Thursday, August 25, 2011

তেলের সঙ্গে গ্যাসও যেন উৎপাত (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-৯)

নাইজেরিয়ায় তেলের বা তেল নিয়ে নানা কর্মকান্ডের কথা এলে গ্যাসের প্রসঙ্গও আসে, যেমন কান টানলে আসে মাথা। নাইজেরিয়ার তেল সমৃদ্ধ নাইজার বদ্বীপ অঞ্চল সম্পর্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনের একটি অংশে উল্লেখ করা হয় গ্যাস বেরিয়ে পড়া ও গ্যাস পুড়ে তৈরি আগুনের লেলিহান শিখার প্রসঙ্গটি। এতে বলা হয় নাইজার অঞ্চলে ভূমির ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে পড়ে, এমন প্রমাণ রয়েছে। সে অঞ্চলের কোনো কোনো জলাভূমিতে বুদ্বুদ দেখা যায়; অর্থাৎ এর আবার আরেকটি অর্থ রয়েছে। সেটা হচ্ছে হাইড্রোকার্বন হয় তো পানিতে থাকা প্রাণে প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, তার পরে তা বেরিয়ে আসছে বায়ুমন্ডলে। বেরিয়ে আসা ও বায়ুমন্ডলে মিশে যাওয়া হাইড্রোকার্বনের পরিমাণ অজানা।
আবার বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৫ সালের এক প্রকাশনায় অনুমান ব্যক্ত করা হয় যে, স্থানীয় বাজার ও অবকাঠামো না থাকায় নাইজেরিয়ায় ৭৫ শতাংশ গ্যাস পুড়িয়ে ফেলা হয়। বিশ্বব্যাংকের এ অনুমান উল্লিখিত হয় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে। এভাবে গ্যাস পুড়িয়ে ফেলায় অক্সাইড অব কার্বন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড প্রভৃতি উপাদানও বাতাসে মিশে যায়। গ্যাস এভাবে পোড়ানোর ফলে এসিড রেইন বা অম্ল বৃষ্টিও একটি বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ করা দরকার যে, অম্ল বৃষ্টি হলে গাছ, দালানকোঠা ও প্রাণের ক্ষতি হয়। গ্যাস এভাবে পুড়িয়ে না ফেলার জন্য তেল শিল্পের বড় বড় কোম্পানি নানান পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। তেল আহরণে ব্যবহার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম ও যন্ত্রও অম্ল বৃষ্টির কারণ। গ্যাস কতটুকু, কিভাবে পোড়ানো হবে, সে ব্যাপারে নাইজেরিয়ায় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সে সব আইন লঙ্ঘনের আর্থিক দন্ডও নির্ধারিত আছে। তবে সেসব আর্থিক দন্ডের পরিমাণ এত কম যে, তা আইন লঙ্ঘনে নিরুৎসাহিত করে না। গ্যাস পোড়ালে বায়ু ও তাপ দূষণ ঘটে; তা নষ্ট করে প্রাণবৈচিত্র্য। এছাড়া পুড়িয়ে ফেলা গ্যাসের দামও উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষতি বিপুল। গ্যাস পোড়নোর সময় শব্দ হয়। তাপ বৃদ্ধি পায়। বেড়ে চলা তাপ মেরে ফেলে উদ্ভিদ, গুল্মলতা এবং বাধাগ্রস্ত করে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে। তা ফুল-ফল ধরার ক্ষেত্রে বাধা দেয়, কৃষি ফলন কমায়। যেখানে গ্যাস পোড়ানো হয়, তার চারপাশে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ দিন-রাত অবিরাম আলোর মধ্যে থাকে। অবিরাম আলো সবার জন্যই ক্ষতিকর। কেবল মানুষ ও প্রাণীরই নয় উদ্ভিদেরও কিছু সময় অাঁধার দরকার, প্রয়োজন বিশ্রাম কাল। এত আলো, এত তাপ, অবিরাম এ যাতনা পাখিদেরও ক্ষতি করে। আর মানুষেরই বেঁচে থাকার জন্য দরকার উদ্ভিদ, পাখি, নানা প্রাণী মিলে এমন এক জগত, যে জগতে আছে প্রাণবৈচিত্র্য।
মাটি দেবে যায় : তেল-গ্যাস আহরণের সঙ্গে এক শ্রেণীর অর্থনীতিতে জড়িত বণ্টনে বৈষম্য, লুট ছাড়াও এ আহরণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা হচ্ছে মাটি দেবে যাওয়া।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মান উন্নয়ন সংক্রান্ত এ প্রতিবেদনে বলা হয় : তেল ও গ্যাস বিপুল পরিমাণে আহরণ করলে মাটি দেবে যায়। তবে এ ব্যাপারে এখনো যা আভাস-সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা সামান্য। মাটি দেবে যাওয়ার সংশয় দেখা গেছে গুনডো অঙ্গরাজ্যের মোলুকে ও রিভারস অঙ্গরাজ্যের বনিত এবং বদ্বীপ অঞ্চলের কয়েকটি জায়গায়।
এ প্রসঙ্গে এ প্রতিবেদনে উল্লৈখ করা হয়- যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি বদ্বীপ অঞ্চলের কথা। সেখানে তেল ও গ্যাস আহরণের ফলে মাটি দেবে গেছে। মাটি দেবে গেলে ধারেকাছে নদীতীর, সাগরের বেলাভূমিতে ভাঙন বেড়ে যায়। নদীতীর-সাগরতটে ভাঙন বৃদ্ধির একটি ফলাফল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও স্রোত প্রবল হওয়া, এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। তবে এটাও বাস্তব যে, তেল ও গ্যাস আহরণ কাজে চলাচল ও যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়া সহজ করার জন্য খাল কাটা, সমুদ্রতট দিয়ে পাইপ বসানো, জেটি তৈরি, ইত্যাদি কাজের কারণেও তীরতট ভাঙন বেড়েছে।
এ ধরনের কাজ কারবারের ফলে যে সব ক্ষতি হয়, তার উদাহরণ দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওনডো অঙ্গরাজ্যে আউয়েতে এক তেল কোম্পানি একটি খাল কাটে। এ খাল কাটার উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির কাজ সহজ করা। অর্থাৎ চলাচল ও পরিবহন স্বচ্ছন্দ করে তোলা। কিন্তু সে খাল দিয়ে ঢুকে পড়ে নোনা পানি। তাতে ক্ষতি হয় ২০ হেক্টরেরও বেশি পরিমাণ জমির। আরেক তেল কোম্পানি ডেল্টা অঙ্গরাজ্যে তাদের স্থাপনা থেকে উপকূল পর্যন্ত পাইপ বসায়। আর সে কাজের ফল দাঁড়ায় প্রতিবেশ নষ্ট, নোনা পনির প্রবেশ, তট ভাঙন।
প্রাণ কি বাঁচে এভাবে, মানুষের জীবন ধারণ কি সহজ হয় এভাবে? না কি জীবন ধারণ হয়ে পড়ে কষ্টকর? এ সব প্রশ্ন ভেবে দেখা দরকার নয় কি? এসব কান্ড দেখে যদি কারো মনে হয় যে, গ্যাস বোধ হয় উৎপাত, তা হলে ভুল হবে কি?
বন ধ্বংস : তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য অনেক সময়ই বনের ভেতরে ঢুকতে হয়। কারণ হয় তো সেখানে মাটির নিচে রয়েছে তেল খনি বা গ্যাস ক্ষেত্র। বনে ঢোকার জন্য পথ তৈরি করতে হয়। তখন সে পথ গাছ চোরদের চলাচল সহজ করে দেয়। বেড়ে যায় গাছ চুরি, ধ্বংস হয় বন। এছাড়াও তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং আহরণের কাজে বন ধ্বংস হয়। বন অঞ্চলে এসব কাজ করার জন্য তৈরি করতে হয় নানান ধরনের স্থাপনা, পাততে হয় পাইপ, বসাতে হয় নানা যন্ত্রপাতি। এতে ধ্বংস হয় বনের সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য।
প্রাণবৈচিত্র্য ছাড়া বনের কথা কল্পনা করা যায় কি? গাছপালা, লতাগুল্ম, শ্যাওলা, ছত্রাক- এসবের ওপর নির্ভর করে থাকা নানা প্রাণী যেমন জীবজন্তু, পাখি, কীট, পতঙ্গ, ছাড়া কল্পনা করা যায় কি বন? সে বন ধ্বংস হলে? নাইজেরিয়ায় তেলসমৃদ্ধ এলাকায় এমন ধ্বংসের ঘটনাই ঘটেছে। আর বন যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট করার জন্য সামান্য কিছু তথ্য উল্লেখ করা যায়। জন বেলামি ফস্টার দ্য ভালনারেবল প্লানেট একটি ইকোনমিক হিস্টরি অব দ্য এনভায়রনমেন্ট (বিপন্ন পৃথিবী, পরিবেশের সংক্ষিপ্ত অর্থনৈতিক ইতিহাস নামে ঢাকায় সাহিত্য প্রকাশ বইটি প্রকাশ করেছে) বইতে লিখেছেন অনুমান করা হয়, বর্তমান বিশ্বে তিন কোটি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে যৎসামান্য ১৪ লাখ প্রজাতিকে চিহ্নিত এবং এ সবের তথ্য তালিকাভুক্ত করা গেছে। একটি প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার অর্থ… প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশের ধারা বিষয়ক তথ্য সম্ভার হারিয়ে যাওয়া। আর এসব তথ্য নতুন খাদ্য, ক্যান্সার মোকাবিলার নতুন ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর সন্ধান দিতে পারে। মানব জাতি বর্তমানে তার খাদ্য সরবরাহের ৮০ শতাংশের জন্য মাত্র ২০টি প্রজাতির ওপর নির্ভর করে। অথচ এখনো খাবার যোগ্য প্রায় ৭৫ হাজার প্রজাতির গাছপালা রয়েছে বলে জানা যায়। এসবের পুষ্টিমানও বিপুল…। মাত্র কয়েক বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্যাসিফিক ইউ গাছকে মনে করা হতো যে, এগুলো ‘আগাছা’। যারা বন কাটতো, তারা এ গাছ পুড়িয়ে ফেলত, আজ জানা গেছে, এ গাছ হচ্ছে এক ধরনের রাসায়নিক উপাদানের উৎস। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত যত ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া ঘটে জনসাধারণের জীবনে। পরিবেশ নষ্ট হলে সাধারণ মানুষের টিকে থাকা হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজের নিচের দিকে থাকা মানুষের বঞ্চনা বেড়ে চলে।
নাইজেরিয়ায় অধিকাংশ তেল স্থাপনায় বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে তেল শিল্পের তৈরি বর্জ্য পড়ে মাটিতে, জলে, বনে, সাগরে, জলায়। এর পরিণতি ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো বিধিবিধান না মেনে ৩০ বছরের বেশি কাজ চালিয়েছে তেল কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে শেল। পরিবেশ রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থাটি গঠন করা হয় ১৯৮৮ সালে। তবে বিভিন্ন ধরনের নিঃসরণ ও আবর্জনা ফেলার ক্ষেত্রে মান এবং বড় ধরনের সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশ নিরূপণের প্রয়োজন সংক্রান্ত আইন নববইয়ের দশকের গোড়ার আগে পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। কিন্তু ততদিনে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের ক্ষতি হয়ে গেছে বিপুল। এমনকি, তেল কোম্পানিগুলোর কাজ-কারবার ঠিক মতো দেখাশোনার সামর্থ্য সে দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর চেয়ে তেল কোম্পানিগুলোর সামর্থ্য ও সুবিধা বেশি। কোম্পানিগুলোর হাতে রয়েছে ভালো মানের ও হালনাগাদ তথ্য সংবলিত মানচিত্র, উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা ছবি, দূর ধাবন প্রযুক্তি, উন্নত কম্পিউটার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাবলী। পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের, বিশ্লেষণের ও উপস্থাপনের জন্য উন্নত কম্পিউটার ইত্যাদি দরকার হয়।
এ প্রতিবেদনেই বলা হয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সরঞ্জাম যন্ত্রপাতি এত অপ্রতুল, এত সেকেলে যে, স্থানীয় জনসাধারণের চোখেই তা ধরা পড়ে। তারা দেখেন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর (বক) সুউন্নত সূক্ষ্ম প্রযুক্তি, কর্মকৌশল। তারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন বকদের দেখে; তারা মনে করেন না যে, সরকারি সংস্থাগুলো জনসাধারণকে রক্ষা করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ পর্যন্ত প্রণীত নানান আইন, বিধিবিধানে কারাদন্ড, অর্থদন্ডসহ নানান দন্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের অভিযোগ, তারা এসব আইন বলবত হতে দেখেননি।
আবার দেখা গেছে, অর্থ দন্ডের যে পরিমাণের কথা আইনে উল্লেখিত হয়েছে, সে পরিমাণ অর্থদন্ড মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় ন্যায়পর নয়। আর নাইজেরিয়াকে মুদ্রাস্ফীতিপ্রবণ দেশ বললে ভুল বলা হবে না। এ মন্তব্যও ওই প্রতিবেদনের। এতে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষতির ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে যা পেয়েছে সেটা যৎসামান্য। পরিবেশ ক্ষতি বিষয়ে মামলা চলে দীর্ঘসময় ধরে- এমন উদাহরণ রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালত ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ প্রদানের আদেশ দেয়, সেটা ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি করা অর্থের পরিমাণের চেয়ে কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার রায় যায় তেল কোম্পানির পক্ষে। এর কারণ হিসেবে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তেল দূষণের ফলে দায়ের মাত্রা ও ক্ষতি নিরূপণের ব্যবস্থা না থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ : নাইজেরিয়ায় তেল কোম্পানিগুলোর রয়েছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অনেক ঘটনা। এমনকি প্রতিশ্রুতি কার্যকরভাবে পালিত না হওয়ার উদাহরণও অনেক। এক গ্রামের নাম ফিশ টাউন- মাছ শহর। গ্রামে কেবল কাঁচা ঘর, বসত গ্রামবাসীদের। শেভরণ টেক্সাকো বলেছিল, গ্রামে স্কুলের জন্য দালান, গ্রামবাসীদের সভা-সমিতি করার জন্য একটি হল, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানির কূপের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তৈরি করে দেওয়া হয়েছে কেবল একটি জেটি, নৌকাঘাটা। শ্বেতহস্তি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে যেমন ঘটে, সে নৌকাঘাটার ক্ষেত্রেও হলো তাই। তা হয়ে পড়ে অকেজো। কয়েক বছরের মধ্যে ভাঙন নৌকাঘাটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মূল ভূমি থেকে। এ গ্রামেরই কাছে আরেক গ্রাম, নাম তার সানগানা। শেভরন টেক্সাকো ও কোম্পানিটির শরিকরা সেখানে ২০০১ সালে হাসপাতাল তৈরি করে দেয়। কিন্তু সেখানে নেই কোনো ডাক্তার, নেই কোনো ওষুধ। এ তথ্যও ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে।
এ যেন প্রতিশ্রুতির খেলা। আর খেলা সাধারণ মানুষকে নিয়ে। এ খেলা কেবল নাইজেরিয়ায়, তা নয়। এ খেলা চলে প্রায় সব দেশে।
নানা দেশ থেকে তেলসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ লুট আর বিনিময়ে চাপিয়ে দেওয়া দারিদ্রে্যর দুর্ভোগের বিবরণ শেষ হওয়ার নয়। এ বিবরণের রয়েছে নানা দিক। এর সঙ্গে জড়িত অনেক পক্ষ, অনেক কর্মকৌশল। কেবল চুক্তির বিবরণ আর তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা লুটের প্রতারণার পন্থাগুলোর বিবরণই দীর্ঘ। এখন সে সবে না গিয়ে অন্যান্য দেশে তেল-গ্যাস-প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। আগামীতে থাকবে এমন আরেক দেশের কথা।

Thursday, August 18, 2011

দুর্দশা নারীদের : ক্ষতি পরিবেশের (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-৮)

নাইজেরিয়া আর তেল নিয়ে আলোচনায় যুবকদের প্রসঙ্গ বারবার আসে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির নাইজার বদ্বীপ অঞ্চল সংক্রান্ত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেও প্রসঙ্গটি এসেছে, যা ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে নারীদের প্রসঙ্গটিও স্থান পায়। এতে বলা হয় : তেলসমৃদ্ধ নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে দারিদ্রে্যর বোঝা বেশি বইতে হয় নারীদের। এ বোঝা সবচেয়ে আগে এসে পড়ে তাদেরই ওপর। চাকরি, স্বাস্থ্য, পানি, শিক্ষা, পরিবেশ, নানান ক্ষেত্রে যা কিছু সমস্যা, অপ্রাপ্তি, সংকট, টানাটানি, অভাব সবই আগে চাপে নারীদের ঘাড়ে। বঞ্চনার এত ব্যাপকতা, বিস্তৃতি, গভীরতা তাদের জড়িয়ে ফেলে সংঘাতে।
শেল পেট্রোলিয়াম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির ২০০২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে নারীদের প্রতিবাদের একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। সে ঘটনার বিবরণ সংক্ষেপে হচ্ছে : আগস্টের একদিন বিপুলসংখ্যক নারী ব্যারিকেড তৈরি করেন ওয়্যারিতে এ কোম্পানির কার্যালয়ের গেটের সামনে। কোম্পানি ঠিকাদারের মাধ্যমে গাড়ি ব্যবহার করে। গাড়ি ও চালকদের যোগান দেয় ঠিকাদার। এ চালকদের সঙ্গে ঠিকাদারের বিরোধ হয়। চালকরা এ বিরোধ নিরসনে গেটের সামনে সমবেত হন। তারা নারীদেরও সমবেত করেন। তাদের হটিয়ে দিতে পুলিশ ডাকা হয়। পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে। এক বিবরণে বলা হয়, একজন নারী গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকজন নারীর খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে পরে আরেক অনুসন্ধানে এ বিবরণের সমর্থন পাওয়া যায়নি। চারজন নারী জানান, তাদের প্রহার করা হয়েছে। মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনে বলা হয় : তেল আহরণের এলাকাগুলোতে পতিতাবৃত্তির বিস্তার ঘটে। পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন এইচআইভি/এইডসে।
পরিবেশ : দারিদ্রে্যর সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তবে কেবল গরিব দেশগুলোতেই পরিবেশ সমস্যা আছে তা নয়, ধনী দেশগুলোতেও পরিবেশ সমস্যা রয়েছে। নাইজেরিয়াকে যেদিক থেকেই গণ্য করা হোক, সেখানেও পরিবেশের সমস্যা রয়েছে। এ লেখায় নাইজেরিয়ার সার্বিক পরিবেশ সমস্যার ওপর আলোকপাত না করে তেল সম্পদ নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে, নাইজার অঞ্চলের পরিবেশ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্যা, পলি জমে জলপ্রবাহ পথ বন্ধ হওয়া, নদী তীর ও বেলাভূমি ভাঙন, বসত গড়ে তোলা ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজের উপযুক্ত জমির অভাব ইত্যাদি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে তেল আহরণ সংশ্লিষ্ট পরিবেশ সমস্যাগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। ওলোইবিরিতে ১৯৫৮ সালে প্রথম বারেরমতো তেল আহরণ শুরু হলো, তারপর থেকে খনন করা হয়েছে এক হাজার ৪৮১টিরও বেশি তেলকূপ, গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫৯টি তেল ক্ষেত্র, সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি পাইপলাইন বা তেল নল ও ফ্লো লাইন বা প্রবাহ নল পাতা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে ২৭৫টি ফ্লো স্টেশন বা প্রবাহকেন্দ্র। এগুলো করেছে ১৩টি তেল কোম্পানি। তেল উৎপাদনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তেল উৎপাদনের পরিবেশগত প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও বৃদ্ধি পায়। নাইজার অঞ্চলের পাঁচ শতাংশ জমি রয়েছে তেল শিল্পের হাতে। সংখ্যার বিচারে এ পরিমাণ জমি কম হলেও তার পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ব্যাপক ও সমগ্র অঞ্চলজুড়ে। তেল আহরণের ফলে পরিবেশের যেসব ক্ষতি হয়, সেগুলোর কয়েকটি চোখে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, এ সবের মধ্যে রয়েছে মাটি, ভূপৃষ্ঠের ও ভূগর্ভের জল, বাতাস দূষিত হয়ে পড়া। কিন্তু এগুলো ছাড়াও প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পড়ে আর্থসামাজিক অবস্থার ওপরে।
চলাচলের জন্য সময় যাতে কম লাগে এবং সহজে তেল ক্ষেত্রগুলোতে ও স্থাপনাগুলোতে যাওয়া যায় সে উদ্দেশ্যে তেল কোম্পানিগুলো খনন করে খাল। এসব খাল দিয়ে মিঠা পানির এলাকায় ঢুকে পড়ে নোনা পানি। ফলে ধ্বংস হয় মিঠা পানি এলাকার প্রতিবেশ। নতুন নতুন এলাকায় ঢোকা সহজ হয়ে ওঠায় বনের গাছ বেআইনিভাবে কাটা বৃদ্ধি পায়। তেল কোম্পানিগুলো কাটা খাল, নদী ইত্যাদি জলপথের নাব্যতা বজায় রাখতে এগুলো অবিরাম ড্রেজিং করে বা পলি ইত্যাদি সরায়। সরিয়ে নেওয়া পলি, মাটি, কাদা ফেলা হয় দুই তীরে। এতে এসব জমির জলপ্রবাহ বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়, বাধা পায় পানির অবাধ প্রবাহ, তৈরি হয় ছোট ছোট জলাশয় বা পুকুর। ভাটিতেও প্রতিবেশের ক্ষতি হয়।
তেল উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও বেড়ে চলে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কখনো তেল ছড়িয়ে পড়ে দুর্ঘটনাবশত, কখনো স্থানীয় লোকদের ইচ্ছাকৃত কাজের ফলে। সরকার আর তেল কোম্পানিগুলোর কাজের প্রতিবাদ হিসেবে জনসাধারণ এ ধরনের অন্তর্ঘাত চালান।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৮১৭টি। এতে আনুমানিক ৩০ লাখ ব্যারেল তেল নষ্ট হয়েছে। এ তেলের ৭০ ভাগের বেশি উদ্ধার করা যায়নি। ছড়িয়ে পড়া তেলের ছয় ভাগ স্থলভাগে, ২৫ ভাগ জলাভূমিতে আর ৬৯ ভাগ সাগর তীরের কাছে পরিবেশ-প্রতিবেশে।
শেল পেট্রোলিয়াম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির ২০০৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩শ’র বেশি। তেল ছড়িয়ে পড়ার পরিবেশগত প্রভাব প্রতিক্রিয়া বহুল আলোচিত বিষয়। জলাভূমি, বনাঞ্চল ইত্যাদি জায়গায় তেল ছড়িয়ে পড়লে বন ধ্বংস হয়, গাছপালা, মাছ, পাখিসহ নানা প্রাণী মারা যায়। খাদ্যে বিষক্রিয়াও ঘটে। এসব বক্তব্য উল্লেখ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালের ১ আগস্ট অনডো অঙ্গরাজ্যে সমুদ্র তট বরাবর উবালে কেরেরের কাছে তেল কোম্পানি শেভরনের এওয়ান তেল ক্ষেত্রে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে ছয়টির বেশি বসত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় মাছপ্রাপ্তির এলাকাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এসব এলাকার বাসিন্দাদের আয়ের উৎস মাছ ধরা। তাই নিজেদের দুর্ভোগের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে জনসাধারণ অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আকুরেতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘন ঘন ঘটতে থাকা এবং তেলশিল্প সংশ্লিষ্ট নেতিবাচক পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া জনমনে উদ্বেগ তৈরি করে। তা জনাসাধারণকে করে তোলে বিক্ষুব্ধ।
নাইজেরিয়ায় তেলের প্রসঙ্গ উঠলে দেশটিতে গ্যাসের নানা দিকও এসে পড়ে। আগামীতে সেই গ্যাস প্রসঙ্গ।

Thursday, August 11, 2011

যে কারণে নাইজেরিয়ায় যুব সংঘাত (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-৭)

তেলকে কেন্দ্র করে সংঘাতে কোনো কোনো তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, সেসব কোম্পানি স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সমঝোতার শর্তগুলো সবসময় মেনে চলে না। এমন বক্তব্য উল্লিখিত হয়েছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির নাইজার অঞ্চল সংক্রান্ত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে।
আরো অভিযোগ রয়েছে যে, তেল সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের প্রতিবাদের নামমাত্র চিহ্ন দেখামাত্র তাদের হত্যা ও জখম করার উদ্দেশ্যে তেল কোম্পানিগুলো সশস্ত্র পুলিশদের ডেকে আনে।  কোনো ব্যক্তি বা সার্বিকভাবে এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেল কোম্পানির মতভেদ দেখা দিলে লঙ্ঘিত হয় ব্যক্তির বা এলাকার জনসাধারণেরই অধিকার।
বিরাজমান এসব বাস্তবতা ফুটে ওঠে ২০০৪ সালের মধ্য এপ্রিলে পোর্ট হাইকোর্টে যুবকদের এক সম্মেলনে দেওয়া নাইজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওলাসেগুন ওবাসানজোর এক বক্তৃতায়। এ বক্তৃতায় ওবাসানজো নাইজার অঞ্চলে বিপুল তেলসম্পদের সঙ্গে অঞ্চলটির উন্নয়ন ও স্বয়ম্ভরতার তুলনা করেন। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে আমি স্বীকার করছি যে, সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতাহীনতা, দূরদৃষ্টির অভাব ও প্রতিশ্রুতির অভাবে কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর চোখে পড়ে না। বরং যা পাওয়া গেছে, সেটা হচ্ছে ব্যর্থ নীতিমালার ফসল। আর তা প্রকাশিত হয়েছে সড়ক ও বিদ্যুৎসহ মৌলিক অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, বিপুলসংখ্যক বেকার, পরিবেশ অবক্ষয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। এর ফলে দিনে দিনে জমে ওঠা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ক্রোধ, সহজেই সহিংসতার পথ অবলম্বন। তিনি বক্তৃতায় ‘সংশ্লিষ্ট সব’ বলতে সরকার, তেল, গ্যাস কোম্পানি প্রভৃতিকে বোঝান।
সংঘাতে সরকারও জড়িয়ে পড়ে। তেল কোম্পানিগুলোকে পুলিশ বাহিনী রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। এর ফলে মৃদু প্রতিবাদের সম্মুখীন হওয়ামাত্র ব্যবহৃত হয় প্রবল শক্তি। নিরাপত্তা বাহিনী শান্তি রক্ষা করবে বলেই মনে করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করায় বাহিনী বলপ্রয়োগ করে, আর তা তৈরি করে সংঘর্ষ। এ দ্বিতীয়পর্যায়ে সংঘর্ষ এগিয়ে চলে নিজ পথ ধরে। কখনো কখনো তা হয়ে ওঠে মূল সংঘাতের চেয়েও হিংস্র।
এমনই ঘটনা ঘটেছিল ওলেতে। পুলিশ বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয় ওলে শহর। সামরিক বাহিনী নিয়োগ করলে তাও হয়ে ওঠে ধ্বংসকর। ওডির যুবকরা পাঁচজন পুলিশ অপহরণ করে। ফলে সৈন্যরা প্রবেশ করে শহরটিতে। তারপর সৈন্যরা শহরটি ধ্বংস করে। ইজো শহরে যুবকরা কয়েকজনকে জিম্মি করে। ফলে শহরটিতে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করা হয। তবে আতঙ্ক ধরানো এসব ব্যবস্থা যুবকদের নিবৃত্ত করে না; বরং পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। সরকারের ব্যর্থতাও সহিংস সংঘাতে উস্কানি দেয়। এসব ঘটনার মাসুল গুনতে হয় আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে। ঘন ঘন সংঘাত, তার সঙ্গে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রবল অবস্থান গ্রহণ, অস্ত্রের ছড়াছড়ি গোটা অঞ্চলে এমনকি সারাদেশে তৈরি করে নিরাপত্তাহীনতাবোধ। জানমালের প্রতি গুরুতর হুমকি দেখা দেওয়ায় গোটা অঞ্চলে, এমনকি সারা নাইজেরিয়ায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীভিত্তিক আধা সামরিক বাহিনী। এরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, অনুসরণ করে জঙ্গলের বিচার। যে যুবকদের উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত করা যেত, তারাই হয়ে ওঠে সংকট জর্জরিত এক প্রজন্মের প্রতিনিধি, রোধ আর উদ্ধার ‘শিল্পে’র চর। এ শিল্প তাদের ‘চাওয়ামাত্র পাওয়া’ অর্থের যোগান দেয়। এসব কথা লেখা হয়েছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, এমনকি সংকট মেটাতে পাঠানো সেনাবাহিনী কখনো কখনো হয়ে ওঠে মানবসত্তা অবনতির কারণ যেমন ঘটেছিল ওডিতে। মানবসত্তা অবনতির একটি উপকরণ ধর্ষণ। ওডিতে ব্যাপকসংখ্যক নারী ধর্ষিতা হন সৈন্যদের হাতে। অথচ ওডিতে সেনাদল পাঠানো হয়েছিল শান্তি নিশ্চিত করতে। দু’বছর পরে এলাকাটি ভরে ওঠে পিতৃপরিচয়হীন শিশুতে। মানব মর্যাদার ওপর আঘাতের পাশাপাশি ছড়ায় এইচআইভি রোগ। এ পরিস্থিতি বাড়তি বোঝা চাপায় নারী ও যুবকদের ওপর।
ওই প্রতিবেদনে একথাও উল্লেখ করা হয়, যুবকদের মধ্যে যে সংকট দেখা দেয়, তার একটি প্রকাশ ঘটে ১৯৬৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ইজোতে শুরু হয় ১২ দিনের বিপ্লব। একদল যুবক নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের ইজো এলাকাকে ‘নাইজার ডেল্টা পিপলস রিপাবলিক’ বা ‘নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের জনপ্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল এলাকাটিকে মুক্ত করে পেট্রোলিয়াম সম্পদের সুবিধাপ্রাপ্তি। এ যুবদল তেলের পাইপলাইনগুলো উড়িয়ে দেয। কিন্তু ১২ দিনের মধ্যে দলনেতা ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিচার হয়। বিচারে তাদের মৃত্যুদন্ড হলেও পরে তা মার্জনা করা হয়।
ওগোনি ও অন্যান্য অঞ্চলেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। সেটা শুরু হয় নববইয়ের দশক থেকে। স্থানীয় পর্যায়ের সংঘাতগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। তা হচ্ছে : প্রতিবাদ ছিল প্রধানত তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল রিভারস অঙ্গরাজ্যে উনুয়েচেমে বিক্ষোভ। সেখানকার তরুণরা ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এ বিক্ষোভ করে। তাদের বিক্ষোভ ছিল তেল কোম্পানি শেল অয়েলের বিরুদ্ধে। আর বিক্ষোভের কারণ তাদের এলাকায় তেল আহরণের ফলে পরিবেশের ক্ষতি এবং উন্নয়ন না ঘটা। শেল অয়েলের আমন্ত্রণে বিক্ষোভ দমনে আসে পুলিশ। একজন পুলিশ কর্তা নিখোঁজ হন। সন্দেহ করা হলো যে, যুবকরা বিক্ষোভকালে তাকে হত্যা করেছে। ফলে পুলিশ পাঠালো এলাকায় দমন দল। এর তান্ডবে এলাকায় জানমালের বিপুল ক্ষতি হয়।
এ ধরনের বিক্ষাভ, প্রতিবাদ, দমন, নৃশংসতা, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির বিবরণ কম নয়। এসব বিক্ষোভ অনেকাংশেই স্বতঃস্ফূর্ত, অপরিকল্পিত, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া। কিন্তু এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধে বিবর্তন ঘটে, ঘটে বিকাশ। তেমনই ঘটনা দেখা গেল ১৯৯০ সালে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনেই এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। শিক্ষিত, উচ্চবর্গের মানুষ ১৯৯০ সালে গঠন করেন মুভমেন্ট ফর দ্য সারভাইভাল অব ওগোনি পিপল, ওগোনি জনগণের বেঁচে থাকার আন্দোলন। সে বছরের শেষ ভাগে এ আন্দোলন পেশ করে ওগোনি বিল অব রাইটস নামে একটি দলিল। এ দলিলে সুস্পষ্টভাবে পরিবেশগত ও সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকারগুলোর ভিত্তিতে দাবিনামা ব্যক্ত করা হয়। অল্প কালের মধ্যে গড়ে ওঠে যুব শাখা। এ যুব শাখা প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত করা শুরু করে। এসব প্রতিবাদ বিক্ষোভ বহুলাংশে ছিল শান্তিপূর্ণ। তবে ১৯৯৪ সালের ২১ মে পর্যন্তই তা ছিল শান্তিপূর্ণ। সেদিন আরেক দল যুবকের আক্রমণে নিহত হয় এ দলের চার যুবক। এ ঘটনা চূড়ান্ত রূপ নেয় এক ওগোনি যুবকের ফাঁসির মধ্য দিয়ে। সেই থেকে ওগোনিল্যান্ডে শুরু হয় যুব বিদ্রোহের সংকট। এর বহুলাংশে রয়েছে পরিবশ আর জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে তেল আহরণ করায় তেল কোম্পানিগুলোকে বাধা দেওয়া।
যুব বিদ্রোহের সংকটের বিস্তার নিয়ে ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এ বিষয়টি তেল আহরণের ক্ষেত্রে তেল কোম্পানিগুলোর অনুসৃত পন্থার উপজাত বলেই মনে হয়।
এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইজো যুব পরিষদের কথা। কয়েকজন ইজো যুবকের বৈঠকের পরে বিস্তার ঘটে এ সংকটের। এ যুবকরা ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর এই বৈঠকে মিলিত হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রণীত হয় কাইয়ামা ডিক্লারেশন বা কাইয়ামা ঘোষণা। এ ঘোষণায় সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সুদূর প্রসারী সব দাবি জানানো হয়। এ যুবকরা দাবি তোলে, উত্থাপিত বিষয়গুলোর নিরসন না হলে ১৯৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সব তেল কোম্পানিকে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চল ছেড়ে যেতে হবে। ইজো অধ্যুষিত প্রধান প্রধান শহরে আয়োজন করা হয় র‌্যালি। কিন্তু অবশেষে এ বিদ্রোহ দমন করা হয় নির্মমভাবে।
ওগোনি বিল অব রাইটস, কাইয়ামা ডিক্লারেশন এবং উরহোবো ও ইটসেকিরিসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কর্তৃক বিভিন্ন বিল বা রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নের পর থেকে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ বা আধা সামরিক দল। এ তথ্য উল্লেখ করে উপরোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব আধা সামরিক দল স্ব স্ব জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে বলে দাবি করে। এ আধা সামরিক দলগুলো কেবল নাইজার বদ্বীপে সীমাবদ্ধ নয়। ইয়োরুবাল্যান্ডে রয়েছে উড়ুয়া পিপলস কংগ্রেস, ইবোল্যান্ডে রয়েছে যাকাসি বয়েজ, নাইজেরিয়ার উত্তর অঞ্চলে রয়েছে এরেওয়া পিপলস কংগ্রেস। নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের আধা সামরিক গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হচ্ছে এগবেসু বয়েজ অব আফ্রিকা, কাইয়ামা ডিক্লারেশনের পরে এ সংগঠনের উত্থান। ইজোদের পরিবেশগত ও সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারগুলো রক্ষার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে এ সংগঠন। এসব আধা সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরন রয়েছে বলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, এ ধরনের কোনো কোনো সংগঠনের ভিত্তি হচ্ছে জাতিগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীগত সীমানা। বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে এদের বিপুলসংখ্যক অনুসারী। আবার কোনো কোনো আধা সামরিক গোষ্ঠীর আয়তন সীমিত। এগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এমনই সংগঠনের গড়পড়তা উদহারণ হচ্ছে নাইজার ডেল্টা ভলান্টিয়ার ফোর্স। এটি গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্ব করেন রিভারস স্টেটের আসারি ডোকুবো। এ সংগঠনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি এবং সে মুক্তি অঞ্চলটির তেল সম্পদের মালিকানা ও তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্জন করা।
প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, কেন এ যুব বিদ্রোহ, কেন এ যুব অসন্তোষ? তেল সম্পদ আহরণের সঙ্গে কি এর সম্পর্ক? তেল-গ্যাস আহরণ নিয়ে আলোচনায় এ বিষয়টি উল্লেখের কারণ কি?
মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক ওই প্রতিবেদনে বলা হয় : এর কারণ হিসেবে নানা অভিমত রয়েছে। নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের বাইরে মনে করা হয় যে, এসব হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অশুভ ব্যাপার স্যাপার। এর বিপরীতে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে মনে করা হয় যে, এসব অনিবার্য ঘটনা ধারা, কখনো কখনো তা অশুভ চরিত্র গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট ওবাসানজোর অভিমত আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সাবেক গভর্নর আলামিয়েসেইঘার মতামত এ সংঘাতের মিশ্র দিক তুলে ধরে।
তিনি ২০০৫ সালে এক বক্তৃতায় বলেন : ‘সাম্প্রতিক কালে সম্মেলনের পর সম্মেলন, রিপোর্টের পর রিপোর্ট, কমিশনের পর কমিশন চেষ্টা করেছে তারই সমাধান করতে, যা অভিহিত হয়েছে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের যুব সংকট হিসেবে। অথচ সামাজিক সংঘাত কমছে না। এসব সংঘাতের প্রধান চরিত্র যুবকরা। তারা পরিস্থিতিকে যেদিকে নিয়ে গেছে, তাকে এখন অভিহিত করা হয় যুব অসহিষ্ণুতা হিসেবে। স্পষ্টভাবে বলতে হয়, এ যুব অস্থিরতা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে বিরাজমান আর্থসামাজিক অবস্থায় অসহিষ্ণু হওয়া ছাড়া যুবকদের আর কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র সমস্যা হচ্ছে, কখনো কখনো তারা সীমা ছাড়িয়ে গেছে আর অনুসরণ করেছে সেসব পথ, যা নিয়ে গেছে সহিংসতায় ও আইনহীনতায়। তা না হলে, তাদের লক্ষ্য মহান এবং তা তাদের চালিত করে তাদের ভবিষ্যৎকে সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করার দিকে।
এভাবে দেখা যাবে বিষয়টি বা সমস্যাটি নিয়ে নানা অভিমত। সমস্যাটিকে কেবল যুবকদের সমস্যা হিসেবে দেখা হলে তা বাস্তবতার ধারে কাছে যাবে না, কারণ ১. সমস্যাটি এলো কোথা থেকে? তা তো আকাশ থেকে যুবকদের মাথায় ঢোকেনি, ২. সমস্যাটির সঙ্গে যুক্ত আর কোন কোন বিষয়? সমস্যা তো কেবল যুবকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ৩. সমস্যাটি কি কেবল যুবকদের বিষয়গুলোকেন্দ্রিক? যুবকরা যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছে, সেগুলো তো বৃহত্তর আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এবং এ প্রেক্ষাপটে সেগুলো বৃহত্তর ও মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে যুক্ত, ৪. যুবকরা কেন অসন্তুষ্ট বা অস্থির বা অধৈর্য হয়ে উঠছে? কেবল যুবকরা নয়, সার্বিকভাবে কোনো মানুষই সহজে বা অল্প কারণে অস্থির-অধৈর্য হয়ে ওঠেন না।
এভাবে প্রশ্ন করে করে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে এ সমস্যাটির সঙ্গে যুক্ত যত দিক, বিষয়, পক্ষ তাতে আর এটিকে যুবসমস্যা বা যুবসংকট বলা যায় না। সমাজের অন্যান্য অংশও প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে সময়, সুযোগ, সাধ্যমতো। আগামীতে সে দিকটি তুলে ধরা যাবে।

Thursday, August 4, 2011

অস্ত্র আর সংঘাত যে দেশে বাস্তবতা (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-৬)

এত তেল সম্পদের মধ্যেও হানাহানি-সংঘাত যেন নাইজেরিয়ার ‘স্বাভাবিক’ বাস্তবতা। ট্রেড অ্যান্ড পলিটিক্স ইন দ্য নাইজার ডেল্টা এইটিন থার্টি টু এইটিন এইটি ফাইভ বইতে কেও ডাইক জানান, নাইজার বদ্বীপে অধিকাংশ শহর গড়ে ওঠে ১৪৫০ সাল থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে, ইউরোপীয় বাণিজ্যের পর্বে। পামঅয়েল বাণিজ্যের কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা বা ফড়িয়ারা হয়ে ওঠে একটি শক্তিধর শ্রেণী। কালক্রমে এদের ও স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় সে সময় নাইজার বদ্বীপ শাসনের জন্য ভারপ্রাপ্ত রয়্যাল নাইজার কোম্পানির। তা বিদ্রোহে রূপ নেয়। কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার নাইজেরিয়া সরাসরি শাসনের দায়িত্ব নেয়। ঔপনিবেশিক-পূর্ব ও গোটা ঔপনিবেশিক, এ দুই পর্বজুড়ে নাইজার বদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষি ও মাছ।
ভি আলমিয়েসেইঘা তার থটস অন ফেডারেলিজম, সাউথ-সাউথ অ্যান্ড রিসোর্স কন্ট্রোল বইতে বিশ্ব ব্যাংকের ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লিখেছেন : প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয় যে, কৃষিক্ষেত্রে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কাঠ হয়ে ওঠে এক বিশাল পণ্য। সে সময় উৎপাদিত হতো পামঅয়েল, নারকেল শাঁস, রাবার, কোকো ও কাঠ। এসব পণ্য উৎপাদিত ও রফতানি করে উপার্জিত হতো বিদেশী মুদ্রা। ইউনাইটেড আফ্রিকান কোম্পানির সাবসিডিয়ারি আফ্রিকান টিম্বার অ্যান্ড প্লাইউড কোম্পানি কাঠ প্রক্রিয়া করার বিশাল কারখানা স্থাপন করে সাপেলে নামের জায়গায়। সেটাই ছিল সে সময় আফ্রিকায় এ ধরনের বৃহত্তম কারখানা। নাইজেরিয়া ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিল বিশ্বের বৃহত্তম পামঅয়েল উৎপাদক, নাইজেরিয়ায় পামঅয়েল উৎপাদন দেখেই মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ নাইজেরিয়া থেকে পামঅয়েল উৎপাদন শেখে। আজ মালয়েশিয়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পামঅয়েল উৎপাদক দেশ, আর, শীর্ষস্থানীয় পামঅয়েল রফতানিকারক দেশগুলোর তালিকায় নাইজেরিয়ার নাম মুছে গেছে। এ তথ্য জানায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন।
এই প্রতিবেদনেই বলা হয় : পামঅয়েল উৎপাদনের অবস্থা আজ নাইজেরিয়ায় এমন স্তরে নেমেছে যে, বহু পামগাছ থেকে তেল আর আহরণই করা হয় না, নতুন পামগাছও লাগানো হয় খুব কম। রাবার আবাদ যেন পুরনো দিনের ছায়া, নদীর পানি আর মাটিকে তেল এমনভাবে দূষিত করেছে যে, ফসল আর মাছপ্রাপ্তিও গেছে কমে।
এতে আরো বলা হয় : মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে সহিংস রাজনৈতিক সংঘাত ষাটের দশকে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা যায়নি। ফলে ধসে পড়ে স্বাধীন নাইজেরিয়ার প্রথম সরকার। সেটা ১৯৬৬ সালের ঘটনা। নাইজেরিয়ায় ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে যে গৃহযুদ্ধ, তা সারা দেশে বিস্তার ঘটায় ক্ষুদ্র অস্ত্রের, বিরোধ মীমাংসায় অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। নাইজার বদ্বীপ অঞ্চল সংঘাত দীর্ণ হয়ে ওঠে নববইয়ের দশক থেকে। সংঘাত চলে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, সম্প্রদায়ের মধ্যে, জাতিগত ক্ষেত্রে, তেল কোম্পানির ও জনবসতের মধ্যে। তেল সার্ভিস কোম্পানি আরকোর সঙ্গে বিরোধ দেখা হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। সে বিরোধ গড়িয়ে চলে; একপর্যায়ে তা স্থানীয় বাসিন্দাদের দুই বিবদমান দলে বিভক্ত করে।
ওজেবি ওজোর লেখা দ্য নাইজার ডেল্টা ম্যানেজিং রিসোর্সেস অ্যান্ড কনফ্লিক্টস বইতে বলা হয়েছে : তরুণদের মধ্যে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, মিলিয়ন মিলিয়ন (দশ লাখে এক মিলিয়ন) নায়রা (নাইজেরীয় মুদ্রা) দামের সম্পত্তি ধ্বংস হয়, বন্দুক হাতে কিশোররা হয়ে ওঠে সশস্ত্র ডাকাত, চাঁদাবাজ।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির উপরোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘নেমবে যুদ্ধ’ নামে এক ধরনের সংঘাত দেখা দেয়। শেল, এগিপ, প্রভৃতি কোম্পানি নেমবেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ প্রদান কন্ট্রাক্ট বা ঠিকা কাজ দেওয়া ও চাকরি দেওয়ার চুক্তি করে। সচরাচর যেমন ঘটে, সেভাবেই গোত্র বা সমাজপ্রধান প্রাপ্ত সুবিধার বেশিরভাগ রেখে দেয় নিজের ভাগে। বেশিরভাগ অর্থ নেয় তারা। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পায় অধিকাংশ ঠিকা কাজ। এমনকি সর্দার বা প্রধানদের সুপারিশ পেলেই চাকরি পাওয়া যেত। যে যুবকরা এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ল, তারা নববইয়ের দশকে সংগঠিত হলো এ লেনদেনের মধ্যে ঢোকার জন্য। তারা তেলকর্মীদের হয়রানি করা, জিম্মি হিসেবে আটক রাখা, তেল প্রবাহ কেন্দ্র দখল করা এবং এ ধরনের নানা কাজ শুরু করল। তেল কোম্পানিগুলো যাতে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ও পয়সাকড়ি দেয়, সেই উদ্দেশ্যে তারা এসব কাজ শুরু করে। প্রাপ্ত পয়সাকড়ির পরিমাণ এত বেশি যে এ যুবকরা আরো ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে পড়ে এবং প্রতিটি ছোট দল আলাদা আলাদাভাবে দাবি জানাতে থাকে। দেখা দেয় প্রতিদ্বন্দ্বী সব গ্যাং বা দল। উদ্ভব ঘটে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের চাঁদাবাজ দল সব। এরাও তরুণ। তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এরাও চাঁদা দাবি করতে থাকে। একবার, প্রথম প্রজন্মের চাঁদাবাজরা গেছে চাঁদার অর্থ আদায়ে অঙ্গরাজ্যের সদরে; সে সময় নেমবেতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের আরেকটি দল। সমাজের সবাই ২০০০ সালে এ অবস্থা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত নেমবেতে চলতে থাকে সন্ত্রাসের রাজত্ব। ফল দাঁড়ায় জানমালের বিপুল ক্ষতি।
সংঘাতের বিবরণ দিয়ে এ প্রতিবেদনে বলা হয় : বিভিন্ন গোত্রের বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সবসময় সহিংস রূপ নেয় না। কোনো কোনো বিরোধ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। মামলার রায় পছন্দসই না হলে বিরোধ রূপ নেয় সহিংসতায়। কখনো একই সম্প্রদায়ের বা গোত্রের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এধরনের সংঘাত সত্তরের দশক, বিশেষ করে নববইয়ের দশক থেকে বেড়েছে। সংঘাতের অন্যতম বিষয় জমি। কারণ, প্রতি খন্ড জমিই হয় তেল আহরণ নয় এ আবাদ বা দালানকোঠা তৈরির জন্য মূল্যবান। সংঘাতে গোটা সম্প্রদায়, গোত্র বা বসত ধ্বংস হয়ে গেছে, এমন একাধিক উদাহরণ রয়েছে। সংঘাতের বহু বছর পরে কোনো কোনো জায়গায় গিয়ে কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে যে, সেখানে এক সময় একটি শহর ছিল, আর সে শহরে ছিল কয়েক হাজার মানুষের বাস। সংঘাতের আরেকটি কারণ তেলের অর্থের ভাগাভাগি। উন্নয়ন কার্যক্রমের ভাগাভাগি, রাজনৈতিক প্রাধান্য, প্রভৃতি বিষয়ও সংঘাতের কারণ হয়ে ওঠে।
মানব উন্নয়নবিষয়ক এ প্রতিবেদনে তেল কোম্পানিগুলো ও বসত বা জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্কও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয় : তেল সংক্রান্ত কার্যক্রমের পরিণতি নিয়ে সার্বিকভাবে কমিউনিটি বা বসত বা সম্প্রদায়গুলো অসন্তুষ্ট। এ অসন্তোষ প্রকাশ পায় বিভিন্ন রূপে। এসবের মধ্যে থাকে তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভ, তেল কোম্পানিগুলোর কাজে অবরোধ, তেলের পাইপে ও স্থাপনায় অন্তর্ঘাত চালানো, তেল কর্মীদের জিম্মি নেওয়া। কোনো কোনো গ্রুপ সনদ, দাবিনামা বা ঘোষণা প্রণয়ন করেছে। বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কোনো কোনো গ্রুপ। নিজেদের দাবিগুলো ব্যক্ত করার জন্যই এগুলো প্রণীত হয়েছে। এমন একটি ঘোষণার নাম কাইয়ামা ডিক্লারেশন বা কাইয়ামা ঘোষণা। এটি প্রণয়ন করেছে নাইজার বদ্বীপের যুবকরা। এতে রয়েছে ‘আমাদের সম্পদ আমরা চাই কেন? তার ১০০টি কারণ।’ ওরোন বিল অব রাইটস নামের একটি ঘোষণায় আকওয়া ইবোম অঙ্গরাজ্যের ওরোন জনগোষ্ঠী নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেছে। আবার, ওয়ারি একর্ড নামের ঘোষণায় বা রাজনৈতিক দলিলে ডেল্টা অঙ্গরাজ্যের ইটসেকিরি জনগোষ্ঠী তাদের এলাকায় তেল উৎপাদন থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার উপায়গুলো সন্ধান করেছে। রিভার অঙ্গরাজ্যের ওগোনি জনগোষ্ঠী ওগোনি বিল অব রাইটস নামের রাজনৈতিক দলিলে তাদের এলাকায় তেলসম্পদ আহরণের ফলে তৈরি হওয়া পরিবেশ অবক্ষয়, অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।
এসব মাত্র কয়েকটি। এসব ঘোষণা বা কর্মসূচি বা রাজনৈতিক/সামাজিক/পরিবেশগত দলিল থেকে স্পষ্ট হয় যে, তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জনসাধারণের বিরোধ নাইজেরিয়ার বাস্তবতার তেল-বাস্তবতার অন্যতম প্রধান বিষয়। আর, এ তেল বাস্তবতা তৈরি হয়েছে প্রাপ্য সুবিধা না পাওয়া, পরিবেশের ক্ষতি, নিজেদের ভাগ্যের ওপর অন্যের নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি নানা সমস্যা থেকে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির এ প্রতিবেদনে বলা হয় : তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা যে এলাকা থেকে তেল নিয়ে যায়, সে এলাকাকে যথেষ্ট সহায়তা করে না। তারা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থা, সড়ক, বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি অবকাঠামো পর্যাপ্তভাবে দেয় না। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বিশেষ করে একটি কোম্পানির নাম উল্লিখিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে তেল কোম্পানিগুলোর কাজের কারণে পতিতাবৃত্তির বিস্তার ঘটেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে : জমি হারিয়ে যায় তেল আহরণের কাছে। এর পাশাপাশি, তেলকর্মীদের অনুপ্রবেশ বাড়িয়ে তোলে জীবনধারণের ব্যয়। তেল কোম্পানিতে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা দরকার, স্থানীয় মানুষের তা না থাকায় তারা চাকরি পান না, পেলেও কায়িক মেহনতের ও কম বেতনের কাজ। তারা পড়েন মর্যাদাহীন অবস্থায়। আন্দোলনকারীরা বলেছেন, এটা করা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে, স্থানীয় মানুষকে বাইরে রাখার জন্য। প্রধান প্রধান কোনো তেল কোম্পানিরই সদর দফতর বদ্বীপ অঞ্চলে নয়। সংঘাতের আরো কারণ রয়েছে। সেসব আগামীতে। নাইজেরিয়ায় তেল নিয়ে যা হয়েছে, তা যে ফলাফল বয়ে এনেছে, সেটা গভীরভাবে দেখার বিষয়। এ কারণেই নাইজেরিয়ার তেল ও সংশ্লিষ্ট নানাদিক দেখা দরকার। তা একটু দীর্ঘ হতে পারে। তবে তা দরকার।