Friday, October 23, 2009

পূণিমার চাঁদ যখন ঝলসানো রুটি

দারিদ্র্যের যত বিস্তৃতি, দারিদ্র্য ‘মোকাবেলা’র আয়োজনও এ পৃথিবীতে তত বিস্তৃত। কিন্তু ফল কিছু কি এসেছে ঘরে? আজ পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ, যারা দারিদ্র্যের মধ্যে দিন-রাত, সারাজীবন পার করেন, তারা এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তারা প্রশ্ন করতে পারেন, কেন এ দারিদ্র্য, এর উৎসই বা কী? তারা আরও প্রশ্ন করতে পারেন, দারিদ্র্যের কারণ দূর না করে বা উৎসের মুখটুকু না আটকে এত হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে দারিদ্র্য লাঘবের আয়োজন কেন? দারিদ্র্যের বাস্তবতা, গরিব মানুষের দুনিয়া আজ কেবল গরিব দেশগুলোতে, কেবল এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নয়। সবচেয়ে ‘সুখের দেশ’, ‘সবার স্বপ্নের’ দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রেও আজ গাদা-গাদা গরিব মানুষ। গরিব মানুষের পৰে লড়াই করে রাষ্ট্রৰমতা কায়েম হয়েছিল যে চীনে, গরিবি হটানোর স্বপ্নভরা সেই চীন দেশেও অগুনতি গরিব। সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছিল যে সোভিয়েত ভূমিতে, সেখানেও গরিব মানুষের সংখ্যার কমতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার অন ফ্যামিলি হোমলেসনেস নামের সংগঠন কিছু দিন আগে ‘আমেরিকান ইয়ং আউটকাস্টস্‌’ নামের প্রতিবেদনে জানায় : সে দেশে প্রতি ৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন আশ্রয়হীন। এ সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। ত্রিশের মহামন্দার পরে এ ক্ষেত্রে এত খারাপ অবস্থা আর দেখা যায়নি। এরা কেবল আশ্রয়হীন তাই নয়, এদের অনেকে অনাহারে থাকে, অনেকে অসুস্থ, অনেকে স্কুল ছেড়েছে। আজ আরও অনেক প্রতিবেদনে, খবরে যুক্তরাষ্ট্রে গরিব মানুষের খবর প্রকাশ হচ্ছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত’র জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সংখ্যায় এ বিষয়ে একটি লেখা ছাপা হয়েছে। এটা গেল ‘দুধ-মধুর নহর বয়ে যাওয়া’ ডালাস-টেলিফিল্মখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের গরিবি বাস্তবতা। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ১৯ জুন জানায় : বিশ্ব ক্ষুধা এ বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঐতিহাসিক পর্যায়ে পৌঁছবে, হররোজ ক্ষুধার্ত থাকবেন ১০২ কোটি মানুষ। অর্থাৎ, এ পৃথিবীতে প্রতি ছ’জন মানুষের মধ্যে একজনের দিন কাটবে অনাহারে। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৯১ কোটি ৫০ লাখ। উন্নত, সমৃদ্ধ মহাদেশ ইউরোপ আজ ধনী আর গরিব মানুষে এমনভাবে বিভক্ত যে, তা সে মহাদেশের রাষ্ট্রে নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বলা হচ্ছে, এক নতুন লৌহ যবনিকা টেনে দিয়েছে ধনী-নিধনে বিভেদ। এ বষয়ে এ বছরের মার্চ মাসে ইউরোপের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। কর্মসংস্থান, সামাজিক বিষয় ও সম-সুযোগবিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার ভ্লাদিমির স্পিদলা ইউরোপিয়ান ভয়েস ডটকম নামের ই-সাময়িকীতে লিখলেন : ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এদের কথা যেন কেউ না ভোলে। ইউরোপ-আমেরিকায় দারিদ্র্যের এ বাস্তবতা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় দারিদ্র্যের বাস্তবতার তুলনায় যৎসামান্য। আর দারিদ্র্য কেবল অনাহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আশ্রয়, লেখাপড়া, চিকিৎসা, কাপড় তো আছেই; নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি, সহজপ্রাপ্য-নিরাপদ জ্বালানি, মর্যাদা, ভীতি-আতংক-অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি ইত্যাদিও দারিদ্র্যের প্রশ্নটির সঙ্গে জড়িত। দারিদ্র্যের এসব দিক নিয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে। তাই এদিকগুলো এখানে উল্লেখের আর দরকার পড়ে না। আজ দারিদ্র্যের বিষয়টি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে কয়েকটি কারণে। বিশ্বজোড়া সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন তথা সার্বিক পরিবেশগত সংকট, মহাৰুধা হিসেবে অভিহিত বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও কৃষি সংকট, তেলসহ জ্বালানি সংকট বিশ্ব দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরও শোচনীয়। বিশ্বায়ন নামে একটি ‘বিষয়’কে আপামর সাধারণ মানুষের কাছে ‘নতুন কিছু’ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছিল কয়েক বছর ধরে। এটা করছিল মূল ধারা। বলা হচ্ছিল বিশ্বায়ন মহা সুখ-সমৃদ্ধি এনে দেবে। তাই ‘নতুন বিষয় বিশ্বায়ন’কে স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু তথ্য বলছে, বিশ্বায়ন মোটেই নতুন বিষয় নয়, তা একটি প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়াটি চলছে কয়েকশ’ বছর ধরে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সমাজবিজ্ঞানী পল সুইজি এ বিষয়ে অনেক আগে চমৎকার আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজি সীমান্ত অতিক্রম করার সময় থেকে বিশ্বায়ন চলছে। বিশ্ব পরিধিতে পুঁজি ছড়িয়ে পড়ার এ বিশ্বায়নও পরে উল্লেখ করা সংকটগুলোর সঙ্গে মিলে দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে করে তুলেছে অসহনীয়। বিশ্ব ব্যবস্থার মুরুব্বিরা সারা পৃথিবীতে চাপিয়ে দিয়েছে মুক্তবাজার নামে পুঁজির ‘যথেচ্ছ’ চলার সুযোগ। অবশ্য পুঁজি যথেচ্ছ বা মুক্তভাবে চলতে চাইলেও পারে না। কিন্তু যতটুকু পারে, তারই মধ্যে পুঁজি বাড়িয়ে তুলেছে মানুষের দুর্দশা-দুর্ভোগ। গরিব দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল কাঠামো বিন্যাস কর্মসূচি। চূড়ান্ত অর্থে এ কর্মসূচি গরিব দেশগুলোর গরিব মানুষের অবস্থা আরও খারাপ করা ছাড়া ভালো করেনি। কেবল গরিবরা নয়, মধ্যবিত্তরাও হয়েছেন এসব দুর্ভোগের শিকার। এসব বিষয় নিয়েও অনেক লেখালেখি হয়েছে। আজ মূল ধারাও এসব নিয়ে খুব একটা জোর গলায় আপত্তি করে না। আইএলও’র ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ক রিপোর্ট টু থাউজেন্ড এইট : ইনকাম ইনইকুয়ালিটিজ ইন দি ওয়েজ অব ফিন্যান্সিয়াল গ্লোবালাইজেশন শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘ইতিমধ্যেই অনেক দেশে এ ধারণা ব্যাপকভাবে তৈরি হয়েছে যে, বিশ্বায়ন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সুবিধার্থে কাজ করে না।’ এ প্রতিবেদনটিতে এবং আইএলও’র গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট টু থাউজেন্ড এইট/নাইন প্রতিবেদনটিতে আজ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা বেড়ে চলতে থাকা বৈষম্য, ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব-নিকাশ করে প্রতিবেদন দুটিতে বলা হয়েছে : বৈষম্য বেড়েছে, শ্রমজীবী মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বেড়েছে, মজুরদের জন্য সামনে আরও কঠিন সময় অপেৰা করছে। এ বাস্তবতা উন্নত হিসেবে গণ্য অনেক দেশে, কেবল গরিব দেশগুলোতেই নয়। নারীদের অবস্থা আরও দুর্ভার।
গরিবদের এসব অবস্থার বিবরণ আজকাল কম-বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আর গরিবদের গরিবি কমানোর জন্য আলোচনা-বিশ্লেষণ-গবেষণার তো কমতি নেই-ই। কম নেই গরিবি হটানোর উদ্যোগ-আয়োজনের। এসব উদ্যোগ-আয়োজনের বয়সও কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়। সেসব প্রশ্ন সহজ। তবে উত্তর যেমন জটিল, উত্তর পাওয়াও তেমনি কঠিন। সহজ সেসব প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে : (১) ‘ক’ কেন গরিব, ‘খ’ কেন গরিব নয়? (২) ‘খ’র অবস্থা দিন দিন ভালো থেকে খুব ভালো হয়, অথচ ‘ক’ যেন কেবলই খারাপ অবস্থা থেকে আরও খারাপ অবস্থায় ডুবে যায়? (৩) এত উদ্যোগ-আয়োজনও গরিবদের অবস্থা ভালো করতে পারে না কেন? (৪) গরিবির উৎসই বা কি? এমন প্রশ্নের সংখ্যা অনেক। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে : বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার, উপরোলিৱখিত সব সংকট, গরিব দেশগুলো থেকে সম্পদ ও মেধা পাচারের সঙ্গে কি দেশের মধ্যকার দারিদ্র্যের সম্পর্ক আছে? প্রশ্ন হতে পারে : অন্যের মেহনত আত্মসাৎ করা আর সম্পদ বণ্টনের সঙ্গে কি দারিদ্র্যের সম্পর্ক রয়েছে? দেখা যাবে, এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত, যেমন যুক্ত গণতন্ত্রের প্রশ্নের সঙ্গে দারিদ্র্যের প্রশ্ন। এভাবে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, দারিদ্র্যের প্রশ্নটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশ্নটি রাজনৈতিকও এবং দারিদ্র্যকে রাজনৈতিক দিক থেকে না দেখে কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখে এবং কতিপয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিলে গরিবরা কোনভাবে বেঁচে-বর্তে থাকবেন, কিন্তু দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবেন না। এমনকি ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান’ বলে কবিতা লেখা হলেও দারিদ্র্যের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সম্মানবোধ, মর্যাদাবোধের প্রশ্নটি পর্যন্ত দানাবাঁধবে না। অথচ মর্যাদাবোধ দারিদ্র্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে, সাহায্যের জন্য হাত না পেতে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে শেখায়। এ দুনিয়ায় এমন নজির অনেক।
দৈনিক যুগান্তর, উপসম্পাদকীয়, ১৮ই অক্টোবর, ২০০৯)

মুনাফা ছাড়া ব্যবসা কি সম্ভব

মুনাফা না করে ব্যবসা করার কথা শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, গরিবদের কল্যাণের জন্য মুনাফা করার দরকার নেই; তাই, ব্যবসা করা হোক, কিন্তু মুনাফা করা হবে না। প্রস্তাব বা পরিকল্পনাটি প্রশংসনীয়; যেহেতু এ প্রস্তাবে দরিদ্র-কল্যাণ-ভাবনা রয়েছে। তাই দেখা যাক, মুনাফা না করে ব্যবসা করা সম্ভব কিনা।

মুনাফা আসে বাড়তি মেহনত থেকে। অর্থাৎ একজন মানুষ যখন কাজ করেন, তখন তিনি যে মেহনত দেন, সে মেহনতের একাংশের দাম দেয়া হয় পারিশ্রমিক হিসেবে। অপর অংশের দাম দেয়া হয় না; সেটা নিয়ে নেন নিয়োগকারী। এ অংশটিই বাড়তি মেহনত। আর এই বাড়তি মেহনতই তৈরি করে মুনাফা। তাহলে, শিল্পে-ব্যবসায়ে মুনাফা না করতে হলে বাড়তি মেহনতটুকু নেয়া যাবে না। অর্থাৎ বাড়তি মেহনতের দামটুকুও দিয়ে দিতে হবে মেহনত যিনি করছেন, তাকে। এমন হলে মেহনতকারীর জন্য ভালোই হয়। কিন্তু সেভাবে কি হওয়া আদৌ সম্ভব?

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পে বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজি কি মুনাফা ছাড়বে? মুনাফাই যদি ছাড়বে তা হলে পুঁজি শিল্পে বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত কেন হল? পুঁজি বলতে যে ধারণাটি সহজে করা হয়, সেটি হচ্ছে বিনিয়োগের অর্থ বা উৎপাদনের জিনিসপত্র। প্রকৃতপক্ষে, পুঁজি তা নয়। পুঁজি হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত একটি সামাজিক-উৎপাদন সম্পুরক। এ সম্পর্কটি কি বাড়তি মেহনত নেবে না? সেটি হয় না। যদি পুঁজির এই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা গণ্য না করে আরও সহজভাবে বলা হয়, বিনিয়োগের জন্য অর্থ নিয়ে কোন বিনিয়োগকারী কি মুনাফা না নেয়ার শর্তে বিনিয়োগ করবেন? যদি কল্যাণ-ইচ্ছা থেকে এই বিনিয়োগকারী বা কয়েকজন বিনিয়োগকারী তা করেন, তাহলেও কি বিনিয়োগ করার মতো পুঁজির মালিকদের নিয়ে গঠিত একটি সামাজিক শ্রেণী তা করবে? সেটা করবে বলে কল্পনা করে নিলে এটাও কি কল্পনা করতে হবে না যে, তেমন পরিস্থিতিতে পুঁজির মালিক এই সামাজিক শ্রেণীটি বাঁচবে বা টিকবে কিভাবে?

মুনাফা যদি না করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ করা পুরো পুঁজির অনুপাতে মুনাফাকে শূন্যের স্তরে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ, মুনাফার হার হচ্ছে বিনিয়োগ করা পুরো পুঁজি ও মুনাফার অনুপাত। উদ্বৃত্ত মূল্যের হারের ওপরে মুনাফার হার নির্ভর করে। উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বেশি হলে মুনাফার হারও বেশি হবে। পুঁজি যত দ্রুত ফিরে আসে, মুনাফার হারও তত বেশি হয়। মুনাফার হার কমাতে হলে অস্থির পুঁজিও কমাতে হবে। মুনাফার পরিমাণ ও হার কমাতে হলে পুঁজি সঞ্চয় বন্ধ করতে হবে। পুঁজিপতি যদি মুনাফা না করার প্রস্তাবটি মেনে নেন, তাহলে তাকে উদ্বৃত্ত মূল্যহারকে নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়, পুঁজি ফিরে আসার হারকে নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়, পুঁজির গঠনকে পাল্টে দিতে হবে। সেটা কিভাবে করা যাবে? একজন পুঁজিপতি কি তা করবেন? যদি তিনি করেন, তাহলে তিনি বিনিয়োগ কেন করবেন? শিল্পে বা ব্যবসায়ে মুনাফা না করার প্রস্তাবকারীদের কাছে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। কিন্তু, অর্থনীতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এর যে উত্তর, তা হচ্ছে প্রস্তাবটি চমৎকার শোনালেও বাস-বে কার্যকর করা সম্ভব নয়।

মুনাফা আর পুঁজির এসব দিক যদি বিবেচনা কেউ না করতে চান, তিনি তা করতে পারেন, কিন্তু তাতে কাজ হবে না, কথাবার্তা বলা যাবে। তাই, এ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে দেখা যাক যেসব শিল্পে মুনাফা হার কম, সেখানে কি ঘটে। সেখান থেকে পুঁজি সরে যায়; সেখানে উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কমে যায়; চাহিদা অনুযায়ী জোগান থাকে না, তা কমে যায়; সে শিল্পের তৈরি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় এবং মুনাফা হার বেড়ে সে স্তরেই পৌঁছায়, যেটি সব শিল্পে মুনাফা হারের মোটামুটি সমান। অর্থাৎ গরিবদের সাহায্য করার জন্য কোন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী যদি মুনাফা না করার সিদ্ধান- নেন, তাহলেও সার্বিকভাবে সুবিধা তো হবেই না, বরং অসুবিধাই হবে।

মুনাফার গড় হারের যে নিয়ম, সেটি দেখলে মুনাফা না করার প্রস্তাবের অসারতা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে। গড় মুনাফা পুঁজিপতিদের মধ্যে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্য ভাগাভাগি করে দেয়। একজন পুঁজিপতির মুনাফা সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের কাছ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার ওপর কেবল নির্ভর করে না। একটি সমাজে যত মানুষ মেহনত বিক্রি করেন, তাদের কাছ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয় সেই সমাজে যত পুঁজি তার ওপরও নির্ভর করে। তাহলে মুনাফা কম করতে হলে বা মুনাফা না করতে হলে গোটা সমাজ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়া বন্ধ করতে হবে। মুনাফা না করার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি কি ভেবে দেখা হয়েছে? মুনাফা না করতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিককে যেমন অন্যের বাড়তি মেহনত নেয়া বন্ধ করতে হবে, সেভাবে ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজিকেও বাদ দিতে হবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত পুঁজির নেয়া বাড়তি মেহনতে ব্যবসা পুঁজির ভাগ, সুদে কর্জ দেয়ায় নিয়োজিত পুঁজিকে ভুলে যেতে হবে, সুদের মধ্যে থাকা অন্যের বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার কাজটি। সব পুঁজি মালিকের মুনাফা একটি সমাজে তৈরি করা মোট বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার সঙ্গে যুক্ত। ফলে, মুনাফা না করার প্রস্তাবে সব পুঁজি মালিককে সায় দিতে হবে। তা হবে কি?

মুনাফার হারের সঙ্গে আরও কয়েকটি দিক যুক্ত। মুনাফা হার কমতে থাকলে গোটা পুঁজির শিবিরে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। পুঁজির বিভিন্ন অংশের মধ্যে যখন প্রতিযোগিতা হয়, তখন মুনাফার গড় হারের নিয়মিত প্রযোজ্য হয়। আগেই এটি উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কয়েকজন পুঁজি মালিক মুনাফা না করার ধারণাটি গ্রহণ করেন এবং অন্যরা তা গ্রহণ না করেন, সে ক্ষেত্রে অবস্থাটি কি দাঁড়াবে? এর উত্তর : গড় মুনাফা বিধি। তা নয় কি? সে ক্ষেত্রে মেহনত বিক্রি করে যে গরিবরা, তাদের অবস্থার কি হেরফের হবে? মুনাফা হার হ্রাস পাওয়া মোট মুনাফা হ্রাস পাওয়াকে বোঝায় না। মোট মুনাফা বাড়তে থাকে, পুঁজি বাড়তে থাকে। কারণ, মেহনত বিক্রি করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়াও বাড়তে থাকে। ফলে একটি শিল্পে বা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মুনাফা না করা বা কম করার ওপরে গরিবদের অবস্থার কিছুই নির্ভর করে না। মুনাফা না করার বা কম করার প্রস্তাব যারা করছেন, তারা তো নিশ্চয়ই জানেন, পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পুঁজিপতিদের কোথায় নিয়ে যায়। প্রস্তাবকরা চাইলেও পুঁজিপতিরা কি অন্তর্দ্বন্দ্ব বা অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি চাইবেন?

এসব কারণে ভেবে দেখা দরকার, মুনাফা না করা বা মুনাফা কম করার প্রস্তাবটি চমৎকার শোনালেও বাস-বে সম্ভব কিনা এবং প্রস্তাবটি গরিব বা পুঁজির মালিক, কোন পক্ষের জন্যই কল্যাণকর কিনা। ভুল ধারণা বা ভাবনা প্রচার করলে তা সমাজে বিভ্রান্তিতো বৃদ্ধি করেই, সেই সঙ্গে বিশৃংখলাও তৈরি করে। আর, বিশৃংখলা গরিব বা পুঁজি মালিক, কারও জন্যই সুবিধাজনক নয়। বরং এ ধরনের ভুল ভাবনা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, পুঁজিকে মুনাফা করতে তো হবেই, সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে যথাসম্ভব সর্বাধিক মুনাফা করার জন্য, সবসময় পুঁজি বৃদ্ধি করার জন্য। মুনাফা না করলে পুঁজি বাড়তে পারবে না। আর মুনাফা আসে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়া থেকে। যদি ধরে নেই, মুনাফা না করার ভাবনা পুঁজি গ্রহণ করল, সে ক্ষেত্রে পুঁজি বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে কি পুঁজির? পুঁজি বৃদ্ধি না পেলে নতুন বিনিয়োগ হবে কি? সেক্ষেত্রে কেবল আমাদের মতো দেশ নয়, উন্নত দেশে অবস্থাটি কেমন দাঁড়াবে। সেজন্যই, যে ভাবনা কোন একটি সমাজের অর্থনীতির জন্য সুবিধা বয়ে আনে না, সেই ভাবনা কি প্রচার করা উচতি?

(লেখাটি দৈনিক যুগান্তর হতে সংগৃহীত)