Thursday, June 30, 2011

তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১

গরিব দেশগুলোর ইতিহাস মোটামুটি একই ধরনের, তা হচ্ছে ঔপনিবেশিক দেশগুলো দিয়ে বিজিত হওয়া, অবনত করে রাখা, নির্যাতিত হওয়া, লুণ্ঠিত হওয়া। সেই সঙ্গে থাকে অনাহার, মৃত্যু, দুঃশাসন। এ যেন গরিব দেশগুলোর নিয়তি। তাদের সম্পদ যেন আমন্ত্রণ করে আনে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে। তার পরে তা ললাটে একে দেয় নির্যাতিত হওয়ার, লুণ্ঠিত হওয়ার ‘অমোচনীয় চিহ্ন’।

এ সম্পদ ছড়িয়ে আছে এসব দেশের প্রান্তরে, বনে, ক্ষেতে, নদী-সমুদ্রে, ভূগর্ভে, আর অসহায় দেশবাসীর মেহনতে। এ যেন সম্পদসমৃদ্ধ দেশ আর দারিদ্রে্যর মধ্যে আপন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত সম্পদরাজি আর মৃত্যুর মধ্যেই দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা বিরোধ। বিপুল সম্পদরাজি যেন এ দেশগুলোর অভিশাপ হয়ে ওঠে। অভিশাপ হিসেবে যেন নেমে আসে লুটেরার দঙ্গল, অন্য দেশ থেকে নানা বেশে, নানা কাঠামোতে, নানা সংগঠন রূপে।

কখনো এরা ইউরোপের কোনো রাজার সেনাদল, ‘সভ্য’ করার জন্য পাঠানো শাসকবর্গ, কখনো এরা বহুজাতিক কোম্পানি (বক)- যে রূপেই যে সংগঠনের চেহারাতেই এরা আসুক, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এরা এনেছে অনাহার, দুর্ভিক্ষ, রোগ, মহামারী, মৃত্যু, দমন, নির্যাতন, এরা বইয়ে দিয়েছে রক্ত।

রক্ত বয়ে গেছে সুমাত্রায়, জাভায় (আজকের ইন্দোনেশিয়া), ইন্দোচিনে (আজকের ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া), বর্মায় (আজকের মিয়ানমার), আমাদের এ উপমহাদেশে, আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায়। সে রক্ত আজও বইছে। অর্থনীতির অধ্যাপক পল কোলিয়ার ‘দ্য প্লানডার্ড প্লানেট : হোয়াই উই মাস্ট – অ্যান্ড হাউ উই ক্যান – ম্যানেজ ন্যাচার ফর গ্লোবাল প্রসপারিটি’ বইতে সম্পদ লুটের ইতিহাস আর তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। আরো প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন মাইকেল প্যারেন্টি ‘সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে’ বইতে (বইটি ঢাকায় শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ছাপা হয়েছে)।

প্যারেন্টি এ বইতে লিখেছেন : ‘‘এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সুদীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়েছে খাদ্যশস্য, খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল ভান্ডার রয়েছে তাদের।… তৃতীয় বিশ্ব খুবই সম্পদশালী। দরিদ্র কেবল এসব দেশের মানুষ। সীমাহীন লুণ্ঠনের কারণেই কেবল এর মানুষ দরিদ্র। তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠন শুরু হয়েছে বহুশতক আগে। তা আজও চলছে। উপনিবেশবাদীরা প্রথমে লুট করে সোনা, রূপা, পশম, রেশম এবং মসলা। এরপরে তন্তু তৈরির উদ্ভিদ, কাঠ, গুড়, চিনি, রাম, রাবার, তামাক, সুতিবস্ত্র, কোকোয়া, কফি, তুলা, তামা, কয়লা, পাম অয়েল, টিন, লোহা, গজদন্ত, আবলুস কাঠ এবং তারপরে তেল, দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ, পারদ, প্লাটিনাম, কোবাল্ট, বক্সাইট, অ্যালুমিনিয়াম ও ইউরেনিয়াম। (ওমর তারেক চৌধুরীকৃত অনুবাদ)

এ বইটির আগে পিয়ের জ্যাল ‘দ্য পিলেজ অব দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড’ বইতে বিবরণ দেন লুটের। এ বইতে তিনি জানান, প্রায় মধ্য ষাটের দশকে ভারত, চীন, নাইজেরিয়া ও সেনেগাল পৃথিবীর মোট চীনা বাদামের ৬৫%, ঘানা, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল মোট কোকোয়ার ৬৮%, ভারত, সিলোন (আজকের শ্রীলংকা) মোট চায়ের ৬৮%, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড মোট প্রাকৃতিক রাবারের ৭৬% যোগান দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্ব ১৯৬৪ সালে যোগান দিয়েছিল ১ লাখ ৪২ হাজার টন টিন। সে বছর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিরেকে সারা পৃথিবীতে টিন উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টন। এ বছরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন ব্যতিরেকে সারা পৃথিবীতে আহরিত হয়েছিল ২ কোটি ৯০ লাখ টন বক্সাইট। এর মধ্যে তৃতীয় বিশ্বে আহরণের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ টন। সে সময় তামা, ম্যাঙ্গানিজ আর তেলের কাহিনীও একই ধাঁচের। কোথায় গেল সে সম্পদ? ইতিহাস জবাব দেয় : দারিদ্র্য তৈরি করে যে নির্মম হাত, বঞ্চনা তৈরি করে যে অনন্ত লোভ, সে নিষ্ঠুর হাতের মুঠোয় সে লোভাতুর মুখ গহবরে আর বিনিময়ে কি এলো তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে? এবারও ইতিহাস উত্তর দেয় : মৃত্যু, অনাহার, বুভুক্ষা, নিরক্ষরতা, মহামারী, ভাঙাচোরা জীবন।

ওপরে উল্লেখিত বইটি প্রকাশের প্রায় বছর দুয়েক পরে পিয়ের ‘দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড ইন ওয়ার্ল্ড ইকোনমি’ বইতে লিখলেন : অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের খনিজসম্পদের ওপরে আরো নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। সময় যতো এগিয়ে চলবে এ নির্ভরশীলতা ততোই বাড়বে। বিশেষ করে তা বাড়বে পেট্রোলিয়াম, লোহা আকর ও বক্সাইটের ক্ষেত্রে।

আজকের দুনিয়ায় পেট্রোলিয়াম, লোহা আর বক্সাইটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। আজ পেট্রোলিয়াম বা সোজা বাংলায় তেল নিয়ে তোলা হচ্ছে গুরুতর সব প্রশ্ন। এ সব প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত সারা পৃথিবীর বিশেষ করে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর অর্থনীতির চাকা চালু থাকার প্রশ্ন। কারণটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক জন বেলামি ফস্টার, তার সর্বোচ্চমাত্রায় তেল উৎপাদন এবং ইন্ধন সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বিখ্যাত নিবন্ধে। এ নিবন্ধের শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ইন্ধনের ক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা তেলের অনুপাত মোট প্রয়োজনীয় তেলের ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে বাড়তি তেল উৎপাদনের আর ক্ষমতা না থাকা, চলতি তেলসম্পদ পৃথিবীতে যা আছে তা উত্তরোত্তর পারস্য উপসারগীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া এবং তেল উত্তোলন সর্বোচ্চমাত্রায় পেঁŠছাতে চলেছে বলে আশঙ্কা। (নিবন্ধটির বাংলা অনুবাদ বাংলা মান্থলী রিভিউর ডিসেম্বর ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে)

তেল উৎপাদন সর্বোচ্চ মাত্রায় পেঁŠছানোর অর্থ এটা নয় যে, তেল ফুরিয়ে গেছে। ‘এর সোজা অর্থ হচ্ছে সর্বাধিক পরিমাণ তেল উৎপাদিত হওয়ার পর থেকে তেল উৎপাদন শেষ হওয়ার দিকে কমতে থাকা…। ফস্টার এ নিবন্ধ লেখার আগে সায়েন্টেফিক আমেরিকান সাময়িকী ১৯৯৮ সালের মার্চ সংখ্যায় ‘দি য়েন্ড অব চিপ অয়েল’ শিরোনামের নিবন্ধে উল্লেখ করে যে, বিশ্বে তেল উৎপাদন সর্বোচ্চমাত্রায় পৌঁছাবে ১০ বছরের মধ্যে।

এর পরে এ সময়সীমা নিয়ে বাদানুবাদ, হিসাব-নিকাশে হেরফের চলতে থাকে। তবে তেল উৎপাদন সর্বোচ্চ মাত্রায় বা পিক অয়েল স্তরে পেঁŠছানো নিয়ে আজ আর সংশয় নেই। সময় নিয়েও মতভেদ কমে এসেছে। ওপেক বা তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থাভুক্ত সদস্যদের বাড়তি তেল উৎপাদন ক্ষমতা যাচাই করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন সংক্রান্ত কর্তা বিল রিচার্ডসনকে এসব দেশে পাঠানো হয়েছিল। ম্যাথু সাইমন্স নামে এক ব্যাংক কর্তা ‘টোয়াইলাইট ইন দ্য ডেজার্ট : দ্য কামিং সৌদি অয়েল শক অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমি’ নামে বইয়ে ২০০৫ সালে লেখেন, সৌদি আরবের তেল উত্তোলনের পরিমাণ অল্প দিনের মধ্যে সর্বোচ্চমাত্রায় পৌঁছাবে।

উল্লেখ করা দরকার, অস্ট্রিয়ায় ১৯৫৫ সালে, জার্মানিতে ১৯৬৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশে ১৯৭১ সালে, কানাডায় ১৯৭৪ সালে, রোমানিয়ায় ১৯৭৬ সালে, ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৭৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় ১৯৮৯ সালে, ভারতে ও সিরিয়ায় ১৯৯৫ সালে, গ্যাবনে ও মালয়েশিয়ায় ১৯৯৮ সালে, আর্জেন্টিনা ও ভেনেজুয়েলায় ১৯৯৮ সালে, কলম্বিয়ায় ও ইকুয়েডরে ১৯৯৯ সালে, অস্ট্রেলিয়ায় ২০০০ সালে, ওমান, নরওয়ে ও ইয়েমেনে ২০০১ সালে এবং ডেনমার্ক ও মেক্সিকোতে ২০০৪ সালে তেল উৎপাদন শীর্ষ অবস্থায় বা পিক অয়েল পর্যায়ে পৌঁছে যায়। জার্মানির এনার্জি ওয়াচ গ্রুপের ক্রুড অয়েল : দ্য সাপ্লাই আউটলুকের (অক্টোবর, ২০০৭) তথ্য উদ্ধৃত করে ফস্টার ওপরে ওই নিবন্ধে এটি উল্লেখ করেন।

এসব তথ্য উল্লেখের পরে তেল সংক্রান্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। এমন পরিস্থিতিতে আরো উত্তেজনা বা আলোড়ন তোলে তিনটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সাময়িকীর ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘আফ্রিকান অয়েল : হুজ বোনানজা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় : তিনটি কারণ উত্তর আমেরিকাকে (প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রকে) ও এশিয়াকে (প্রধানত চীনকে) আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত অঞ্চল থেকে আরো তেল আমদানির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ কারণ তিনটি হচ্ছে- বিশ্বজুড়ে তেলের বর্ধমান চাহিদা, পশ্চিম আফ্রিকায় গভীর জলে বর্ধমান হারে তেল মজুদের সন্ধান প্রাপ্তি আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল সরবরাহের প্রতি হুমকি।

এমন পরিস্থিতিতে তেল নিয়ে উত্তেজনা, টানাটানি বা ঠেলাঠেলি, ষড়যন্ত্র, সংঘাত সহিংসতা, বেচাকেনা, কেমন হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলী একটু খেয়াল করে দেখলেও তা বুঝতে পারা যায়। রাজনীতির সঙ্গে, শাসনের সঙ্গে, জনসাধারণের জীবন-জীবিকার সঙ্গে, ভূরাজনীতি ও ভূঅর্থনীতির সঙ্গে এসব ঘটনার সংযোগ খুবই ঘনিষ্ট তাই এসব ঘটনা রাজনীতি, শাসন, জীবন, পররাষ্ট্রগত সম্পর্কের ওপরে প্রভাবও ফেলে। এ কথাই নক্রুমা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন বহু আগে। তার ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত বই ‘নিও কলোনিয়ালিজম, দ্য লাস্ট স্টেজ অব ইম্পেরিয়ালিজময়ে’ লেখা হয় : নিকট, মধ্য ও দূরপ্রাচ্যে, লাতিন আমেরিকায় ও উত্তর আমেরিকায় উপনিবেশ এবং আধা উপনিবেশগুলোতে জনগণের আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে তেলের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি প্রধান কারণ। ইরান, ইরাক, কুয়েত, এডেন (আজকের ইয়েমেন), সৌদি আরব, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, ব্রুনেই ও আলজেরিয়ায় সহিংসতা, বিপ্লব ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ঘটনা প্রবাহ অনেকাংশেই তেল নিয়ন্ত্রণের সংঘাত দিয়ে তাড়িত হয়েছে। তেলের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার ও চাহিদার এলাকা প্রসারিত হওয়ায় দুনিয়াজুড়ে চলছে এক তীব্র লড়াই। নক্রুমার এ পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য কি কাল্পনিক? আজও কি এমনই চলছে না? তেল নিয়ে, ইন্ধন নিয়ে, কেমন এ লড়াই? এ লড়াই কি কেবল তেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? তেল দখলের এ লড়াই জনসাধারণের জীবনে কি ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া তৈরি করে? আগামীতে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে।