Friday, October 23, 2009

মুনাফা ছাড়া ব্যবসা কি সম্ভব

মুনাফা না করে ব্যবসা করার কথা শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, গরিবদের কল্যাণের জন্য মুনাফা করার দরকার নেই; তাই, ব্যবসা করা হোক, কিন্তু মুনাফা করা হবে না। প্রস্তাব বা পরিকল্পনাটি প্রশংসনীয়; যেহেতু এ প্রস্তাবে দরিদ্র-কল্যাণ-ভাবনা রয়েছে। তাই দেখা যাক, মুনাফা না করে ব্যবসা করা সম্ভব কিনা।

মুনাফা আসে বাড়তি মেহনত থেকে। অর্থাৎ একজন মানুষ যখন কাজ করেন, তখন তিনি যে মেহনত দেন, সে মেহনতের একাংশের দাম দেয়া হয় পারিশ্রমিক হিসেবে। অপর অংশের দাম দেয়া হয় না; সেটা নিয়ে নেন নিয়োগকারী। এ অংশটিই বাড়তি মেহনত। আর এই বাড়তি মেহনতই তৈরি করে মুনাফা। তাহলে, শিল্পে-ব্যবসায়ে মুনাফা না করতে হলে বাড়তি মেহনতটুকু নেয়া যাবে না। অর্থাৎ বাড়তি মেহনতের দামটুকুও দিয়ে দিতে হবে মেহনত যিনি করছেন, তাকে। এমন হলে মেহনতকারীর জন্য ভালোই হয়। কিন্তু সেভাবে কি হওয়া আদৌ সম্ভব?

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পে বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজি কি মুনাফা ছাড়বে? মুনাফাই যদি ছাড়বে তা হলে পুঁজি শিল্পে বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত কেন হল? পুঁজি বলতে যে ধারণাটি সহজে করা হয়, সেটি হচ্ছে বিনিয়োগের অর্থ বা উৎপাদনের জিনিসপত্র। প্রকৃতপক্ষে, পুঁজি তা নয়। পুঁজি হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত একটি সামাজিক-উৎপাদন সম্পুরক। এ সম্পর্কটি কি বাড়তি মেহনত নেবে না? সেটি হয় না। যদি পুঁজির এই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা গণ্য না করে আরও সহজভাবে বলা হয়, বিনিয়োগের জন্য অর্থ নিয়ে কোন বিনিয়োগকারী কি মুনাফা না নেয়ার শর্তে বিনিয়োগ করবেন? যদি কল্যাণ-ইচ্ছা থেকে এই বিনিয়োগকারী বা কয়েকজন বিনিয়োগকারী তা করেন, তাহলেও কি বিনিয়োগ করার মতো পুঁজির মালিকদের নিয়ে গঠিত একটি সামাজিক শ্রেণী তা করবে? সেটা করবে বলে কল্পনা করে নিলে এটাও কি কল্পনা করতে হবে না যে, তেমন পরিস্থিতিতে পুঁজির মালিক এই সামাজিক শ্রেণীটি বাঁচবে বা টিকবে কিভাবে?

মুনাফা যদি না করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ করা পুরো পুঁজির অনুপাতে মুনাফাকে শূন্যের স্তরে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ, মুনাফার হার হচ্ছে বিনিয়োগ করা পুরো পুঁজি ও মুনাফার অনুপাত। উদ্বৃত্ত মূল্যের হারের ওপরে মুনাফার হার নির্ভর করে। উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বেশি হলে মুনাফার হারও বেশি হবে। পুঁজি যত দ্রুত ফিরে আসে, মুনাফার হারও তত বেশি হয়। মুনাফার হার কমাতে হলে অস্থির পুঁজিও কমাতে হবে। মুনাফার পরিমাণ ও হার কমাতে হলে পুঁজি সঞ্চয় বন্ধ করতে হবে। পুঁজিপতি যদি মুনাফা না করার প্রস্তাবটি মেনে নেন, তাহলে তাকে উদ্বৃত্ত মূল্যহারকে নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়, পুঁজি ফিরে আসার হারকে নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়, পুঁজির গঠনকে পাল্টে দিতে হবে। সেটা কিভাবে করা যাবে? একজন পুঁজিপতি কি তা করবেন? যদি তিনি করেন, তাহলে তিনি বিনিয়োগ কেন করবেন? শিল্পে বা ব্যবসায়ে মুনাফা না করার প্রস্তাবকারীদের কাছে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। কিন্তু, অর্থনীতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এর যে উত্তর, তা হচ্ছে প্রস্তাবটি চমৎকার শোনালেও বাস-বে কার্যকর করা সম্ভব নয়।

মুনাফা আর পুঁজির এসব দিক যদি বিবেচনা কেউ না করতে চান, তিনি তা করতে পারেন, কিন্তু তাতে কাজ হবে না, কথাবার্তা বলা যাবে। তাই, এ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে দেখা যাক যেসব শিল্পে মুনাফা হার কম, সেখানে কি ঘটে। সেখান থেকে পুঁজি সরে যায়; সেখানে উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কমে যায়; চাহিদা অনুযায়ী জোগান থাকে না, তা কমে যায়; সে শিল্পের তৈরি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় এবং মুনাফা হার বেড়ে সে স্তরেই পৌঁছায়, যেটি সব শিল্পে মুনাফা হারের মোটামুটি সমান। অর্থাৎ গরিবদের সাহায্য করার জন্য কোন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী যদি মুনাফা না করার সিদ্ধান- নেন, তাহলেও সার্বিকভাবে সুবিধা তো হবেই না, বরং অসুবিধাই হবে।

মুনাফার গড় হারের যে নিয়ম, সেটি দেখলে মুনাফা না করার প্রস্তাবের অসারতা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে। গড় মুনাফা পুঁজিপতিদের মধ্যে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্য ভাগাভাগি করে দেয়। একজন পুঁজিপতির মুনাফা সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের কাছ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার ওপর কেবল নির্ভর করে না। একটি সমাজে যত মানুষ মেহনত বিক্রি করেন, তাদের কাছ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয় সেই সমাজে যত পুঁজি তার ওপরও নির্ভর করে। তাহলে মুনাফা কম করতে হলে বা মুনাফা না করতে হলে গোটা সমাজ থেকে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়া বন্ধ করতে হবে। মুনাফা না করার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি কি ভেবে দেখা হয়েছে? মুনাফা না করতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিককে যেমন অন্যের বাড়তি মেহনত নেয়া বন্ধ করতে হবে, সেভাবে ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজিকেও বাদ দিতে হবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত পুঁজির নেয়া বাড়তি মেহনতে ব্যবসা পুঁজির ভাগ, সুদে কর্জ দেয়ায় নিয়োজিত পুঁজিকে ভুলে যেতে হবে, সুদের মধ্যে থাকা অন্যের বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার কাজটি। সব পুঁজি মালিকের মুনাফা একটি সমাজে তৈরি করা মোট বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়ার সঙ্গে যুক্ত। ফলে, মুনাফা না করার প্রস্তাবে সব পুঁজি মালিককে সায় দিতে হবে। তা হবে কি?

মুনাফার হারের সঙ্গে আরও কয়েকটি দিক যুক্ত। মুনাফা হার কমতে থাকলে গোটা পুঁজির শিবিরে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। পুঁজির বিভিন্ন অংশের মধ্যে যখন প্রতিযোগিতা হয়, তখন মুনাফার গড় হারের নিয়মিত প্রযোজ্য হয়। আগেই এটি উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কয়েকজন পুঁজি মালিক মুনাফা না করার ধারণাটি গ্রহণ করেন এবং অন্যরা তা গ্রহণ না করেন, সে ক্ষেত্রে অবস্থাটি কি দাঁড়াবে? এর উত্তর : গড় মুনাফা বিধি। তা নয় কি? সে ক্ষেত্রে মেহনত বিক্রি করে যে গরিবরা, তাদের অবস্থার কি হেরফের হবে? মুনাফা হার হ্রাস পাওয়া মোট মুনাফা হ্রাস পাওয়াকে বোঝায় না। মোট মুনাফা বাড়তে থাকে, পুঁজি বাড়তে থাকে। কারণ, মেহনত বিক্রি করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়াও বাড়তে থাকে। ফলে একটি শিল্পে বা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মুনাফা না করা বা কম করার ওপরে গরিবদের অবস্থার কিছুই নির্ভর করে না। মুনাফা না করার বা কম করার প্রস্তাব যারা করছেন, তারা তো নিশ্চয়ই জানেন, পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব পুঁজিপতিদের কোথায় নিয়ে যায়। প্রস্তাবকরা চাইলেও পুঁজিপতিরা কি অন্তর্দ্বন্দ্ব বা অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি চাইবেন?

এসব কারণে ভেবে দেখা দরকার, মুনাফা না করা বা মুনাফা কম করার প্রস্তাবটি চমৎকার শোনালেও বাস-বে সম্ভব কিনা এবং প্রস্তাবটি গরিব বা পুঁজির মালিক, কোন পক্ষের জন্যই কল্যাণকর কিনা। ভুল ধারণা বা ভাবনা প্রচার করলে তা সমাজে বিভ্রান্তিতো বৃদ্ধি করেই, সেই সঙ্গে বিশৃংখলাও তৈরি করে। আর, বিশৃংখলা গরিব বা পুঁজি মালিক, কারও জন্যই সুবিধাজনক নয়। বরং এ ধরনের ভুল ভাবনা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, পুঁজিকে মুনাফা করতে তো হবেই, সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে যথাসম্ভব সর্বাধিক মুনাফা করার জন্য, সবসময় পুঁজি বৃদ্ধি করার জন্য। মুনাফা না করলে পুঁজি বাড়তে পারবে না। আর মুনাফা আসে বাড়তি মেহনত নিয়ে নেয়া থেকে। যদি ধরে নেই, মুনাফা না করার ভাবনা পুঁজি গ্রহণ করল, সে ক্ষেত্রে পুঁজি বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে কি পুঁজির? পুঁজি বৃদ্ধি না পেলে নতুন বিনিয়োগ হবে কি? সেক্ষেত্রে কেবল আমাদের মতো দেশ নয়, উন্নত দেশে অবস্থাটি কেমন দাঁড়াবে। সেজন্যই, যে ভাবনা কোন একটি সমাজের অর্থনীতির জন্য সুবিধা বয়ে আনে না, সেই ভাবনা কি প্রচার করা উচতি?

(লেখাটি দৈনিক যুগান্তর হতে সংগৃহীত)

No comments:

Post a Comment