Thursday, November 24, 2011

তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফার ‘খেলা’

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-২০)
তেল-গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার মধ্যে প্রাপ্তি অনেক। আইনগত কাঠামোর মধ্যে, আইনসম্মতভাবে সম্পদ আত্মসাতের মধ্যেও প্রাপ্তি বিপুল। চারধারেই তা ঘটছে। এ বিবরণ প্রায় অফুরন্ত। কেবল তেল কোম্পানির কথাই উল্লেখ করা যাক।

তেলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি কোম্পানি এ বছরের প্রথম ৯ মাসে মুনাফা করেছে ১০২.৮৫ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ২৮৫ কোটি ডলার। এক ডলারকে ৭০ টাকার সমান গণ্য করলে টাকার অঙ্কে মুনাফার এ পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ পাঁচটি কোম্পানি হচ্ছে বিপি বা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, কনোকো-ফিলিপস, শেভরন, এক্সনমবিল ও শেল। এসব কোম্পানির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। অনুমান করা হয় যে, মুনাফার পরিমাণ এ বছর শেষে ১৪০০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে।

বার্তা সংস্থা রয়টার অক্টোবরের শেষ দিকে ‘টোটাল, শেভরন প্রফিটস লিফটেড বাই ফার্ম অয়েল প্রাইম’ (‘তেলের মজবুত দামের ফলে টোটাল, শেভরনের মুনাফা বেড়েছে’) শিরোনামে এক খবরে জানায় : তেল কোম্পানি শেভরন ও টোটাল ২৮ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে অধিকতর মুনাফা অর্জনের কথা জানিয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি কষ্টকর হলেও মুনাফা বেড়েছে। বছরের প্রথম ৯ মাসে এ দুটি কোম্পানি ছাড়াও এক্সনমবিল, শেল ও বিপিরও মুনাফা বৃদ্ধি পায়।

এ বছরের জুলাইয়ে এক খবরে জানা যায় : ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় তিনটি তেল কোম্পানি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলার মুনাফা করে। এর মধ্যে শেল প্রতিদিন মুনাফা করে ৭৫ মিলিয়ন বা সাড়ে সাত কোটি ডলার। এ তিনটি কোম্পানি হচ্ছে শেল, বিপি এবং বিজি।

উল্লেখ করা দরকার যে, শেল ২০০৮ সালে মুনাফা করেছিল ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার সাতশ’ কোটি ডলারের বেশি। এ পরিমাণটিই ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ কোম্পানির এক বছরে সর্বাধিক পরিমাণ মুনাফা। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন যে, এ বছরও শেলের মুনাফার পরিমাণ ২০০৮ সালের সমপরিমাণ হতে পারে বা ছাড়িয়েও যেতে পারে।

তেল কোম্পানিগুলোর বিপুল মুনাফার ঘটনা কেবল কোনো একটি বছরের ঘটনা নয়। এরা অন্যান্য বছরেও চড়া মুনাফা করে থাকে। যেমন ২০০৮ সালের প্রথম ৯ মাসে পাঁচটি সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানির মুনাফা ছিল প্রায় রেকর্ড পরিমাণ। এ পাঁচটি কোম্পানি হচ্ছে বিপি, শেভরন, কনোকো-ফিলিপস, এক্সনমবিল ও শেল। ওই সময়ে তেলের দাম ছিল খুব চড়া। পরবর্তী তিন মাসে দাম কিছুটা পড়লে মুনাফার পরিমাণও কিছুটা কমে। তবে পুরো বছরের হিসাবে ২০০৮ সালে এ পাঁচ কোম্পানির মুনাফা দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার। এ পরিমাণ কেবল ২০০৭ সালের মুনাফার চেয়ে কম। এ পাঁচটি কোম্পানির ২০০৭ সালের মুনাফার পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এ সব তথ্য উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল জে ওয়েইস তার ‘বিগ অয়েল মেড ওভার সিক্স হান্ড্রেড বিলিয়ন ডলার ডিউরিং বুশ ইয়ার্স’ শিরোনামের নিবন্ধে।

তিনি এ সব তথ্য উল্লেখ করে আরো জানান যে, বুশের দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সবচেয়ে বড় পাঁচটি তেল কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬৫৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি ডলারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। অন্যভাবে বলা যায়, এ পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ছয়শ’ কোটি ডলার। এতো বিপুল মুনাফা করার ব্যাপারে অনেকের আপত্তি না থাকলেও কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, এত মুনাফা কিভাবে হয় এবং সে মুনাফা যায় কোথায়? এ প্রশ্ন অনেকেই করেছেন ও করছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের শুনানিতে এ প্রশ্ন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বা আইনসভার তেল মূল্য ও ইন্ধন স্বাধীনতা বিষয়ক বাছাই কমিটির এক শুনানি হয় ২০০৮ সালের প্রথম ভাগে। সেখানে তলব করা হয় এক্সনমবিল, শেল, বিপি, কনোকো-ফিলিপস ও শেভরনের কর্তাদের। সেখানে কংগ্রেস সদস্যরা বা আইন প্রণেতারা তলব করে আনা তেল কর্তাদের কাছে জানতে চান যে, এত বিপুল মুনাফা করা সত্ত্বেও বারবার ব্যবহার করা যায়, এমন জ্বালানি খাতে প্রায় কিছুই বিনিয়োগ করা হচ্ছে না কেন? এ কারণে তাদের তিরস্কারও করা হয়। এসব কোম্পানি যে বছর ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার মুনাফা করে সে বছরেই কর রেয়াত হিসেবে পায় ১৮০০ কোটি ডলার। তেল কর্তাদের এই বিপুল পরিমাণ কর রেয়াত বা কর সুবিধা নেওয়ার যুক্তি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়।

এসব কোম্পানি তাদের বড় কর্তাদের এত বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা দেয় যে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারি না। উদাহরণ দেওয়া যাক। লি রেমন্ড নামে একজন প্রধান নির্বাহী কর্তা ছিলেন এক্সনমবিলে। এই প্রধান নির্বাহী কর্তা পদটিকে ইংরেজিতে চিফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার বা সংক্ষেপে সিইও বলে। লি রেমন্ড চাকরি ছেড়ে যাবেন তাই চাকরি ছেড়ে যাওয়া বাবদ তাকে দেওয়া হলো ৪০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। এ অর্থ কেবল আমাদের মতো দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কাছেও অকল্পনীয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এমানুয়েল ক্লিভার এত অর্থ প্রদান বিষয়ে কোম্পানিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টেফান সাইমনকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। উদাহরণ হিসেবে একটি প্রশ্নের উল্লেখ করা হলো। প্রশ্ন করার শুরুতে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য ক্লিভার বলেন : আমার বাবা সারাজীবন কাজ করেছেন। তিনি কখনোই বছরে ২৫ হাজার ডলারের বেশি আয় করতে পারেননি। বহু বছর তিনি একসঙ্গে তিনটি কাজ করেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাজ করেছেন দুটি। তার চার সন্তানকে তিনি কলেজ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। এখন তার বয়স ৮৬। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাবার মতো অনেক মানুষ আছেন। আগামী শনিবার এমন কয়েক জনের সঙ্গে আমি এক সভায় মিলিত হব। এটা আইনসভা সদস্যের সঙ্গে প্রতি মাসের সভা। সাইমন, লি রেমন্ড এক্সনমবিল থেকে চাকরি ছেড়ে যাওয়া বাবদ যে ৪০ কোটি ডলার পেলেন সে ঘটনাটি এইসব মানুষের কাছে আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এই ৪০ কোটি ডলার মানে দিনে এক লাখ ৪১ হাজার ডলার (প্রায় এক কোটি টাকা)। যে মানুষ কাজ খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন, তাদের আমি কি বলে বোঝাবো যে, রেমন্ড সাহেবের ৪০ কোটি ডলার পাওয়া ঠিক আছে? এইসব মানুষ টিকে থাকার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছেন আর তেল কোম্পানি সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। এ প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছিলেন তেলকর্তা সাইমন সাহেব, তা হাস্যকর।

এরপরে কমিটির অন্যান্য সদস্য নবায়ন করা যায়, এমন জ্বালানি খাতে অতি সামান্য বিনিয়োগ করা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন সাইমন সাহেবকে। সেসব প্রশ্নের জবাবও সন্তোষজনক ছিল না। এসব তথ্য অ্যামি গুডম্যানের এক বেতার অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাও এ বছরের এপ্রিলে তেল কোম্পানিগুলোকে কর দাতাদের অর্থ দিয়ে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানান। এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, কর দাতাদের অর্থ দিয়ে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারটি ঠিক নয়। তিনি এ ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য আইনসভার প্রতি আহবান জানান।

এ ঘটনা থেকে বুঝতে সুবিধা হয় যে, মুনাফার বিপুল অর্থ কোথায় যায়। কেবল এখানেই যায় না। মালিকদের ভোগেও ব্যয় হয় সে অর্থের একাংশ। তবে এটা ধারণা করা ভুল হবে যে, মুনাফার সব অর্থই এভাবে খরচ হয়। আবার এটাও স্পষ্ট যে, এত মুনাফা এবং মুনাফার অর্থ এভাবে ভাগবাটোয়ারা করা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ কাজটি যুক্তিসঙ্গত নয়। বিশেষ করে, বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও সচ্ছলভাবে সম্মানজনকভাবে চলতে পারেন না তখন হাতেগোনা কিছু লোকের এভাবে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থ নানা উসিলায় হাতিয়ে নেওয়া কোনো যুক্তিতেই টেকে না। আবার সারা পৃথিবীতেই যখন জ্বালানি সংকট, সে সংকট যখন ক্রমাগতভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন তেল পোড়ানোর কারণে পৃথিবীর গরম হাওয়া বাড়ছে ও তাতে মানুষসহ সব প্রাণের অস্তিত্বই হুমকির মুখে, যখন পৃথিবীকে রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের তাগিদ বাড়ছে, সে সময় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণায়, উদ্ভাবনে, ব্যবহারে অর্থ বিনিয়োগ না করে মুনাফার অর্থ বাবু সাহেবরা ভাগবাটোয়ারা করে নেবেন, সেটা যুক্তি বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

এত মুনাফার ‘ব্যাপারটি’ আরো উৎকটরূপে চোখে পড়বে, যদি তা বেকারত্বের হারের পাশাপাশি তুলনা করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর বিভিন্ন প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ইত্যাদি থেকে দেখা যায় যে, সারা পৃথিবীতে বেকার মানুষের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ একদিকে, বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, আরেক দিকে বেড়েছে কয়েকটি কোম্পানির মুনাফা। দুটোই বেড়েছে। একটির মুনাফার বৃদ্ধি, কতিপয় মানুষকে বিলাস, অকল্পনীয় ভোগের সুযোগ দিয়েছে; আরেকটির বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি কোটি কোটি মানুষের জীবনে এনেছে সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ-অনাহার।

বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিণতিতে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, বেকার হয়েছেন। আর তেলের মূল্য বৃদ্ধি মুনাফা বাড়িয়েছে।

মুনাফা ‘অর্জনের’ আরো ‘কাহিনী’ রয়েছে। টিএনএস মিডিয়া ইন্টেলিজেন্স নামে তথ্য মাধ্যম পর্যবেক্ষণ বিষয়ে একটি সংগঠন জানায়, কেবল একটি তেল কোম্পানি ২০০৭ সালে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছিল ১০ কোটি ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা। আবার এ কোম্পানিটি জনমনে ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের পরিবেশ ‘সচেতন’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সে ধরনেরই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তবে সে ধরনের বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল কোম্পানিটি, তার চেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য দিয়েছিল এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর গরম বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে সবসময় সন্দেহ ছড়াচ্ছে। আচরণটি কি মুনাফার ‘সততা’?

মুনাফা কোথা থেকে আসে এ প্রশ্ন অনেক পুরনো। এ দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ যুগ যুগ ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আমাদের বিশ্বকবি যেমন প্রশ্ন করেছেন আকাশকে যে, মেঘেরা দলবেঁধে কোথায় যায়, সেভাবেই মানুষেরও প্রশ্ন : মুনাফা যায় কোথায়? এ দুটি প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেছে। সে উত্তর দিয়েছে বিজ্ঞান, তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করে। সংক্ষেপে সে উত্তর হচ্ছে : মুনাফা আসে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া মেহনত থেকে আর মুনাফার এক অংশ যায় অল্প কিছু লোকের ভোগে, আরেক অংশ যায় মুনাফা আরো বাড়িয়ে তোলার কাজে। আর মুনাফা করার জন্য তেল কোম্পানি কেবল উৎপাদনে বিনিয়োগ করে না। বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হয় হানাহানি, সংঘাত, সশস্ত্র দল-উপদল তৈরি করার কাজে, রাজনীতিতে অর্থ যোগাতে, ঘুষ দিতে, দালাল বানাতে, কিছু লোককে কিনে নিতে। এ হচ্ছে মুনাফার ‘খেলা’।

No comments:

Post a Comment