কঙ্গো, আয়তনের দিক থেকে বিশাল এক দেশ,
বাংলাদেশের প্রায় ১৭ গুণ বড়। এ বিশাল দেশের দুর্দশার ইতিহাসও বিশাল। দীর্ঘ
সে ইতিহাস যেন দখল, লুট, গৃহযুদ্ধ, দুর্নীতি, আততায়ীর দীর্ঘ ছায়া,
অভ্যুত্থান, হানাহানি, আর এ সবের সঙ্গে থাকা মৃত্যুর মিছিল। দীর্ঘ সে
মিছিল। সেই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ বসতচ্যুত। মহামারীও যেন পাল্লা দেয় এসবের
সঙ্গে। তাই গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের পতাকায় রক্তিম লাল রেখা তার
দেশের নাগরিকদের রক্তকেই স্মরণ করে।
যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ আর এদের সঙ্গী অনাহার
ও ব্যাধি কেড়ে নিয়েছে অর্ধ কোটি বা ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল
রেসকিউ কমিটির ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে এ সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। এদের
প্রায় অর্ধেক হচ্ছে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু। এত মৃত্যুর অধিকাংশই ঘটেছে
বা ঘটানো হয়েছে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল অর্থাৎ মাত্র ৫ বছরের মধ্যে। বিবিসি
জানায়, সংঘাতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল হিসেবে গণতান্ত্রিক কঙ্গো
প্রজাতন্ত্রে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। দেশটির এ
সংঘাতে যত প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এত মৃত্যু আর
কোনো দেশে আর কোনো সংঘাতে ঘটেনি।
অথচ নয় লাখ পাঁচ হাজার বর্গমাইলের
বেশি এ দেশে রয়েছে বিপুল সম্পদ : হীরা, ইউরেনিয়াম, সোনা, তামা, কোবাল্ট,
দস্তা, কোলটান আর তেল ও গ্যাস। কোলটান ব্যবহৃত হয় মোবাইল ফোনে ও
ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীতে। কফিও উৎপাদিত ও রফতানি হয়। পশ্চিম ইউরোপের সমআয়তনের
এ দেশটির সম্পদ এত বেশি যে, তা-ই এদেশকে করে তুলতে পারে বিশ্বের অন্যতম
ধনী দেশ। এর মাটি উর্বর। এর রয়েছে অনেক পানি। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক
খবরে বলা হয় : দেশটির হীরা শিল্প বছরে ৮৭ কোটি ডলার আয় করে। সে শিল্প প্রায়
১০ লাখ খননকারীকে কাজ দিয়েছে। কিন্তু বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে তারা
জনপ্রতি দিনে আয় করে এক ডলারেরও কম। কি নির্মম লোভ খনি মালিকদের!
এই হীরা, ইউরেনিয়াম, সোনা, তেল ও
অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদই যেন দেশটি জুড়ে আয়োজন করেছে মুনাফাবাজদের
‘খেলা’। সে ‘খেলা’র নাম আজ আফ্রিকাজ ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়্যার, আফ্রিকার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আফ্রিকার ইতিহাসে বৃহত্তম যুদ্ধ ক্ষেত্রগুলোর অন্যতম হয়ে
ওঠে কঙ্গো, খুব সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ। এ বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডার
দেশটিতে যুগে যুগে ডেকে এনেছে অভিযাত্রী, দখলদার, সাম্রাজ্য বিস্তারকারী
রাজশক্তি, আধুনিক বেপারী, বহুজাতিক করপোরেশনকে। এদের চেহারা ছিল
সুন্দর-সভ্য। এদের সঙ্গে ছিল স্থানীয় দালালরা, মুৎসুদ্দিরা, যুদ্ধবাজরা। আর
ছিল দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকার। এরা সবাই মিলে দেশের জনসাধারণকে
বিভক্ত করল, জাতিগত, গোত্রগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করল, এ
প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পৌঁছে দিল বিদ্বেষ আর সংঘাতের পর্যায়ে। দশকের পর দশক
ধরে চলা লুট, দুর্নীতি, হানাহানি, ষড়যন্ত্র দেশটির অর্থনীতিকে করে ফেলল
স্থবির, পঙ্গু।
কঙ্গো ও তার আশপাশের নয়টি দেশ বসে আছে
এ পৃথিবীর সব চেয়ে ধনসমৃদ্ধ অংশে। অথচ ধন লোভী সাম্রাজ্যবিস্তার, মুনাফা
সন্ধানী কোম্পানির ষড়যন্ত্রের পরে ষড়যন্ত্রে, সংঘাতে দেশটির আবাদ ধ্বংস
হলো, কার্যত থেমে গেল বাণিজ্য, খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা,
শিক্ষ যোগান দেওয়া গেল না; এগুলো নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গড়ে উঠল
না অবকাঠামো। দেশটি হয়ে উঠল প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র দল-উপদলের রণক্ষেত্রে।
কখনো সরকারি বাহিনী আর বিদ্রোহীদের মধ্যে চলল লড়াই। একদিকে সরকারি
বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছে এঙ্গোলা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে আরেকদিকে
বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছে রুয়ান্ডা ও উগান্ডা। সব বিবাদের আড়ালে ছিল কঙ্গোর
প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর খেলা।
জাতিসংঘের একটি প্যানেল ২০০১ সালে
উল্লেখ করে : সোনা, হীরা, গাছের কাঠ, কোলটান, লুট করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধরত
পক্ষগুলো ইচ্ছে করে সংঘাত দীর্ঘায়িত করছে। এর আট বছর পরে ২০০৯ সালে জাতিসংঘ
নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের এক প্রতিবেদনে বলা হয় : বিদ্রোহীরা মানুষ হত্যা করছে,
লুট করছে প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ এরা রয়ে যাচ্ছে আইনের, বিচারের ধরাছোঁয়ার
বাইরে। এ বিদ্রোহীদের মদদ যোগাচ্ছে দুর্বৃত্তদের একটি আন্তর্জাতিক
নেটওয়ার্ক বা জাল। এ জাল ছড়িয়ে আছে গোটা আফ্রিকাজুড়ে, সেখান থেকে পশ্চিম
ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায়। পাঠকের মনে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে : সে জাল বোনে
কারা?
জাতিসংঘের ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে
দেশটির জনসংখ্যা ছয় কোটি ৭০ লাখ। সে দেশের পুরুষের গড় আয়ু ৪৭ বছর, আর
নারীদের ৫০। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুসারে, দেশটির রফতানি আয়ের
প্রায় অর্ধেক আসে হীরা থেকে; এর পরই অশোধিত তেল, প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
বাকিটুকু আসে কোবাল্ট, তামা, কফি ও অন্য পণ্য থেকে। দেশটির প্রবৃদ্ধি ২০০০
সালেও ছিল বিয়োগাত্মক। মাইনাস সাত শতাংশ। তা ২০০১ সালে কমে আসে মাইনাস
দুইয়ে। এর পরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ২০০২ সালে তা দাঁড়ায় ৪ শতাংশ; তা ২০০৩ ও
২০০৪ সালে আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে। দেশটির সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার
বেলজিয়াম, দেশটির সাবেক সাম্রাজ্যবাদী প্রভু দেশ। এর পরের স্থান
যুক্তরাষ্ট্রের। তারপর চীনের। এসব তথ্যের আড়ালে রয়ে গেছে নিষ্ঠুর সব সত্য।
বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব থেকে দেখা যায়
: গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ১৯৯০ সালে গড় আয়ু যা ছিল, সেটা ২০০৪
সালে হ্রাস পায়, শিশু মৃত্যুর হার থাকে একই, অথচ একই সময়ের ব্যবধানে চীন ও
যুক্তরাজ্যে গড় আয়ু বেড়েছে এবং শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। গণতান্ত্রিক
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে প্রবৃদ্ধি হার ২০০২ সাল থেকে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ কেবল
প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে দেশটির নাগরিকদের অবস্থা বুঝতে পারা যাবে না। যখন
প্রবৃদ্ধি হার বেড়ে চলেছে সে সময়ের আগে থেকে, ১৯৯৩ সাল থেকে, রুয়ান্ডার
সেনাবাহিনী ও এ সেনাবাহিনী সমর্থিত বিদ্রোহীরা কঙ্গোতে যে অপরাধ সংঘটিত
করেছে, তাকে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ
অবস্থা চলতে থাকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। তা হলে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, এমন
অবস্থায় প্রবৃদ্ধি বাড়ল কিভাবে? সহজে এর উত্তর দেওয়া যায়। তা হচ্ছে
প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানি বা পাচার হয়েছে বিপুল। সে সম্পদের দাম হিসেবে
প্রাপ্ত অর্থ দেশবাসী পেয়েছেন কিনা, সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে।
এ দেশটিতেই জাতিসংঘ পাঠিয়েছিল
শান্তিরক্ষা বাহিনী, জাতিসংঘের ইতিহাসে বৃহত্তম শান্তিরক্ষা কার্যক্রম।
কমপক্ষে ১০ বছর ধরে চলেছে সে কার্যক্রম। এক সময় কিছুদিন আগেও সে দেশে পুলিশ
খুঁজে পাওয়া যেত না। অথচ পুলিশ ছিল। তারা থাকত গরহাজির বা মাতাল অবস্থায়।
পাহাড়ে পাহাড়ে ছিল সশস্ত্র দল-উপদল। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সরকার গঠিত
হয়; তার আগে প্রণীত হয় সংবিধান। নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা
রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এসব নির্বাচন দেশটিতে বিনিয়োগের এবং সংঘটিতভাবে
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের পরিবেশ তৈরি করবে। এ আশা বিনিয়োগকারীদের, প্রাকৃতিক
সম্পদ আহরণকারীদের। এ ঘটনা ধারা আর আশার মধ্যে যে সম্পর্ক, তা অনেকের কাছে
নির্মম পরিহাস বলে মনে হতে পারে। লুট আগেও হতো। প্রাকৃতিক সম্পদ আগেও
অর্থকড়ি যোগাত কতিপয় লোককে; কিন্তু হানাহানি, রক্তারক্তির পরিবেশে বিনিয়োগ
যেমন স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ হয় না, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের কাজে তেমনি ঝুঁকি ও
খরচ থাকে বেশি। তাই বিনিয়োগ ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ সহজ-স্বচ্ছন্দ হয়
শান্তির পরিবেশে। তাই খুব দরকার ছিল সংবিধান সম্মত শাসনের, নির্বাচনের। তাই
বলে এ কথা মনে করার কারণ নেই যে, সংবিধান ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত
সরকার জনগণের দরকার নেই। বরং এ পরিবেশ জনগণকেও সুযোগ করে দেয় গণতান্ত্রিক
সংগ্রাম গড়ে তোলার, এগিয়ে নেওয়ার।
তবে বিনিয়োগকারী, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট
বা আইনসম্মতভাবে আহরণ করে অর্থশালীরা যে লাভবান হন, তার জন্য দাম দিতে হয়
জনসাধারণকে। সে দাম চড়া, খুব চড়া। সব দেশের মতো কঙ্গোর ইতিহাসও তাই বলে।
কেবল একটি বিষয়ই তা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট। সে বিষয়টি হচ্ছে ধর্ষণ।
কঙ্গোতে এত হানাহানি, যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা যেন মহামারির
রূপ নেয়। এগুলো চালিয়েছে সশস্ত্র দল-উপদল, সেনাবাহিনীর লোকেরা। কোনো কোনো
সশস্ত্র দল এ জন্য নারীদের ক্রীতদাসীর মতো করে রাখত।
এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে এ বছরই
ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয় : কঙ্গোয় ‘প্রায়
প্রতি মিনিটে’ একজন করে নারীকে ধর্ষণ করা হতো। সেখানে একজন নারীর ধর্ষিতা
হওয়ার আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১৩৪ গুণ বেশি। এসব হিসাব এ সংক্রান্ত
আগের হিসাবগুলোর চেয়ে ২৬ গুণ বেশি।
আমেরিকান জার্নাল অব পাবলিক হেলথে
প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে গবেষকরা জানান, ১২ মাসে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী
চার লাখের বশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় : প্রতিদিন এক হাজার
১শ’ জনের বেশি বা প্রতি পাঁচ মিনিটে চারজন। এ সীমাক্ষার আগে আরো কয়েকটি
সমীক্ষা চালানো হয়। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল জাতিসংঘ পরিচালিত সমীক্ষা। সে
সব সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০০৬-০৭ সালে ১২ মাসে ১৫ হাজার নারীকে ধর্ষণ করা
হয়।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনটি রচনা
করেন এমবার পিটারম্যান। তিনি সরকারি নথিতে থাকা তথ্য এবং জাতীয় পর্যায়ের
প্রতিচ্ছবি থাকে, এমন তথ্যই কেবল ব্যবহার করেছেন। তাই তিনি বলেছেন,
সাম্প্রতিক হিসাবও কম, খুব কম। এ হিসাব গুণতে পারেনি তাদের, যারা লজ্জার
কারণে তথ্য জানাননি; এ হিসাবের গণ্য হয়নি সে সব ঘটনা, যেগুলো ক্ষমতার কারণে
ফাঁস হয়নি; এ হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হননি বৃদ্ধারা বা একেবারে কম বয়সীরা।
নির্মমতা, বর্বরতা, অমানবিকতার চরিত্র ফুটে ওঠে কেবল এ তথ্যটুকুর মধ্য
দিয়েই। কোনো আদর্শ, কোনো রাজনীতি, কোনো শত্রুতার সূত্র, কোনো বৈরীতা এ
কাজকে সমর্থন করতে পারবে না। কারণ, তা সমর্থন করলে সে আদর্শ, সে রাজনীতি-
সে বৈরীতা হারাবে তার অবস্থান। অথচ লুট, সম্পদের লোভ কত নিষ্ঠুর, কত
অমানবিক হতে পারে যে, তার অনুসৃত কর্মধারা তৈরি করে এমনই অমানবিকতা,
মানবতার অপমান!
No comments:
Post a Comment