Thursday, October 27, 2011

কঙ্গোর সংঘাত ও লুটের মাল কোলটান (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৭)

কঙ্গোতে লুটের ‘কাহিনী’ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয় : সেখানে সংঘাতের ধরনটি লোভনীয়। এ কারণে এ সংঘাত বিবদমান সব পক্ষের জন্যই লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। শত্রুরা, বৈরী পক্ষগুলো ব্যবসায়ের শরিক, খনিতে মজুর হিসেবে কাজ করতে হয় বন্দিদের। শত্রুরা একই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অস্ত্র পায়, অস্ত্র বেচাকেনার মধ্যস্থতাকারীরাও একই। ব্যবসা আড়াল করে ফেলেছে নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে। এ ব্যবসা-উদ্যোগে লোকসান হয় কেবল কঙ্গোর জনগণের।

ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সব পাঠকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে কঙ্গোয় লুটের সত্য। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের উপসংহারে আরো নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে : এ সংঘাতের ধরন লোভনীয়। তাই বিভিন্ন দেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডারদেরও এ সংঘাত দরকার। এর ফলে সম্পদ নাগালের মধ্যে আসে, এ কমান্ডাররা উপলব্ধি করেছেন যে, যুদ্ধ নিজেই নিজেকে চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই এ যুদ্ধ অপরাধীদের জাল তৈরি করেছে।

এতে বলা হয় : দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতারা কঙ্গোয় অবস্থানরত সেনাবাহিনীগুলোর সরকারগুলোকে বিভ্রান্তিকর ইঙ্গিত দিয়েছে। এসব উপসংহার স্পষ্টভাবে বলে দেয় কঙ্গোর সম্পদ লুটের সঙ্গে সংঘাতের সম্পর্ক, স্পষ্টভাবে বলে দেয় সম্পদ লুটের সঙ্গে কোন কোন পক্ষ জড়িত। এবং এ মন্তব্য পর্যবেক্ষণ করেন কোনো দলীয় বা কোনো দেশের পক্ষ অনুযায়ী দেশ নয়, তা করেন জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডার মধ্য দিয়ে কঙ্গোর খনিজ সামগ্রী আমদানি করে বিভিন্ন দেশের কোম্পানি। রুয়ান্ডার রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাওয়া আংশিক তথ্য থেকে দেখা যায় এসব কোম্পানি হচ্ছে নিম্নোক্ত দেশগুলোর : বেলজিয়াম, জার্মানি, রুয়ান্ডা, মালয়েশিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে অাঁতাত রয়েছে সরকারের সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের। এতে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাংকের, মন্ত্রণালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়। দেখা যায় যে, লুটের কাজে ব্যবহারের জন্য কোনো কোনো দেশ জাল মার্কিন ডলার ছাপে। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে রাজনৈতিক বৈধতা যোগায় কোনো কোনো উন্নত দেশ। এতে বিশ্বব্যাংকের নাম উল্লেখ করে ১৮৮ নম্বর প্যারাতে যা বলা হয় তার সারকথা দাঁড়ায় এটাই যে, এ লুটের কথা বিশ্বব্যাংক জানে, বিশ্বব্যাংক জানে এ লুট উগান্ডার ও রুয়ান্ডার অর্থনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ছিল নীরব।

মজার ব্যাপার হচ্ছে লুটের অর্থের বিপুল অংশ ব্যয় হয় অস্ত্র কেনায় এবং অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে লুটের কাজ দ্রুততর করা হয়। এ বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়। লুট থেকে পাওয়া অর্থের শেষ গন্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই গন্তব্য অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও অস্ত্র কোন কোন পন্থায় আসে? প্রতিবেদনে বলা হয় : এটা চলে তিনভাবে। এগুলো হলো : এক. সরাসরি অর্থ দিয়ে কেনা হয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম; দুই. বিনিময়; অর্থাৎ খনিজ সামগ্রীর বিনিময়ে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়; এবং তিন. যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।

জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা এটাও দেখেন যে, সংঘাতে জড়িত দেশগুলোর সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ, প্রকৃত খরচ তার চেয়ে বেশি। কিভাবে আসে এ অর্থ? উত্তর সহজ : লুট।

প্রতিবেদনটির আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে কঙ্গোর এ সংঘাতে লুটে জড়িত কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা। এ ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক নেতা নন; কিন্তু ঘটনার নায়ক বা নায়িকা। এদের একটি তালিকা পেশ করে প্রতিবেদনে বলা হয় : এ তালিকা পরিপূর্ণ নয়। লুটে ও সংঘাতে এ নায়ক-নায়িকাবৃন্দ সরাসরি জড়িত। এদের নাম মেজর জেনারেল সলিম সালেহ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস কাজিনি, কর্নেল টিকামানিয়ার, কর্নেল উতাফায়ার, জনাব খলিল, জনাব আবদুর রহমান এবং এমন আরো।

প্রতিবেদনে এদের কান্ডকারখানার কম-বেশি উল্লেখ করা হয়। মেজর জেনারেল সালেহ ও তার স্ত্রী কহোয়া উগান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বেআইনিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের মূল চরিত্র। সালেহ উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির ছোট ভাই বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তার ডান হাত ব্রি জে কাজিনি। তিনি রক্ষা করেন নিয়মবিসি ও তিবাসিমাকে। আর এ দু’জন রক্ষা করেন তার বাণিজ্য। সে বাণিজ্য হীরা, কাঠ, কফি, সোনার।

এভাবে একের পর এক বিবরণ পড়লে পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, তা রহস্য উপন্যাসকে যেন ম্লান করে দিচ্ছে।

এ প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে এক নারীর নাম। তিনি যেন নায়িকা। তিনি আজিজা কুলসুম গুলাম আলি। (বাংলায় আমরা হয়তো লিখতাম ‘গোলাম আলি’)। মিসেস গুলাম আলির কয়েকটি পাসপোর্ট। তিনি থাকেন কখনো বুকাভুতে, কখনো ব্রাসেলসে, কখনো বা নাইজেরিয়াতে। ব্যাপারটি নির্ভর করে তার কাজের ওপরে। এ মিসেস ইতিপূর্বে বুরুন্ডিতে গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বুরুন্ডিতে একদল ‘বিদ্রোহী’কে অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়েছিলেন। এর পরে, তিনি নতুন জোট গড়ে তোলেন রুয়ান্ডার সরকারের সঙ্গে, হয়ে ওঠেন কিগালি সরকারের বড় মিত্র। মিসেস গুলাম আলি রুয়ান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সোনা, কোলটান ও ক্যাসিটেরাইট ব্যবসায়ে জড়ান। এর আগে তিনি জড়িয়ে ছিলেন বুরুন্ডির হটুদের সুবিধার্তে অস্ত্র, সোনা ও গজদন্ড চোরাকারবারে। সিগারেট চোরাচালানেও তার নাম শোনা যায়। বেআইনি ব্যবসাকে তিনি আড়াল করতেন তার সিগারেট ফ্যাক্টরি দিয়ে। সে কারখানা আজ লাটে উঠেছে। কোলটান ব্যবসায়ে তার খদ্দেরদের মধ্য রয়েছে স্টার্ক, কোগেকম, সোগেম। বড় দুটি ব্যাংক তার আর্থিক লেনদেনের কিছুটা সামাল দেয়। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা কয়েকবার অনুরোধ জানালেও বেগম গুলাম আলি তাদের সঙ্গে দেখা দেখা করেননি। এ প্রতিবেদন রচনাকালে কোলটান রফতানি ব্যবসায়ের একচেটিয়া আয়োজনের প্রধান হয়ে ওঠেন তিনি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জাল নোটও তৈরি করেন। তিনি শুল্ক সংক্রান্ত কাগজপত্র জাল করেন। তিনি বলেছেন, ‘এ ব্যবসায়ে সবাই এটা করে।’ বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন কোলটান রফতানির কোম্পানিগুলোর মধ্যে জুয়াচুরি ব্যাপক।

এসব কর্মে এক শ্রেণীর ব্যাংকও যুক্ত। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে এদের নাম ও কাজের বিশদ বিবরণ রয়েছে। এতে জড়িত এক শ্রেণীর বিশাল কোম্পানি। এগুলো সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। এ লুটের কাজ সহজ করতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রশাসনিক কাঠামোও সাজানো হয় উপযুক্তভাবে। কখনো ভিন দেশের প্রশাসনিক প্রধানপদে আসীন করা হয় কঙ্গোর লোককে। তার কাজ হবে স্বদেশে লুটের কাজ সংগঠিত করা।

আর শ্রম? সে তো বিশ্বজনীন। শৃঙ্খলিত শ্রমকে নিয়োগ করা হয় পৃথবীর গভীর থেকে সম্পদ তুলে আনতে। শিশু শ্রমও রেহাই পায় না। লুট কতটুকু, কেমন পরিমাণ হয়? জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনেই উত্তর খোঁজা যাক। প্রতিবেদন বলেছে : ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৯৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশী সেনা দলগুলোর দখল করা কঙ্গোর এলাকাগুলো থেকে খনিজ সম্পদ, কৃষিজ ও বনজ সামগ্রী, গবাদিপশু লুটে নিঃশেষ করা হয়েছে; যাকে ইংরেজিতে অভিহিত করা হয়েছে ড্রেইনড অফ। বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা যে দেশই হোক, লুটের ধরন এক। একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য আসে খামার, গুদামে, কারখানায়, ব্যাংকে, তারা আদেশ দেয় দরোজা খুলে দিতে। সেনারা লুটের মাল তোলে গাড়ির পর গাড়িতে। লুটের মাল নিয়ে গাড়ির বহর চলে যায়। কঙ্গোর একটি অঞ্চলে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৯ সালে এপ্রিলের মধ্য ২০০০-৩০০০ টন ক্যাসিটেরাইট ও ১০০০-১৫০০ টন কোলটান লুটে নেওয়া হয়। সৈন্যদের পাহারায় বস্তা বস্তা অর্থ নেওয়া হয়।

দেখা যাচ্ছে, লুটের অাঁতাত অনেক বিস্তৃত, ব্যক্তি মালিক থেকে রাষ্ট্র, ‘বিদ্রোহী’ থেকে ব্যবসায়ী, সেনানায়ক থেকে অস্ত্র নির্মাতা, সবাই আছে এ কাজে মিলেমিশে। এরাই কি সব? এদের আড়ালে কি কেউ নেই। কোন সে সুতো, যা এদের সবাইকে বেঁধে রাখে এক সঙ্গে? সে কি ধনলিপ্সা, লোভ? সে কি ‘আরো আরো চাই, যত পাই, তত চাই?’ স্থানাভাবে সবের বিবরণে না গিয়ে কেবল কোলটানে কান্ডটাই দেখা যাক। এন্টয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ম্যারিজ ২০০২ সালে রাইজ অ্যান্ড ডিক্লাইন অব দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম বিষয়ে সম্মেলনে পেশ করেন প্লান্ডার, ক্রিমিনালাইজেশন অব দ্য স্টেট অ্যান্ড ডিক্লাইন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম : দ্য কেস অব ডি আর কঙ্গো শিরোনামে প্রবন্ধ। এতে তিনি ছক কেটে দেখান যে, খনি আর নদীর বুক থেকে মজুররা তুলে আনেন কোলটান। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সামরিক চক্রের হাত ঘুরে তা পেঁŠছায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এবং সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর হাতে। সেগুলো পেঁŠছে দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে। সেখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানার ভেতর দিয়ে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো নাম নিয়ে তা হাজির হয় সূক্ষ্ম প্রযুক্তির শিল্পে। এ সামগ্রী প্রক্রিয়ার কারখানা জগতে রয়েছে গোটা বিশেক কাজাখস্তানে, যুক্তরাষ্ট্রে, জার্মানিতে, চীনে, জাপানে। এগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি কারখানা বানাতে পারে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো। সে চারটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, জাপানে, জার্মানিতে, চীনে। আর সূক্ষ্ম প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলকাটেল কমপ্যাক, ডেল, এরিকসন, এইচপি, আইবিএম, নকিয়া, সিমেন্স, লুসেন্ট, মটোরোলা। বড় চেনা নাম এগুলো। এই চেনা নামের কোম্পানি সব কোটি কোটি খদ্দেরের কাছে পেঁŠছে দেয় মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গেম বা খেলার ডিজিটাল সামগ্রী।

এসবের মাঝে থাকে পরিবহন, ব্যাংক, রাজনীতি, বিধি, শুল্ক, বিশ্ব শক্তি। ডেনা মন্টেগু ২০০২ সালে স্টোলেন গুডস : কোলটান অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন দ্য ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : রোয়ান্ডা ও উগান্ডাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।

এসবে আরো মিশে থাকে : রক্ত। আরো থাকে : মেহনত, মজুরদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে নেওয়া মেহনত। আর সব শেষে থাকে মুনাফা। কতিপয়ের পকেটে, অ্যাকাউন্টে। সে কতিপয় প্রমোদতরীতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ থেকে দ্বীপে, ক্যারিবিয়ানের সূর্যাস্ত রং মেখে দেয় তাদের চোখে। কোলটানের রক্তাক্ত, নিষ্ঠুর, ‘সুন্দর’ যাত্রা!

কোলটান থেকে কে কত পায়? এ হিসাব করা প্রায় ধাঁধার উত্তর খোঁজার মতো। কারণ, তথ্যগত বিভ্রান্তি বেশি। একজন গবেষক এ সংক্রান্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে অনুমান করেছেন যে, স্থানীয় বেপারী ১০ ডলার পেলে রুয়ান্ডার ব্যবসায়ী পায় ২০০ ডলার, আর পাঁচ-ছয়জন খনিমজুরের একেকটি গ্রুপ পায় সপ্তাহে ৩০ ডলার। অর্থাৎ দিনে একজন পায় ১ ডলারের কম। আহরণের পরে ৩০ কিলোগ্রাম সামগ্রী বস্তায় ভরে হেঁটে হেঁটে তা নেওয়া হয় স্থানীয় ব্যবসায় কেন্দ্রে, গড়ে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে। সোনা, হীরা লুটের ঘটনা আরো নিষ্ঠুর। তবে লুটের ধরন একই। সে বিষয়ে আর আলোকপাত না করে আগামীতে দেখা যাবে আরো লোভনীয় ক্ষেত্রে কেমন ঘটনা ঘটে চলেছে।

Friday, October 21, 2011

যুদ্ধে জড়িত কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি

মবুতুর পরে ক্ষমতায় বসানো হলো লরেন্ট কাবিলাকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ অনুগত মিত্র। কাবিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে, ১৯৯৭ সালে একজন প্রতিনিধি পাঠালেন কানাডার টরেন্টোতে। উদ্দেশ্য : বিনিয়োগ সুযোগ নিয়ে খনি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা। কাবিলার বাহিনী গোমা দখলের পর পরই, ১৯৯৭ সালে, আমেরিকান মিন্যারাল ফিল্ডস (এএমএফ) নামের কোম্পানি কাবিলার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের চুক্তি করে। এ এলাকায় দস্তা, তামা ও কোবাল্ট খনিগুলো থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয় এএমএফকে। এ কোম্পানির প্রধান ছিলেন মাইক ম্যাকমরো। মাইক আবার যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বন্ধু। আর এ চুক্তি সম্পাদনে কাবিলার পক্ষে আলোচনা করেছিলেন কঙ্গোর যে লোকটি, তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে আগেই উল্লেখ করা ‘এ গেম এজ ওল্ড এজ অ্যাম্পায়ার’ বইতে।

ঘটনা, সম্পদ লুটের ঘটনাগুলো খেয়াল করে দেখলে এভাবে বন্ধুত্ব, যোগসাজশ, ইত্যাদি চোখে পড়ে। হানাহানি, হামলা, যুদ্ধ চলতে থাকল। এ সবে সামনাসামনি জড়িয়ে থাকল উগান্ডা, রুয়ান্ডা প্রভৃতি দেশ; আড়ালে রইল বহুজাতিক করপোরেশন (বক), আর বকদের আশ্রয় দেওয়া রাষ্ট্র শক্তিগুলো। উগান্ডা ও রুয়ান্ডা চেয়েছে স্ব স্ব দেশের সীমান্ত বরাবর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে। কাবিলা গোটা দেশ নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছেন। উপরে উল্লেখিত বইতে বলা হয়েছে, কাবিলার সেনাবাহিনী ও বিরোধী কোঙ্গোলিজ র‌্যালি ফর ডেমোক্র্যাসি নামের বাহিনীকে, দু’পক্ষকেই মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে সংঘাত বেড়েছে, দেশটির অস্থিতিশীলতা বেড়েছে; ফলে বিদেশী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার জন্যই সবাই মিলে চেষ্টা চালিয়েছে দেশটিকে স্থিতিহীন রাখার।

রুয়ান্ডা ও উগান্ডার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; রুয়ান্ডার সৈন্যদের ও বিদ্রোহী সশস্ত্র দলগুলোকে যুদ্ধের নানা কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডো সেনারা। রুয়ান্ডা কঙ্গোতে সেনাবাহিনী পাঠানোর আগে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট সফর করেছিলেন পেন্টাগন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর। এমনকি, এ সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল যে, সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে রুয়ান্ডা কঙ্গোয় অভিযান শুরু করার আগেই, ১৯৯৮ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই কঙ্গোতে ঢুকে পড়া রুয়ান্ডার সৈন্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের দেখা গেছে। আগে উল্লিখিত ‘এ গেম এজ ওল্ড এজ অ্যাম্পায়ার’ বইতে এসব তথ্য রয়েছে।

এদিকে, কঙ্গো-রুয়ান্ডা সীমান্তে রুয়ান্ডার সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে দেয় সামরিক বিষয়ে ঠিকাদার কেলগ, ব্রাউন অ্যান্ড রুট নামে কোম্পানি। এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল কোম্পানি হ্যালিবার্টনের সাবসিডিয়ারি। এ ঘাঁটিতে রুয়ান্ডার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আবার, উপগ্রহের মাধ্যমে সংগ্রহ করা মানচিত্র ও ছবি কাবিলাকে যোগান দেয় বেকটেল করপোরেশন। এগুলো কাবিলাকে দেওয়া হতো যাতে মবুতুর সৈন্যদের চলাচলের হালনাগাদ খবর ও অবস্থান কাবিলা জানতে পারেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল কোম্পানি বেকটেলয়ের পরিচালকমন্ডলীতে বা প্রধান পদে যারা আছেন/ছিলেন, তাদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। এদের মধ্যে জর্জ শুলজ, কাসপার ওয়েইনবার্গার প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। আবার, ডিক চেনি এক সময়ে ছিলেন হ্যালিবার্টনের প্রধান। কেলগ, ব্রাউন অ্যান্ড রুটয়ের মালিক আবার হেলিবার্টন, কেইথ হারমন স্নো ‘দ্য ওয়ার দ্যাট ডিড নট মেক দ্য হেডলাইনস : ওভার ফাইভ মিলিয়ন ডেড ইন কঙ্গো’ প্রবন্ধে লিখেছেন : মানবাধিকার বিষয়ে দলনিরপেক্ষ একজন তদন্তকারী দেখেছেন যে, মিলিটারি প্রফেশনাল রিসোর্সেস ইনকরপোরেটেড এবং কেলগ, ব্রাউন অ্যান্ড রুট নামে ব্যক্তি মালিকানাধীন সামরিক কোম্পানি দুটির সঙ্গে পেন্টাগনের সম্পর্ক রয়েছে।

এবার লুটের ছোট্ট একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি। তার ভাই সলিম সালেহ। তিনি তিনটি বিমান ইজারা দিলেন উগান্ডার সামরিক বাহিনীকে। এ বিমানগুলো কঙ্গোতে সৈন্য ও সামগ্রী সরবরাহের কাজে লাগানো হলো। উগান্ডার সেনা কর্তাবৃন্দ, কঙ্গোর বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশে সালেহ নিশ্চিত করলেন যে, ফেরত পথে বিমানগুলো যেন বোঝাই থাকে সোনা, কাঠ, কফি দিয়ে।

আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যাক। রুয়ান্ডায় হীরা খনি নেই। অথচ রুয়ান্ডা ১৯৯৮ সালে ১৬৬ ক্যারেট হীরা রফতানি করে। আর তা ২০০০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৫০০ ক্যারেটে।

আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যাক। পাশ্চাত্যের বিশাল খনি কোম্পানি বারিক গোল্ড করপোরেশন। এটি কানাডীয় কোম্পানি। কঙ্গোর খনি সম্পদে এ কোম্পানির রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। এ কোম্পানির পরিচালকমন্ডলীর পরিচয়? কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মুলরোনে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের উপদেষ্টা ভার্নন জর্ডান। এ কোম্পানির উপদেষ্টাদের একজন হচ্ছেন জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ, যাকে সংক্ষেপে জর্জ ডব্লু বুশ বা জর্জ বুশ নামে পৃথিবীর মানুষ চেনেন।

কঙ্গো থেকে সুবিধা পেয়েছে যেসব কোম্পানি, সেগুলোর অন্যতম কানাডার হেরিটেজ অয়েল অ্যান্ড গ্যাস। উগান্ডা আর রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনী ১৯৯৮ সালে যখন কঙ্গোর মাটিতে পা রাখল, সে সময়েই সেখানে পৌঁছায় হেরিটেজ অয়েল অ্যান্ড গ্যাস। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংক পাঁচ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ডলার কর্জ দেয় কঙ্গোয় রুয়ান্ডা সমর্থিত বিদ্রোহী দলের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। আর, রুয়ান্ডা ও উগান্ডা যখন কঙ্গোয় লুট চালাচ্ছে, সে সময়েই এ দু’দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ছে বলে এ দু’দেশ প্রশংসা পাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের।

উপরে উল্লিখিত তথ্যগুলো পরিবেশিত হয়েছে ইতোমধ্যে উল্লেখ করা এ গেম এজ অ্যান্ড… বইতে। সত্য যে কোথায় কোনটি, তা বুঝতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের তথ্য বিপুল। একের পর এক এসব তথ্য সাজালে সহজেই কয়েকটি বই লেখা যায়। এসব তথ্য যথাযথভাবে সংযুক্ত করলে, এগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক খুঁজে পেলে সত্য আর আড়ালে থাকে না। লুট, হামলা, পেছনে থাকা শক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতির ভালো ভালো কথা, লেনদেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যকার সম্পর্ক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক, ইত্যাদি সত্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। তখন আর বিভ্রান্তি থাকে না এ পৃথিবীর বড় শক্তিদের চেহারা-চরিত্র-বক্তব্য নিয়ে। তবে, এক বিপুল আশ্চর্য তবুও অপেক্ষা করে। সে বিপুল আশ্চর্য হচ্ছে : আজো দেশে দেশে এ শক্তিবর্গের মিত্ররা পরম শ্রদ্ধায় পূজা পান। তারাও ভেবে দেখেন না যে, দেশের সাধারণ মানুষ যেদিন জানতে পারবেন এ পূজনীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে এ শক্তিবর্গের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা, সেদিন সাধারণ মানুষই ধিক্কার দেবেন এ ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে। আর, সাধারণ মানুষ প্রতিদিন তা করেন না, মাঝে মধ্যে করেন। যেমন, আমাদের এ ভূখন্ডেই, আমাদের আজকের বাংলাদেশে, ১৯৪৭ সালের আগে-পরে কতই না শ্রদ্ধা পেতেন মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহ। তাকে তো এ দেশেরই মানুষ ধিক্কার দিয়েছেন, প্রত্যাখ্যান করেছেন, তার কথার প্রতিবাদ করেছেন। কোনো কথাই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখতে পারেনি। একইভাবে, দেশে দেশে লুটের সঙ্গে জড়িত যে রাষ্ট্র শক্তি, তার পরম মিত্র, তার আস্থাভাজন লোককে সাধারণ মানুষ কি গ্রহণ করবেন? ধিক্কারে-নিন্দায় উচ্চারিত হবে সে নাম। কারণ, সাধারণ মানুষ কখনোই দেশের সম্মান ও মর্যাদা বলি দেন না। কঙ্গোতেও তাই হয়েছে। বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্র শোম্বের নাম আজ আর কেউ উচ্চারণ করেন না শ্রদ্ধায়, সে নাম উচ্চারিত হয় ঘৃণায়, ধিক্কারে। মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে আছেন প্যাট্রিস লুমুমবা।

কঙ্গোর দুর্ভোগের শেষ হয় না। কারণ তার সম্পদ কেবল সোনা, হীরা, কোবাল্টে সীমিত নেই। সেখানে আছে তেল। সে তেলের পরিমাণ একেবারে কম নয়। তাই এ তেল নিয়ে প্রতিযোগিতা রয়েছে এবং প্রতিযোগিতা প্রবল। ব্রিটেনের পত্রিকা ফাইন্যানশিয়াল টাইমসের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায় : কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে ৫ নম্বর ব্লক নিয়ে শুরু হয়েছে বিরোধ। এ ব্লকে রয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সেখানে রয়েছে বন, গরিলা, হাতি। এখানে রয়েছে মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো জাতীয় উদ্যান। এ ব্লকটি দেওয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যের দুটি তেল কোম্পানিকে। দেশটির আইন অনুসারে জাতীয় উদ্যানে কেবল বৈজ্ঞানিক কাজ চালানো যায়, তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন করা যায় না। দেশটির ৪১ জন এমপি জাতীয় উদ্যানের সীমানা নতুন করে চিহ্নিত করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রীর কাছে। প্রতিবেশী উগান্ডায় যুক্তরাজ্যের আরেকটি কোম্পানি, তাল্ল অয়েল সন্ধান পেয়েছে আড়াইশ কোটি ব্যারেল তেলের। এর পর থেকেই তেল তোলার জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। এ ব্লকে তেল তোলার জন্য পার্টনারশিপ শেয়ারিং এগ্রিমেন্ট বা উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি করা হয়। এটা খুব গোপন করে রাখা হয়। এ চুক্তি অনুসারে সিগনেচার বোনাস হিসেবে উৎপাদন দেবে ২০ লাখ ডলার, প্রথম উৎপাদন বোনাস হিসেবে দেবে ২০ লাখ ডলার; আর, একটি বার্ষিক কর দেওয়ার পাশাপাশি এক কোটি ব্যারেল তেল কিনবে ৫০ লাখ ডলারে। মুনাফার ওপরে ভাগাভাগি আছে। এ চুক্তি সংশোধন করা হয়। সে সংশোধন অনুসারে কিছু অর্থ আবার সিগনেচার বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়। কত পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে অনুমান করা হয়, এ পরিমাণ পাঁচ লাখ ডলার। এ অর্থ দেওয়া হয় চুক্তিটি প্রেসিডেন্ট অনুমোদন করার কয়েক সপ্তাহ আগে।

এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, তেল কোম্পানিগুলো যে অর্থ দেয়, তার চেয়ে বেশি নিয়ে যায়। তা না হলে এসব কোম্পানি তেল তুলতে আসত না। কারণ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দর্শন ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ নয়।

এ লুটের ‘কাহিনী’ বিশাল। তার ধরন অনেক। ব্যক্তি পর্যায়ে, কোম্পানি পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে, আইনের ও প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায়, আইন ভেঙে লুট চলে। এ লুট এত ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২০০০ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে বেআইনিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বিষয়ে প্রতিবেদন পেশ করতে বলে। জাতিসংঘ মহাসচিব এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করেন তাতে এ লুটের একটি দিক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়।

এ প্রতিবেদন ছয়টি উপসংহারে উপনীত হয়। প্রথম উপসংহারেই বলা হয় : গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে সংঘাত প্রধানত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রাপ্তি, নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য নিয়ে। এ পাঁচটি খনিজ সম্পদ হলো কোলটান, হীরা, তামা, কোবাল্ট ও সোনা। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ এত যে হতবিহবল হয়ে যেতে হয়। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা ও আইনহীনতার প্রেক্ষাপটে এ সম্পদ মুঠো না করার প্রলোভন ঠেকানো কঠিন। দ্বিতীয় উপসংহারে বলা হয় : বিদেশী সেনাবাহিনীগুলো সুব্যবস্থিতভাবে কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করছে। তা লুট করা হচ্ছে। এ নিয়ে গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। এসব চক্রের যোগাযোগ রয়েছে বিশ্বব্যাপী। তৃতীয় উপসংহারের একটি অংশে বলা হয় : কয়েকটি কোম্পানি কঙ্গোতে যুদ্ধে জড়িত। এসব কোম্পানি যুদ্ধে সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছে। এসব কোম্পানি প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে অস্ত্র যুগিয়েছে। অন্য কয়েকটি কোম্পানি দিয়েছে অর্থ। সে অর্থ খরচ হয়েছে অস্ত্র কেনায়। খনিজ সম্পদের ব্যবসা করে যে কোম্পানিগুলো, তারাই দেশটিতে বেআইনিভাবে খনিজ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। লুটের এ কাহিনী আগামীতে আরো তথ্য দেবে।

Thursday, October 13, 2011

কঙ্গো : খুন আর যুদ্ধ

১৯৬০ সালের ৩০ জুন। কঙ্গো স্বাধীন হলো। প্যাট্রিস লুমুমবা প্রধানমন্ত্রী; প্রেসিডেন্ট যোসেফ কাসাভুবু। সময় : ১৯৬০ সালের জুলাই মাস। স্বাধীন কঙ্গোর সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ তৈরি করা হলো, মোশে শোম্বে কঙ্গোর খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ কাটাঙ্গা অঞ্চলকে ঘোষণা করল স্বাধীন। ষড়যন্ত্রকবলিত কঙ্গোর অসহায় মাটিতে আবার পদার্পণ ঘটল বেলজিয়ামের সৈন্যদের। এবারের যুক্তি নতুন। সে নয়া যুক্তি হচ্ছে : বেলজীয় নাগরিকদের ও বেলজীয় খনি স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সময় : ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর। প্রেসিডেন্ট কাবাভুবু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেন লুমুমবাকে। সময় : ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাস। লুমুমবাকে গ্রেফতার করা হলো। সময় : ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। লুমুমবাকে খুন করা হলো। খুন করল সেনাপ্রধান জোসেফ মুবুতুর অনুগত সৈন্যরা।

রাজনীতির, স্পষ্টভাবে বললে বলতে হয়, সম্পদ লুটের রাজনীতির আরেকবার বিজয় ঘটল। বিদায় করে দেওয়া হলো লুটের রাজনীতি প্রতিরোধের আর নবজীবন গড়ার রাজনীতির নায়ককে। কিন্তু কবিতায় যেমন বলা হয়েছে, হাত দিয়ে সূর্যের আলো রোধ করা যায় না, তেমনি সত্য আড়াল করা যায় না। লুমুমবা হত্যার তথ্য কিছু কিছু করে প্রকাশিত হলো। নানা খবরে বলা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও বেলজিয়ামের যোগসাজশে লুমুমবাকে হত্যা করা হয়েছে। লুমুমবাকে হত্যার জন্য দায়ী করা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও বেলজিয়ামকে। এ সংশ্লিষ্ট ঘটনা প্রবাহের একপর্যায়ে রহস্যজনকভাবে ‘নিহত’ হলেন তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব দ্যাগ হ্যামারশোল্ড। এত মিথ্যা প্রচার, ষড়যন্ত্র ও হত্যার মধ্যেও লুমুমবা হয়ে উঠলেন নায়ক, আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকায় নয়া উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান পেলেন প্যাট্রিস লুমুমবা।

কঙ্গোর প্রসঙ্গ উঠলেই লুমুমবার নাম চলে আসে। স্বাধীনতা ঘোষণার অনুষ্ঠানে বেলজিয়ামের রাজা ঔপনিবেশিক শাসন, লুণ্ঠন, নির্যাতন, হত্যার জন্য কোনো অনুতাপ প্রকাশ করলেন না, চাইলেন না ক্ষমা। তিনি কঙ্গোকে উপনিবেশ বানানোর ‘বিচক্ষণতা’র প্রশংসা করলেন। বেলজিয়ামের বদান্যতা ও নানা ‘শুভ’ কাজের স্তূতি গাইলেন। জবাবে অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে লুমুমবা উপবিশেবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে বললেন : বলপ্রয়োগ করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবমাননাকর দাসত্বের অবসান ঘটানোর জন্য সংগ্রাম অবিচ্ছেদ্য, অনিবার্য। আমাদের ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। আমাদের যন্ত্রণা প্রবল। আমরা নিগ্রো তাই সকালে, দুপুরে, রাতে আমাদের মার খেতে হতো, অপমান সইতে হতো। এ নির্মম পরিহাস! আমরা দেখেছি, আমাদের দেশ লুট করে নেওয়া হয়েছে, তা করা হয়েছে আইনের কথা বলে। সে আইন কেবল একটি বিষয়ই স্বীকার করে; তা হচ্ছে শক্তিধরের অধিকার আমরা আইনের নানারূপ দেখেছি। সাদার ক্ষেত্রে এক রকমের আইন, কালো মানুষের ক্ষেত্রে আরেক রকম। আমরা জেনেছি রাজনৈতিক অভিমতের কারণে বন্দিদের নির্মম দুর্ভোগের কথা। তাদের ভাগ্য ছিল মৃত্যুর চেয়েও মন্দ। সেই গুলি চালনার কথা কে ভুলবে, যে ঘটনায় আমাদের এত ভাইয়ের মৃত্যু ঘটেছিল? কে ভুলবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া এত ভাইয়ের কথা, যারা অবিচার, নিপীড়ন, শোষণ-শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাননি? আর আমাদের দমিয়ে রাখার পন্থাই তো ছিল এগুলো।

লুমুমবার ভাষণে রাজা রুষ্ট হলেন। প্রায় ৪১ বছর পরে, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কঙ্গোর নেতা প্যাট্রিস লুমুমবাকে হত্যার জন্য বেলজিয়াম ক্ষমা চায়। কঙ্গোর দৈনিক টেমপেট ডেস ট্রপিকম শিরোনাম লেখে : আততায়ী দিয়ে লুমুমবাকে খুন – ব্রাসেলস অন্তত নিজ দায়িত্ব স্বীকার করছে। লা পটেনশিয়াল পত্রিকা শিরোনাম লেখে : খুন হওয়া মানুষের পরিবার ও কঙ্গোর জনগণের কাছে বেলজিয়াম অপরাধ স্বীকার করছে। লা রেফারেন্স প্লাস শিরোনাম লেখে : বেলজিয়াম আমকস ফরগিভনেস, বেলজিয়াম ক্ষমা চায়।

কিন্তু ইতিহাস ক্ষমা করে না। মানুষ ভোলে না। কঙ্গোর বয়স্ক মানুষের মন থেকে মোছে না তাদের নেতাকে খুনের ঘটনা; ঔপনিবেশিক শাসন আমলে আজকের রাজধানী কিনশাসায় রাতে থাকার জন্য বেলজীয় প্রভুদের কাছ থেকে পারমিট নেওয়ার বিধান; মজুরদের পিঠে বেলজীয় প্রভুদের চাবুকের দগদগে ঘা।

সম্পদ লুট করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র কত গভীর, কত নিষ্ঠুর! আর দ্যাগ হ্যামারশোল্ডের মৃত্যু? সদ্য স্বাধীন কঙ্গোয় গৃহযুদ্ধ যাতে না বাঁধে, সে জন্য সে দেশে ছুটে গিয়েছিলেন সে সময়ের জাতিসংঘ মহাসচিব। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে; ১৯৬১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মারা যান সুইডেনের অভিজাত পরিবার থেকে আসা এ মানুষটি। যিনি শান্তির জন্য কাজ করতেন, বড় শক্তিদের চোখ রাঙানির ধার ধারতেন না, ছোট ছোট দেশের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতেন। সে বিশাল দুর্ঘটনা আজও রহস্যাবৃত। নানা তথ্য থেকে প্রশ্ন দেখা দেয় : তার বিমানটি কি গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছিল? আজ আবার এ প্রশ্ন উঠেছে।

দ্যাগ হ্যামারশোল্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি ‘আমাদের শতাব্দীর সবচেয়ে মহান রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনিই এ যাবত একমাত্র ব্যক্তি, যাকে মৃত্যুর পরে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। আজও তিনি সুইডেনে জাতীয় বীরের সম্মানে অভিষিক্ত। জাতিসংঘের প্রথম নারী আন্ডার সেক্রেটারি ডেম মার্গারেট আনসটি বলেছেন, হ্যামারশোল্ডের কাজের ধরনের কারণে তার সঙ্গে বিরোধ বাধে তাদের, যারা জাতিসংঘকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

কঙ্গোতে বড় প্রশ্ন ছিল : দক্ষিণের কাটাঙ্গা প্রদেশ কে নিয়ন্ত্রণ করবে? প্রদেশটি তামা, ইউরেনিয়াম ও টিন সম্পদে সমৃদ্ধ। শোম্বের বিচ্ছিন্নতাবাদকে মদদ দেয় বেলজিয়াম। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রও মদদ দেয়। কাটাঙ্গায় ছিল এসব দেশের স্বার্থ, সেখানকার খনিতে। আর হ্যামারশোল্ডের সমর্থন ছিল কঙ্গোর নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি। সে সরকার প্যাট্রিস লুমুমবার সরকার। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন জানায়, লুমুমবা সরকারকে। কাটাঙ্গায় নেওয়া হয় অন্য দেশ থেকে ভাড়াটে সৈন্য। প্রভুদের মদদে বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত সে ভাড়াটে বাহিনীর সামনে অসহায় হয়ে পড়ে সেখানে অবস্থানরত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী। হ্যামারশোল্ড চেষ্টা করছিলেন কঙ্গোর কেন্দ্রীয় সরকার আর শোম্বের মধ্যে আলোচনা করে বিরোধ নিষ্পত্তি করাতে। যে রাতে হ্যামারশোল্ডের বিমান রহস্যজনকভাবে ‘বিধ্বস্ত’ হয়, সে রাতে শোম্বের সঙ্গে তার আলোচনায় বসার কথা ছিল। সে ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরে, ১৯৯২ সালে দু’ব্যক্তি ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ানকে চিঠি লিখে জানান, ভাড়াটে সৈন্যরা বিমানটিকে গুলি করেছিল। এ দু’ব্যক্তি হচ্ছেন বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঠিক আগে ও ঠিক পরে কাটাঙ্গায় কর্মরত জাতিসংঘের দু’জন প্রতিনিধি। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের প্রধান ছিলেন ডেজমন্ড টুটু। এ নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বাধীন এ কমিশন ১৯৯৮ সালে আটটি চিঠি প্রকাশ করে। এসব চিঠি থেকে দেখা যায়, ওই বিমানটি নষ্ট করার কাজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তৎকালে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসন ব্যবস্থাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জড়িত ছিল। চার বছর ধরে সুইডেনের সাহায্যকর্মী গোরান বিওর্কডাল গবেষণা করেছেন বিষয়টি নিয়ে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বই লিখেছেন ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ সুসান উইলিয়ামস। বইটির নাম হু কিলড হ্যামারশোল্ড। তারা দু’জনেই এ উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, বিমানটিকে হয়তো গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এসব তথ্য মূল ধারার ব্রিটিশ তথ্য মাধ্যম বিবিসি পরিবেশন করেছে।

কত বিচিত্র, কত রহস্যময়, কত নির্মম, কত ষড়যন্ত্রপূর্ণ সম্পদ লুট করে মুনাফাবাজির জগত। ভাবতে অবাক লাগে, এত ঘটনার পরেও এ পৃথিবীতেই দারিদ্র্য‘বিরোধী’ কত ‘যোদ্ধা’ বিশ্ব প্রভুদের পরম মিত্র! দেশে দেশে এরাই কাজ করে সম্পদলোভীদের স্বার্থ নিরাপদ করতে। আর প্রচার শক্তির কত ক্ষমতা। এ খলনায়করাই হয়ে ওঠেন নায়ক। কঙ্গোতেও একই ধারার নাটকের পুনরাবৃত্তি ঘটল।

সময় তখন ১৯৬৩ সাল। শোম্বে কাটাঙ্গার বিচ্ছিন্নতা অবসানে রাজি হয়ে যায়। কারণ লুটের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই লুমুমবা। এর পরের বছর শোম্বেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন তখনকার প্রেসিডেন্ট কাসাভুবু, যিনি শোম্বেকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরে কাসাভুবু ও শোম্বেকে মসনদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন জোসেফ মুবুতু, এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বহুবার চলা ইতিহাসের প্রতিশোধ যেন!

শুরু হলো মুবুতুর যুগ। তিনি দেশের নাম পাল্টে দিলেন; কঙ্গো হয়ে গেল জায়ের। তিনি নিজের নামও পাল্টালেন, জোসেফ মুবুতু হয়ে গেলেন মুবুতু সেসে সেকো। পাল্টে দেওয়া হলো কাটাঙ্গার নাম, বোধ হয় পাপের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা। তার নাম হলো শাবা। পাল্টে দেওয়া হলো কঙ্গো নদীর নাম। তা হলো জায়ের নদী। কেবল পাল্টাল না সম্পদ লুট আর সে লুটের রাজনীতি। একটি মুবুতুর ৩০ বছরের স্বৈরশাসন জন্ম দেয় একটি শব্দের। তা হলো চৌর্যতন্ত্র। তিনি একদিকে নিজে করলেন লুট। তার প্রিয় সঙ্গীরা করল লুট, তার প্রভুরা করল লুট, আরেক দিকে দেশটিকে বানিয়ে ফেললেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত এঙ্গোলার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোর হামলা ও অন্তর্ঘাত চালানোর স্প্রিংবোর্ড, লাফ দেওয়ার তক্তা। অর্থাৎ মুবুতুর শাসন ছায়ার নিচে আরামে থেকে লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে হামলা করা হতে থাকল এঙ্গোলায়। সেটাও এঙ্গোলাকে লুট করার জন্য নিজ দেশকে এভাবে পরাশক্তির লুটের খেলার ঘুঁটি বানিয়ে মবুতু নিশ্চিত করলেন স্বীয় ‘সু’কর্মের লুটের ও শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। মবুতুর দেশের নাম জায়ের আর দুর্নীতি এক হয়ে উঠল, দুর্নীতির আরেক নাম হলো দুর্নীতি জায়ের, জায়েরের আরেক নাম হলো দুর্নীতি। অনুমান করা হয় যে, কেবল মবুতু চারশ’ কোটি ডলারের সম্পদ লুট করেছেন।

অন্যরা? লুটের প্রভুরা? সে হিসাব কোনো দিন পাওয়া যাবে কিনা, কে জানে? তবু লুট প্রেম থামে না, থামে না প্রভুব প্রেম। এমন প্রভু প্রেমিক বা প্রভুর সেস্নহাস্পদ নানা দেশেই ছড়িয়ে আছে।

লুটের একটি নিয়ম হচ্ছে লুটের সম্পদ মুঠোয় জমা হতে থাকে আর মুঠো শিথিল হয়ে ক্ষমতা পিছলে পড়তে থাকে। মবুতুরও হলো তাই। স্নায়ু যুদ্ধ শেষে তাকে আর দরকার হলো না প্রভুদের। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন।

এর আগে বেলজিয়ামের কাছে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে মবুতুর শাসনাধীন দেশটি। বিচিত্র! এত সম্পদ, অথচ দেশটিকে কর্জ করতে হয় এবং দেশটি কর্জ শোধ করতে পারে না! প্রতিবেশী দেশ রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে গণহত্যা চলে। সে গণহত্যার রেশ ধরে কঙ্গোয় নেমে আসে হানাহানি। আফ্রিকার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধগুলোর একটি আয়োজিত হয় কঙ্গোতে। ঘটনার স্রোত বয়ে চলে, ১৯৯৩ সালে কঙ্গোতে মবুতু সমর্থক ও মবুতুবিরোধী দুটি সরকার গঠিত হয়। রুয়ান্ডার মদদে বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ ১৯৯৭ সালে রাজধানী কিনশাসা দখল করে, তারা ক্ষমতায় বসায় লরেন্ট ডিজায়ার কাবিলাকে। পুনরায় দেশটির নাম হয় গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র।

স্টিভেন হিয়াট সম্পাদিত এ গেম এজ ওল্ড এজ এম্পায়ার : দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব ইকোনোমিক হিট মেন এন্ড দ্য ওয়েব অব গ্লোবাল করাপশন বইতে উল্লেখিত হয়েছে যে, লরেন্ট কাবিলাকে সমর্থন দেয় বুরুন্ডি ও উগান্ডাও। এ দুটি দেশ সৈন্য পাঠিয়েছিল ১৯৯৭ সালে কাবিলার বিদ্রোহী গ্রুপকে মদদ যোগাতে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় মিত্র লরেন্ট কাবিলা ক্ষমতায় বসলেন। এর পরে দেশটিতে নানা ঘটনা আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যুদ্ধে জড়াল উল্লেখিত দেশগুলো ছাড়াও জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, এঙ্গোলা। সঙ্গে রইল প্রভুদের ভাড়া করা নানা সশস্ত্র দল। রুয়ান্ডা ও উগান্ডা কাবিলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদদ দেয়। জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া ও এঙ্গোলা থাকে কাবিলার পক্ষে। সময় তখন ১৯৯৮ সাল। কঙ্গোর মাটিতে শুরু হলো আফ্রিকার ‘প্রথম বিশ্ব’যুদ্ধ। যুদ্ধরত সব পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল কঙ্গোর সম্পদ লুটের উদ্দেশ্যে যুদ্ধকে আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরনো সত্যই যেন আবার উচ্চারিত হলো : লুট আর ভূ-রাজনীতি অনেক সময়ই মিলেমিশে থাকে।

Thursday, October 6, 2011

লুটের জন্য গণহত্যা (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৪)

এত দুর্ভোগ-দুর্গতি যে কঙ্গোর, সেই কঙ্গো সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে ১২০০ সালে। পর্তুগিজ নাবিক দিয়েগো কাও ১৪৮২ সালে আসেন কঙ্গো। তিনিই ছিলেন কঙ্গোয় পদার্পণকারী প্রথম ইউরোপীয়। কঙ্গোর রাজার সঙ্গে পর্তুগালের সম্পর্ক স্থাপিত হয় সে পদার্পণের মধ্য দিয়ে। এর প্রায় সোয়াশ’ বছর পরে শুরু হয় দাস বাণিজ্য, ষোড়শ শতকে ইংরেজ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ও ফরাসি বণিকরা আরম্ভ করে মানুষ নিয়ে সে ব্যবসা। তারা সঙ্গে নেয় স্থানীয় সহযোগীদের; দালা, মধ্যস্বত্বভোগীদের। এ বাণিজ্য চলে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত।

বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গোকে উপনিবেশ বানানোর মতলবে গঠন করলেন ব্যক্তিগত ব্যবসা উদ্যোগ; সময় তখন ১৮৭০-এর দশক। দেশটি হয়ে পড়ে রাজা লিওপোল্ডের জমিদারি। শুরু হলো কঙ্গোকে বেলজিয়ামের উপনিবেশকরণ। এর আগেই শুরু হয়েছে আফ্রিকার বিপুল সম্পদ লুট করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা। রাবারের চাহিদা বেড়েছে বিপুলভাবে। আর কঙ্গোতে তখন ছিল অনেক রাবার গাছ। তাই বেলজিয়াম রাজের ‘মহতী উদ্যোগ’ কঙ্গোতে। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাবার উৎপাদিত হতো, ততক্ষণ পুরুষ কর্মীদের পরিবারগুলোকে আটকে রাখা হতো। যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাবার উৎপাদন করতে পারত না, তাদের দু’হাত কেটে ফেলা হতো। আরো, আরো রাবারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের যে দাবি, তা প্রতিরোধ করত যারা, তাদেরও ভাগ্যে জুটত দু’হাত কেটে ফেলার ‘পুরস্কার’। এর সঙ্গে ছিল অনাহার, অতি শ্রমে শরীর ভেঙে পড়া, রোগ। এসব আর হত্যা মিলে কঙ্গোতে সে যাত্রা মারা যায় এক কোটি মানুষ। রবার্ট ও’ব্রায়ান এবং মার্ক উইলিয়ামের গ্লোবাল পলিটিক্যাল ইকোনমি : ইভোলিউশন অ্যান্ড ডায়নামিক্স বইতে এ তথ্য উল্লেখিত হয়েছে। রবার্ট ও মার্ক আরো লিখেছেন, রাজা লিওপোল্ড যখন কঙ্গো লুট করে চলেছেন, সে সময়ই, বেলজীয় সাম্রাজ্য আর রাবারপতিদের স্বার্থ রক্ষায় সব ‘রাবার চর’ সক্রিয়ভাবে চালাচ্ছে গণহত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার।

বার্লিনে ১৮৮৪-৮৫ সালে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সম্মেলনে কঙ্গো অববাহিকায় রাজা লিওপোল্ডের দাবি স্বীকার করে নেওয়া হয়। এ সম্মেলন আহবান করেছিলেন বিসমার্ক। আফ্রিকার মধ্যাঞ্চল নিয়ে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছিল, তা দূর করাই ছিল এ ১৫ দেশ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। কঙ্গোয় বেলজীয় ও ফরাসি লিপ্সা মেনে নিতে পারছিল না ব্রিটিশ ও পর্তুগিজ শক্তি। আবার পূর্ব আফ্রিকা ও ক্যামেরুন অঞ্চলে জার্মান সম্প্রসারণও তারা মানতে পারছিল না। তাই উত্তেজনা। এ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বেলজিয়াম রাজ ১৮৮৫ সালে কঙ্গো ফ্রি স্টেট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তিনি হলেন সে ফ্রি স্টেটের প্রধান। কঙ্গোর মানুষ, যাদের রক্তে, শ্রমে এ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি, তারা নিজ দেশে রইলেন পদানত। সাম্রাজ্য-শক্তির কি পরিহাস! সাম্রাজ্য শক্তি এভাবেই সব কালে, সব দেশে স্বনির্মিত ‘সত্য’ জবরদস্ত চাপিয়ে দিয়েছে। তবু সাম্রাজ্যের ক্ষুধা মেটে না। রক্ত ঝরতে থাকে বেলজীয় শক্তিমানরা ১৮৯১-৯২ সালে কাতাঙ্গা দখল করে। এর আগেই, বার্লিন সম্মেলনে কঙ্গো ও নাইজার নদীতে অবাধ চলাচলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, নির্ধারিত হয়েছে প্রভাবাধীন এলাকা। এ সবই করা হয়েছে উপনিবেশ বানানোর হুড়োহুড়ি যাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের মধ্যে যুদ্ধ না বাধিয়ে দেয় সে উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ শান্তি বজায় রাখতে হবে লুটের জন্য। লুটেরারা ‘শান্তিপ্রিয়’ কেন হয়, তাদের চাওয়া ‘শাস্তি’ কেমন, চলাচলের অবাধ অধিকার কেন দরকার, এসব স্পষ্ট হয়ে যায় এ ঘটনার মধ্য দিয়ে। এ ঘটনা আরো দেখিয়ে দেয় : দেশ এক দেশবাসীর, দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে প্রভুরা। এ ঘটনা একটি নয়, সাম্রাজ্যগুলোর ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেক। আবার সাম্রাজ্য কেন এমন আচরণ করে, সাম্রাজ্য হয় কিভাবে, কোন শক্তি কাজ করে সাম্রাজ্যের মধ্যে যা সাম্রাজ্যকে নিয়ে যায় অসংখ্য মানুষের রক্ত আর শ্রম আত্মসাৎ করতে, সে বিষয়গুলোও বুঝতে পারা দরকার লুট, হত্যার ইতিহাস বুঝতে পারার জন্য। আজ অবশ্য এ দ্বন্দ্বের কথা অনেকেই অস্বীকার করতে চান হাল্কাচালে বলা চটকদার কথা দিয়ে। ফলে অজানা রয়ে যায় লুটের ইতিহাস। কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন (দশ লাখে এক মিলিয়ন) মানুষকে ক্রীতদাস বানানোর ঘটনা কি অস্বীকার করা যায়? যায় কি ধন-সম্পদ লিপ্সার।

এ অমানবিক ঘটনা অস্বীকার করা? অন্য আরেক দেশের রাজার জমিদারি হয়ে উঠল এক দেশ! চলতে থাকল মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে দাস বানানো। কেন? গুটিকয় লোকের ভোগের জন্য আরো আরো সম্পদ চাই, সে জন্য। কঙ্গোকে অঙ্গীভূত করে নেয় বেলজিয়াম ১৯০৮ সালে। প্রতিবাদ জানান কঙ্গোর মানুষ। সে প্রতিবাদ দমনে রাজা লিওপোল্ডের চরেরা গণহারে, নির্বিচারে চালায় খুন, হত্যা, নির্যাতন।

ইতিহাসের তথ্য বলে : রাজা লিওপোল্ডের কঙ্গো জমিদারিতে কঙ্গোর মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হয় হত্যা করা হয়েছে, নতুবা তারা অন্যের জন্য সম্পদ তৈরিতে বাধ্য হয়ে কাজ করতে করতে মারা গেছেন, এখানে রয়েছে দ্বন্দ্ব : কতিপয়ের সম্পদ আর অগণিতের মেহনত। অর্থাৎ অগণিত সাধারণ মানুষের মেহনতে তৈরি হয় যে সম্পদ, তা যায় কয়েক লোকের ভোগে। এ দ্বন্দ্ব আজ অস্বীকার করে নতুন পথ খোঁজেন কেউ কেউ। কিন্তু অস্বীকার করলেই তো আর দ্বন্দ্ব মিলিয়ে যায় না। তা চলতেই থাকে। যিনি সে দ্বন্দ্ব অস্বীকার করেন, তিনি কেবল অপেক্ষা করেন বোকা হওয়ার মুহূর্তটির জন্য। কঙ্গোতেও হলো তাই।

স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হলো। রক্তাক্ত সে সংগ্রাম। সে লড়াইতে দেশটি ক্ষত-বিক্ষত, কঙ্গো খন্ড খন্ড হওয়ার অবস্থা। উপনিবেশটির ওপর সাম্রাজ্যবাদী প্রভু বেলজিয়াম নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। অবশেষে ১৯৬০ সালে কঙ্গো স্বাধীনতা অর্জন করে। দেশটির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন প্যাট্রিস লুমুমবা। শুরু হয় আরেক রক্তাক্ত অধ্যায়ের। চক্রান্ত আর হত্যাকান্ডে পূর্ণ সে অধ্যায়। সে অধ্যায়তেও নাটের গুরু ধনশালীরা, তাদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো আর এদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো।