Thursday, November 24, 2011

তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফার ‘খেলা’

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-২০)
তেল-গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার মধ্যে প্রাপ্তি অনেক। আইনগত কাঠামোর মধ্যে, আইনসম্মতভাবে সম্পদ আত্মসাতের মধ্যেও প্রাপ্তি বিপুল। চারধারেই তা ঘটছে। এ বিবরণ প্রায় অফুরন্ত। কেবল তেল কোম্পানির কথাই উল্লেখ করা যাক।

তেলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি কোম্পানি এ বছরের প্রথম ৯ মাসে মুনাফা করেছে ১০২.৮৫ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ২৮৫ কোটি ডলার। এক ডলারকে ৭০ টাকার সমান গণ্য করলে টাকার অঙ্কে মুনাফার এ পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ পাঁচটি কোম্পানি হচ্ছে বিপি বা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, কনোকো-ফিলিপস, শেভরন, এক্সনমবিল ও শেল। এসব কোম্পানির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। অনুমান করা হয় যে, মুনাফার পরিমাণ এ বছর শেষে ১৪০০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে।

বার্তা সংস্থা রয়টার অক্টোবরের শেষ দিকে ‘টোটাল, শেভরন প্রফিটস লিফটেড বাই ফার্ম অয়েল প্রাইম’ (‘তেলের মজবুত দামের ফলে টোটাল, শেভরনের মুনাফা বেড়েছে’) শিরোনামে এক খবরে জানায় : তেল কোম্পানি শেভরন ও টোটাল ২৮ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে অধিকতর মুনাফা অর্জনের কথা জানিয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি কষ্টকর হলেও মুনাফা বেড়েছে। বছরের প্রথম ৯ মাসে এ দুটি কোম্পানি ছাড়াও এক্সনমবিল, শেল ও বিপিরও মুনাফা বৃদ্ধি পায়।

এ বছরের জুলাইয়ে এক খবরে জানা যায় : ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় তিনটি তেল কোম্পানি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলার মুনাফা করে। এর মধ্যে শেল প্রতিদিন মুনাফা করে ৭৫ মিলিয়ন বা সাড়ে সাত কোটি ডলার। এ তিনটি কোম্পানি হচ্ছে শেল, বিপি এবং বিজি।

উল্লেখ করা দরকার যে, শেল ২০০৮ সালে মুনাফা করেছিল ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার সাতশ’ কোটি ডলারের বেশি। এ পরিমাণটিই ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ কোম্পানির এক বছরে সর্বাধিক পরিমাণ মুনাফা। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন যে, এ বছরও শেলের মুনাফার পরিমাণ ২০০৮ সালের সমপরিমাণ হতে পারে বা ছাড়িয়েও যেতে পারে।

তেল কোম্পানিগুলোর বিপুল মুনাফার ঘটনা কেবল কোনো একটি বছরের ঘটনা নয়। এরা অন্যান্য বছরেও চড়া মুনাফা করে থাকে। যেমন ২০০৮ সালের প্রথম ৯ মাসে পাঁচটি সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানির মুনাফা ছিল প্রায় রেকর্ড পরিমাণ। এ পাঁচটি কোম্পানি হচ্ছে বিপি, শেভরন, কনোকো-ফিলিপস, এক্সনমবিল ও শেল। ওই সময়ে তেলের দাম ছিল খুব চড়া। পরবর্তী তিন মাসে দাম কিছুটা পড়লে মুনাফার পরিমাণও কিছুটা কমে। তবে পুরো বছরের হিসাবে ২০০৮ সালে এ পাঁচ কোম্পানির মুনাফা দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার। এ পরিমাণ কেবল ২০০৭ সালের মুনাফার চেয়ে কম। এ পাঁচটি কোম্পানির ২০০৭ সালের মুনাফার পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এ সব তথ্য উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল জে ওয়েইস তার ‘বিগ অয়েল মেড ওভার সিক্স হান্ড্রেড বিলিয়ন ডলার ডিউরিং বুশ ইয়ার্স’ শিরোনামের নিবন্ধে।

তিনি এ সব তথ্য উল্লেখ করে আরো জানান যে, বুশের দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সবচেয়ে বড় পাঁচটি তেল কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬৫৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি ডলারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। অন্যভাবে বলা যায়, এ পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ছয়শ’ কোটি ডলার। এতো বিপুল মুনাফা করার ব্যাপারে অনেকের আপত্তি না থাকলেও কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, এত মুনাফা কিভাবে হয় এবং সে মুনাফা যায় কোথায়? এ প্রশ্ন অনেকেই করেছেন ও করছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের শুনানিতে এ প্রশ্ন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বা আইনসভার তেল মূল্য ও ইন্ধন স্বাধীনতা বিষয়ক বাছাই কমিটির এক শুনানি হয় ২০০৮ সালের প্রথম ভাগে। সেখানে তলব করা হয় এক্সনমবিল, শেল, বিপি, কনোকো-ফিলিপস ও শেভরনের কর্তাদের। সেখানে কংগ্রেস সদস্যরা বা আইন প্রণেতারা তলব করে আনা তেল কর্তাদের কাছে জানতে চান যে, এত বিপুল মুনাফা করা সত্ত্বেও বারবার ব্যবহার করা যায়, এমন জ্বালানি খাতে প্রায় কিছুই বিনিয়োগ করা হচ্ছে না কেন? এ কারণে তাদের তিরস্কারও করা হয়। এসব কোম্পানি যে বছর ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার মুনাফা করে সে বছরেই কর রেয়াত হিসেবে পায় ১৮০০ কোটি ডলার। তেল কর্তাদের এই বিপুল পরিমাণ কর রেয়াত বা কর সুবিধা নেওয়ার যুক্তি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়।

এসব কোম্পানি তাদের বড় কর্তাদের এত বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা দেয় যে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারি না। উদাহরণ দেওয়া যাক। লি রেমন্ড নামে একজন প্রধান নির্বাহী কর্তা ছিলেন এক্সনমবিলে। এই প্রধান নির্বাহী কর্তা পদটিকে ইংরেজিতে চিফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার বা সংক্ষেপে সিইও বলে। লি রেমন্ড চাকরি ছেড়ে যাবেন তাই চাকরি ছেড়ে যাওয়া বাবদ তাকে দেওয়া হলো ৪০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। এ অর্থ কেবল আমাদের মতো দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কাছেও অকল্পনীয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এমানুয়েল ক্লিভার এত অর্থ প্রদান বিষয়ে কোম্পানিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টেফান সাইমনকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। উদাহরণ হিসেবে একটি প্রশ্নের উল্লেখ করা হলো। প্রশ্ন করার শুরুতে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য ক্লিভার বলেন : আমার বাবা সারাজীবন কাজ করেছেন। তিনি কখনোই বছরে ২৫ হাজার ডলারের বেশি আয় করতে পারেননি। বহু বছর তিনি একসঙ্গে তিনটি কাজ করেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাজ করেছেন দুটি। তার চার সন্তানকে তিনি কলেজ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। এখন তার বয়স ৮৬। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাবার মতো অনেক মানুষ আছেন। আগামী শনিবার এমন কয়েক জনের সঙ্গে আমি এক সভায় মিলিত হব। এটা আইনসভা সদস্যের সঙ্গে প্রতি মাসের সভা। সাইমন, লি রেমন্ড এক্সনমবিল থেকে চাকরি ছেড়ে যাওয়া বাবদ যে ৪০ কোটি ডলার পেলেন সে ঘটনাটি এইসব মানুষের কাছে আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এই ৪০ কোটি ডলার মানে দিনে এক লাখ ৪১ হাজার ডলার (প্রায় এক কোটি টাকা)। যে মানুষ কাজ খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন, তাদের আমি কি বলে বোঝাবো যে, রেমন্ড সাহেবের ৪০ কোটি ডলার পাওয়া ঠিক আছে? এইসব মানুষ টিকে থাকার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছেন আর তেল কোম্পানি সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। এ প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছিলেন তেলকর্তা সাইমন সাহেব, তা হাস্যকর।

এরপরে কমিটির অন্যান্য সদস্য নবায়ন করা যায়, এমন জ্বালানি খাতে অতি সামান্য বিনিয়োগ করা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন সাইমন সাহেবকে। সেসব প্রশ্নের জবাবও সন্তোষজনক ছিল না। এসব তথ্য অ্যামি গুডম্যানের এক বেতার অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাও এ বছরের এপ্রিলে তেল কোম্পানিগুলোকে কর দাতাদের অর্থ দিয়ে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানান। এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, কর দাতাদের অর্থ দিয়ে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারটি ঠিক নয়। তিনি এ ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য আইনসভার প্রতি আহবান জানান।

এ ঘটনা থেকে বুঝতে সুবিধা হয় যে, মুনাফার বিপুল অর্থ কোথায় যায়। কেবল এখানেই যায় না। মালিকদের ভোগেও ব্যয় হয় সে অর্থের একাংশ। তবে এটা ধারণা করা ভুল হবে যে, মুনাফার সব অর্থই এভাবে খরচ হয়। আবার এটাও স্পষ্ট যে, এত মুনাফা এবং মুনাফার অর্থ এভাবে ভাগবাটোয়ারা করা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ কাজটি যুক্তিসঙ্গত নয়। বিশেষ করে, বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও সচ্ছলভাবে সম্মানজনকভাবে চলতে পারেন না তখন হাতেগোনা কিছু লোকের এভাবে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থ নানা উসিলায় হাতিয়ে নেওয়া কোনো যুক্তিতেই টেকে না। আবার সারা পৃথিবীতেই যখন জ্বালানি সংকট, সে সংকট যখন ক্রমাগতভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন তেল পোড়ানোর কারণে পৃথিবীর গরম হাওয়া বাড়ছে ও তাতে মানুষসহ সব প্রাণের অস্তিত্বই হুমকির মুখে, যখন পৃথিবীকে রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের তাগিদ বাড়ছে, সে সময় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণায়, উদ্ভাবনে, ব্যবহারে অর্থ বিনিয়োগ না করে মুনাফার অর্থ বাবু সাহেবরা ভাগবাটোয়ারা করে নেবেন, সেটা যুক্তি বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

এত মুনাফার ‘ব্যাপারটি’ আরো উৎকটরূপে চোখে পড়বে, যদি তা বেকারত্বের হারের পাশাপাশি তুলনা করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর বিভিন্ন প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ইত্যাদি থেকে দেখা যায় যে, সারা পৃথিবীতে বেকার মানুষের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ একদিকে, বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, আরেক দিকে বেড়েছে কয়েকটি কোম্পানির মুনাফা। দুটোই বেড়েছে। একটির মুনাফার বৃদ্ধি, কতিপয় মানুষকে বিলাস, অকল্পনীয় ভোগের সুযোগ দিয়েছে; আরেকটির বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি কোটি কোটি মানুষের জীবনে এনেছে সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ-অনাহার।

বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিণতিতে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, বেকার হয়েছেন। আর তেলের মূল্য বৃদ্ধি মুনাফা বাড়িয়েছে।

মুনাফা ‘অর্জনের’ আরো ‘কাহিনী’ রয়েছে। টিএনএস মিডিয়া ইন্টেলিজেন্স নামে তথ্য মাধ্যম পর্যবেক্ষণ বিষয়ে একটি সংগঠন জানায়, কেবল একটি তেল কোম্পানি ২০০৭ সালে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছিল ১০ কোটি ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা। আবার এ কোম্পানিটি জনমনে ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের পরিবেশ ‘সচেতন’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সে ধরনেরই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তবে সে ধরনের বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল কোম্পানিটি, তার চেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য দিয়েছিল এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর গরম বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে সবসময় সন্দেহ ছড়াচ্ছে। আচরণটি কি মুনাফার ‘সততা’?

মুনাফা কোথা থেকে আসে এ প্রশ্ন অনেক পুরনো। এ দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ যুগ যুগ ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আমাদের বিশ্বকবি যেমন প্রশ্ন করেছেন আকাশকে যে, মেঘেরা দলবেঁধে কোথায় যায়, সেভাবেই মানুষেরও প্রশ্ন : মুনাফা যায় কোথায়? এ দুটি প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেছে। সে উত্তর দিয়েছে বিজ্ঞান, তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করে। সংক্ষেপে সে উত্তর হচ্ছে : মুনাফা আসে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া মেহনত থেকে আর মুনাফার এক অংশ যায় অল্প কিছু লোকের ভোগে, আরেক অংশ যায় মুনাফা আরো বাড়িয়ে তোলার কাজে। আর মুনাফা করার জন্য তেল কোম্পানি কেবল উৎপাদনে বিনিয়োগ করে না। বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হয় হানাহানি, সংঘাত, সশস্ত্র দল-উপদল তৈরি করার কাজে, রাজনীতিতে অর্থ যোগাতে, ঘুষ দিতে, দালাল বানাতে, কিছু লোককে কিনে নিতে। এ হচ্ছে মুনাফার ‘খেলা’।

Thursday, November 17, 2011

এর পরে স্বৈরাচারীরা শুরু করল লুট

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৯)।। 
লুটপাটের ‘রূপকথার’ যেন শেষ নেই। কারণ যেন শেষ হয় না সেই অর্থনীতি আর সেই রাজনীতির, যা লুটপাট করেই টিকে থাকতে পারে। লুট চলে কখনো খোলাখুলি, আইনের পরোয়া না করে; কখনো তা চলে আইনের কাঠামোর মধ্যে, যখন তাকে লুট বলে চিনতে অসুবিধা হয়। তবে আইনের কাঠামোর মধ্যে বা আইনের আশ্রয়ে থেকেই লুট চলে বেশিরভাগ সময়ে। তখন কেউ যদি সে আইনকে বা আইনের কাঠামোকে বলেন লুটের আইন বা লুটেরার আইন, তা হলে সে অভিধাকে ভুল বলা মুশকিল। এমনই কিছু লুটের দৃষ্টান্ত দেখা যাক।

দেশটির নাম ইকুয়েটরিয়াল গিনি। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে, গ্যাবন ও ক্যামেরনের মাঝখানে দেশটির অবস্থান। আয়তন ১০ হাজার ৮শ’ বর্গমাইলের সামান্য বেশি। স্পেন ছিল দেশটির ঔপনিবেশিক প্রভু। স্বাধীন হয় ১৯৬৮ সালের ১২ অক্টোবর। প্রেসিডেন্ট পদে বসলেন মেসি নগুয়েমা বিয়োগো। তার ১১ বছরের শাসনকে আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে নৃশংস শাসনগুলোর অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। সে শাসন প্রকৃত অর্থে হয়ে ওঠে দুঃশাসন। আর সেই দুঃশাসনে দেশটি হয়ে পড়ে দেউলিয়া। সে শাসন পর্বকে বলা যায় সন্ত্রাসের কাল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সে সময়ে ক্রীতদাস প্রথা আবার চালু করা হয়েছিল; সেনাবাহিনী খুন করেছিল ৫০ হাজার নাগরিককে। এর পরে ১৯৭৯ সালের আগস্টে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বিয়োগো ক্ষমতাচ্যুত হন। তাকে হত্যা করা হয়। তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করলেন তারই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থিওডর নগুয়েমা মোবাসোগো। বিয়োগো ছিলেন মোবাসোগোর চাচা। বিয়োগো নিজেকে দেশটির আজীবন প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন। বিয়োগোর বিরুদ্ধে এ সামরিক অভ্যুত্থানের খবর আগেভাগে জানতেন সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু স্পেনের কর্তারা। তাদের মদদ ছিল সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে।

দেশটির অর্থনীতি কৃষি প্রধান। প্রধান ফসল কোকো, কলা, কফি, পামতেল। সাম্প্রতিক কালে খোঁজ পাওয়া গেল তেল, ইউরেনিয়াম, লোহার। কাঠ আছে প্রচুর। রফতানি করা কাঠের প্রায় সবই যায় স্পেন ও জার্মানিতে। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের সিংহভাগ স্পেনের সঙ্গে। চলতি ধারণা অনুসারে দেশটি গরিব। এ দেশেরই একজন নাম থিওডর নগুয়েমা অবিয়াং মানগু। তিনি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে চাচাকে হত্যা করে প্রেসিডেন্ট পদে বসা থিওডর নগুয়েমার পুত্র।

মানগুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ১১ কোটি ডলার এনেছেন; এ অর্থের ধরনটি সন্দেহজনক; এবং এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন আইনজীবী, ব্যাংকার, ভূসম্পত্তি দালানকোঠা ও হুন্ডি ব্যবসায়ী। মানগু সম্পর্কে  যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি তদন্ত হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ফ্রান্সে। যুক্তরাষ্ট্র আইনসভার এক শুনানি থেকে জানা যায়, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট বা হিসাব খোলা ও সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেনে দেশটির কয়েকজন কর্তাকে সাহায্য করে রিগস ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক। অর্থ পাচার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের আইন ফাঁকি দেওয়ার কাজে তাকে সহায়তা করেন যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন আইনজীবী। কোনো ব্যাংক মানগুর কোনো হিসাবের আসল চরিত্র ধরে ফেললে আরেকটি হিসাব খোলার কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন একজন আইনজীবী। অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে তিনি নানা নামে কয়েকটি কোম্পানি গঠন করেন। চড়া দামের ভূসম্পত্তি কেনাবেচায় তাকে সহায়তা করতেন দু’জন ভূসম্পত্তি ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রে তার কেনা একটি বাড়ির দাম তিন কোটি ডলার। যদি এক ডলারকে ৭০ টাকার সমান গণ্য করা হয়, তা হলে টাকার অংকে বাড়িটির দাম হয় ২১০ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের উল্লেখিত ঘটনা এবং পাচার করা অর্থের পরিমাণ হিসেবে যা উল্লেখিত হয়েছে, তা কেবল চার বছরের, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।

আফ্রিকার আরেক দেশ গ্যাবন। কঙ্গো আর ইকুয়েটরিয়াল গিনির মাঝখানে, আটলান্টিক উপকূলে দেশটির আয়তন এক লাখ ৩ হাজার ৩শ’ বর্গমাইলের কিছু বেশি। সে দেশের সম্পদের মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম, তেল, ম্যাঙ্গানিজ ও কাঠ। দেশটির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স। সে প্রভু প্রত্যক্ষ শাসন ছেড়ে চলে গেলেও এসব ক্ষেত্রে সচরাচর যা ঘটে, অর্থাৎ, নয়া ঔপনিবেশগুলোতে যে ধরন থাকে, গ্যাবনেও তাই রয়েছে। ফ্রান্সের খবরদারি, কর্তৃত্ব রয়েছে ঔপনিবেশিক আমলেরই মতো। সেই সঙ্গে, নতুন করে জুটেছে দেশটির অর্থনৈতিক নীতি ও কার্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ব্যাংকগুলোর প্রভাব।

সে দেশে ৪১ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট ছিলেন ওমর বঙ্গো। তার মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের জুনে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ৬টি সাঁজোয়া যান কেনার এবং যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ছয়টি সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমান সৌদি আরবের কাছ থেকে কিনতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি সংগ্রহের জন্য নিয়োগ করেন যুক্তরাষ্ট্রের এক লবিস্ট বা দেনদরবার কর্তাকে। এ কর্তার নাম জেফরি বিরেল। এ ধরনের কর্তারা ও প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নানাপর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে, নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রায় সব দেশেই এ ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ কাজটি এদের ব্যবসা। কোনো কোনো দেশের রাজধানীতে এদের সংখ্যা হাজার হাজার।

সাঁজোয়া যান ও পরিবহন বিমান কেনায় লাভ অনেকের, কেবল বঙ্গোর নয়। এ লেনদেনের টাকা অনেকেই পাবেন। তবে, টাকা আসবে চূড়ান্ত বিচারে কেবল একটি উৎস থেকে। তা হচ্ছে : দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের সংখ্যা অনেক, যাদের অসন্তোষ-ক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হবে এসব সাঁজোয়া যান। শাসন ব্যবস্থা যখন জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে যায়, তখন এমনই হয়; এমন হয় প্রায় সব জায়গায়।

এই বঙ্গো সাহেব সাঁজোয়া যান ও বিমানগুলো কেনার অংশ হিসেবে গ্যাবন থেকে অর্থ পাঠান যুক্তরাষ্ট্রে। এ অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৮০ লাখ ডলারের বেশি। এ অর্থ পাঠানো হয় একটি আমেরিকান কোম্পানির নামে। কোম্পানিটি গঠন করেন উল্লেখিত লবিস্ট বিরেল সাহেব। এছাড়া কিছু অর্থ সরানো হয় মাল্টায় প্রেসিডেন্ট ওমর বঙ্গোর নামে খোলা একটি বিদেশী মুদ্রা হিসাব থেকে। এটা ছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংকে ওমর বঙ্গোর একজন উপদেষ্টা ও কয়েকজন কনসালট্যান্ট বা পরামর্শকের নামে রাখা হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সরানো হয়। দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ওমর বঙ্গো ১০ কোটি ডলারের বেশি পাচার করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেছেন ভুয়া বিভিন্ন কোম্পানি। ফ্রান্সে তেল নিয়ে এক কেলেঙ্কারিতেও জড়িত ছিলেন ওমর বঙ্গো। দুর্নীতির একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ফ্রান্সে। সেখানেও রয়েছে তার নাম।

তিনি নিজ কন্যা ইয়ামিলি বঙ্গো এমটায়েরকে দেন বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। ইয়ামিলি কিছু অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখেন; আবার কিছু নগদ অর্থ জমা রাখেন সিন্দুকে। এসব ঘটনা ঘটে ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তখন তিনি ছাত্রী, কোনো আয় রোজগার নেই। একটি ব্যাংক তার হিসাব বন্ধ করে দেয়, যখন দেখে যে, সে হিসাবে গ্যাবন থেকে পাঠানো হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৫শ’ ডলার। আরেকটি ব্যাংকও সেটাই করে, যখন দেখে যে, ব্যাংকটির সিন্দুকে তিনি রেখেছেন ১০ লাখ ডলার। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে এনেছিলেন তার বাবা এবং এ কাজে তার বাবা ব্যবহার করেছিলেন কূটনৈতিক সুবিধা। এই কূটনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়নি অর্থ সংক্রান্ত তথ্য। বঙ্গো পরিবারের আরেক সদস্য ইঙ্গো লিন কলিন্স বঙ্গো। তিনি গ্যাবনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলি বঙ্গোর পত্নী। কলিন্স বঙ্গো ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। এর নাম কলিন্স রিভোকেবল ট্রাস্ট। এর পরে ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকটি ব্যাংকে এ ট্রাস্টের নামে খোলা হয় কয়েকটি অ্যাকাউন্ট। পরবর্তী তিন বছরে তিনি এ ট্রাস্টের নামে অন্য দেশ থেকে পাঠানো বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেন। সে অর্থ তিনি ব্যয় করেন নিজের বিলাস বৈভবভরা জীবন ভোগে। এছাড়া ট্রাস্টের তহবিলে জমা করা এ অর্থ এক হিসাব থেকে আরেক হিসাবে এমনভাবে সরানো হয়, যা থেকে লাভবান হন তিনি ও তার স্বামী।

লোকে বলে, তেলের ওপর ভাসছে নাইজেরিয়া। এ ঘটনা সেই নাইজেরিয়ার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আতিকু আবু বকরের চতুর্থ বিবি, মার্কিন নাগরিক জেনিফার ডগলাসকে নিয়ে। জেনিফার ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চার কোটি ডলার নিয়ে আসতে সাহায্য করেন। এসব অর্থ পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। এ অর্থের উৎস, ইত্যাদি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের। এ অর্থ পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ২০০৮ সালে এক দেওয়ানি অভিযোগ দায়ের করে। এতে বলা হয়, ডগলাস বেগম ২০০১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত জার্মানির অন্যতম বিশাল কোম্পানি সিমেন্সের কাছ থেকে ২০ লাখ ডলারেরও বেশি পেয়েছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছেন। তবে সিমেন্স যুক্তরাষ্ট্রে এ সংক্রান্ত ফৌজদারি অভিযোগে দোষ স্বীকার করেছে এবং ঘুষ প্রদান সংক্রান্ত দেওয়ানি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। সেই সঙ্গে, সিমেন্স যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের এ সংক্রান্ত উপ-কমিটিকে বলেছে, সিমেন্স ওই বেগমের আমেরিকান অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে।

আর আবু বকরের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় নাইজেরিয়ায়, ২০০৭ সালে। সে অভিযোগ ছিল পেট্রলিয়াম টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড নিয়ে। এই পেট্রলিয়াম প্রযুক্তি উন্নয়ন তহবিলের চার কোটি ডলারের মধ্যে আড়াই কোটি ডলার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি ব্যাংকে পাঠানো হয়। এ ব্যাংকগুলোতে হিসাব খোলেন বেগম ডগলাস। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো যখন অন্য দেশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ পাঠানো বিষয়ে বেগম ডগলাসকে প্রশ্ন করে, তখন তিনি স্বীকার করেন যে, এ ধরনের অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি বিষয়ে তিনি সামান্যই জানেন। তবে এ অর্থ এসেছে তার স্বামীর কাছ থেকে, সে আভাস তিনি দেন। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি ব্যাংক কোনো একটি হিসাব বন্ধ করে দিলে তার আইনজীবীরা অন্যান্য ব্যাংককে রাজি করিয়েছেন তাদের মক্কেলের নামে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে।

এছাড়া নাইজেরিয়ায় আবু বকরের স্থাপন করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিকে পাঁচ বছর মেয়াদে আবু বকর প্রেরণ করেন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এ অর্থ গ্রহণ করে এবং তা গ্রহণ করে এ তহবিলের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেখায়, এ বিষয়ে প্রশ্ন করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।

এখানে উল্লিখিত তথ্যসমূহ যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের অনুসন্ধান সংক্রান্ত উপ-কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনটি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির। লুটপাটের জগতে এখানে উল্লিখিত ঘটনা মাত্র তিনটি। এমন শত শত ঘটনা রয়েছে। অর্থের পরিমাণের দিক থেকেও এ ঘটনাসমূহ তেমন বেশি নয় লুটপাটের অন্যান্য পরিমাণের তুলনায়। এ তিনটি ঘটনার গুরুত্ব হচ্ছে : ১. এগুলো উদাহরণ, যা লুটপাটের জগতের ব্যাপকতা বুঝতে সাহায্য করে; ২. লুটের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলো ও সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে।

ছিঁচকে চুরি বা পাতি চুরি করা এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব। একাধিক ব্যক্তির দরকার হয় না পাতি চুরি করতে। কিন্তু লুটপাট একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার হয় সঙ্গী-সাথী সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া। এই সঙ্গী-সাথী ইত্যাদি কোনো একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকলে বড় আকারের লুট সম্ভব নয়। এসবের সঙ্গে দরকার অনুকূল পরিবেশ। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সে সমাজে বিভিন্ন অংশের শক্তি, সচেতনতার ও সমবেত থাকার মাত্রা, অবস্থান, বিভিন্ন অংশের মধ্যকার সম্পর্ক, এগুলো মিলে তৈরি হয় পরিবেশ।

ঘটনা তিনটিতে লক্ষণীয় দুটি বিষয়। সে বিষয় দুটি হচ্ছে- ১. লুটের প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখিত হচ্ছে কেবল ব্যক্তি, ২. তবে কাজটির অর্থাৎ লুটের ক্ষেত্রে প্রকাশ হয়ে পড়ছে ব্যাংকের সম্পর্ক এবং আইনের ফাঁকফোকর। দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিরা ধোঁকা দিচ্ছে বা বোকা বানাচ্ছে ব্যাংককে, আইনকে। আবার তা ফাঁসও হয়ে যাচ্ছে যখন প্রতিষ্ঠান প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ লুটের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ব্যক্তির চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে। লুটপাটের বিষয়টি দেখার সময় এ দিকগুলোও দেখা দরকার।

খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে : প্রতিষ্ঠান কখন ও কেন লুট সহ্য করে এবং কখন ও কেন করে না? প্রশ্ন হতে পারে : মাত্র এই তিন চার সাহেব-বিবির মাত্র ক’বছরের লুটের পরিমাণ যদি এত টাকা হয়, তা হলে লুটপাটের জগতে টাকার পরিমাণের হিসাবে কত বড়? আরো প্রশ্ন হতে পারে ইকুয়েটরিয়াল গিনি বা গ্যাবন বা নাইজেরিয়ার সাধারণ মানুষ বা একজন মজুর বা একজন গৃহবধূ বা একজন কৃষক কি খবর রাখেন এ লুটপাটের? তারা কি তুলনা করতে পারেন তাদের আয়ের, সারাজীবনের উপার্জনের সঙ্গে লুট করা অর্থের পরিমাণের? অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের কাছে তথ্য পৌঁছায় না, যারা পড়তে পারেন না, তারা কি জানেন, লুটের জগতের খবর, লুটের পরিমাণ? তারা কি জানেন যে, লুটের এ অর্থ তাদেরই?

Thursday, November 3, 2011

কেবলই দুর্ভোগ কান্না-রক্ত (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৮)

গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের খনিজ সম্পদের প্রসঙ্গ উঠলেই দেশটির হীরা, সোনা আর কোলটানের কথা ওঠে। দেশটির ইন্ধন সম্পদও কম নয়। এ সম্পদ এখন ক্রমান্বয়ে আগ্রহীদের চোখে পড়ছে। দেশটিতে রয়েছে তেল, গ্যাস ও কয়লার উল্লেখযোগ্য মজুদ। এছাড়া পানি বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনাও বিপুল। প্রায় এক লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে দেশটিতে। এ পরিমাণ হচ্ছে বিশ্বে উৎপাদিত জলবিদ্যুতের প্রায় ১৩ শতাংশ। এসবই দেশটির প্রতি আকৃষ্ট করছে মুনাফা সন্ধানকারীদের।

আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের অশোধিত তেলের মজুদ এঙ্গোলার পরেই; অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানীয়। দেশটির অশোধিত তেলের মজুদ ২০০৯ সালের হিসাব অনুসারে ছিল ১৮ কোটি ব্যারেল। তেল ও গ্যাস বিষয়ে দেশটি প্রথমবারের মতো সম্মেলন আয়োজন করে ২০০৮ সালের মধ্য আগস্টে। এ খবর জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার।

দেশটিতে তেল খোঁজার কাজ শুরু হয় গত শতকের ষাটের দশকে। সেখানে উপকূলের কাছে সাগরে তেল তোলা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। ভূ-ভাগে তেল তোলা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। এ তোলার কাজ ১৯৮৬ সালে চলছিল আটটি তেল ক্ষেত্র থেকে। এরপর থেকে তেল আহরণের কাজ বেড়ে চলে। এ ঘটনা ধারার সঙ্গে দেশটিতে হানাহানি-সংঘাত-যুদ্ধের এবং এসব হ্রাস-বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির জ্বালানি জরিপ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয় : কঙ্গোতে তেলের প্রমাণিত মজুদ বিপুল। গ্যাসও তেমন আছে। তেলের ওপর ভিত্তি করেই দেশটির সবল অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে। স্থলভাগে তেল-গ্যাস যা আছে, তাতে হাতের ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। উপকূলের কাছে তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে তেল তুলছে ফ্রান্সের পেরেনকো, জাপানের টেইকোকু, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন টেক্সাকো। স্থলভাগে, উপকূল অঞ্চলের কাছাকাছি জায়গা তেল তুলছে পেরেনকো এবং কঙ্গোর তেল কোম্পানির কোহাইড্রো। আরো ছয়টি ব্লক নির্দিষ্ট করে সেগুলোতে সন্ধান কাজ চালানোর জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার এনারগাল্ফ, যুক্তরাজ্যের সোকো এবং শিওরাস্ট্রিম নামের কোম্পানিকে। মধ্য সমতল অঞ্চলে উগান্ডা সীমান্তের লাগোয়া লেক কিভুতেও তেল রয়েছে। কিন্তু হ্রদের লাগোয়া এলাকায় উগান্ডা এরই মধ্যে ভালো মানের তেল তুলছে। ফলে এখানে বেড়েছে উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতা। কঙ্গোতে তেলসংশ্লিষ্ট নানাপর্যায়ের কাজে জড়িত রয়েছে শেল, ফিনা, টোটাল, এনজেন, কোবিল, কঙ্গো অয়েল ও কোহাইড্রো।

এ দেশটিতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি নথিতে বলা হয় : নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ২৬ ট্রিলিয়ন বা ২৬ লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানগুলো সবল করা ইত্যাদি উদ্যোগ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে। এজন্য দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সুবিধা। এ সুবিধার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ছাড়, মুনাফার ওপর করসহ বিভিন্ন কর রেয়াত, বিদেশী বিনিয়োগ ও সম্পদ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এ দলিলেই বলা হয় : কঙ্গোতে রয়েছে নগর অঞ্চলে অবস্থানরত বিপুল শ্রম। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চ বিদ্যালয় উত্তীর্ণ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক। তবে দক্ষ শ্রমের ঘাটতি রয়েছে। এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পুঁজি আনা-নেওয়া প্রসঙ্গে এ নথিতে বলা হয় : কঙ্গো থেকে পুঁজি রফতানিতে এবং অন্যত্র সরাসরি বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো নীতি নেই। অর্থাৎ  পুঁজির চলাচল অবাধ অনিয়ন্ত্রিত। এরই মধ্যে কঙ্গোতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে দেখা দিয়েছে শেভরন অয়েল (কোম্পানিটির সাবসিডিয়ারি কঙ্গো গাল্ফ অয়েলকে সঙ্গে নিয়ে), সিটি ব্যাংক, টেলেসেল, মবিল। এসব তেল, ব্যাংক আর টেলিফোন কোম্পানির সঙ্গে একইসারিতে রয়েছে বিয়ার তৈরির কোম্পানি ব্র্যালিমা ও ইউনিব্রা, সিগারেট তৈরির কোম্পানি টোবাকঙ্গো/রথম্যান ও বিএটিকঙ্গো, পাইকারি ব্যবসায়ী হাসন গ্রুপ, পাম তেল শোধনের কোম্পানি পিএলসি।

একটি দেশের সম্পদ প্রকৃত অর্থে লুট করার জন্য আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে বলেই দেখা যাচ্ছে। সম্পদ আছে, সে সম্পদ নির্বিঘ্নে লুট করার জন্য রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, এ সংক্রান্ত সব কাজ সুরক্ষার জন্য আছে আইনের আশ্রয়, আছে শ্রম, আছে মুনাফা সরিয়ে নেওয়ার পথে কোনো বাধা না রাখার আশ্বাস। এসবের মাথায় আছে অনুগত রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

কোম্পানিরা আসছে, বিনিয়োগ করছে, বিনিয়োগের জায়গা বাছাই চলছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শুরু হচ্ছে প্রতিযোগিতা। কেবল খেয়াল রাখা হচ্ছে, এই হুড়োহুড়িতে সবেমাত্র দাঁড় করানো কাঠামো যেন হুড়মুড় করে ভেঙে না পড়ে। এক দফায় লুট চলল বিনিয়োগ নিরাপদ করার আইন না মেনে, আক্ষরিকভাবেই লুট। কিন্তু তাতে কিছু বিনিয়োগকারীর অসুবিধা হয়। তাছাড়া ও পথে লুট পুরোমাত্রায় করা যায় না। তাই আয়োজন হয় গৃহযুদ্ধের আগুন নেভানোর। সে কাজে জাতিসংঘের সাহায্যও পাওয়া যায়। জাতিসংঘ শান্তি কায়েমের যে কাজটি করে দেয়, তার খরচ পড়ে কম। এ হিসাবও করেছে বার্তা সংস্থাগুলো। সব ঠিকঠাক চললে, স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে মুনাফা আহরণের হার খারাপ হয় না; গায়েও লেপ্টে থাকে না লুটেরার লেবাস।

কিন্তু পুঁজির প্রতিযোগিতা চলে। স্থিতাবস্থার কাঠামোর মধ্যেই চেষ্টা চলে প্রতিযোগিতার মীমাংসা করার। গোপন থাকে না বহু বিষয়। ফলে খবর বেরোয় : ব্রিটিশ তেল কোম্পানি টাল্লো ও ব্রিটিশ দূতাবাস বিতর্কিত চুক্তি সম্পাদনের চেষ্টা করছে। এ চুক্তি সম্পাদিত হলে কঙ্গো হারাতে পারে ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার। বিতর্কিত এ চুক্তিটি ফাঁস করে দেয় তেল বিষয়ে নজর রাখে এমন একটি সংগঠন। এ সংগঠনের নাম প্ল্যাটফর্ম।

এ কাজে প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ছিল আফ্রিকান ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি গভর্নেন্স। চুক্তিটি হচ্ছে প্রডাকশন শেয়ারিং এগ্রিমেন্ট বা উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি। প্ল্যাটফর্ম এ চুক্তিটি ফাঁস করে দেওয়ার পাশাপাশি একটি বিশ্লেষণও প্রকাশ করে। এ বিশ্লেষণে বলা হয় : অতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করা হয় চুক্তি মারফত। এর খেসারত দেবেন কঙ্গোর গরিব মানুষ। টাল্লোর চুক্তি বহাল হলে যে হাজার কোটি ডলার রাজস্ব সরকার হারাবে, সেটা দেশটির পুরো জাতীয় ঋণের সমান। এ চুক্তিটি সম্পাদনের জন্য টাল্লো এবং কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় ব্রিটিশ দূতাবাস জোর লবিং বা দেনদরবার করছে। চুক্তিটি সম্পাদিত হলে আফ্রিকার সব চেয়ে গরিবদের একাংশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ হস্তান্তরিত হবে ব্রিটিশ ও আইরিশ বিনিয়োগকারীদের কাছে। এ বিশ্লেষণ ছাড়াও প্ল্যাটফর্ম পরিকল্পিত চুক্তিটির কয়েকটি দিক তুলে ধরে, যা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণীয় নয়। যেমন তেল কোম্পানিগুলো ও সশস্ত্র উপদলগুলোর মধ্যে দোস্তি কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে আবার শুরু করবে সম্পদ দখলের লড়াই; প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে ফেলার আইনসম্মত অধিকার প্রদান; পরিবেশের কোনো ক্ষতি হলে দন্ড প্রদানের ব্যবস্থা একটুও নেই এবং চুক্তির এমন একটি ধারা, যা কঙ্গোর পরিবেশ ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাধা দেবে। এগুলো রয়েছে চুক্তির ২১, ২৪, ২৬, ২৭ ও ৩৩ পৃষ্ঠায়।

এমন আরো উদাহরণ পাওয়া যাবে। প্রতিযোগিতায় অনেক সময় স্বচ্ছতা থাকে না। যেমন দেশটির পূর্বাঞ্চলে ১ ও ২ নম্বর ব্লক দেওয়া হলো দুটি কোম্পানিকে। এ দুটি কোম্পানি মিলে গঠন করতে চলেছে স্থানীয় একটি কোম্পানি। এতে দু’কোম্পানির মালিকানা থাকবে ৮৫ শতাংশ আর কঙ্গো রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এতে কঙ্গোর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি কোহাইড্রোর কোনো অংশ নেই। সেই সঙ্গে বিদেশী কোম্পানি দুটিতে বিনিয়োগকারীদের পরিচয় জানানো হচ্ছে না। আবার এ দুটি কোম্পানি শুরু করেছিল একটি ট্রাস্ট। কোম্পানি দুটির একটি হচ্ছে লগ্নি বিনিয়োগকারী, অপরটি হচ্ছে শিল্প বিনিয়োগকারী। জেনেভার যে আইনজীবী এ কোম্পানি দুটির প্রতিনিধি এবং ট্রাস্টটি পরিচালনা করেন, তিনি পাওয়ার অব এটর্নি সংক্রান্ত কাগজপত্র হস্তান্তর করেছেন যাদের কাছে, তাদের আবার কোম্পানি দুটিতে কোনো অংশীদারিত্ব নেই। রয়টারের এক খবর বলা হয়, এ দুটি ব্লকের জন্য চুক্তি করেছে টাল্লো। সঙ্গে আছে হেরিটেজ ও কোহাইড্রো।পুরো ব্যাপারটি হয়ে উঠেছে বড্ড ঘোরপ্যঁাচের।

পুঁজির জগতই এমন। আইনের ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নানা দেওয়া-নেওয়া হয়, যা আইনের হাতে ধরা পড়বে না। আর এমন ঘোরালা-প্যঁাচালো দেওয়া-নেওয়া সহজ হয় অস্বচ্ছতার আবরণে। এ অস্বচ্ছতার আবরণ বিষয়গুলোকে জনসাধারণের চোখের আড়ালে রাখতে সাহায্য করে। একদিকে রাখা হয় ঘোরপ্যাচ, আরেক দিকে অস্বচ্ছতা। ফলে ‘আইনসম্মতভাবে’ লুটের কাজটি হয় সহজ।

এ ব্লক দুটিতে অর্থাৎ ১ আর ২তে ইতালির বড় তেল কোম্পানি এনিরও আগ্রহ রয়েছে। ফলে হয়তো আবার হবে লেনদেন এনির সঙ্গে ওই দু’কোম্পানির, কঙ্গোর তেল প্রবাহিত হবে নল দিয়ে, তেল বিক্রির মুনাফা উঠবে কয়েকজনের ঘরে এবং কঙ্গোর মানুষ এত কান্ডের কিছুই জানবেন না।

কঙ্গোতে স্বার্থ অনেকেরই। তেলের খোঁজ যতই পাওয়া যাচ্ছে, ততই স্বার্থ গভীর হচ্ছে, বাড়ছে আগ্রহ। কেবল প্রধান প্রধান শক্তিধর দেশ নয়, অন্যান্য দেশেরও স্বার্থ রয়েছে। কঙ্গোতে ২৫টি আন্তর্জাতিক খনি কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে কানাডার খনি কোম্পানিগুলোর প্রাধান্য রয়েছে। দেশটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মরক্কোর খনি কোম্পানি। এ তথ্য মার্কেটলাইন বিজিনেস ইনফরমেশন সেন্টারের, এংলোগেল্ডি অশান্তির এবং বিভিন্ন কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনের। এসব কোম্পানির বিনিয়োগ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ লাখ কোটি, লাখ কোটি ডলার। গৃহযুদ্ধের অস্থিরতায় এত বিনিয়োগ সম্ভব ছিল না। হানাহানি সংঘাতের ডামাডোলে সরাসরি লুট সম্ভব। শ্রমকে শৃঙ্খলে বেঁধে সম্পদ তুলে, অতিরিক্ত শ্রম আত্মসাৎ করে মুনাফা ঘরে তুলতে দরকার হয় স্থিতিশীলতা, কাঠামোর মধ্যে আটকে রাখা শান্তি। এ স্থিতিশীলতা, এ শান্তি পুঁজির, মুনাফার, বাড়তি মেহনত আত্মসাতের। মেহনতের প্রসঙ্গ আসছে এ কারণে যে, মেহনত যোগ না হলে মাটির গভীর থেকে কোনো সম্পদ তোলা হতো না। খনির গর্ভ থেকে সম্পদ আহরণে কল বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয়; কিন্তু সে কলও তো চালায় মেহনত, মানুষের মেহনত।

এত অর্থ যেখানে বিনিয়োজিত হয়, সেখানে আরো অর্থের উৎস রয়েছে। আর এত কোম্পানির এত অর্থ সেখানে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রেষারেষি উৎস হিসেবেও কাজ করে। আইনের কাঠামোর মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিযোগিতার, ভাগাভাগির মীমাংসা না হলে সে মীমাংসা হয় আইনের কাঠামোর প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-রীতির বাইরে। তখনই রাজনীতিতে আসে হানাহানি পিছু পিছু আসে রক্তপাত। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে খনির কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা এ বছরের গোড়ার দিকে তা তুলে নেন। ফলে কাজ শুরু হবে খনি থেকে সম্পদ আহরণের; শুরু হবে প্রতিযোগিতা, লেনদেন; তৈরি হবে আগামীর হানাহানি, রক্তপাতের পটভূমি। হয়তো গজিয়ে উঠবে নতুন নতুন বিদ্রোহী গ্রুপ। সব কিছুর আড়ালে থাকবে পুঁজির হাত।

কঙ্গোর ৫ নম্বর ব্লকে উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি (উভাচু) করেছে ডোমিনিয়ন পেট্রোলিয়াম, সঙ্গে আছে সোকো ইন্টারন্যাশনাল ও কোহাইড্রো। এ খবরও বার্তা সংস্থা রয়টারের। উগান্ডা সীমান্তে এ ব্লকে  তেল তোলা নিয়ে উগান্ডার সঙ্গে কঙ্গোর রয়েছে রেষারেষি। কঙ্গোর আটলান্টিক উপকূলে দুটি উভাচু করেছে শিওরস্ট্রিম নামের এক কোম্পানি। এ কোম্পানির প্রধান হচ্ছেন সেনেগালের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি এর আগে কঙ্গোয় শান্তি আলোচনায় সাহায্য করেছিলেন। কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট এক ডিক্রি বলে এ চুক্তির ব্যবস্থা করেন। লেনদেনটি চমৎকার নয় কি?

কঙ্গোয় আরো তেলের ও গ্যাসের খোঁজ চলছে। তেল কোম্পানিগুলো ধারণা করছে ভালো মানের অনেক তেল-গ্যাস পাওয়া যাবে; হয়তো তা হয়ে উঠবে আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি তেল-গ্যাস মজুদগুলোর অন্যতম। ফলে দেশটির আশপাশে দূরদেশী প্রভুর সৈন্যদের আনাগোনার খবরে কেউই অবাক হবেন না। কঙ্গোর মানুষও আশ্চর্যবোধ করবেন না। তেমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো কঙ্গোর জনগণের বিধিলিপি এ মুহূর্তে রচিত হচ্ছে কোনো দূর দেশের রাজধানীতে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তেল কোম্পানির সদর দফতরে, হয়তো কোনো সেনানায়ক ছক তৈরি করছেন সেনা মোতায়েনের। সম্পদ কি তা হলে দুর্ভোগ-রক্ত-কান্না ডেকে আনে?