে, খাতকের অবস্থা হয় আরো খারাপ।

রূপান্তরের গতিপথ

খুদে কর্জে খাতকের রূপান্তর হয় খাতক (খ) থেকে উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির মালিক (ম), এসবের মালিক থেকে স্বাধীন উৎপাদনকারী (উ), স্বাধীন উৎপাদক থেকে মজুরী-শ্রমিক (শ), মজুরী-শ্রমিক থেকে স্বাধীন ব্যবসায়ী (ব), স্বাধীন ব্যবসায়ী থেকে আবার খাতকে (খ১), এবং তিনি হয়ে পড়েন ঋণ-দাস। রূপান্তরের এই গতিপথের প্রতিটি পর্যায়ে খাতকের কাছ থেকে কর্জদাতা নিয়ে নেয় উদ্বৃত্ত মূল্য, প্রতিটি পর্যায়েই খাতকের নিজের ও/ বা তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্য এবং কোনো কোনো েত্ের অন্যের তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ খাতকের মাধ্যমে কর্জদাতা মহাজনের গাঁটে জমা হয়। একই সাথে, রূপান্তর প্রক্রিয়ার কোনো কোনো পর্যায়ে উদ্বৃত্ত মেহনতটুকু কর্জদাতাকে দেয়া ছাড়াও খাতককে নিতে হয় অতিরিক্ত বিভিন্ন দায়দায়িত্ব-ভার, যেগুলো মাসুল নিয়ে নেয় খাতক ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের কাছ থেকে। এসবেরই পরিণতি খাতক ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আরো বঞ্চনা, আরো দুর্ভোগ-দুর্গতি-দারিদ্র্য। কারণ, এসব দায়-দায়িত্বের সাথে, প্রকৃত অর্থে, জড়িয়ে থাকে খাতক ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের মেহনত।
খুদে কর্জ-খাতকের রূপান্তর গতিপথ একই সাথে দুটি রূপ নেয়। একটি রূপে এই গতিপথ বৃত্তাকার; অপরটি বৃত্তাকার নয়, একমুখী। প্রথমটিতে, অর্থাৎ, বৃত্তাকার গতিপথে খাতক ঋণে আটকে থাকেন, ঋণ থেকে আরো ঋণে জড়িয়ে ঋণের জাল ছিঁড়ে বের হতে পারেন না। দ্বিতীয়টিতে খাতকের গরিবী অবস্থার অবনতি ঘটে এবং তিনি স্থানচ্যুত হন। প্রথমটি বিরাজমান অবস্থাকে বজায় রাখে ও রাখার চেষ্টা করে; দ্বিতীয়টি চাপ তৈরী করে দারিদ্র্য সৃষ্টি করে যে-ব্যবস্থা, তার ওপর। সমাজে শ্রেণীতে শ্রেণীতে সংঘাতের েত্ের দুটোই নির্দিষ্ট রূপে প্রতিভাত হয়; কেবল কখনো তা থাকে ‘আড়ালে, কখনো আসে প্রকাশ্যে’। পত্রপত্রিকায় এ ধরনের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে, বিভিন্ন গবেষণায়-সমীায়ও এমন তথ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মার্কসের মন্তব্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে। পুঁজি বইয়ের প্রথম খণ্ডে তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন :

প্রাচীনকালে শ্রেণী সংগ্রাম প্রধানত রূপ নেয় খাতক ও কর্জদাতার মধ্যে, রোমে প্লেবীয় খাতকদের নিঃশেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে। তাদের জায়গায় আসেন দাসেরা। মধ্যযুগে এ প্রতিযোগিতার পরিসমাপ্তি ঘটে সামন্ত খাতকদের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, যারা অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে সাথে রাজনৈতিক মতা হারান আর ওই অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে ছিল রাজনৈতিক মতা। এ দুটি পর্বে খাতক ও কর্জদাতার মধ্যকার মুদ্রা সম্পর্ক উল্লেখিত শ্রেণীগুলোর টিকে থাকার সার্বিক অর্থনৈতিক শর্তসমূহের মধ্যে গভীরে নিহিত বিরোধেরই প্রতিফলন ঘটায় কেবল।

খুদে কর্জের খাতকেরও তাই ঘটে : আরো ঋণে জড়িয়ে নিঃশেষ হওয়া; তাকে হারাতে হয় ঘরের চালার টিন, তৈজসপত্র, কর্জের টাকায় তৈরী মাছ-ধরার জাল বা নৌকা বা তাঁত, ইত্যাদি; তাকে হতে হয় গৃহত্যাগী-পলাতক, শিল্প এলাকায় গিয়ে মজুর বা শহরে গিয়ে রিকশাচালক। এ যেন বুড়ো জেলেকে নিয়ে লেখা হেমিংওয়ের অমর সৃষ্টির সেই সংলাপ : ধার করলে শেষমেষ ভি েকরতে হয়। কিন্তু, এখানেই কি থেমে যায়? না, থামে না। অভিসম্পাত, ঘৃণা দিয়ে শুরু হয়ে অনুচ্চারিত-মৌন প্রতিবাদ হয়ে তা কখনো কখনো যৌথ সোচ্চার প্রতিবাদে রূপ নেয়। এ ধরনের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়; বিভিন্ন গবেষণাপত্র-বইতেও উল্লেখিত হয়েছে। আত্মহত্যাও প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে সংঘাতের প্রতীক। এ প্রতীক প্রাথমিক, নিষ্ক্রিয়; কিন্তু তা সক্রিয়-সোচ্চার হওয়ার অন্যতম ও প্রাথমিক উপাদান হয়ে ওঠে। খুদে ঋণে জর্জরিত-উপায়ান্তরহীন-দেউলিয়া খাতকের আত্মহত্যার অনেক খবরও প্রকাশিত হয়, পত্রিকার পাতায়, গবেষণাপত্রে। কোনো কোনো গবেষণাপাত্রে এ ধরনের আত্মহত্যাকে সংশ্লিষ্ট কর্জদাতা সংগঠনের নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন : ‘ক’ আত্মহত্যা।

জামানত লাগে না?

খুদে কর্জের সংকীর্তনকারীরা বলেন : খুদে কর্জ নিতে জামানত লাগে না এবং এ বৈশিষ্ট্যটিই খুদে কর্জকে গরিবের কাছে ‘সহজলভ্য’ করেছে, সেই সাথে খুদে কর্জকে দিয়েছে ‘মাহাত্ম্য’।
সত্যিই কি ঘটনাটি তাই?
তথ্য বলছে অন্য কথা। খুদে কর্জ দেয়ার আগেই জামানত, কিয়দংশে হলেও এবং অধিকাংশ েত্ের কর্জ দেয়া অর্থের চেয়ে বেশি জামানতই রাখা হয়, নেয়া হয়। ইতিপূর্বেই এটা আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়াও আরেক প্রকার জামানত রয়েছে। তা হচ্ছে মানুষ জামানত; কতিপয়ের ঋণের জামানত থাকেন সংঘবদ্ধ বা গ্রুপবদ্ধ সকল খাতক। এ বিষয়টিও বিভিন্ন বইপত্রে আলোচিত হয়েছে। তাই এখানে বিস্তারিত উল্লেখের দরকার পড়ে না।
অমর শেকস্‌পীয়র মার্চেন্ট অব ভেনিসে সুদখোর মহাজনের যে চরিত্র এঁকেছিলেন, তাকে কি এখন ‘মার্জিত, বিবেচক, সংযত’ মনে হয় না? খুদে কর্জের কারবার দেখে কখনো কখনো কারো কারো কাছে তা মনে হতেই পারে। এবং তেমন মনে হলে তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না।
খুদে কর্জ পরিশোধে খাতকের ওপরে থাকে চাপ; একদিকে, কর্জদাতা সংগঠনের কর্মী এবং কখনো কখনো কর্মীবাহিনীর; অপর দিকে, খাতকের সাথে সংঘবদ্ধ অন্যদের। চাপ তৈরী করা হয় সমাজপতিদের মাধ্যমে ও স্থানীয় সরকার নেতাদের মাধ্যমে। চাপ তৈরী করা হয় মানসিকভাবে ও সামাজিকভাবে। এসব কথাও মূল ধারারই বইপত্রে উল্লেখিত হয়েছে। এ চাপই শত ভাগ বা প্রায় শত ভাগ কর্জ ফেরত নিশ্চিত করে এবং কর্জ ফেরতপ্রাপ্তির এ হারই মূল ধারার অর্থনীতির খুদে কর্জ সংকীর্তনকারীদের কণ্ঠে খুদে কর্জকে ‘গৌরবান্বিত’ ও কেজো রূপে হাজির করতে যুক্তি যোগায়। সেই সাথে আরো দু’টি কাজ করে। সেগুলো হচ্ছে : প্রচারের উপাদান, বিভ্রান্ত করার আচরণ যোগায়; এবং, লগ্নির জন্য পুঁজিকে প্রলুব্ধ করে। দুনিয়ার দিকে দিকে, আলবেনিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে (‘এ’ থেকে ‘জেড’) বা আমেরিকা থেকে সোমালিয়া (‘আ’ থেকে ‘স’) পর্যন্ত পুঁজি প্রলুব্ধ হয়েছে ও হচ্ছে খুদে কর্জে লগ্নি করতে।

নারীর মতায়নের দাবিটি কি সত্যি?

ুদে কর্জদাতা মহাজনরা ও তাদের পথ সমর্থনকারী তাত্ত্বিকজন-অর্থনীতিবিদরা খুঁজে পেয়েছেন যে, ুদে কর্জ নারীর মতায়ন ঘটায়। প্রকৃতপ েকি তা ঘটে?
এদের অন্যতম যুক্তি : নারীকে কর্জ দেয়া হয়; কর্জ দেয়ার েত্ের নারীকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়; কর্জের টাকা হাতে পেয়ে নারী উৎপাদনে নিয়োজিত হন, উপার্জন করেন, পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ও মতামত দেয়ার অংশ নেয়ায় নারীর সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
বাস্তব তথ্য কিন্তু বলে অন্যকথা। বিভিন্ন সমীা/ জরিপ/ গবেষণায় পাওয়া ফলাফল উপরোক্ত দাবিদারদের দাবি নাকচ করে দেয়। এসব ফলাফলের কয়েকটি সংেেপ নিচে দেয়া হলো:৮
১. নারীদের যে অর্থ কর্জ দেয়া হয়, তা ব্যবহার করেন বা বিনিয়োগ করেন পুরুষরা এবং ব্যবহারকারী বা বিনিয়োগকারী পুরুষরাই এ অর্থের ব্যবহার বা বিনিয়োগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন।
২. পুরুষরাই অর্থ সংগ্রহ করার জন্য নারীকে কর্জদাতা সংগঠনের সদস্য হতে অনুপ্রাণিত; অনেক েত্ের, বাধ্য করেন। বহু েত্ের পুরুষরাই অধিকতর অর্থ সংগ্রহে নারীকে কর্জদাতা একাধিক সংগঠনের সদস্য হতে বুদ্ধি দেন/ বাধ্য করেন।
৩. কর্জ এনে-দেয়া নারীর কর্জ-কিস্তি শোধের অর্থ নিয়মিত যোগান দেন অর্থ ব্যবহারকারী পুরুষরা।
৪. কর্জ আনতে গিয়ে নারীকে কর্জদাতা সংগঠনে ও গৃহে হেনস্তা/ অপমানের মুখোমুখি হতে হয়। অনেক েত্ের, পরিবারে, বসতিতে, কর্জদাতা সংগঠনের গঠন করা খুদে সংগঠন বা গ্রুপে কলহ, সহিংসতার শিকার হতে হয় নারীকে।
এ সংক্রান্ত বইপত্রে এ ধরনের আরো ফলাফলের আরো সুনির্দিষ্ট, আরো বিস্তারিত, আরো সূক্ষ্ম উল্লেখ অনেক রয়েছে। তাই এখানে এ বিষয়ক ফিরিস্তি বৃদ্ধি না করে কেবল মন্তব্য এইটুকু থাকবে যে, নারীর মতায়ন সংক্রান্ত দাবীটি ও প্রচারটি মিথ্যাকে সত্য বলে চালানোর প্রয়াস মাত্র, একটি দুষ্কর্মকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টার অংশ ভিন্ন অন্যকিছু নয়।

তাহলে নারীকে কেন কর্জদানে অগ্রাধিকার দেয়া হয়?

জামানতসহ কর্জকে জামানতবিহীন কর্জ হিসাবে বিশ্বাস করানো বা ধারণা জন্মানো, সুদসহ কর্জকে সুদহীন কর্জ হিসাবে বিশ্বাস করানো বা ধারণা জন্মানো, একটি গভীরতর ল্যে-উদ্দেশ্যে চালিত খুদে কর্জকে গরীব বাঁচানোর মহতি প্রয়াস হিসেবে বিশ্বাস করানো বা ধারণা জন্মানো, ইত্যাদি েত্ের খুদে কর্জের মহাজনরা যেমন চাতুর্য ও দতা দেখিয়েছেন, নারী ও খুদে কর্জের েত্েরও তেমনটি ঘটানো হয়েছে। খুদে কর্জ দেয়ার েত্ের নারীকে অগ্রাধিকার দেয়ার বা বিশেষ বিবেচনা দেখানোর কারণগুলোও বিভিন্ন সমীায়/গবেষণায়/বইতে৯ উল্লেখিত হয়েছে, যেগুলোর সারাংশের কিছুটা নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. পুরুষ খাতক সচরাচর ‘বেয়াড়া’, ‘উদ্ধত’, ‘তর্কপ্রবণ’, ‘কলহপ্রিয়’, যা কর্জ আদায়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং অনেক েত্ের সুদাসলে কর্জের অর্থ ফেরতপ্রাপ্তি অনিশ্চিত করে তোলে।
২. খাতকের এ ধরনের মনোভাব ও আচরণ অন্যান্যের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে খুদে কর্জের গোটা কাজটিকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।
৩. পুরুষ খাতক সহজেই ‘পলাতক’ হয়ে যেতে পারে, বহু েত্ের হয়েছেও।
৪. পুরুষ খাতককে অনেক েত্ের ধমক, হুমকি, রক্তচু দেখিয়ে ভীত, বশীভূত, অনুগত, বিশ্বস্ত খাতকে, অর্থাৎ, সুকুমার রায়ের ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না, করে নাকে ফোঁস্‌ ফাঁস্‌, মারো নাকো ঢুঁশ্‌ ঢাঁশ, নেই কোনো উৎপাত মার্কা খাতকে রূপান্তরিত করা সবসময় সহজসাধ্য নয়।
৫. নারী খাতকের েত্ের এগুলোর বিপরীতটি ঘটে; অর্থাৎ, নারী খাতক খুদে কর্জের মহাজনদের কাছে সহজসাধ্য, সহজপ্রাপ্য। আমাদের এ সমাজে নারীকে সহজেই আঘাত করা যায়, কাবু করা যায়, সহজেই নারীর সম্মানহানি করা যায়। কর্জের বোঝা খুব দুর্ভার হয়ে উঠলেও ঘর-সংসার-সন্তান ফেলে রাতের অন্ধকারে অন্যকোথাও গিয়ে ‘পলাতকা’ হওয়া নারীর জন্য একেবারেই বা প্রায়-একেবারেই অসম্ভব। তাই ‘অবলা’ নারীর ‘মতায়নে’ নেমেছেন খুদে কর্জের মহাজনরা এবং ‘অবলা’ নারীর কম জোর অবস্থান হয়ে উঠেছে খাতকদের ও সমাজের অন্যান্য অংশের সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করার সহজ মাধ্যম আর এই কদর্য রূপটি আড়াল করার জন্য গানের ধুয়ো ধরা হয়েছে ‘নারীর মতায়ন’; বহুজাতিক কোম্পানী যেমন মানব দেহের জন্য তিকর মলম বিক্রি করে রং ফর্সার ধুয়ো তুলে, তাতে যেমন সামিল করায় গণমাধ্যমের ‘অভিজাত’ বিবেচিত একাংশকে ও কতিপয় ব্যক্তিকে।

খাতকের ঘরে টিনের চালা আর বেশী পুষ্টি গ্রহণ

খুদে কর্জের সাফল্য দেখাতে গিয়ে এক ধরনের খবর পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তা হচ্ছে : খুদে কর্জের খাতকের বাড়িতে আগে ছিল ভাঙ্গা ঘর, এখন হয়েছে টিনের ঘর এবং এ ধরনের নানা নজির। খুদে কর্জের খাতকের সংখ্যা, খুদে কর্জ ব্যবসার এ যাবৎকাল পর্যন্ত সময়, ইত্যাদির সাথে তুলনা, আনুপাতিক হার, ইত্যাদি মিলিয়ে দেখলে যে কেউই বলবেন যে, এসব নজির হচ্ছে সার্বিক অবস্থাটি পেছনে সরিয়ে রেখে ব্যতিক্রমটিকে সামনে ঠেলে আনা এবং সার্বিকের স্থানে ব্যতিক্রমকে দাঁড় করানোর অর্থ একটাই হয় : প্রকৃতপ েসার্বিক অবস্থাটি মেনে নেয়া; অর্থাৎ, খুদে কর্জ সব খাতকের অবস্থা ফেরাতে পারে নি; দু-একজনের ফিরেছে।
সমাজ, অর্থনীতির নিয়ম জানলে একটি খানার বা পরিবারের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হওয়ার কারণ হিসেবে একটি বিষয় বা উপাদান, অর্থাৎ, খুদে কর্জকে দেখানো যে পুরোপুরি ভুল, তা বলার অপো থাকে না। কারণ, গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীা-নিরীা করা যায়, যদিও সেটাও সবেত্ের নিখাদভাবে সবসময় সম্ভব হয় না। এ ধরনের পরীার পরে একটি কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু, খোলা জায়গায়, বৃহত্তর সমাজ পরিধিতে একটি কারণ চিহ্নিত করা এবং বিচ্ছিন্ন, দুটি-একটি নমুনা দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় নির্বুদ্ধিতা-অমতা, নয়তো চালিয়াতি ধুরন্ধর মনোবৃত্তি ও মিথ্যাচারিতার প্রকাশ। কোনো একজন খাতকের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হওয়ার েত্ের কেবল খুদে কর্জের ভূমিকা ছিল, তা বলা এ কারণেই যায় না। ওই খাতকের েত্ের অন্যান্য উপাদানও কাজ করেছে বা করতে পারে। যেমন, পরিবারের গঠন; পরিবার সদস্যদের বয়স, স্বাস্থ্য, শিা, উদ্যোগ, মনোভাব, সুযোগ, গোত্রগত অবস্থান; সামাজিক সম্পর্ক; আর্থিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক; এলাকার মতা কাঠামো; বাজার ও বাজার পরিস্থিতি; যোগাযোগ ব্যবস্থা; ভৌগলিক অবস্থা; আবহাওয়া; আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি; এলাকার শিল্প-বাণিজ্যগত দিক; কর, শুল্ক, খাজনা কাঠামো; সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি; স্থানীয় সরকার; ইত্যাদি। এমনকি বিশ্ব বাণিজ্যের অবস্থা ও ধারা-উপ-ধারা; চোরাচালান-কালোবাজার পরিস্থিতিও বিবেচ্য। তাই, এ ধরনের কতিপয় নজিরকে খুদে কর্জের সাফল্য হিসাবে না দেখানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
উপস্থাপিত ঘটনা বা খাতকদেরকে নজির হিসেবে অতি সংপ্তিকালের জন্য এবং খণ্ডিতভাবে হলেও দেয়া যেতে পারতো, যদি উল্লেখিত খাতকের বা খাতকদের পরিপার্শ্বের, আনুষঙ্গিক অবস্থা এবং ওই গ্রামেরই বা ওই খাতকের সঙ্গী খাতকদের বিবরণ ও অবস্থা উল্লেখ করা হতো। তাই, উল্লেখিত নজিরগুলোকে যাদুকরদের হাত সাফাই খেলা ছাড়া কিচ্ছু বলা যায় না।
এছাড়া, একটি পদ্ধতি বা ব্যবস্থার কার্যকারিতা বা সাফল্য কয়েকটি ঘটনা দিয়ে বিচার বা মূল্যায়নের পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয়। পদ্ধতি বা ব্যবস্থাটিকে মূল্যায়ন করতে হয় সার্বিকভাবে। যদি দু-একটি টিনের চালা, রজনীগন্ধা ফুল বা হাঁস-মুরগী-গরু-ছাগল লালন-পালনের ফলে আয় বৃদ্ধির ঘটনাকে সাফল্য হিসাবে প্রচার করা হয়; তাহলে একই সাথে সহস্র সহস্র খাতকের দশক দশক ধরে একই অবস্থায় থাকা বা ক্রমবর্ধমান ঋণভারে জর্জরিত হওয়া কি পদ্ধতিটির ব্যর্থতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না? কল-কারখানায় মজুর হিসেবে অনেক দিন কাজ করেছেন, ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে’ কিছু টাকা পেয়েছেন, অনেক দিন ধরে রিকশা চালিয়েছেন, এমন বেশ কিছু মানুষকে পাওয়া যাবে, যারা গ্রামের বাড়িতে কিছু জায়গা-জমি কিনেছেন, টিনের ঘর তুলেছেন, সন্তানদের উচ্চশিার ব্যবস্থাও করেছেন। এর অর্থ এই নয় যে, ওই মানুষরা যে ব্যবস্থার জোয়াল কাঁধে নিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করেছেন, তাদের মেহনতের যে ফসল যে ব্যবস্থায় জমা হয়েছে ধনীর বা শিল্প মালিকের ঘরে, সেই ব্যবস্থাটি ভালো, কেজো, গ্রহণযোগ্য এবং সেই ব্যবস্থায় সকলের অবস্থা একদিন এমন হবে এবং উদ্বৃত্ত মেহনত চুরির ব্যবস্থাটি বহাল রাখতে হবে।
সর্বোপরি, এ েত্ের যে যুক্তিটি আসে, তা হচ্ছে, টিনের চালা উঠুক না উঠুক, শীতে চাদর জুটুক না জুটুক, পায়ে স্যান্ডেল পরুক না পরুক, খাতকের বা/ও খাতকের মাধ্যমে অন্যদের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করার ব্যাপারটিকে কোনো যুক্তিতে কি গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা দেয়া যায়? যদিও সম্মানের-শ্রদ্ধার-জ্ঞানচর্চার উঁচু আসনে বসে থাকা কেউ কেউ খুদে কর্জের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সে-েত্ের তাদের কথাবার্তাকে যদি খুদে কর্জের মারপ্যাঁচ বোঝা কেউ ধান্ধাবাজি বা মিথ্যাচার বা নিদেন প অরে্থনীতির ভারী বোলচালের আড়ালে মিথ্যার বেসাতি বলেন, তাতে ভুল হবে কি-না, সেটা পাঠকেরা ও খুদে কর্জের লাখ লাখ খাতকেরা বুঝবেন।
খুদে কর্জের মূল্যায়ন, ইত্যাদি বেশ কিছু প্রকাশনা পাওয়া যায়, যেগুলো বিশিষ্টজনদের। এসব প্রকাশনায় তারা বেশ হিসেব-কিতেব করে দেখিয়েছেন যে, খুদে কর্জের খাতকের ও তার ওপর নির্ভরশীলদের বা তার খানা-সদস্যদের ভোগ্যপণ্য ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ। এ ফলপ্রাপ্তি থেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত টেনেছেন, প্রত্য বা পরো সুরে, খুদে কর্জের প। এে েত্ের বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে কেবল কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করব মার্কসের পুঁজি বই থেকে :

পুঁজিপতি শোষণ করতে পারে, এমন বস্তু হিসেবে মজুরকে যেহেতু বাজারে সব সময় থাকতে হয়, তাই মজুরকে বেঁচে থাকতে হয়, সেজন্যই মজুরদেরকে ব্যক্তি হিসেবে খেতে-পরতে হয়। এ েত্ের খোদ এই ভোগটি পুঁজি কর্তৃক শ্রম-শক্তির উৎপাদনমূলক ভোগের একটি শর্ত হিসেবেই কেবল গণ্য হয়। (খণ্ড ২, অধ্যায় ১)
শ্রমজীবী শ্রেণীর ব্যক্তি-ভোগ হচ্ছে শোষণের উদ্দেশ্যে পুঁজির এখতিয়ারাধীন নতুন শ্রম-শক্তির জন্য শ্রম-শক্তির বিনিময়ে পুঁজির দেয়া প্রাণ ধারণের মাধ্যমে পুনঃ-রূপান্ত-র। এটা হচ্ছে সেই উৎপাদন মাধ্যমের উৎপাদন ও পুনঃউৎপাদন, যা পুঁজির কাছে অপরিহার্য, অর্থাৎ, খোদ মজুর। যন্ত্র চালু থাকুক বা থেমে থাকুক, যে অবস্থাতেই হোক, যন্ত্র পরিষ্কার করার কাজটি যেমন, সেভাবেই মজুরের ব্যক্তি-ভোগ, তা কাজের জায়গায় হোক বা তার বাইরে হোক, তা উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ হোক বা না হোক, পুঁজি উৎপাদন ও পুনঃউৎপাদনের একটি ফ্যাক্টর। পুঁজিপতিকে খুশি করার জন্য নয়। মজুর নিজের জন্যই প্রাণধারণের মাধ্যম ভোগ করেন। এ বাস্তবতার কারণে ওপরে উল্লেখিত বিষয়টির কোনো হেরফের হয় না।... শ্রমজীবী শ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখা পুঁজি পুনঃউৎপাদনের প্রয়োজনীয় শর্ত এবং পুঁজিকে তা করতেই হবে। (খণ্ড ১, অধ্যায় ২৩) [ বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের ]

খাতকদের ভোগ, অর্থাৎ, খাদ্য, বস্ত্র, ইত্যাদি গ্রহণ/ব্যবহার বৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে খুদে কর্জের যে সুফল তুলে ধরা হয়, নিশ্চয় তার রূপটি এবার স্পষ্ট হয়েছে। এ লেখাতেই ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, খুদে কর্জের খাতক খানাভিত্তিক, বিচ্ছিন্ন উৎপাদন বা সেবা ইউনিটের মজুরে রূপান্তরিত হন। তিনি এভাবে রূপান্তরিত হয়েই উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করেন বা অন্যত্র অন্যের তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ তাঁর কাছে আসে এবং তাঁর উদ্বৃত্ত মূল্য বা তাঁর কাছে-আসা উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ আত্মসাৎ করে খুদে কর্জদাতা। তাই, খাতক বেঁচে না থাকলে উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের পথই যে কেবল বন্ধ হবে, তাই নয়; লগ্নি-করা অর্থও বিপন্ন হবে। সে কারণে খাতকের ভোগবৃদ্ধি খুদে কর্জ পুঁজির অপরিহার্য শর্ত। গ্রাম থেকে সব হারিয়ে কেবল মেহনত নিয়ে কারখানার শেকলে বাধা মজুরের আয় ও ভোগও সব হারা, কর্মহীন, উন্মূল থাকাকালীন অবস্থার চেয়ে ভালো হয়, বৃদ্ধি পায়। তার মানে এই নয় যে, কারখানায় মজুরের উদ্বৃত্ত মেহনত আত্মসাৎ করার ব্যাপারটি ভালো।
জাস্টাস ভি লাইবিগের একটি লেখায় বলা হয়েছে : দণি আমেরিকার খনিগুলোতে এক সময় মজুরদের দৈনিক কাজ ছিল সাড়ে চার শ’ ফুট নিচ থেকে কাঁধে করে ১৮০ থেকে ২০০ পাউন্ড ওজনের ধাতব আকর একেকবারে খনির ওপরে বা ভূ-পৃষ্ঠে তুলে আনা। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজ। এরা বেঁচে থাকতেন কেবল রুটি আর সীম দানা খেয়ে। তবে, খাদ্য হিসেবে এই মজুরদের পছন্দ ছিল কেবল রুটি। কিন্তু, তাদের মালিকরা দেখেছিল যে, কেবল রুটি খেয়ে কোনো মানুষ এতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে পারবে না। মালিকরা মজুরদের ঘোড়ার তুল্য বিবেচনা করতো এবং মজুরদের বাধ্য করতো সীম দানা খেতে। কারণ, ফসফেট অব লাইম রুটির চেয়ে সীম দানায় তুলনামূলকভাবে বেশী। এটা খনি মজুরদের কাজের উপযুক্ত দেহরায় সহায়ক। এ বিষয়টি মার্কস পুঁজি বইয়ের ওপরে উল্লেখিত অধ্যায়ে পরিহাসের সাথে উল্লেখ করেছেন। আর এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, এটি হচ্ছে উৎপাদনমূলক ভোগ। মজুরের উৎপাদনমূলক ভোগের েত্ের মজুর কাজ করেন পুঁজির চালিকা শক্তি হিসেবে। অপরটি, ব্যক্তি-ভোগ, যা দিয়ে মজুর প্রাণ ধারণ করেন। আবার, তার ব্যক্তি-ভোগ সরাসরি উৎপাদনমূলক ভোগ (পুঁজি, পূর্বোক্ত অধ্যায়)। ফলে খাওয়া-পরা খাতে খরচ বেড়ে গেলেই আনন্দিত হওয়া এবং একটি ব্যবস্থার সুফল বা সাফল্য হিসেবে মনে করা নিছক নির্বুদ্ধিতা বা সত্যের অপলাপ বা মেহনতকারীকে ধোঁকা দেয়ার সামিল। এছাড়া, ‘... কোনো মানুষ যখন দিনে এক ডলারের সামান্য কম-বেশী অর্থ উপার্জন করে বেঁচে থাকার কিনারায় টিকে থাকেন, তখন দিনে আধা ডলার উপার্জন বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য উন্নতিই তুলে ধরে।’১০
অতঃপরও যদি টিনের চালা, গাঁদা ফুলের আবাদ করে স্বাবলম্বী হওয়া, একটু ভালো ও নিয়মিত খাওয়ার ঘটনাগুলো উল্লেখ করে খুদে কর্জের খাতকের অবস্থা ভালো হওয়ার উদাহরণ দিয়ে খুদে কর্জব্যবস্থার সুফল তুলে ধরা হয়; বলা হয় যে, গবেষণালব্ধ তথ্য, তাতে কোনো খুদে কর্জ খাতক ও এ বিষয়ে আগ্রহীরা আস্থা না রাখলে ‘অজ্ঞানতা-অবাধ্যতার’ জন্য তাঁদের দোষারোপ করা যাবে না। কারণ, কিছু মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হলেও বহু মানুষের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের পদ্ধতিটি রয়েই যায় এবং সে কারণেই অন্যের তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ নিন্দিত ও বর্জিত হতেই পারে।

বিপর্যয়, ফের নিচে পড়ে-যাওয়া

খুদে কর্জ বিষয়ক লেখালেখির একটি উল্লেখযোগ্য অংশে খাতকদের অবস্থা ভালো হওয়ার পরে আবার ‘দৈব-দুর্বিপাকে’ দারিদ্র্য রেখার নিচে তাদের পড়ে যাওয়া, তাদের আর্থিক বিপর্যয় ঘটার ফলে আবার আগের গরীব অবস্থায় ফিরে যাওয়া, ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। এটা খুদে কর্জবিষয়ক গবেষণার অন্যতম বিষয়। এগুলোকে ‘সেট ব্যাক’, ‘ড্রপ আউট’, ‘স্লাইডিং ডাউন’ ইত্যাদি নামে খুদে কর্জগবেষকরা অভিহিত করে থাকেন। এসব নিচে ফিরে যাওয়াদের হার নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়, হারের হিসেবে হেরফের দেখানো হয়।
নিচে ফের পড়ে-যাওয়ার হার নিয়ে তর্ক কেউ করতেই পারেন। তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় এ কারণে যে, ফের নিচে পড়ার হার কম বা খুব কম বা একেবারেই কম হলেই ত’ পদ্ধতিটি সঠিক বা ভালো বা যথার্থ বা কেজো প্রমাণিত হতো না। কারণ, অন্যের মেহনত চুরির বিষয়টি রয়েই যেতো।
এর পরেও যে প্রশ্নগুলো দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে : ১. ‘দৈব-দুর্বিপাকে’ একজন ধনী দারিদ্র্য রেখার নিচে পড়ে না কেন? ২. দারিদ্র্য রেখার ওপরে ওঠা বা ‘গ্রাজুয়েট’ হওয়া খাতক এক বানের টানে বা এক ঝড়ের ধাক্কায় বা এক মামলার প্যাঁচে বা এক অসুখের ছোবলে ফের ফিরে যেতে বাধ্য হন আগের গরিবী জায়গায় যে-ব্যবস্থায়, সে-ব্যবস্থাটিই ঠুনকো বা ‘নন্‌-সাসটেইনেবল’ নয় কি?
মাও সেতুঙ নেতৃত্বাধীন চীনে নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের অল্প ক’বছরের মাথায় একটি বিরাট রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বৈরিতার প্রোপটে জোর কদমে সামনে বাড়ো বা গ্রেট লীপ ফরোয়ার্ড উদ্যোগকালে কিছু কিছু বিপর্যয়কে ফেনিয়ে-ফুলিয়ে প্রচার করা হয়েছে। এ প্রচারে ভূমিকা ছিল অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী একজন বঙ্গসন্তান অর্থনীতিবিদেরও। এসব প্রচারের ও গবেষণা নামের কাজকর্ম দিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। অথচ, অনেক আগেই লেখা বিখ্যাত বই এ কার্টেন অব ইগনোরেন্স১১ এবং সামপ্রতিককালে লেখা একটি প্রবন্ধে১২ সেই প্রচার যে কতটা ভিত্তিহীন, অতিরঞ্জন ও বানোয়াট, এমনকি অংকের হিসাবে গরমিলে ভরা, তা দেখানো হয়েছে। অথচ, কয়েক দশক ধরে চলতে-থাকা যে-পদ্ধতি গুটি কয়েক খাতককে ‘গ্রাজুয়েট’ হওয়া অবস্থায় ‘দুর্যোগে-দুর্বিপাকে’র মুখে ধরে রাখতে পারে না, সে-পদ্ধতিটির অসারতা স্বীকার না করে গ্রাজুয়েশন-বাতিলদের আবার গ্রাজুয়েট করার সিঁড়ি সন্ধান করা হাস্যকর নয় কি? উত্তর হয়ত হবে : দুই পদ্ধতি, দেখার দুই চোখ, দুই মাপ, দুই স্বার্থ? দুই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী।

এ ভার দুর্বহ

রূপান্তর প্রক্রিয়ায় খুদে কর্জের খাতক বিভিন্ন রূপ নিয়ে মজুরী-দাস হয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করে তা থেকে বঞ্চিত হয়ে ঋণ-দাসে পরিণত হন আর রূপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের ঘাড়ে চাপে বেশ কিছু বোঝা, যা সচরাচর কারখানায় কর্মরত মজুরের ঘাড়ে বা খাতকের মতোই অন্যগরীবদের ঘাড়ে চাপে না। যেমন :
১. কর্জের টাকা নিয়ে খাতক যখন উৎপাদন যন্ত্র/সরঞ্জাম/উপকরণ কিনতে বাজারে যান, তখন সেসবের গুণাগুণ, সুবিধা-অসুবিধা, কার্যকারিতা, দতা, কর্ম ও উৎপাদন মতা, বাজার দর, ইত্যাদি তুলনামূলক বিচার করে কেনার দায়ভার খাতকের। কারণ, এসবের ওপর নির্ভর করবে তাঁর উৎপাদিত পণ্যের গুণাগুণ, বাজার দরপ্রাপ্তি এবং কর্জের কিস্তি পরিশোধের ‘সাফল্য’। কারখানার মজুরকে এ দায়িত্বটি নিতে হয় না। এ দায়িত্ব থাকে মালিকের।
২. উৎপাদন যন্ত্র/ সরঞ্জাম/ উপকরণ কিনে এসবের মালিক হয়ে এগুলো নিরাপদে, অত অবস্থায় নিজ খানাভিত্তিক উৎপাদনস্থলে পরিবহনের এবং এজন্য শুল্ক, খাজনা, টোল, ভাড়া, চাঁদা, ইত্যাদি মেটানোর দায়ভার খাতকের।
৩. এসবের মালিক হিসেবে এসব অত অবস্থায় নিরাপদ রাখা, সংরণ করা, এ জন্য ব্যবস্থা করার, এসবের রণাবেণ, মেরামত/ সারাই/ উপশম/ নিরসনের দায়ভারও খাতকের।
৪. কোনো দুর্ঘটনায় এসবের কোনো তি হলে তা পুনঃস্থাপন/ সংযোজন এবং এ জন্য খেসারত দেয়ার দায়ও খাতকের ঘাড়ে।
৫. খুদে কর্জে চালু খানাভিত্তিক উৎপাদন ইউনিটটিকে নিরাপদ, উৎপাদন-উপযোগী ও সচল রাখার দায়ভার খাতকের।
৬. স্বাধীন উৎপাদক হিসেবে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা, তা নিরাপদে, অত অবস্থায় মজুদ রাখার দায় ঘাতকের।
৭. উৎপাদিত পণ্য বিপণন, ক্রেতা আকৃষ্ট করার দায়ভার খাতকের।
৮. উৎপাদিত পণ্য নিরাপদে, অত অবস্থায় বাজারে পরিবহনের দায় খাতকের।
৯. বাজার বাছাই এবং বিপণনকাল নির্ধারণের দায়ভার বর্তায় খাতকের ওপর।
১০. পণ্য বিক্রির অর্থ নিরাপদ রাখার দায় খাতকের ওপর বর্তায়।
১১. খানাভিত্তিক উৎপাদক হিসাবে উৎপাদনের সময়, পালা, গতি, নিজেকে এবং/ বা অন্যকে উৎপাদন কাজে নিযুক্ত করার দায় খাতকের।
১২. খাতক হিসাবে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে কর্জ-কিস্তির অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করা, এজন্য উৎপাদন সময়, বিপণন সময়, কিস্তি পরিশোধ সময়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের দায় খাতকের।
১৩. খাতক হিসাবে কর্জ-কিস্তির অর্থ নিরাপদে কর্জদাতার কাছে পৌঁছানোর দায় খাতকের।
আপাতঃদৃষ্টে এসব দায়ভারকে অনুল্লেখ্য, ুদ্র বা ুদ্রাতিুদ্র, তাৎপর্যহীন মনে হলেও এসবের প্রতিটির সাথে জড়িয়ে আছে সময় ও মেহনত, এবং ঋণমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বা ঋণজালে জড়িয়ে পড়ার আশংকা। সময়, মেহনত ও অর্থের হিসাবে এ-সবের মোট পরিমাণ অনেক এবং খাতকদের মোট সংখ্যার হিসাবে তা আরো অনেক। এসব কাজের সাথে যুক্ত থাকেন খাতকের ওপর নির্ভরশীলরা, ঋণগ্রস্ত খানা বা খাতক খানার সদস্যরা, বয়স নির্বিশেষে। এঁদের সময় ও মেহনত যোগ করলে ওপরে উল্লেখিত আরো অনেক হয়ে ওঠে আরো আরো অনেক। এসবকে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় ও উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়ে ভাগ করে ফেললে কোন দিকের পাল্লা ভারী হবে? উত্তর : উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়। কোথায় তা জমা হয়? উত্তর : খাতককে যিনি বা যে সংগঠন কর্জ দিয়েছে, তার কাছে। গোটা গতিপথের সাথে লেগে থাকে খাতকের ঘাম; আর, চলতি চোখের আড়ালে থাকে খাতকের দীর্ঘশ্বাস, অশ্রু।
তাই, বলতে হয় : একই সাথে, উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির মালিক আর স্বাধীন উৎপাদকের ‘গৌরব’ তিলক কপালে এবং মজুরী-দাস ও ঋণ-দাসের শৃঙ্খল গলায়, এমন নমুনা পুঁজির পৃথিবীতে কম মেলে। খুদে কর্জ পুঁজি সে নমুনা পিছিয়ে থাকা দুর্বল মানুষের জীবনে দতার সাথে হাজির করেছে। অথচ, এই কমজোর মানুষদেরকেই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তির। কিন্তু, হিসাবের খাতা বলছে, সুকান্তের অনুকরণে, মেহনত খরচ তাতে। অথবা, পাঠকের হয়ত মনে পড়ে মার্টিন লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ভাষণ আই হ্যাভ এ ড্রিম-আমার স্বপ্ন-র সেই লাইন ক’টি :

আমরা এসেছি একটি চেক ভাঙ্গাতে। জীবন, মুক্তি ও সুখ অন্বেষণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার সকল মানুষের জন্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আজ কালো মানুষদের জন্য সেই প্রতিশ্রুতির খেলাপ হয়েছে। সেই পবিত্র প্রতিশ্রুতি রার বদলে ঘাটতি ঘটেছে ওইসব অধিকারের। কিন্তু ন্যায়বিচারের ভাণ্ডার দেউলিয়া, এ কথা বিশ্বাস করতে আমরা অস্বীকার করছি। ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দিন দেখা না দেয়া পর্যন্ত বিদ্রোহের ঘূর্ণি বাতাস আমাদের জাতির ভিত্‌ কাঁপিয়ে তুলতেই থাকবে। [ অত্যন্ত সংপ্তি অনুবাদ, বর্তমান লেখকের ]

এটা আছে, ওটা কোথায়?

খুদে কর্জ পুঁজির বীমা আছে; সে-বীমার প্রিমিয়াম খাতকরা দেন; খুদে কর্জ আদায়ের খরচও দেন খাতকরা; খুদে কর্জের জামানত আছে, সে-জামানত খাতকরাই দেন ও হোন; খুদে কর্জে খেলাপির কোনো ঘটনা ঘটলে খাতকরাই তা পূরণ করে দেন; গরীব হলেই খুদে কর্জ পাওয়া যায় না, খুদে কর্জ দেয়ার আগে সূক্ষ্ম বাছ-বিচার-যাচাই-বাছাই আছে। এসব কথা খুদে কর্জ সংক্রান্ত একাধিক বইপত্রে উল্লেখিত, স্বীকৃত, বিশ্লেষিত হয়েছে এবং সেসব বইপত্র খুদে কর্জের বিরোধীদের লেখা নয়। খুদে কর্জ প্রদানের েত্ের লাভালাভের নানান হিসেবপত্রও সেসব বইতে রয়েছে। খাতক যাতে খুদে কর্জ শোধ করেন, সে-উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নানা বিধি-বিধান-রীতি-কায়দা নেটওয়ার্ক বা জাল, ইত্যাদি রয়েছে।
যদি দারিদ্র্য থেকে দরিদ্র মানুষকে মুক্তির প্রশ্নই আসে, তাহলে গরীব মানুষটির স্বেচ্ছাসম্মতি, সম-সুযোগ, সম-মতপ্রকাশের কথাও ত’ আসে। এ বিবেচনায় খাতকের কি:
১. দরকষাকষির সুযোগ আছে? অর্থাৎ তিনি কি সুদের হার, ঋণের আয়তন, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা, ইত্যাদি বিষয়ে বার্গেন বা দরকষাকষি বা টানাটানি করতে পারেন?
২. খাতকের উৎপাদন উপকরণ, ইত্যাদির এবং উৎপাদনকালে খাতকের বা খাতক কর্তৃক নিয়োজিতদের বীমা খুদে কর্জ ব্যবস্থার মধ্যে আছে?
৩. খাতকদের উৎপাদনকালে য়তির কারণে রেয়াত/অবকাশের ব্যবস্থা আছে কি?
কল-মজুরদের দীর্ঘ অব্যাহত সংগ্রামের মুখে পুঁজিকে নিজ স্বার্থেই আপোস করতে হয়েছে শ্রমের সাথে, ছাড় দিতে হয়েছে; প্রণয়ন করতে হয়েছে শিশু শ্রম, নারী শ্রম, নারীর নৈশকালীন কাজ, কর্মঘণ্টা, ছুটি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন আইন। কিন্তু, খুদে কর্জ পুঁজি খানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় মজুরী দাসে রূপান্তরিত খাতকের জন্য এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা রাখে নি। বস্তুত, মজুরী দাসে রূপান্তরিত লাখ লাখ খাতকের সংগ্রাম খুদে কর্জ পুঁজি এখন পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে যেতে সম হয়েছে।
খাতকের অবস্থা কেমন হয়, তা দু-একটি উদাহরণ থেকে বুঝতে পারা যাবে। ধরা যাক, খাতক ‘ক বেগম’ খুদে কর্জের অর্থে মুড়ি বানিয়ে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির চেষ্টা করছেন। তিনি সন্তানসম্ভবা বা মাত্র ক’দিন আগে তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তিনি কি মাতৃত্বকালীন ছুটি বা এ সময় মুড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকলে কয়েক কর্জ কিস্তি পরিশোধে ছাড় পাবেন? অথবা ধরা যাক, খাতক ‘খ বানু’কে মঙ্গলবার বিকালে গ্রুপ সভায় কিস্তির অর্থ শোধ করতে হবে। তিনি মোয়া বানান। মঙ্গলবারে কিস্তির অর্থ শোধে তাঁকে রোববার বা সোমবারে কাছের একটি হাটে মোয়া বিক্রির জন্য স্বামী বা সন্তানের মাধ্যমে মোয়া পাঠাতে হবে। কিস্তির অর্থ শোধের অর্থ আসে, এমন পরিমাণ মোয়া বানানোর জন্য তাঁকে যদি শনিবার বা রোববার ১০/১২/১৪/১৬ ঘণ্টা বা অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়, যদি তার উৎপাদন কাজে হাত বাড়িয়ে দেয় তার ৮-৯ বছর বয়সী মেয়েটি, সে েত্ের কি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস বা নারীর নৈশকালীন কাজ বা শিশু শ্রমের বিধান প্রযোজ্য হবে? খুদে কর্জদাতারা, তাঁদের সমর্থক তাত্ত্বিক-অর্থনীতিবিদ-শ্রদ্ধেয়জনেরা নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের জবাব দেবেন বলে খাতকরা আশা করতে পারেন।
আরো প্রশ্ন আসতে পারে যে, কারখানা, ইত্যাদির জন্য ফ্যাক্টরী ইন্সপেক্টর আছেন, বয়লার ইন্সপেক্টর আছেন, শ্রম আদালত আছে। খুদে কর্জে চালিত খানাভিত্তিক উৎপাদন ইউনিটের এবং এসব ইউনিট সংশ্লিষ্ট খাতকসহ মানুষদের জন্য উপযুক্ত কি কি ব্যবস্থা রয়েছে? শত শত কোটি টাকার ঋণ খেলাপীর সুদ মওকুফ হয়; খুদে কর্জের খাতকের সুদ কি ‘দুর্যোগে-দুর্বিপাকে’ মওকুফ হয়? ‘দুর্যোগে-দুর্বিপাকে’ মানুষের দুরবস্থায় যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন, তাঁরাও কি দুর্গত খাতকদের এসব দুর্ভারের কথা তুলে ধরতে পারতেন না? ঋণে-ঋণে জর্জরিত, ‘গ্রাজুয়েট’ হতে ব্যর্থ খাতকদের কর্জ সালিশি ধরনের কোনো ব্যবস্থার কথা কি চিন্তা-ভাবনা করা যেতো না? তাহলে হয়ত কিছু খাতককে আত্মহত্যা করতে হতো না, পরিবার ফেলে রেখে পলাতক হতে হতো না। এমন অনেক প্রশ্নই খুদে কর্জের খাতকদের মনে মনে আছে, আজ সেসব হয় চুপিসারে আলোচনা করেন খাতকরা, আগামীকাল বা পরশু হয়ত এসব নিয়েই তাঁরা সোচ্চার হবেন। এতে কারো ‘উস্কানি’ দরকার হবে না; বিরোধের ধারাই তা করে দেবে।

খাতকের দেয়া সুদের প্রসঙ্গ

খুদে কর্জের প্রসঙ্গ উঠলেই সুদের প্রশ্ন ওঠে আর সুদের প্রশ্ন এলেই ওঠে সুদের হারের বিষয়টি। বিভিন্ন আলোচনা থেকে মনে হয় যে, খুদে কর্জের ব্যাপারে সবচেয়ে আগের অভিযোগ সুদের উচ্চ হার। এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার।
খুদে কর্জের সুদ, সুদের হার, সুদের উচ্চহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়া দরকার। এ বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াও দরকার। তবে এ বিষয়টিকে খুদে কর্জের সমালোচনার সর্বাগ্রগণ্য বা প্রধান বিষয় করলে খুদে কর্জের সমালোচনা কার্যতঃ দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। কারণ, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, খুদে কর্জের সুদের হার ২০ বা ২৬ বা ১৮ বা ১৬ না হয়ে ৬ বা ৪ বা ৩ হয় বা হয়ে যায়, তাহলে কি খুদে কর্জ গ্রহণযোগ্য হবে? সমাজ-অর্থনীতি-সভ্যতা-মানবতা-জনসাধারণের সমৃদ্ধির বিবেচনায় সেই স্বল্পহারের সুদসমেত খুদে কর্জও গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, সুদের হার যাই হোক, বেশী বা কম, খাতকের এবং খাতকের মাধ্যমে অন্যদের বাড়তি মেহনত আত্মসাৎ করার পদ্ধতিটি সে-েত্েরও বজায় থাকে। অন্যের বাড়তি মেহনতই কেবল নয়, অন্যের কোনো কিছু আত্মসাৎ করাই মানবতার স্বার্থে, মানুষের জন্য কল্যাণকর জীবনব্যবস্থার স্বার্থে অগ্রহণযোগ্য।
সুদের ব্যাপারটি স্পষ্ট হওয়াও দরকার। অন্যের মেহনত আত্মসাৎ করার বা ধনীদের স্বার্থরার তত্ত্বগত আলোচনায় সুদের হার নির্ধারণ নিয়েই কথা হয়; সুদের উৎস খোঁজার চেষ্টা করা হয় না। কিন্তু, সুদের উৎস খুঁজে বের করাটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সুদ যে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে প্রকাশ করে, সেটা চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একেবারে সংেেপ বলা যায়, কর্জ-সুদ হচ্ছে উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ। অন্যভাবে বলা যায়, কর্জের সুদ হচ্ছে উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি ধরন। সুদ গড় মুনাফারও অংশ মাত্র। তাই সুদের হার মুনাফার গড় হারের চেয়ে বেশী হতে পারে না। সুদের হার কর্জ পুঁজির সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে। পুঁজিবাদ বিকাশের সাথে সাথে সুদের হার ন্বিগামী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এর প্রথম কারণ, মুনাফার গড় হার পড়ার দিকে থাকে; দ্বিতীয় কারণ, কর্জ পুঁজির মোট পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। যতোটুকু দরকার, তার চেয়ে বেশী কর্জ পুঁজি পাওয়া যায়।১৩
তাই, খুদে কর্জের সুদ, সুদের হার ও সুদের উচ্চ হার নিয়ে আলোচনার আগে উল্লেখ করা উচিৎ সুদের উৎস, খুদে কর্জ যে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে, ইত্যাদি। তখন খাতকের অবস্থা, খাতক কিভাবে কর্জের কিস্তি শোধ করেন এবং শোধ করতে গিয়ে তার অবস্থা কেমন দাঁড়ায়, এসব স্পষ্ট হবে; স্পষ্ট হবে যে, বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, প্তি-বিপ্তিভাবে ছড়ানো দু-একজন খাতকের ব্যতিক্রমী নমুনা নয়, সার্বিক বিবেচনায় খাতকেরা হয়ে পড়েন খুদে কর্জের জালে আটকে-পড়া খুদে কর্জ ব্যবস্থারই একটি অংশ, যে-অংশটির কাজ খুদে কর্জদাতা কর্তৃক উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের শিকার হওয়া মাত্র। এই খাতকদের পুঞ্জিভূত সংখ্যা জানার আগ্রহ হতেই পারে পাঠকের। আগে উল্লেখিত সিডিএফ প্রকাশনা অনুসারে ২০০৪ সালে ৭২১টি খুদে লগ্নি সংগঠনের পুঞ্জিভূত খাতক সংখ্যা ছিল ১,৬২,৪৪,২৪২। এদের মেহনত কি পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করেছে? জানা যাবে কি কখনো?

খুদে কর্জের সামাজিকীকরণ

খুদে কর্জের সামাজিকীকরণ হয়েছে। কারণ : মেহনত চরিত্রগত দিক থেকে সবসময়ই সামাজিক। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সম্পর্কে আবদ্ধ না হয়ে মানুষের প েউৎপাদন করা সম্ভব নয়। এ কন্ট্রিবিউশন টু দি ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনোমি বইতে মার্কস লিখেছেন, যে মেহনতে বিশেষ প্রশিণ লাগে না, যা অদ মেহনত, যে কোনো গড়পড়তা ব্যক্তিকে যে কাজ শেখানো যায়, তা হচ্ছে সরল মেহনত। খুদে কর্জে পরিচালিত উৎপাদন ইউনিটগুলোতে আছে প্রধানত সরল মেহনত। তবে এই সরল মেহনত উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরী করে, এবং তা উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরীকারীর হাতছাড়া হয়ে যায়। খুদে কর্জে খানাভিত্তিক উৎপাদন ইউনিটে খাতক বস্তুত মজুরী-শ্রমিকে পরিণত হন। তিনি বস্তুত নিজের বাসায় বসে কাজ করেন কর্জদাতার জন্য। এটা করতে গিয়ে তাঁকে আবদ্ধ হতে হয় বিভিন্ন অর্থনৈতিক সম্পর্কে। কুটির শিল্পের কারিগর বস্তুত মজুরী-শ্রমিকে পরিণত হওয়ার বিষয়টি লেনিন রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ বইতে আলোচনা করেছেন। এর পাশাপাশি, এটাও উল্লেখ করা দরকার যে, ‘ব্যাংক, একদিকে, অর্থ-পুঁজির, কর্জদাতাদের কেন্দ্রীভবনের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং অপর দিকে, প্রতিনিধিত্ব করে খাতকদের কেন্দ্রীভবনের।’১৪ এসব দিক বিবেচনায় বলা যায় যে, খুদে কর্জের সামাজিকীকরণ ঘটেছে, যা সমাজে নানা সম্পর্কে ও দ্বন্দ্বে প্রতিভাত হবে। খুদে কর্জের প্রশ্নটি আলোচনাকালে খুদে কর্জ খাতকের পাশাপাশি খুদে কর্জের সামাজিকীকরণের বিষয়টি আলোচনা হওয়াও দরকার।
একই সাথে এটাও খেয়াল রাখা দরকার যে, খুদে কর্জ একটি প্রতিষ্ঠান, যা কার্যত ঋণ প্রতিষ্ঠানের অংশ। বিকশিত পণ্য সঞ্চালনের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঋণ। এ বিষয়টি লেনিন একাধিকবার আলোচনা করেছেন। খুদে কর্জের পুঁজি এসেছে ঋণ পুঁজি থেকে; ঋণ পুঁজি থেকে যতোটুকু এসেছে, তার চেয়ে অধিকতর কাজ করছে ঋণ পুঁজি হিসেবে। খুদে কর্জ পুঁজির খাতক পণ্য উৎপাদন করে তা বিক্রি করছেন বাজারে। এ েত্ের পণ্য উৎপাদনের পর্যায়টি রয়েছে ন্বি স্তরে। “যেখানে পণ্য উৎপাদনের বিকাশ হয়েছে সামান্য, সেখানে খুদে উৎপাদক তার তৈরী সামগ্রী স্থানীয় খুদে বাজারে, কখনো সরাসরি খদ্দেরের কাছে বিক্রি করার মধ্যে নিজেকে সীমিত রাখেন। এ হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের ন্বিতম পর্যায়।”১৫ খুদে কর্জকে প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করার সময় এ দিকটি খেয়াল রাখা দরকার। কারণ, এর সাথে খুদে কর্জের খাতক যুক্ত, জড়িত খুদে কর্জের খাতকের স্বার্থ।
খুদে কর্জের সামাজিকীকরণ বিস্তৃত ও গভীরতর হচ্ছে। দেশ-বিদেশের লগ্নি পুঁজি আসছে খুদে কর্জের খাতকের খোঁজে। দি টেলর সিস্টেম-এনস্লেভমেন্ট অব ম্যান বাই মেশিনারি প্রবন্ধে লেনিন লিখেছিলেন :

মুনাফা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মজুরকে আরো নিপীড়ন করতে কারখানার মধ্যে শ্রমকে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করে পুঁজি।

খুদে কর্জে নিয়োজিত পুঁজি, শেকস্‌পীয়রের ভাষায়, ‘গরীবের পর্ণকুটিরকে রাজপুত্রের প্রাসাদের’ (মার্চেন্ট অব ভেনিস) সাথে যুক্ত করেছে, খাতকদের এবং খাতকদের খানাগুলোর সদস্যদের জীবনপ্রবাহ খানাভিত্তিক উৎপাদন ইউনিটের মধ্যে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করছে, আত্মসাৎ করছে তাদের তৈরী এবং তাঁদের মাধ্যমে অন্যদের তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্য, আর ঋণ-জালে আটকে খাতকদের করছে ঋণ-দাস।

টীকা ও তথ্যসূত্র

১. খুদে কর্জ কেবল গরীবের জন্য, নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির মালিক খুদে চাষী, ইত্যাদির জন্য বলা হলেও খুদে কর্জদাতাদের নথিপত্রে, বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে, সমীায় দেখা গেছে ধনীরাও তা পায়। তাছাড়া, নামে খুদে কর্জ হলেও, কখনো কখনো তা বড় কর্জে রূপ নেয়। এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে ড. আমিনুর রহমানের উইম্যান অ্যান্ড মাইক্রোক্রেডিট ইন রুরাল বাংলাদেশ, এনথ্রোপোলোজিকাল স্টাডি অব দি রেটরিক এ্যান্ড রিয়ালিটিজ অব গ্রামীণ ব্যাংক লেন্ডিং-য়ে। ওয়েস্টভিউ প্রেস এটি প্রকাশ করেছে ১৯৯৯ সালে। বইটির ১৩৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে যে, জনৈক পুরুষ খাতককে কর্জ দেয়া হয়েছিল দেড় লাখ টাকা, পরিবহন ব্যবসার জন্য; এ খাতকের খানা যৌথ; খানার মালিকানায় ছিল প্রায় ১৫ একর আবাদি জমি, পাঁচটি পুকুর, যেখানে বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদিত হতো রেনু। এ বইয়ের পরিশিষ্টে উদ্বৃত্ত গ্রামীণ ব্যাংক বিধিমালায় উল্লেখিত হয়েছে : কর্জ দেয়া হবে ভূমিহীন, সম্পদহীনদের, এদের নিয়ে গঠন করা হবে ‘গ্রুপ, ০.৫ একরের কম জমির মালিক খানা যে কোনো সদস্য এ গ্রুপে যোগ দিতে পারবে, গ্রুপই হচ্ছে ঋণদানের প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো।
২. বাংলাদেশে খুদে কর্জ বাজারে লগ্নি করেছে, এমন সকল প্রতিষ্ঠান সিডিএফকে তথ্য প্রদান করে নি। সিডিএফকে তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প, কর্মসূচী খুদে কর্জ হিসাবে খাতককে ঋণ দিয়েছে। এসবের মোট সংখ্যা ৭২১-এর বেশী।
৩. এই আলোচনায় কেবল পণ্য উৎপাদন প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হয়েছে। এ পণ্যটি হতে পারে মুড়ি তৈরি বা পাটি বোনা বা কাঁথা সেলাই। রিকশা-ভ্যান চালনা, দোকান চালানো, হাঁস-মুরগী বা গরু-ছাগল পালন, ফুলের চাষ, জাল দিয়ে মাছ ধরা, পণ্য ফেরি করা, খুদে ব্যবসা, শাড়ি-লুঙ্গি বোনা, ইত্যাদি েত্েরও বিষয়টি এভাবে দেখা যেতে পারে এবং তাতে অবস্থা খাতকের আরো প্রতিকূলে যায়। যদি বাজার ও মওসুমের বিষয় বিবেচনা করা হয়, তাহলে খাতক আরো আরো প্রতিকূল ও অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েন এবং তার অর্থ দাঁড়ায় খাতকের ভোগান্তি কষ্ট বঞ্চনাবৃদ্ধি।
৪. এ বিষয়ে চমৎকার আলোচনা রয়েছে ডেভিড হিউম ও পল মসলের ফিন্যান্স এগেনস্ট পভার্টি বইয়ের ১ম খণ্ডে। রুটলেজ ১৯৯৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশ করে।
৫. ষোলো সিদ্ধান্তের ১ নম্বরে বলা হয়েছে : আমরা নিজেদের জীবনের সর্বস্তরে গ্রামীণ ব্যাংকের চারটি নীতি-শৃংখলা, ঐক্য, সাহস ও কঠোর মেহনত-মেনে চলবো [ বাংলা অনুবাদ ও গুরুত্ব আরোপ বর্তমান লেখকের ]। ১৫ নম্বরে বলা হয়েছে : কোনো [ ঋণ ] কেন্দ্রে শৃংখলা লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা জানতে পারলে আমরা সবাই সেখানে যাব এবং শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করব।
৬. প্রকাশনাটির উল্লেখিত পৃষ্ঠাগুলোতে ১৬ এবং ১৭ ও ১৮ নম্বর কলাম বা স্তম্ভ তিনটি দ্রষ্টব্য। ১৬ নম্বর স্তম্ভের শিরোনাম সঞ্চয়ের েত্ের প্রদত্ত সুদের হার। ১৭ ও ১৮ নম্বর স্তম্ভদ্বয়ের যৌথ শিরোনাম সার্ভিস চার্জ (%)। ১৭ নম্বর স্তম্ভের উপ-শিরোনাম ফ্যাট মেথড এবং ১৮ নম্বর স্তম্ভের উপ-শিরোনাম ডিকাইনিং মেথড। প্রকাশনাটির ২৩৫ পৃষ্ঠায় ফ্যাট মেথড ও ডিকাইনিং মেথড দুটির সংজ্ঞা উল্লেখিত আছে। প্রথমটিতে কর্জ নেয়া আসল কিস্তি মারফত ক্রমাগত কমতে থাকলেও সুদ হয় মোট আসলের ওপরে। অপরটিতে, সুদ হয় ক্রমে কমতে-থাকা আসলের ওপরে। উল্লেখিত ৮১ পৃষ্ঠাতেই দেখা গেছে সঞ্চয়ের ওপর দেয় সুদের হার যে েত্েরই ৫ এবং সে েত্েরই সার্ভিস চার্জ ফ্যাট মেথডে (ফ) ১৫ এবং ডিকাইনিং মেথডে ২৪। এভাবে ২ এবং ফ’তে ১৫ (পৃ ৯১); ০ এবং ফ’তে ১৫ (পৃ ৯৩)। সমগ্র বিষয়টির একটি পরিসংখ্যানগত উপস্থাপনা ও বিশ্লেষণ হতবাক করে দেয়। স্থানের কথা বিবেচনায় তা এখানে উল্লেখিত হলো না। এই ৭২১ বা ৭২০টি সংগঠন ছাড়া অন্যদের দিকে তাকালে আরো ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যাবে। সংবাদপত্রগুলোতে এ সংক্রান্ত অনেক খবর নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ও বিভিন্ন বস্তিতে প্রত্য অভিজ্ঞতা থেকে যে কেউ এটা জানতে পারেন।
৭. খাতকরা ক্রমাগত ও সবসময়ই এ ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। গরীবদের জীবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে কেউই জানেন যে, দুর্বল মানুষদের জীবনে দুর্ঘটনা খুব বেশী। কম জোর মানুষেরাই খুব সামান্য বিষয়ে মামলার ভোগান্তি পোহান, তাদেরই অসুখের সুচিকিৎসা হয় না, একটু ঝড়েই তারা আশ্রয়হীন হয়ে উদভ্রান্ত হন, এমন অনেক। কারণ, কমজোর, গরীব, দুর্বলদের গোটা জীবনই খুব নাজুক, খুব ভঙ্গুর, গোটা ব্যবস্থায় তার সহায় প্রায় নেই।
৮. এনী ম্যারি গোয়েটস্‌ এবং আর সেনগুপ্ত, হু টেকস্‌ ক্রেডিট? জেন্ডার, পাওয়ার এন্ড কন্ট্রোল ওভার লোন ইউজ ইন রুরাল ক্রেডিট প্রোগ্রামস ইন বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট, ২৪ (১), ১৯৯৬; হেলেন টড, উইম্যান এট দি সেন্টার : গ্রামীণ ব্যাংক বরোয়ার্স আফটার ওয়ান ডিকেড, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯৭; রুশিদান ইসলাম রহমান, ইমপ্যাক্ট অব দি গ্রামীণ ব্যাংক অন দি সিচুয়েশন অব পুওর রুরাল উইম্যান, বিআইডিএস, ঢাকা, ১৯৮৬; এস জনসন এবং বি রোজালে, ফিনাসিয়াল সার্ভিসেস এন্ড পোভার্টি রিডাকশন (খসড়া), অঙফাম ও একশন এইড, লন্ডন, ১৯৯৭; ড. আমিনুর রহমানের পূর্বোক্ত বই, ইত্যাদি।
৯. ড. আমিনুর রহমান এবং হেলেন টডের পূর্বোক্ত বই দুটি অন্যতম। এছাড়া অন্য কয়েকটি গবেষণাতেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে পিয়ের বোরডিউর ১৯৭৭ ও ১৯৯০ সালে যথাক্রমে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত আউটলাইন অভ এ থিওরি অব প্রাকটিস এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত দি লজিক অব প্রাকটিস বই দুটি।
১০. জো রেমেনয়ি, হয়ার ক্রেডিট ইজ ডিউ : ইনকাম জেনারেটিং প্রোগ্রামস ফর দি পুওর ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ, আইটি পাবলিকেশন, লন্ডন, ১৯৯১
১১. ফেলিঙ গ্রীন, এ কার্টেন অভ ইগনোরেন্স, ডাবলডে এ্যান্ড কোম্পানী, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৪
১২. জোসেফ বল লিখিত ও মান্থলি রিভিউতে প্রকাশিত এ প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ বাংলা মান্থলি রিভিউতে (মার্চ, ২০০৭ সংখ্যা) প্রকাশিত
১৩. পি আই নিকিতিন, দি ফান্ডামেন্টালস অব পলিটিক্যাল ইকোনোমি এবং এল আবালকিন, এস জারাসফ, এ কুলিকভ, পলিটিক্যাল ইকোনোমি। দুটি বইই মস্কো থেকে প্রগ্রেস পাবলিশার্স ১৯৮৩ সালে প্রকাশ করে। এর সাথে, এ লিওনথিয়েফের পলিটিক্যাল ইকোনোমিও দেখা যেতে পারে। এটা দিয়েই শুরু হতে পারে। তবে, মার্কসের পুঁজি বইটি এ েত্ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উপরোল্লিখিত প্রাথমিক বইগুলোর পরে হলেও তা দেখা উত্তম।
১৪. পুঁজি, খণ্ড ৩, পৃ ৪০২
১৫. লেনিন, রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ; (ইংরেজীতে)
এছাড়া উল্লেখিত অন্যান্য লেখা/ বই হচ্ছে : টমাস ডিকটার, এ সেকেন্ড লুক এট মাইক্রোফিন্যান্স, দি সিকোয়েন্স অব গ্রোথ এন্ড ক্রেডিট ইন ইকোনোমিক হিস্টরি, ক্যাটো ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র, ২০০৭; ডেভিড হিউম এবং পল মসলে, ফিন্যান্স এগেন্সট পোর্ভাটি, ১ম ও ২য় খণ্ড, রুটলেজ, লন্ডন, ১৯৯৬; সিডিএফ, মাইক্রোফিন্যান্স স্ট্যাটিসটিঙ, খণ্ড ১৭,২০০৪-এর ডিসেম্বর, প্রকাশকাল ২০০৫-এর আগস্ট; এ ফাগলেসাঙ এবং ডি চ্যান্ডলার, পার্টিসিপেশন এজ এ প্রসেস-প্রসেস এজ গ্রোথ, গ্রামীণ ট্রাস্ট, ঢাকা, ১৯৯৩।

Friday, October 23, 2009

পূণিমার চাঁদ যখন ঝলসানো রুটি

দারিদ্র্যের যত বিস্তৃতি, দারিদ্র্য ‘মোকাবেলা’র আয়োজনও এ পৃথিবীতে তত বিস্তৃত। কিন্তু ফল কিছু কি এসেছে ঘরে? আজ পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ, যারা দারিদ্র্যের মধ্যে দিন-রাত, সারাজীবন পার করেন, তারা এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তারা প্রশ্ন করতে পারেন, কেন এ দারিদ্র্য, এর উৎসই বা কী? তারা আরও প্রশ্ন করতে পারেন, দারিদ্র্যের কারণ দূর না করে বা উৎসের মুখটুকু না আটকে এত হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে দারিদ্র্য লাঘবের আয়োজন কেন? দারিদ্র্যের বাস্তবতা, গরিব মানুষের দুনিয়া আজ কেবল গরিব দেশগুলোতে, কেবল এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নয়। সবচেয়ে ‘সুখের দেশ’, ‘সবার স্বপ্নের’ দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রেও আজ গাদা-গাদা গরিব মানুষ। গরিব মানুষের পৰে লড়াই করে রাষ্ট্রৰমতা কায়েম হয়েছিল যে চীনে, গরিবি হটানোর স্বপ্নভরা সেই চীন দেশেও অগুনতি গরিব। সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছিল যে সোভিয়েত ভূমিতে, সেখানেও গরিব মানুষের সংখ্যার কমতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার অন ফ্যামিলি হোমলেসনেস নামের সংগঠন কিছু দিন আগে ‘আমেরিকান ইয়ং আউটকাস্টস্‌’ নামের প্রতিবেদনে জানায় : সে দেশে প্রতি ৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন আশ্রয়হীন। এ সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। ত্রিশের মহামন্দার পরে এ ক্ষেত্রে এত খারাপ অবস্থা আর দেখা যায়নি। এরা কেবল আশ্রয়হীন তাই নয়, এদের অনেকে অনাহারে থাকে, অনেকে অসুস্থ, অনেকে স্কুল ছেড়েছে। আজ আরও অনেক প্রতিবেদনে, খবরে যুক্তরাষ্ট্রে গরিব মানুষের খবর প্রকাশ হচ্ছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত’র জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সংখ্যায় এ বিষয়ে একটি লেখা ছাপা হয়েছে। এটা গেল ‘দুধ-মধুর নহর বয়ে যাওয়া’ ডালাস-টেলিফিল্মখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের গরিবি বাস্তবতা। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ১৯ জুন জানায় : বিশ্ব ক্ষুধা এ বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঐতিহাসিক পর্যায়ে পৌঁছবে, হররোজ ক্ষুধার্ত থাকবেন ১০২ কোটি মানুষ। অর্থাৎ, এ পৃথিবীতে প্রতি ছ’জন মানুষের মধ্যে একজনের দিন কাটবে অনাহারে। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৯১ কোটি ৫০ লাখ। উন্নত, সমৃদ্ধ মহাদেশ ইউরোপ আজ ধনী আর গরিব মানুষে এমনভাবে বিভক্ত যে, তা সে মহাদেশের রাষ্ট্রে নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বলা হচ্ছে, এক নতুন লৌহ যবনিকা টেনে দিয়েছে ধনী-নিধনে বিভেদ। এ বষয়ে এ বছরের মার্চ মাসে ইউরোপের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। কর্মসংস্থান, সামাজিক বিষয় ও সম-সুযোগবিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার ভ্লাদিমির স্পিদলা ইউরোপিয়ান ভয়েস ডটকম নামের ই-সাময়িকীতে লিখলেন : ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এদের কথা যেন কেউ না ভোলে। ইউরোপ-আমেরিকায় দারিদ্র্যের এ বাস্তবতা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় দারিদ্র্যের বাস্তবতার তুলনায় যৎসামান্য। আর দারিদ্র্য কেবল অনাহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আশ্রয়, লেখাপড়া, চিকিৎসা, কাপড় তো আছেই; নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি, সহজপ্রাপ্য-নিরাপদ জ্বালানি, মর্যাদা, ভীতি-আতংক-অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি ইত্যাদিও দারিদ্র্যের প্রশ্নটির সঙ্গে জড়িত। দারিদ্র্যের এসব দিক নিয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে। তাই এদিকগুলো এখানে উল্লেখের আর দরকার পড়ে না। আজ দারিদ্র্যের বিষয়টি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে কয়েকটি কারণে। বিশ্বজোড়া সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন তথা সার্বিক পরিবেশগত সংকট, মহাৰুধা হিসেবে অভিহিত বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও কৃষি সংকট, তেলসহ জ্বালানি সংকট বিশ্ব দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরও শোচনীয়। বিশ্বায়ন নামে একটি ‘বিষয়’কে আপামর সাধারণ মানুষের কাছে ‘নতুন কিছু’ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছিল কয়েক বছর ধরে। এটা করছিল মূল ধারা। বলা হচ্ছিল বিশ্বায়ন মহা সুখ-সমৃদ্ধি এনে দেবে। তাই ‘নতুন বিষয় বিশ্বায়ন’কে স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু তথ্য বলছে, বিশ্বায়ন মোটেই নতুন বিষয় নয়, তা একটি প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়াটি চলছে কয়েকশ’ বছর ধরে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সমাজবিজ্ঞানী পল সুইজি এ বিষয়ে অনেক আগে চমৎকার আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজি সীমান্ত অতিক্রম করার সময় থেকে বিশ্বায়ন চলছে। বিশ্ব পরিধিতে পুঁজি ছড়িয়ে পড়ার এ বিশ্বায়নও পরে উল্লেখ করা সংকটগুলোর সঙ্গে মিলে দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে করে তুলেছে অসহনীয়। বিশ্ব ব্যবস্থার মুরুব্বিরা সারা পৃথিবীতে চাপিয়ে দিয়েছে মুক্তবাজার নামে পুঁজির ‘যথেচ্ছ’ চলার সুযোগ। অবশ্য পুঁজি যথেচ্ছ বা মুক্তভাবে চলতে চাইলেও পারে না। কিন্তু যতটুকু পারে, তারই মধ্যে পুঁজি বাড়িয়ে তুলেছে মানুষের দুর্দশা-দুর্ভোগ। গরিব দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল কাঠামো বিন্যাস কর্মসূচি। চূড়ান্ত অর্থে এ কর্মসূচি গরিব দেশগুলোর গরিব মানুষের অবস্থা আরও খারাপ করা ছাড়া ভালো করেনি। কেবল গরিবরা নয়, মধ্যবিত্তরাও হয়েছেন এসব দুর্ভোগের শিকার। এসব বিষয় নিয়েও অনেক লেখালেখি হয়েছে। আজ মূল ধারাও এসব নিয়ে খুব একটা জোর গলায় আপত্তি করে না। আইএলও’র ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ক রিপোর্ট টু থাউজেন্ড এইট : ইনকাম ইনইকুয়ালিটিজ ইন দি ওয়েজ অব ফিন্যান্সিয়াল গ্লোবালাইজেশন শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘ইতিমধ্যেই অনেক দেশে এ ধারণা ব্যাপকভাবে তৈরি হয়েছে যে, বিশ্বায়ন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সুবিধার্থে কাজ করে না।’ এ প্রতিবেদনটিতে এবং আইএলও’র গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট টু থাউজেন্ড এইট/নাইন প্রতিবেদনটিতে আজ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা বেড়ে চলতে থাকা বৈষম্য, ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব-নিকাশ করে প্রতিবেদন দুটিতে বলা হয়েছে : বৈষম্য বেড়েছে, শ্রমজীবী মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বেড়েছে, মজুরদের জন্য সামনে আরও কঠিন সময় অপেৰা করছে। এ বাস্তবতা উন্নত হিসেবে গণ্য অনেক দেশে, কেবল গরিব দেশগুলোতেই নয়। নারীদের অবস্থা আরও দুর্ভার।
গরিবদের এসব অবস্থার বিবরণ আজকাল কম-বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আর গরিবদের গরিবি কমানোর জন্য আলোচনা-বিশ্লেষণ-গবেষণার তো কমতি নেই-ই। কম নেই গরিবি হটানোর উদ্যোগ-আয়োজনের। এসব উদ্যোগ-আয়োজনের বয়সও কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়। সেসব প্রশ্ন সহজ। তবে উত্তর যেমন জটিল, উত্তর পাওয়াও তেমনি কঠিন। সহজ সেসব প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে : (১) ‘ক’ কেন গরিব, ‘খ’ কেন গরিব নয়? (২) ‘খ’র অবস্থা দিন দিন ভালো থেকে খুব ভালো হয়, অথচ ‘ক’ যেন কেবলই খারাপ অবস্থা থেকে আরও খারাপ অবস্থায় ডুবে যায়? (৩) এত উদ্যোগ-আয়োজনও গরিবদের অবস্থা ভালো করতে পারে না কেন? (৪) গরিবির উৎসই বা কি? এমন প্রশ্নের সংখ্যা অনেক। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে : বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার, উপরোলিৱখিত সব সংকট, গরিব দেশগুলো থেকে সম্পদ ও মেধা পাচারের সঙ্গে কি দেশের মধ্যকার দারিদ্র্যের সম্পর্ক আছে? প্রশ্ন হতে পারে : অন্যের মেহনত আত্মসাৎ করা আর সম্পদ বণ্টনের সঙ্গে কি দারিদ্র্যের সম্পর্ক রয়েছে? দেখা যাবে, এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত, যেমন যুক্ত গণতন্ত্রের প্রশ্নের সঙ্গে দারিদ্র্যের প্রশ্ন। এভাবে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, দারিদ্র্যের প্রশ্নটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশ্নটি রাজনৈতিকও এবং দারিদ্র্যকে রাজনৈতিক দিক থেকে না দেখে কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখে এবং কতিপয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিলে গরিবরা কোনভাবে বেঁচে-বর্তে থাকবেন, কিন্তু দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবেন না। এমনকি ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান’ বলে কবিতা লেখা হলেও দারিদ্র্যের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সম্মানবোধ, মর্যাদাবোধের প্রশ্নটি পর্যন্ত দানাবাঁধবে না। অথচ মর্যাদাবোধ দারিদ্র্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে, সাহায্যের জন্য হাত না পেতে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে শেখায়। এ দুনিয়ায় এমন নজির অনেক।
দৈনিক যুগান্তর, উপসম্পাদকীয়, ১৮ই অক্টোবর, ২০০৯)

মুনাফা ছাড়া ব্যবসা কি সম্ভব

মুনাফা না করে ব্যবসা করার কথা শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, গরিবদের কল্যাণের জন্য মুনাফা করার দরকার নেই; তাই, ব্যবসা করা হোক, কিন্তু মুনাফা করা হবে না। প্রস্তাব বা পরিকল্পনাটি প্রশংসনীয়; যেহেতু এ প্রস্তাবে দরিদ্র-কল্যাণ-ভাবনা রয়েছে। তাই দেখা যাক, মুনাফা না করে ব্যবসা করা সম্ভব কিনা।

মুনাফা আসে বাড়তি মেহনত থেকে। অর্থাৎ একজন মানুষ যখন কাজ করেন, তখন তিনি যে মেহনত দেন, সে মেহনতের একাংশের দাম দেয়া হয় পারিশ্রমিক হিসেবে। অপর অংশের দাম দেয়া হয় না; সেটা নিয়ে নেন নিয়োগকারী। এ অংশটিই বাড়তি মেহনত। আর এই বাড়তি মেহনতই তৈরি করে মুনাফা। তাহলে, শিল্পে-ব্যবসায়ে মুনাফা না করতে হলে বাড়তি মেহনতটুকু নেয়া যাবে না। অর্থাৎ বাড়তি মেহনতের দামটুকুও দিয়ে দিতে হবে মেহনত যিনি করছেন, তাকে। এমন হলে মেহনতকারীর জন্য ভালোই হয়। কিন্তু সেভাবে কি হওয়া আদৌ সম্ভব?

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পে বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজি কি মুনাফা ছাড়বে? মুনাফাই যদি ছাড়বে তা হলে পুঁজি শিল্পে বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত কেন হল? পুঁজি বলতে যে ধারণাটি সহজে করা হয়, সেটি হচ্ছে বিনিয়োগের অর্থ বা উৎপাদনের জিনিসপত্র। প্রকৃতপক্ষে, পুঁজি তা নয়। পুঁজি হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত একটি সামাজিক-উৎপাদন সম্পুরক। এ সম্পর্কটি কি বাড়তি মেহনত নেবে না? সেটি হয় না। যদি পুঁজির এই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা গণ্য না করে আরও সহজভাবে বলা হয়, বিনিয়োগের জন্য অর্থ নিয়ে কোন বিনিয়োগকারী কি মুনাফা না নেয়ার শর্তে বিনিয়োগ করবেন? যদি কল্যাণ-ইচ্ছা থেকে এই বিনিয়োগকারী বা কয়েকজন বিনিয়োগকারী তা করেন, তাহলেও কি বিনিয়োগ করার মতো পুঁজির মালিকদের নিয়ে গঠিত একটি সামাজিক শ্রেণী তা করবে? সেটা করবে বলে কল্পনা করে নিলে এটাও কি কল্পনা করতে হবে না যে, তেমন পরিস্থিতিতে পুঁজির মালিক এই সামাজিক শ্রেণীটি বাঁচবে বা টিকবে কিভাবে?

মুনাফা যদি না করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ করা পুরো পুঁজির অনুপাতে মুনাফাকে শূন্যের স্তরে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ, মুনাফার হার হচ্ছে বিনিয়োগ করা পুরো পুঁজি ও মুনাফার অনুপাত। উদ্বৃত্ত মূল্যের হারের ওপরে মুনাফার হার নির্ভর করে। উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বেশি হলে মুনাফার হারও বেশি হবে। পুঁজি যত দ্রুত ফিরে আসে, মুনাফার হারও তত বেশি হয়। মুনাফার হার কমাতে হলে অস্থির পুঁজিও কমাতে হবে। মুনাফার পরিমাণ ও হার কমাতে হলে পুঁজি সঞ্চয় বন্ধ করতে হবে। পুঁজিপতি যদি মুনাফা না করার প্রস্তাবটি মেনে নেন, তাহলে তাকে উদ্বৃত্ত মূল্যহারকে নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়, পুঁজি ফিরে আসার হারকে নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়, পুঁজির গঠনকে পাল্টে দিতে হবে। সেটা কিভাবে করা যাবে? একজন পুঁজিপতি কি তা করবেন? যদি তিনি করেন, তাহলে তিনি বিনিয়োগ কেন করবেন? শিল্পে বা ব্যবসায়ে মুনাফা না করার প্রস্তাবকারীদের কাছে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। কিন্তু, অর্থনীতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এর যে উত্তর, তা হচ্ছে প্রস্তাবটি চমৎকার শোনালেও বাস-বে কার্যকর করা সম্ভব নয়।

মুনাফা আর পুঁজির এসব দিক যদি বিবেচনা কেউ না করতে চান, তিনি তা করতে পারেন, কিন্তু তাতে কাজ হবে না, কথাবার্তা বলা যাবে। তাই, এ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে দেখা যাক যেসব শিল্পে মুনাফা হার কম, সেখানে কি ঘটে। সেখান থেকে পুঁজি সরে যায়; সেখানে উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কমে যায়; চাহিদা অনুযায়ী জোগান থাকে না, তা কমে যায়; সে শিল্পের তৈরি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় এবং মুনাফা হার বেড়ে সে স্তরেই পৌঁছায়, যেটি সব শিল্পে মুনাফা হারের মোটামুটি সমান। অর্থাৎ গরিবদের সাহায্য করার জন্য কোন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী যদি মুনাফা না করার সিদ্ধান- নেন, তাহলেও সার্বিকভাবে সুবিধা তো হবেই না, বরং অসুবিধাই হবে।

মুনাফার গড় হারের যে নিয়ম, সেটি দেখলে মুনাফা না করার প্রস্তাবের অসারতা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে। গড় মুনাফা পুঁজিপতিদের মধ্যে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্য ভাগাভাগি করে দেয়। একজন পুঁজিপতির মুনাফা সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের কাছ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার ওপর কেবল নির্ভর করে না। একটি সমাজে যত মানুষ মেহনত বিক্রি করেন, তাদের কাছ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয় সেই সমাজে যত পুঁজি তার ওপরও নির্ভর করে। তাহলে মুনাফা কম করতে হলে বা মুনাফা না করতে হলে গোটা সমাজ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়া বন্ধ করতে হবে। মুনাফা না করার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি কি ভেবে দেখা হয়েছে? মুনাফা না করতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিককে যেমন অন্যের বাড়তি মেহনত নেয়া বন্ধ করতে হবে, সেভাবে ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজিকেও বাদ দিতে হবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত পুঁজির নেয়া বাড়তি মেহনতে ব্যবসা পুঁজির ভাগ, সুদে কর্জ দেয়ায় নিয়োজিত পুঁজিকে ভুলে যেতে হবে, সুদের মধ্যে থাকা অন্যের বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার কাজটি। সব পুঁজি মালিকের মুনাফা একটি সমাজে তৈরি করা মোট বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার সঙ্গে যুক্ত। ফলে, মুনাফা না করার প্রস্তাবে সব পুঁজি মালিককে সায় দিতে হবে। তা হবে কি?

মুনাফার হারের সঙ্গে আরও কয়েকটি দিক যুক্ত। মুনাফা হার কমতে থাকলে গোটা পুঁজির শিবিরে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। পুঁজির বিভিন্ন অংশের মধ্যে যখন প্রতিযোগিতা হয়, তখন মুনাফার গড় হারের নিয়মিত প্রযোজ্য হয়। আগেই এটি উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কয়েকজন পুঁজি মালিক মুনাফা না করার ধারণাটি গ্রহণ করেন এবং অন্যরা তা গ্রহণ না করেন, সে ক্ষেত্রে অবস্থাটি কি দাঁড়াবে? এর উত্তর : গড় মুনাফা বিধি। তা নয় কি? সে ক্ষেত্রে মেহনত বিক্রি করে যে গরিবরা, তাদের অবস্থার কি হেরফের হবে? মুনাফা হার হ্রাস পাওয়া মোট মুনাফা হ্রাস পাওয়াকে বোঝায় না। মোট মুনাফা বাড়তে থাকে, পুঁজি বাড়তে থাকে। কারণ, মেহনত বিক্রি করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়াও বাড়তে থাকে। ফলে একটি শিল্পে বা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মুনাফা না করা বা কম করার ওপরে গরিবদের অবস্থার কিছুই নির্ভর করে না। মুনাফা না করার বা কম করার প্রস্তাব যারা করছেন, তারা তো নিশ্চয়ই জানেন, পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পুঁজিপতিদের কোথায় নিয়ে যায়। প্রস্তাবকরা চাইলেও পুঁজিপতিরা কি অন্তর্দ্বন্দ্ব বা অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি চাইবেন?

এসব কারণে ভেবে দেখা দরকার, মুনাফা না করা বা মুনাফা কম করার প্রস্তাবটি চমৎকার শোনালেও বাস-বে সম্ভব কিনা এবং প্রস্তাবটি গরিব বা পুঁজির মালিক, কোন পক্ষের জন্যই কল্যাণকর কিনা। ভুল ধারণা বা ভাবনা প্রচার করলে তা সমাজে বিভ্রান্তিতো বৃদ্ধি করেই, সেই সঙ্গে বিশৃংখলাও তৈরি করে। আর, বিশৃংখলা গরিব বা পুঁজি মালিক, কারও জন্যই সুবিধাজনক নয়। বরং এ ধরনের ভুল ভাবনা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, পুঁজিকে মুনাফা করতে তো হবেই, সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে যথাসম্ভব সর্বাধিক মুনাফা করার জন্য, সবসময় পুঁজি বৃদ্ধি করার জন্য। মুনাফা না করলে পুঁজি বাড়তে পারবে না। আর মুনাফা আসে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়া থেকে। যদি ধরে নেই, মুনাফা না করার ভাবনা পুঁজি গ্রহণ করল, সে ক্ষেত্রে পুঁজি বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে কি পুঁজির? পুঁজি বৃদ্ধি না পেলে নতুন বিনিয়োগ হবে কি? সেক্ষেত্রে কেবল আমাদের মতো দেশ নয়, উন্নত দেশে অবস্থাটি কেমন দাঁড়াবে। সেজন্যই, যে ভাবনা কোন একটি সমাজের অর্থনীতির জন্য সুবিধা বয়ে আনে না, সেই ভাবনা কি প্রচার করা উচতি?

(লেখাটি দৈনিক যুগান্তর হতে সংগৃহীত)