Thursday, July 28, 2011

তেলের আগুনে পুড়ছে নাইজেরিয়ার মানুষ (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশ-৫)

যে দেশটির তেল নিয়ে রাজনীতির এত জটিল খেলা তেল কোম্পানি আর অন্যান্য দেশের, সেই নাইজেরিয়ার অবস্থা কেমন? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য দেখা যেতে পারে বিশ্ব শান্তি সূচকে নাইজেরিয়ার অবস্থান কোথায়? এ সূচক অনুযায়ী ২০১১ সালে নাইজেরিয়ার অবস্থান ছিল ১৪২তম। ইন্সটিটিউট অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস ১৫৩টি দেশের অবস্থান নির্ণয় করে এ সূচকের সাহায্যে। মোট ২৩টি গুণগত ও সংখ্যাগত সূচক দিয়ে ১৫৩টি দেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয় প্রতি বছর। সমাজে সহিংসতা আছে নাকি নেই, সেটা যাচাই করার কাজে ব্যবহৃত হয় এ সূচক, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় গ্লোবাল পিস ইনডেক্স বা জিপিআই। এ অবস্থান নির্ণয়ে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে থাকে একটি রাষ্ট্রের সামরিক ব্যয়, রাষ্ট্রটি মানবাধিকার কতটা মেনে চলে ইত্যাদি। জিপিআই অনুসারে নাইজেরিয়ার অবস্থান হয় জিম্বাবুয়ে ও শাদের পরে।

এরই পাশাপাশি দেখা যেতে পারে গণতন্ত্র সূচকে নাইজেরিয়ার অবস্থান। এ সূচক অনুসারে ২০১০ সালে নাইজেরিয়ার অবস্থান ছিল ১২৩তম। ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে এ সূচক ব্যবহার করে ১৬৬টি দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা পরিমাপ করে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন, ভোটারদের নিরাপত্তা, বিদেশী শক্তি বা সরকারের প্রভাব, রাষ্ট্রের নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়। ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স বা গণতন্ত্র সূচক ২০১০ প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ২৬ মে। এর আগের গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করা হয়েছিল ২০০৮ সালে।

এবার দেখা যাক এ দেশটিতে সংঘাতের ‘ছবি’টি কেমন? একেবারে সংক্ষেপে তা হচ্ছে :

১. তিন বছরে তেল সংশ্লিষ্ট বা তেল সৃষ্ট সংঘাতে সেখানে নিহতের সংখ্যা ৫৩ হাজার। অর্থাৎ তেল সংশ্লিষ্ট ঘটনায় বছরে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অর্থাৎ মাসে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। অর্থাৎ দিনে প্রায় ৫০ জন মানুষ। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় দু’জন মানুষ মারা যান বা মারা হয় সে দেশে। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। বাস্ত্তচ্যুত হয়েছেন হাজার হাজার নারী-শিশু-বৃদ্ধ-অসুস্থ মানুষ।

২. কোনো কোনো পরিসংখ্যান বলে, সে দেশের ৭০ ভাগ মানুষকে দারিদ্র্যরেখার নিচে জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে ব্যবস্থাটি। আবার কোনো কোনো পরিসংখ্যান বলে এ হার প্রায় ৩৭ ভাগ। জাতিসংঘের দারিদ্র্য সূচকের হিসাব অনুসারে এ দেশটির অবস্থান সবচেয়ে গরিব দেশ হিসেবে কোনো কোনো বছরে দাঁড়ায় ২৫তম।

৩. মরণরোগ এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের হিসাবের দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতের পরে নাইজেরিয়ার স্থান। এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২০০৫ সালে ছিল ২৯ লাখ। এদের মধ্যে ৫৫ ভাগ ছিলেন নারী। এইডস এতিম বলা যায় যে শিশুদের তাদের সংখ্যা সে সময় ছিল প্রায় ১০ লাখ।

৪. ইউনিসেফের হিসাব অনুসারে পৃথিবীতে অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুর সংখ্যা কমপক্ষে সাড়ে ১৪ কোটি। এদের মধ্যে কেবল নাইজেরিয়াতেই রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ।

ওপরের এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে রবি ভবানীর ২০০৮ সালে লেখা রিসোর্স স্কার্স সিটি অ্যান্ড এবানড্যান্স : অয়েল, ডেমোক্র্যাটাইজেশন অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন দ্য নাইজার ডেল্টা দ্য হিউম্যান ফেস অব রিসোর্স কনফ্লিক্ট ইউনিসেফ ও বিবিসিসহ বিভিন্ন নিবন্ধ/সংবাদ মাধ্যম/আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশনা/খবর থেকে।

এ অবস্থা যে দেশটির, সে দেশ আফ্রিকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তেল উৎপাদক ও রফতানিকারক। দেশটির রাজস্বের প্রায় ৪০ ভাগ আসে তেল থেকে। ফলে দেশের গোটা অর্থনীতি হয়ে পড়েছে তেলনির্ভর। এর পরিণতিতে অর্থনীতি যে রোগে আক্রান্ত হয়, তার নাম ডাচ ডিজিজ বা ওলন্দাজ রোগ। এ রোগে এক পাশে কাৎ হয়ে পড়ে অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতির অন্যান্য অংশ হয়ে পড়ে বলহীন, যায় শুকিয়ে, কেবল তেলসিক্ত অশংটুকু হতে থাকে স্ফীত, তেল চকচকে। একে কেন্দ্র করে দেখা দেয় টানাটানি, উত্তেজনা। চালাক-চতুর ধুরন্ধর লোকেরা, ওপর মহলে হাত আছে এমন ফন্দিবাজরা বা মহাজনরা হাতিয়ে নিতে থাকে সব। তাদের চলাচল, বেশভূষা, গাড়ি-বাড়ি, শানশওকত, খাওয়া-দাওয়া, হাবভাব-ভঙ্গি, আচরণ, কথাবার্তায় যা প্রকাশ পায় তা উদ্ধত্য, বলদর্পী। সবাইকে পদানত করে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ধারাই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজে। রাজনীতি সমাজের, অর্থনীতির অংশ হওয়ায় ওলন্দাজ রোগের অপচ্ছায়া পড়ে রাজনীতিতে। সাধারণ যারা, যারা গরিব, কম আয় করা মানুষ হয়ে পড়েন কোণঠাসা। তাদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনী তোলে না রাজনীতিতে, সমাজে। মিথ্যাচার আর ভন্ডামির পাশাপাশি বেড়ে চলে বঞ্চনা, বৈষম্য, ধনী-গরিব বিভেদ। তৈরি হয় সংঘাতের পটভূমি।

এ অবস্থা অন্যান্য দেশেও দেখা গিয়েছিল/গেছে। সব ক্ষেত্রে তেলের পয়সার রোগ নয়। কোথাও তা হয় বিদেশী সাহায্য লুট করে নেওয়া পয়সায়। আবার কোথাও কাপড় সেলাই করা পয়সা, কোথাও মানুষ রফতানি করা পয়সা, কোথাও ব্যাংক ও অন্যান্য বাজার থেকে লুটে নেওয়া জনসাধারণের পয়সায়।

নাইজেরিয়ায় দেখা গেল তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে তেল কোম্পানিগুলো। এরা বিদেশী। দেশের মানুষ সবসময়ই দেখতে পাচ্ছেন তেল থেকে যে পয়সা আসে, তা তাদের ভাগ্যে জোটে না, সে তেল তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরায় না, তৈরি হয় ক্ষোভ, অসন্তোষ, ক্রোধ, তা অনেক ক্ষেত্রে চরমে রূপ নেয়। প্রাণ ধারনের শেষ উপায় হিসেবে কেউ কেউ তেল চুরি করেন, কেউ করেন অপহরণ, ক্রোধ প্রকাশে কেউ চালান অন্তর্ঘাত। সেই সঙ্গে থাকে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা, যে প্রতিযোগিতা কোম্পানিগুলো আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিষ্পত্তি করতে পারে না; আর তা পারে না বলেই এসব কোম্পানি তখন গড়ে তোলে/উস্কে দেয়/মদদ দেয় সশস্ত্র সংগঠন/সংগঠনগুলোক। একদিকে, অব্যবস্থাপনা-লুট-দুর্নীতি-পুকুর চুরি, আরেকদিকে দারিদ্র্য-ক্ষোভ, ছিচকে চুরি বাড়িয়ে তোলে সংঘাত। এ যেন খনি থেকে তেল তোলার সময় উপজাত হিসেবে বেরিয়ে আসা বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া আগুনের বিশাল শিখা। নাইজেরিয়ার নাইজার বদ্বীপে এমন শিখা, আক্ষরিক অর্থেই, অনেক জ্বলতে দেখা যায়।

এমনি এক শিখা জ্বলছিল সত্তরের দশক থেকে ইতালীয় তেল কোম্পানি এগিপের মালিকানাধীন তেলকূপের মাথায়। দিন-রাত পোড়ে গ্যাস, মাঝে-মধ্যে তেল ছিটকে পড়ে পাশের গ্রাম আকারাউলুতে, আর সে কূপের নাম অশি। সেই অশির শিখায় পুড়ে যায় আকারাউলুর কিশোর ভাগোগো জোয়েলের বাহু। জোয়েল তখন বাবার সঙ্গে মাছ ধরছিল। সে গ্রামের ১৭শ’ পরিবারকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, অর্থনৈতিক কল্যাণ আসবে তাদের জীবনে, এ তেলের বিনিময়ে। এ তথ্য দিয়েছে নাইজেরিয়ার তেল সংক্রান্ত একটি কেস স্টাডি।

এ অবস্থা যে ছবি ফুটিয়ে তোলে, তা হচ্ছে শোষণের, লুটের, আর এসবের সাথী সংঘাত, দারিদ্র্য, বৈষম্যের। তাই, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির নাইজার ডেল্টা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বা নাইজার বদ্বীপ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ২০০৬ সালে বলা হয় : চারপাশে প্রাচুর্য। আর তারই মধ্যে স্থানীয় অধিবাসীরা ভুগছেন দারিদ্রে্য, দুর্দশায়। এ কারণেই সেদেশে অনেকে তেল ও গ্যাসকে অভিশাপ হিসেবে গণ্য করেন, তেল গ্যাসকে মনে করেন দুধারী তলোয়ার।

এতে বলা হয়, তেলের দাম যখন বাড়তে বাড়তে সবকিছু ফাটিয়ে দিচ্ছে, তখনো নাইজেরিয়ায় মানুষের আয়ু কমছে। যে অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ যোগায়, সে অঞ্চলটির মানুষের ইন্ধন প্রাপ্যতা শোচনীয়। এ বদ্বীপ অঞ্চল প্রতি দিন ২০ লাখ ব্যারেলের বেশি অশোধিত তেল উৎপাদন করলেও এ অঞ্চলেই জ্বালানি আমদানি করতে হয়। যে অঞ্চলটি নাইজেরিয়ার অন্যান্য স্থানে বিশাল সব অবকাঠামো উন্নয়নে আর আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে ব্যয়বহুল শান্তিরক্ষা কাজে অর্থ যোগায়, সে অঞ্চলটিতে সড়ক নেই বললেই চলে। অথচ এ বদ্বীপ অঞ্চলই নাইজেরিয়ার বিদেশী মুদ্রা আয়ের ৮০ ভাগ ও সরকারি রাজস্বের প্রায় ৭০ ভাগ যোগায়।

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে পানি সরবরাহ ও টেলিযোগাযোগসহ অবকাঠামো ও সামাজিকসেবা পাওয়া যায় না; যতটুকু আছে, তার মান খারাপ।

এ প্রতিবেদন তৈরির জন্য সে অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে আলাপকালে একজন বলেন, এখানে জলের কলে পানি ছিল এক সময়ে। সেটা ২০ বছর আগে, আমরা এখন মূলত নদীর পানি পান করি।

এ অঞ্চলের বাসিন্দারা পানি সংগ্রহ করে নদী, হ্রদ, পুকুর থেকে। মাটির গভীরে নল বসিয়ে জল তোলা হলে, তা কিনতে হয়। বেকারত্বও ব্যাপক। অথচ এ বদ্বীপ অঞ্চলটিই প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির কাছে আকর্ষণীয়। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে শেল, শেভরন, মবিল, এল্ফ, এগিপ, টেক্সাকো। আরো কোম্পানি রয়েছে। পল্লী অঞ্চলের অনেক মানুষের কাছেই পরিবহন ও যোগাযোগ দুর্ভোগের উৎস হিসেবে গণ্য। মোটরসাইকেলে যাতায়াতের খরচ চড়া। তাই তাদের অনেকে হেঁটে পাড়ি দেন দীর্ঘপথ।

এমন বিবরণী জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির উপরোক্ত প্রতিবেদনে রয়েছে। আর এমন বিবরণ সে দেশে অনেক। তাই, তেল-গ্যাস আহরণ হলেই তা দূর করবে দারিদ্র্য, এ কথা যে সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়, নাইজেরিয়া তার প্রমাণ।

Thursday, July 21, 2011

নাইজেরিয়া আর কোম্পানির রাজনীতি (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশ-৪)

তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে লোভের শেষ নেই। তাই শেষ নেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার। আর এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রতিযোগিতা প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তপাতের অন্যতম কারণ। উইকিলিকস নাইজেরিয়ার তেলসম্পদ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর (বক) বিশেষ করে শেল অয়েলের তৎপরতা সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের যেসব তারবার্তা ফাঁস করে দেয়, সেগুলো থেকে বকদের তীক্ষ্ম নজর, তৎপরতার ব্যাপ্তি ও গভীরতার ব্যাপার-স্যাপার কিছুটা অনুমান করা যায়। প্যাট্রিক মার্টিন ‘উইকিলিকস ডকুমেন্টস শো শেল অয়েল ডমিনেশন অব নাইজেরিয়া’ নিবন্ধে এসব তারবার্তার কিছুটা তুলে ধরেছেন। এমনই এক তারবার্তা থেকে দেখা যায়, শেল অয়েলের আফ্রিকা বিষয়ক নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট এন পিকার্ড রুশ তেল-গ্যাস কোম্পানি ন্যাজপ্রম সম্পর্কে মার্কিনি কর্তাদের জানাচ্ছেন যে, ব্রিটিশ সরকারের ভেতরে থেকে যারা তাকে তথ্য দেন, তারা পিকার্ডকে বলছেন, নাইজেরিয়া রুশ কোম্পানিটিকে ১৭ ট্রিলিয়ন বা ১৭ লাখ কোটি ঘন ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটা করতে হলে অন্যান্য কোম্পানিকে এখন যতটুকু দেওয়া হয়েছে, তা কমাতে হবে। পিকার্ড অনুমান ব্যক্ত করেন, এর প্রধান ধাক্কা এসে পড়বে শেল অয়েলের ওপর।
মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে আরেকটি সভা হয় পিকার্ডের, ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ সভায় পিকার্ড নাইজেরিয়া সরকারের মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপ্তি নিয়ে অভিযোগ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, তেল ক্রেতাদের বিশাল অংকের ঘুষ দিতে হয় নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি নাইজেরিয়ান ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এমনকি ফার্স্ট লেডি তুরাই ইয়ারআদুয়াকে। তারবার্তায় বলা হয় : পিকার্ড আরো জানান, এটর্নি জেনারেল এগুনডোয়াকা একটি দলিল সই করতে ঘুষ নিয়েছেন দু’কোটি ডলার।
পিকার্ডের মার্কিন দূতাবাস কর্তাদের সঙ্গে দেখা করার তাৎক্ষণিক একটি কারণ ছিল। সে কারণটি হচ্ছে- বনিতে শেল অয়েলের তেল প্লাটফর্মে তেল ভর্তি করছিল তেলবাহী একটি জাহাজ। সেই তেলবাহী জাহাজে বা ট্যাংকারে সশস্ত্র সংগঠনের কর্মীরা হামলা চালায়। এ ঘটনাটিই ছিল তেল কর্তা আর কূটনীতিকদের সাক্ষাতের কারণ। এর আগে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি তেল কোম্পানির ওপর ১৪ দফা হামলা হয়, এটা ছিল নাইজেরিয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সার্বিকভাবে ভেঙে পড়ারই অংশ। এসব বিষয় উল্লিখিত নিবন্ধে বলা হয়েছে।
তারবার্তাটিতে আরো উল্লেখিত হয়েছে যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত অভ্যুত্থানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে শেল অয়েলের ভাবনা জানতে চান। জবাবে পিকার্ড বলেন, একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করা ও তা রূপায়ন করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিগত ক্ষমতা নাইজেরিয়ায় সামান্যই আছে। শেল অয়েলের দৃষ্টিতে এ ধরনের সম্ভাবনা অল্প।
এরপর তারা দু’জন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ারআদুয়ার শরীরের শোচনীয় অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। পরের বছর ইয়ারআদুয়া মারা যান। তার স্থলাভিষিক্ত হন ভাইস প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথন। দূতাবাসের আরেকটি তারবার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়ারআদুয়ার স্ত্রীর ঘুষ, চোরাচালানি ও অন্যান্য ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকার অসমর্থিত খবরের কথা উল্লেখ করা হয়। ইয়ারআদুয়ার স্ত্রী লন্ডনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এক কোটি ডলার দিয়ে একটি বাড়ি কেনেন। সংবাদ প্রদানের একটি সূত্র দূতাবাস কর্তাদের জানায়, প্রেসিডেন্ট ইয়ারআদুয়া নিজে ঘুষ নিচ্ছেন না; তবে তার স্ত্রী ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সরকারি তহবিলের লাখ লাখ টাকা সরাচ্ছেন।
আরেকটি তার বার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্যান্ডার্স ও গুডলাক জনাথনের মধ্যে একটি বৈঠকের বিবরণ রয়েছে। এ বৈঠকটি হয় ২০১০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। জনাথন তখন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। সৌদি আরব থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়ারআদুয়া তখন অপ্রত্যাশিতভাবে দেশে ফিরে এসেছেন। তার এ প্রত্যাবর্তনের কারণে তড়িঘড়ি করে অপ্রত্যাশিতভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। সৌদি আরবে চিকিৎসাকালে তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ইয়ারআদুয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য জনাথনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা কেমন, তার একটি বিবরণ জনাথন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান। এ পরিকল্পনায় জনাথনের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হওয়া, মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া ও নতুন করে নির্বাচন করার বিষয়গুলোও স্থান পায়। সাবেক প্রেসিডেন্টদের ও সামরিক শাসকদের সঙ্গে জনাথনের যেসব শলাপরামর্শ হয়, সেগুলোর পূর্ণ বিবরণও জনাথন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান। এসব শলাপরামর্শ হয়েছিল ইয়ারআদুয়ারকে পদত্যাগে রাজি করানোর পন্থা নিয়ে।
দেশটির শাসকবর্গের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণের হিসেবে বিভাজন বা আঞ্চলিক ভিত্তিতে উত্তেজনা তৈরি হওয়ার বিপদ সত্ত্বেও এ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জনাথনকে উৎসাহ যোগান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ২০১১ সালের প্রস্তাবিত নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে ‘কারিগরি সহায়তা’ দেওয়ার সুযোগ প্রদানে রাজি হন। ক্ষমতার প্রকৃত সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রদূত স্যান্ডার্স তখন নির্বাচন কমিশনের প্রধানকে সরিয়ে ফেলা হবে মর্মে আশ্বাস দাবি করেন। নির্বাচন কমিশন প্রধানকে ‘আগামী মাসের মধ্যে’ সরানোর প্রতিশ্রুতি দেন জনাথন। এসব তথ্য দিয়েছেন প্যাট্রিক মার্টিন উইকিলিকসের বরাত দিয়ে।
এসব তেল-গ্যাস কোম্পানির বকদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তি-হস্তক্ষেপ যে কত প্রবল, কত ব্যাপক বিস্তৃত, কত গভীরে প্রোথিত তা এসব বার্তা থেকে বুঝতে পারা যায়। ব্রিটেনের দৈনিক পত্রিকা গার্ডিয়ানে এসব তারবার্তার যে খবর প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল ‘উইকিলিকস কেবলস : শেলস গ্রিন অন নাইজেরিয়ান স্টেট রিভিলড’ অর্থাৎ ‘উইকিলিকসের ফাঁস করা তারবার্তা : নাইজেরিয়া রাষ্ট্রের ওপর শেল কোম্পানির বজ্রমুষ্ঠি প্রকাশ হয়ে পড়েছে।’ এ শিরোনামের নিচেই বড় হরফে লেখা হয় : মন্ত্রণালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে কোম্পানি ‘সবই জানে’ বলে উচ্চপর্যায়ের কোম্পানি কর্তার দাবি প্রকাশ করে দিয়েছে মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো তারবার্তাগুলো। এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয় : তেল দানব শেল দাবি করেছে যে, নাইজেরিয়ার সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কোম্পানিটি কর্মী ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে রাজনীতিবিদদের সব কাজকর্মের খবর পায় শেল। এসব মন্ত্রণালয়ের সবই জানে শেল। নাইজেরিয়া সরকার ভুলে গেছে যে, শেল অয়েলের অনুপ্রবেশ কত গভীরে। নাইজেরিয়া সরকারের কাজকারবার সম্পর্কে শেল কত বেশি জানে, সে ব্যাপারে নাইজেরিয়া সরকার অসচেতন।
গার্ডিয়ানের এ খবরে বলা হয়, এই অ্যাংলো-ডাচ বা ইঙ্গ-ওলন্দাজ কোম্পানি, অর্থাৎ শেল গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে যক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। একবার এ কোম্পানি মার্কিন কূটনীতিকদের দেয় নাইজেরিয়ার সেইসব রাজনীতিকের নাম, যারা সশস্ত্র গ্রুপ সদস্যদের মদদ দেন বলে সন্দেহ করা হয়। চীনকে লেখা নাইজেরিয়া সরকারের চিঠিটি শেল কিভাবে পেয়েছে, সে বিবরণ দেন শেল কর্তা পিকার্ড মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্যান্ডার্সকে। পিকার্ড বলেন, নাইজেরিয়ার পেট্রোলিয়াম প্রতিমন্ত্রী ওদেইন আজুমোহগাবিয়া এ ধরনের চিঠি পাঠানোর কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু শেল জানে, চীন ও রাশিয়াকে নাইজেরিয়া এমন চিঠি লিখেছে, এসব চিঠিতে তেল বিষয়ে বিড বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য চীন ও রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
উইকিলিকসের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের এ খবরে বলা হয়, শেল কর্তা পিকার্ড সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাজপ্রম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গোপন খবর দেওয়ার জন্য মার্কিন কনসুলেটকে অনুরোধ করে। পিকার্ড অভিযোগ করেন, নাইজেরিয়ার এক মন্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপের বিবরণ রুশরা গোপনে রেকর্ড করে এবং মন্ত্রীর দফতরে এ সভার অল্পক্ষণ পরেই পিকার্ডের অফিসে ‘রুশদের কাছ থেকে’ সে সভার একেবারে হুবহু বিবরণ পৌঁছায়। এই শেল কর্তা বার বার মার্কিন কর্তাদের বলেন, তিনি মার্কিন সরকারি কর্তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চান না; কারণ মার্কিন সরকারে ‘ছিদ্র’ রয়েছে। পিকার্ড উদ্বিগ্ন যে, নাইজেরিয়ায় শেল অয়েলের অপারেশন বা কাজকারবারের খারাপ খবর ফাঁস হয়ে যাবে।
এসব তার বার্তায় ফাঁস হওয়া খবর সম্পর্কে শেল গার্ডিয়ান পত্রিকার কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে। নাইজেরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রবলভাবে এসব তথ্য অস্বীকার করে বলা হয়, শেল নাইজেরিয়া সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে না, কখনো করেনি, এগুলো হচ্ছে সরকারকে খাটো করার চেষ্টা।
তবে নানা অধিকার প্রশ্নে যারা আন্দোলন করেন, তারা বলেছেন, এসব তথ্য নাইজেরিয়ার তেলসম্পদের ওপর শেল অয়েলের বজ্রমুষ্ঠির প্রমাণ। সোশ্যাল অ্যাকশন নাইজেরিয়া নামে একটি সংগঠনের একজন নেতা বলেন, শেল আর নাইজেরিয়া সরকার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। শেল আছে সব জায়গায়। নাইজেরিয়ার সব মন্ত্রণালয়ে তাদের একটি চোখ, একটি কান আছে। প্রত্যেক বসত এলাকায়, প্রত্যেক পেশাজীবী গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে তাদের টাকা খাওয়া কর্মী। এ কারণেই তারা সব কিছু থেকে রেহাই পেয়ে যায়। নাইজেরিয়া সরকারের চেয়ে শেল বেশি ক্ষমতাধর। তেল সংক্রান্ত ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখে, লন্ডনে এমন একটি সংগঠনের কর্মকর্তাও একই ধরনের মন্তব্য করেন বলে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়। বেন আমুনওয়া নামের এ কর্মকর্তা বলেন, শেল দাবি করে, নাইজেরিয়ার রাজনীতি নিয়ে শেল অয়েলের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু বাস্তবে ব্যবস্থাটির গভীরে ঢুকে কাজ করে শেল। শেল নিজের সুবিধার জন্য নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক চ্যানেলগুলো দীর্ঘকাল ধরে কাজে লাগাচ্ছে।
উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি তার বার্তায় বলা হয়, শেল কর্তা পিকার্ড বলেন, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য হচ্ছে অনুমানের খেলা। সাম্প্রতিককালে প্রেসিডেন্টর সঙ্গে পিকার্ডের যে সব বৈঠক হয়েছে, সেগুলোতে প্রেসিডেন্টকে দেখা গেছে সজাগ। তবে তাকে দেখায় ক্ষীণ। পিকার্ডের কাছে তথ্য রয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট শিগগিরই মারা যাওয়ার বিপদের মধ্যে নেই। আবার তিনি পুরোপুরি সুস্থও হয়ে উঠবেন না। পিকার্ড জানান, পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী ড. লুকমানের সঙ্গে শেলের একটি  পূর্বনির্ধারিত সভা বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অজুহাত দেখানো হয়েছে যে, মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছে। দূতাবাসের কর্তারাও দেখেছেন, মন্ত্রীদের ও ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক প্রায়ই বাতিল করা হয়। এসব ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে, তাদের প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছে। অথচ দূতাবাস জানে, সে সময়ে প্রেসিডেন্ট নগরেই ছিলেন না, মার্কিন কর্তারা ও পিকার্ড গ্যাস সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। এসবের মধ্যে ছিল গ্যাস আহরণ, গ্যাস বণ্টন অবকাঠামো ইত্যাদি। প্রেসিডেন্ট আবুজায় তার বাসভবনে আর ফিরে আসবেন কি-না, তার বাসভবন থেকে তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সরানো হচ্ছে। এ বিষয়ও আলোচনা স্থান পায়। নাইজেরিয়ার কোনো কোনো মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তার নিয়োগ, কারো কারো লেখাপড়ার বিষয়, শিক্ষা লাভের প্রতিষ্ঠান, মানসিকতা, জলবায়ু সংক্রান্ত আলোচনা কালের অভিজ্ঞতা, গ্যাসকে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর গুরুত্ব প্রদান, কোন উপমন্ত্রীকে কোন মন্ত্রী প্রভাবিত করতে পারবেন, জাতীয়তাবাদীমুখী ও শ্যাভেজের মতো শব্দগুচ্ছ কার প্রিয়, কাকে পেট্রোলিয়াম খাতে ‘সঠিক’ পথে চলানো যায়, এসব প্রসঙ্গও এ বৈঠকে আলোচিত হয় বলে একটি তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়।
এমন একেকটি তারবার্তার পূর্ণ বিবরণ স্থানাভাবে দেওয়া সম্ভব নয় এখানে। যে কোনো মনোযোগী পাঠককে সে সব তার বার্তা স্তম্ভিত করে দেয়, তেল-গ্যাস সংশ্লিষ্ট এসব কোম্পানির তীক্ষ্ণ, গভীর, বিস্তৃত দৃষ্টি; গভীর ব্যাপক প্রভাব, হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ; পরিকল্পনার সুদূরপ্রসারী খুঁটিনাটি সব বিবেচ্য বিষয়গুলোর কারণে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন এ সব কোম্পানির অপতৎপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পক্ষগুলোকে শিশু-কিশোর সুলভ বিপক্ষের কার্যাবলীকে কিশোরসুলভ চপলতা, বিপক্ষের বিশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের ধরনকে একেবারেই ভাসাভাসা বলে কোনো পাঠকের মনে হতে পারে।
এসব তার বার্তার মধ্য দিয়ে কেবল তেল ও গ্যাসের প্রসঙ্গ প্রকাশিত হয়নি। রাজনীতি, রাজনীতিবিদ, রাজনীতিকদের জীবন, সংশ্লিষ্টদের লেখাপড়া, নানা বিষয়ের মধ্যকার সম্পর্কও ফুটে উঠেছে। কোনো কোনো তৎপরতা যে পুরোমাত্রায় গোয়েন্দাবৃত্তির পর্যায়ে পড়ে, সেটাও চোখ এড়ায় না। এসব তারবার্তা থেকে বুঝতে পারা যায়, কেবল রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি করেন না; এসব কোম্পানিও রাজনীতি করে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কোম্পানি রাজনীতিবিদদের ওপর দিয়ে রাজনীতি করে; রাজনীতির আসল কলকাঠি নাড়ে; সেসব তৎপরতার ক্ষেত্রে একটি দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব কোম্পানির হাতে ধরা কল মাত্র। সে বিবেচনায় এসব কোম্পানিকে সারার্থে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বললে ভুল হবে না। দেশের সাধারণ মানুষ কি রাজনীতির এসব ছলাকলা-লেনদেন-বোঝাপড়ার খবর জানেন? দেখা যাবে জনসমক্ষে রাজনৈতিক বোলচাল নেহাতই বোলচাল, তার বেশি কিছু নয়; রাজনীতির আসল খেলা চলে অন্দর মহলে, সে খবর কদাচিৎ পৌঁছায় মূক-নিরক্ষর জনসাধারণের কাছে।
এর ফলাফল কি দাঁড়ায়? হস্তক্ষেপ, মোচড়ামুচড়ি, হাসাহাসি, ব্যবসার স্বার্থ হাসিলে রাজনীতিতে ছড়ায় সংঘাত। এত বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা, হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক-কূটনৈতিক কাজ কারবার কেন? মুনাফার উদ্দেশ্যে। তেল আর গ্যাস মুঠোয় না এলে কাঙ্ক্ষিত বা স্বপ্নের মুনাফা হবে না।

Friday, July 15, 2011

নাইজেরিয়া আর উইকিলিকস(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশ-৩)

আফ্রিকায় তেলের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে যে দেশগুলোর নাম উচ্চারিত হয়, সেগুলোর অন্যতম নাইজেরিয়া। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক লর্ড লুগার্ডের সৃষ্টি আধুনিক কালের নাইজেরিয়ার ললাট লিখন যেন শুধুই রক্তপাত। নাইজার, বেনু আর ক্রস নদীর পানি ধোয়া তিন লাখ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বেশি এলাকায় বিস্তৃত পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলের এ দেশটির ভূগর্ভে রয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লা, লোহা, টিন, চুনাপাথর, কলামবাইট, সোনা, ট্যানট্যালাইট। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অসাধারণ সম্ভাবনার দেশ নাইজেরিয়ার সমস্যাগুলোও যেন তুলনাহীন। খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৭০০-তে গোড়াপত্তন যে ভূখন্ডের সংস্কৃতির, সেটিকে পর্তুগিজ আর ব্রিটিশরা পদানত করে পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে। প্রায় আড়াইশ’ উপজাতির/গোত্রের প্রায় আড়াইশ’ ভাষা/স্থানিক ভাষার এ দেশটি গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা ‘অর্জন’ করে ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার প্রায় সাত বছরের মাথায়। বায়াফ্রা নাম নিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঞ্চলের সে যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৭০ সালে। সে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, ১৯৬৬ সালের শুরুতেই ২৫ জন সেনাকর্তা অভ্যুত্থান করে এবং খুন করে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের দুই মুখ্যমন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলসহ কয়েকজন সেনাকর্তাকে। দু’দিনের মধ্যে, ১৭ জানুয়ারি, সে বিদ্রোহ দমন করেন সেনাপ্রধান, গ্রহণ করেন সর্বময় ক্ষমতা। তিনি স্থগিত করেন সংবিধান, গঠন করেন সুপ্রিম সামরিক পরিষদ, বিলোপ করেন সব রাজনৈতিক দল ও উপজাতীয় সমিতি। এর প্রায় সাড়ে ছয় মাস পরে ঘটে আরেক সেনা অভ্যুত্থান। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেই জেনারেলকে খুন করা হয়। ক্ষমতায় বসানো হয় একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে। পরে তিনি হন জেনারেল, জেনারেল গওয়ান। জাতীয় সামরিক সরকারের নাম হয় ফেডারেল সামরিক সরকার। গিনি উপসাগর তীরের এ দেশটি ১৩ বছর সেনাশাসনের পরে ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে ফিরে পায় বেসামরিক সরকার।
কিন্তু নাইজার উপত্যকায় ব্রিটিশ স্বার্থের ভিত গেঁড়েছিল যে ন্যাশনাল আফ্রিকান কোম্পানি উনবিংশ শতাব্দীতে, সনদ পেয়ে যে কোম্পানি হয়েছিল রয়্যাল নাইজার কোম্পানি, সে কোম্পানির হাত থেকে রাজপ্রভুর হাতে গিয়ে ১৯১৪ সালে হয়েছিল যে ‘নাইজেরিয়া উপনিবেশ ও আশ্রিত রাজ্য’, সেই উপনিবেশটি যেন শোষিত আর রক্তাক্ত হওয়ার ‘ভাগ্য’ এড়াতে পারে না বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতেও। গণতন্ত্রও সেখানে রয়ে যায় অবিকশিত। ব্রিটেনের পত্রিকা ইকনোমিস্টের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট গণতন্ত্রের অবস্থা পরিমাপের জন্য যে গণতন্ত্র সূচক ব্যবহার করে তার বিচারে ২০১০ সালে ১৬৭টি দেশের মধ্যে নাইজেরিয়ার অবস্থান হয় ১২৩তম।
আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার এ দেশটিকে তেল কোম্পানি শেল অয়েল যেন মরণ বাঁধনে আটকে রেখেছে। শাসন ব্যবস্থাতেও তার বিপুল প্রভাব। এ তেল কোম্পানির সঙ্গে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নাইজেরিয়া থেকে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের যে সব তারবার্তা উইকিলিকস ফাঁস করে দিয়েছে, সেগুলো থেকে এমন ধারণাই হয় বলে ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েব সাইটে প্যাট্রিক মার্টিন মন্তব্য করেছেন। ‘উইকিলিকস ডকুমেন্টস শো শেল অয়েল ডোমিনেশন ইন নাইজেরিয়া’ শিরোনামের নিবন্ধে তিনি এ মন্তব্য করেন।
উইকিলিকস নাইজেরিয়া সংক্রান্ত প্রায় ছয়টি তারবার্তা ফাঁস করে। মার্টিন উল্লিখিত সে সব তার বার্তা থেকে দেখা যায়, শেল কোম্পানির আফ্রিকা বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট এন পিকার্ড ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবিন স্যান্ডার্সের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে যান। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি বিল নামে তেল শিল্পসংক্রান্ত একটি বিল। সে সময় এ বিলটি নিয়ে নাইজেরিয়ার আইন সভায় আলোচনা চলছিল। এ বিলটি আইন সভায় গৃহীত হলে সে দেশে আন্তর্জাতিক যৌথ উদ্যোগ আইনগত সম্মতি পাবে, দেশটির তেলশিল্প বিদেশী পুঁজির কাছে আরো খুলে যাবে। নাইজেরিয়ার তেলশিল্প নামমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছিল। এতে দেখা যায়, নাইজেরিয়ার আইনসভাকে ইচ্ছে মতো ম্যানিপুলেট বা নাড়াচাড়া করার জন্য কোম্পানির কৌশল নিয়ে পিকার্ড আলোচনা করেন। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নাইজেরিয়ার সিনেট বা আইন সভার উচ্চকক্ষ খারাপ ধরনের বিল পাস করবে। তবে ‘এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। আইন সভার নিম্নকক্ষের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। নিম্নকক্ষও আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায় বলে মনে হয়।’
পিকার্ডের কাছে রাষ্ট্রদূত স্যান্ডার্স জানতে চান, তেল কোম্পানিগুলো ঐক্যবদ্ধ কিনা অর্থাৎ শেলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মতভেদ রয়েছে কিনা? উল্লেখ করা দরকার যে, শেল হচ্ছে ব্রিটিশ-ডাচ মালিকানাধীন কোম্পানি।
পিকার্ড জানান, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সবপর্যায়ে সঙ্গতি রয়েছে। রাষ্ট্রদূত তখন পিকার্ডকে জানান, যৌথ উদ্যোগের পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ, ডাচ ও ফরাসি দূতাবাসের কর্তারা একত্রে নাইজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেছেন।
পিকার্ড এর পরে নাইজেরিয়ায় তেল ব্লকগুলো নিয়ে বিডিংয়ে চীনের আগ্রহের কথা রাষ্ট্রদূতকে জানান। তিনি বলেন, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের পেট্রোলিয়াম বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা চীনাদের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছে তার একটি কপি শেল পেয়েছে।
মার্টিনের ওই লেখায় তার বার্তার উল্লেখ করে বলা হয়, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে তেল নিয়ে নাইজেরিয়ার যে আলাপ-আলোচনা চলছে সেখানে শেলের ‘ভালো সোর্স’ বা তথ্য জানানোর ভালো লোক রয়েছে। কারণ, নাইজেরিয়া সরকার ‘ভুলে গেছে যে, প্রাসঙ্গিক সব মন্ত্রণালয়েই শেল লোক রেখেছে এবং এর ফলে এসব মন্ত্রণালয়ে যা করা হয়, তার সবই শেল জানতে পারে।’
উইকিলিকসের ফাঁস করে দেওয়া এ তারবার্তায় যা প্রকাশ হয়েছে, তা থেকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সরকারের লেনদেন, আলাপ-আলোচনা; একটি বিদেশী কোম্পানির আগ্রহের, নাক গলানোর ও তৎপরতার ব্যাপ্তি; একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের আইনসভার কার্যক্রমে একটি বিদেশী কোম্পানির হস্তক্ষেপ, ইত্যাদি বুঝতে পারা যায়। এসব কোম্পানির হাত অনেক শক্তিশালী ও দীর্ঘ।
উইকিলিকসের ফাঁস করে দেওয়া তারবার্তা থেকে দেখা যায়, তেল কোম্পানি শেলের এ কর্তা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেবল তেল সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই যে আলোচনা করেছেন, তা নয়। তারা নাইজেরিয়ার রাজনীতি, অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশ পর্যায়ে পরবর্তী নির্বাচন, নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ও তাদের আলোচনায় স্থান পায়।
তারবার্তা থেকে জানা যায়, শেলের একটি স্থাপনায় সশস্ত্র হামলার পরে সে স্থাপনায় শেল নিয়োগ করে ইসরাইলি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল ডোনা ব্লেয়ারের পাঠানো তারবার্তা থেকে জানা যায়, আরেক সভায় পিকার্ড নাইজেরিয়ায় রুশ তেল-গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রময়ের কোনো আগ্রহ আছে কিনা এবং থাকলে সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু জানে, সেটা জানতে চান। নাইজার ডেল্টায় সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর সম্ভাব্যতা সম্পর্কেও তিনি জানতে চান। তেল কোম্পানির এ কর্তা ও দূতাবাসের কর্তা নাইজেরিয়ায় সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অনুসৃত নতুন ধরনের সামরিক কলাকৌশল নিয়েও বিস্তারিত আলাচনা করেন। এসব সশস্ত্র গ্রুপ তখন স্থলভাগ থেকে আক্রমণ চালাচ্ছিল। এর আগে এসব গ্রুপ আক্রমণ চালাতো জলভাগ থেকে, তাদের বিশদ আলোচনায় এসব সশস্ত্র গ্রুপের ব্যাপারে নাইজেরিয়া সরকারের রাজনৈতিক সাড়া বা পাল্টা ব্যবস্থাও স্থান পায়। শেল কর্তা পিকার্ড এ আলোচনাকালে অভিযোগ করেন, ‘ডেলটা স্টেট ও বায়েলসা স্টেটের [নাইজেরিয়ার দুটি অঙ্গরাজ্য] গভর্নরদ্বয় স্ব স্ব অঙ্গরাজ্যে যেভাবে সশস্ত্র সংগঠনের কর্মীদের নিজ পক্ষে ভিড়িয়ে নেওয়ার কাজে সফল হয়েছেন, সেভাবে রিভারস স্টেটে সফল হওয়ার জন্য সে অঙ্গরাজ্যের সশস্ত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই’ রিভারস স্টেটের গভর্নরের।
এসব তার বার্তা থেকে আরো জানা যায়, শেল কর্তা যুক্তরাষ্ট্রের কনসালকে বলছেন, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপ করার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হয়েছে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে। এ মর্মে ‘গোয়েন্দা’ খবর আছে তেল কোম্পানির কাছে। তবে এ খবরের নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে কোম্পানি নিশ্চিত নয়। ‘আকাশপথে নিরাপত্তার জন্য শেল গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে পিকার্ড জানান, শেলের হেলিকপ্টারগুলো মোটামুটি সবসময়ই সশস্ত্র সংগঠনের ব্যবহৃত ছোট ও মাঝারি মাপের অস্ত্রের পাল্লার ওপর দিয়ে চলাচল করে।’ এসব তথ্য কোনো প্রতিপক্ষের নয়। সংশ্লিষ্টদের কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনার বিবরণ এগুলো। আর এ বিবরণগুলো লিখেছেন সংশ্লিষ্টরাই। তাদের বয়ান তারা লিখে পাঠিয়েছেন তাদেরই ঊর্ধ্বতন মহলে, সদর অফিসে। উইকিলিকস এগুলো ফাঁস করেছে মাত্র। তাই এখানে বানোয়াট বিবরণের সুযোগ নেই, যদি বানোয়াট, অতিরঞ্জন, অল্পকথন কিছু থেকে থাকে, সে দায় বার্তা রচয়িতাদের। তবে সে সুযোগও নেই। কারণ, এসব কথাবার্তা সবই কাজকর্মে সংশ্লিষ্ট। আর এসব কাজকর্ম যে ব্যবসার ও যে কোম্পানির সঙ্গে জড়িত তার ব্যাপ্তি অনেক দেশের চেয়ে বড়, যার রাজস্ব অনেক দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের চেয়ে বেশি। সামান্য হেরফেরে বহু টাকার লোকসান হয়ে যাবে।
ফাঁস হওয়া এসব বার্তা দেখিয়ে দেয় এমন বাণিজ্যে জড়িতদের হয় তো কত দীর্ঘ, কত সবল, একটি দেশের কত গভীরে, কত পর্যায়ে কত জনের সঙ্গে তাদের সখ্য। এগুলো আরো দেখিয়ে দেয় এ ধরনের কোম্পানিগুলো একটি দেশের কত দিকে সূক্ষ্মভাবে ও গভীর মনোযোগ দিয়ে নজর রাখে, কত দিককে নিজেদের ইচ্ছেমতো নাড়াচাড়া করে, সাজায়-গোছায়, দোমড়ায়-মোচড়ায়। একটি সমাজে বাইরের পক্ষ, ব্যবসায়, কোম্পানি এভাবে হস্তক্ষেপ করলে, প্রভাবিত করলে, দোমড়ালে, মোচড়ালে সে সমাজ কি আপন গতিতে আপন পছন্দসই দিকে চলতে পারে? এভাবে প্রভাবিত করলে, দোমড়ালে-মোচড়ালে সে সমাজ, সে রাষ্ট্র কি স্ব দেশের জনসাধারণের কল্যাণ বয়ে আনে?
ঘটনাবলী সাক্ষ্য দেয় : কল্যাণ আসে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ের সংশ্লিষ্ট পুঁজির, দেশটির জনসাধারণের কল্যাণ হয় না। নাইজেরিয়া বিষয়ে আরো তথ্য সে সত্যই প্রকাশ করে। আগামীতে এমন আরো তথ্য পাওয়া যাবে বুধবারেরই পাতায়।
ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৫০০ সালে বলেছিলেন, ‘সোনা হচ্ছে পৃথিবীর সেরা জিনিস।… আত্মাকে উড়িয়ে স্বর্গে পাঠানোর কাজেও তা ব্যবহার করা যায়।’ আজ তেল যেন পাখা পেয়েছে। সে পাখাতেই ভর করে তেল ব্যবসায়ীরা উড়ে চলেছে মুনাফা গগনের ওপরে, আরো ওপরে।
রাজনীতিকে লেনিন বলেছিলেন, অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য সেটা দেখিয়ে দেয়। আদার বেপারি জাহাজের খোঁজ নেয়া অবান্তর মনে হলেও তেল বেপারীর রাজনীতির খোঁজ নেওয়া খুব জরুরি। কারণ রাজনীতির হালচাল তাদের ব্যবসার অনেক দিকই নির্ধারণ করে। তাই রাজনীতিকে পছন্দমতো কাজে লাগাতে তেল বেপারীরা রাজনীতিবিদদের, আইন প্রণেতাদের বা আইনসভা সদস্যদের দলে ভেড়াবে, তাতে আশ্চর্যের কোনো কারণ নেই। এ বেপারীরা আসলে বিশাল সব বহুজাতিক করপোরেশন, দানবতুল্য। এদের ব্যবসার জগতে সব আছে, এক সঙ্গে মিলেমিশে : ব্যবসা, কারখানা, খনি, পরিবহন, ব্যাংক, বিনিয়োগ। জন কেনেথ গলব্রেথ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত দ্য নিউ ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টেট নামের বইতে লিখেছিলেন : ‘প্রযুক্তিগত দিক থেকে গতিময়, বিপুল পুঁজি সমৃদ্ধ, খুবই সংগঠিত কয়েকশ’ করপোরেশনের’ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্বের উৎপাদনের বিশাল অংশ, তা বেড়ে চলেছে। এ বছরেই ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে ওয়ার/পিস রিপোর্টে ‘এমার্জিং নিউ ওয়ার্ল্ড পাওয়ার : দ্য ওয়ার্ল্ড করপোরেশন’ শিরোনামের প্রবন্ধে এ বারবার লিখলেন : চারশ’ থেকে পাঁচশ’ বহুজাতিক করপোরেশন এক প্রজন্মের মধ্যে গোটা পৃথিবীর স্থির সম্পদের মোটামুটি দু-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করবে।
আজ নাইজেরিয়ায় তেল নিয়ে যা কিছু কারবার, তা সে তেল আহরণ, শোধন, পরিবহন হোক বা সে সব পছন্দ মতো করার জন্য রাজনীতি, নির্বাচন, আইনসভা, সরকার, নানান দল-উপদল গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করা বা নিয়ন্ত্রণ করাই হোক, সব ক্ষেত্রে হাত রয়েছে এসব ব্যবসাদারের, বহুজাতিক করপোরেশনের, যাকে সংক্ষেপে বলা যায় বক।

Thursday, July 7, 2011

তেল-গ্যাস লুন্ঠন দেশে দেশে-২ : আফ্রিকার অভিজ্ঞতা

সম্পদ, প্রাচুর্য আর দারিদ্র্য, লুট আর দুর্দশা, কতিপয়ের বিলাস আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মানবেতর জীবনের কথা উঠলেই আফ্রিকার প্রসঙ্গ ওঠে। ‘বিচিত্র’ এক মহাদেশ!
নক্রুমা আগের সংখ্যায় উল্লেখিত বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শুরুতেই লিখেছেন : আফ্রিকা আপাতদৃশ্য এক বৈপরীত্য। তার মৃত্তিকা প্রাচুর্যে ভরা। অথচ সে মাটির ওপর আর নিচ থেকে যে সামগ্রী আসে, সেগুলো আফ্রিকানদের সমৃদ্ধ করে না। সে সামগ্রী সম্ভার ধনী বানায় তাদেরই যারা আফ্রিকাকে গরিব বানানোর জন্য কাজ করে চলে। আফ্রিকার খনিতে যে লোহা আকর মজুদ আছে তা আমেরিকার মজুদের দ্বিগুণ, (তৎকালীন) সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই-তৃতীয়াংশ। আফ্রিকার খনিতে যে কয়লা মজুদ আছে তা দিয়ে তিনশ’ বছর চলা যায়। তেলের নতুন নতুন খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশ্বের সম্ভাব্য জলশক্তির শতকরা ৪০ ভাগ রয়েছে আফ্রিকায়। অন্য কোনো মহাদেশে এতো পানি শক্তি নেই। সাহারা মরুভূমির বিস্তৃতি সত্ত্বেও আফ্রিকায় আবাদযোগ্য ও চারণ ভূমি যা আছে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে বেশি। বেশি এশিয়ার চেয়ে। আফ্রিকার বনভূমি যুক্তরাষ্ট্রের বনভূমির দ্বিগুণ। এমন মহাদেশ সম্পর্কে যে কাউকে প্রশ্ন করলে আফ্রিকার পরিচয়ের সঙ্গে উঠে আসবে দারিদ্র্য, সংঘাত, দুর্ভিক্ষ, লুটের কথা। অথচ এ মহাদেশটি মানব জাতির সূতিকাগার। এখানে প্রায় ৭০ লাখ বছর আগে প্রাণী আর পূর্ব মানবের বিবর্তন রেখা দুটির মিলন ঘটেছিল। এখানেই সর্বপ্রথম মানুষের পূর্ব পুরুষরা বসতি গড়ে তোলেন। সেখান থেকে তাদের যাত্রা হয় ইউরোপে, এশিয়ায়।
দফায় দফায় সে যাত্রার পরে মহাদেশটিকে করায়ত্ত করে বেলজিয়াম, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন। পৃথিবীর ভূভাগের শতকরা ২০ ভাগ নিয়ে গঠিত এ মহাদেশে বসবাস বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ। আর ২০০৫ সালে মহাদেশটিতে উদ্বাস্ত্তর সংখ্যা ছিল দেড় কোটি। এদের মধ্যে ৩৩ লাখ মানুষ সংঘাত, সহিংসতা, রক্তপাতের হাত এড়াতে নিজ বাসভূমি থেকে পালিয়েছেন অন্য দেশে। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজ দেশেই আছেন। তবে নিজ বসতের এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায়। সারা পৃথিবীতে যে ৩৮টি দেশকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বিপুলভাবে ঋণগ্রস্ত গরিব দেশ হিসেবে গণ্য করে, সেগুলোর মধ্যে ৩২টি রয়েছে এ মহাদেশে। এ সব তথ্য দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সাময়িকীর ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। ব্রুন্টল্যান্ড কমিশন তার রিপোর্টে আফ্রিকা সম্পর্কে বলেছিল : মহাদেশটি চক্কর খেতে খেতে নিচে নামছে। সেখানে আছে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, হ্রাসমান সঞ্চয়, নতুন বিনিয়োগে অবহেলা, শিক্ষার অভাব, শিশু মৃত্যুর চড়া হার, গ্রামে অনাহার থেকে পালাতে শহরে এসে ভিড় জমানো। এসব বাড়িয়ে তোলে অপর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের সমস্যা।
আফ্রিকার এই সংকটের বহু কারণ। এ সবের একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, আফ্রিকার অনেক দেশের কাঁচামালের দাম পড়ে গেছে। বাণিজ্যের শর্ত হয়েছে প্রতিকূল, সাহায্যের তহবিল গেছে কমে। আফ্রিকায় কৃষি উৎপাদন সাম্প্রতিককালে এতো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, সেটা কোনো আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করলে যে ক্ষতি হতো তার চেয়েও বেশি। অথচ আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের সরকার মাটির সে ক্ষতি রোধে যে অর্থ খরচ করে, সম্ভাব্য আক্রমণকারী সেনাদলের হাত থেকে রক্ষা পেতে খরচ করে তার চেয়ে বেশি।
কেন এমন অবস্থা এ মহাদেশের? এ প্রশ্নেরও উত্তর দেন নত্রুুমা : আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ মহাদেশটির শিল্পোন্নয়নে নিয়োজিত হয়নি। তা ব্যবহৃত হয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার শ্রী বৃদ্ধিতে। এ এক বিরামহীন প্রক্রিয়া। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা প্রবলভাবে বেড়েছে। সমর প্রস্ত্ততি আর পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। কারণ হিসেবে তিনি পাকা মালের বর্ধমান চাহিদা মেটাতে ধাতব ও অ-ধাতব কাঁচা মাল আহরণে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। এ সব প্রযুক্তি কাঁচা মাল আহরণের কাজ দ্রুত করতে পারে।
মোদ্দা কথায় ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে : আরো মুনাফার জন্য আরো পণ্য তৈরি, আরো পণ্য তৈরির জন্য আরো কাঁচা মাল আহরণ, আরো কাঁচা মাল আহরণের জন্য খুবলে নাও, কেড়ে নাও, ছিনিয়ে নাও, দখল কর যা কিছু আছে আফ্রিকার। আর কাঁচা মালের ক্ষেত্র ও পাকা মালের বাজার দখলে রাখতে বানাও অস্ত্র। সেই সঙ্গে কোনো কোনো দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে পড়েছে সমর শিল্পনির্ভর।
এ ধারাই আফ্রিকাকে আবৃত করে দেয় নিরক্ষরতা, অনাহার, দুর্নীতি, অপশাসন, বঞ্চনা, নির্যাতনের কালো চাদরে। সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধ-গৃহযুদ্ধ-অস্ত্র কেনা আর সেনাদল পোষার বিপুল ব্যয়।
অথচ ব্রিটেনের শ্রমিক দলীয় নেতা ও এককালীন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ১৯৫৩ সালে দ্য ওয়্যার অন ওয়ার্ল্ড পভার্টি এন এপিল দ্য কনশেন্স অব অ্যানকাউন্ড বইতে লিখেছিলেন : মানবজাতির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সবচেয়ে জরুরি সমস্যা যুদ্ধ নয়, নয় কমিউনিজম বা জীবন ধারণ ব্যয় বা কর। তাহচ্ছে ক্ষুধা, এ ক্ষুধা একই সঙ্গে দারিদ্র্য, দুর্দশার কারণ ও ফলাফল।
আফ্রিকার এ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্দশার সঙ্গে যুক্ত মহাদেশটির সম্পদ অন্যত্র চলে যাওয়া, শিল্পে ব্যবহার্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ৫৩টি খনিজ সম্পদ ও ধাতব পদার্থ রয়েছে আফ্রিকায়। অথচ আফ্রিকায় শিল্পোন্নয়ন হয়নি। এগুলো চলে যায় বহুজাতিক কোম্পানির (বক) হাত ধরে অন্য দেশে, প্রভুদের পকেটে। সব বহুজাতিক কোম্পানি (বক) বিনিময়ে দিয়েছে হানাহানি, অস্ত্র, যুদ্ধ, বিবাদ।
আফ্রিকাকে কব্জা করতে ঔপনিবেশিক প্রভুরা তৈরি করেছে খন্ড খন্ড সত্তা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। তাদের ঘরে গেছে মুনাফা। এ কাজে যুক্ত নানা নাম : শেল, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ইম্পেরিয়াল টোবাকো, বর্মা অয়েল, নচাংগা কপার, রোকানা করপোরেশন, রোডেশিয়ান মাইন্স, ব্রিটিশ সাদ আফ্রিকা। এসব একচেটিয়া কোম্পানির নামে ও সংগঠনে সময়ান্তরে পরিবর্তন ঘটেছে। বেশ কিছু নাম এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুরনো নাম বদলে হয়েছে নতুন নাম। তবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের কাজ অব্যাহত রয়েছে। কেবল ব্রিটিশ একচেটিয়া কোম্পানি নয়, ফরাসি, জার্মান, বেলজিয়াম, ইতালীয় একচেটিয়া কোম্পানিগুলোও ছিল। এদের মধ্যে ছিল খনি কোম্পানি, পরিবহন কোম্পানি, ব্যাংক, বিনিয়োগ কোম্পানি, সব মিলিয়ে এক অাঁতাত। আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বেসরকারি বিনিয়োগ ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে বৃদ্ধি পায় ১১ কোটি ডলার থেকে ৭৮ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। এর অধিকাংশই আসে মুনাফা থেকে। যে ৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার বৃদ্ধি পায় তার মাত্র ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রকৃতপক্ষে নতুন বিনিয়োগ। উদ্বৃত্ত আবার বিনিয়োগসহ মোট বিনিয়োগ থেকে মুনাফা পায় যুক্তরাষ্ট্র, আর আফ্রিকার দেশগুলোর লোকসান হয় ৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া কোম্পানিগুলো ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সেই মুনাফা করে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবের ভিত্তি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান। তবে অন্যান্য সূত্রের হিসাবে মুনাফার পরিমাণ ১৫০ কোটি ডলার। এখানে উল্লেখিত ডলারের মূল্যমান তৎকালীন। এসব তথ্য প্রদান করে নত্রুুমা মন্তব্য করেছেন : এসব সংখ্যা দিয়ে এ কথা বুঝতে গণিতবিদ হওয়ার দরকার পড়ে না যে, আফ্রিকায় বিনিয়োগ থেকে মুনাফা প্রায় শত ভাগ।
এভাবে পুঁজি, বিনিয়োগ, মুনাফা, অাঁতাত, কোম্পানি, একচেটিয়া বাজার, ইত্যাদির ‘কাহিনী’ আফ্রিকাজুড়ে, প্রায় ৫০০ বছর আগে পর্তুগিজ উপনিবেশিক শক্তির আফ্রিকায় পা দেওয়ার সময় থেকে। আজ সে ‘গল্প’ আরো মার্জিত, পরিশীলিত, সূক্ষ্ম, ‘শিল্প’ সম্মত। আজ সে ‘গল্পে’ মূল চরিত্ররা বহুজাতিক কোম্পানি (বক), তাদের পেটোয়ারা এবং তাদের বশংবদ সরকারগুলো।
সবাই মিলে খুঁজে বেড়িয়েছে আফ্রিকার সম্পদ আর সে সম্পদ লুটের কৌশল। যেমন ১৯৪৯ সালের জুলাইয়ে জানানো হয়, ‘‘মার্শাল প্ল্যান সংশ্লিষ্ট মার্কিন বিশেষজ্ঞরা এটলাস পর্বতমালা থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছেন আফ্রিকায় কৃষিজ ও খনিজসম্পদরাজির খোঁজে।’’ পাওয়া গেল ফরাসি-উত্তর আমেরিকায় (অর্থাৎ সেখানে ফরাসি উপনিবেশ) সীসা খনি, ফরাসি-ক্যামেরুনে টিন খনি, ফরাসি-কঙ্গোতে দস্তা ও সীসা খনি, এমন প্রাপ্তি চলেছে, চলছে।
দেখা যাবে লোহা, বক্সাইট, হীরা, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেট, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, ইউরেনিয়াম, সোনা, মোনোজাইট, জিরকন, ক্রোমিয়াম, দস্তা, সীসা, তেল ও গ্যাস আহরণ আফ্রিকার নানা দেশে বেড়েছে অকল্পনীয় হারে। সাহারা মরুভূমিতে লোহা, তেল ও গ্যাস রয়েছে। সেখানে রয়েছে মুনাফার নজর।
আফ্রিকায় তেল ও গ্যাসের সন্ধান বকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে থাকে অনেক আগে থেকেই। লগ্নি আর শিল্প স্বার্থগুলোর মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। সেখানে অনেক আগেই জড়িয়ে পড়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল, মবিল-সকোনি, গালফ অয়েল, কন্টিনেন্টাল অয়েল, ডাচ শেল, টেক্সাকো, হ্যানোবার ব্যাংক, টেনেসি করপোরেশন, টেনেসি ওভারসিজ করপোরেশন। আজ ব্যবসায়িক লেনদেন ও কলাকৌশলে এ সব কোম্পানির গঠন, নাম, ইত্যাদিতে পরিবর্তন ঘটেছে, এসেছে নতুন নাম।
তবে তেল ও গ্যাস দখলের প্রতিযোগিতা রয়ে গেছে। রয়েছে আগ্রাসন, যুদ্ধ, দখল। সেই সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক ছলাকলা, যুক্তরাষ্ট্রের এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস বলেছিলেন : একটি বিদেশী জাতিকে জয় করার দুটো পথ আছে। একটি হচ্ছে অস্ত্রবলে দেশটির জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অপরটি হচ্ছে আর্থিক পন্থায় দেশটির অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম।
আজও এ ‘খেলা’ বা ‘যুদ্ধ’ চলছে। তাই আফ্রিকার নানা দেশে এর চিহ্ন বা তান্ডব দেখা যায়। আফ্রিকার যে দেশগুলোতে সংঘাত, সহিংসতা, গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা, বিদেশী সামরিক হস্তক্ষেপ দেখা গেছে বা যাচ্ছে এবং দেখা যাবে, সে দেশগুলোতে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজসম্পদ, তেল, গ্যাস এবং এসব সম্পদ নিয়ন্ত্রণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কয়েকটি দেশের ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি দিলে তা স্পষ্ট হবে। আগামীতে এমন কয়েকটি দেশের ঘটনার দিকে চোখ ফেরানো যাবে।