Friday, December 2, 2011

উগান্ডা : বিপরীত মেরুতে বসে কে গাইছে গান?

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-২১)
উগান্ডার প্রাকৃতিক দৃশ্য আর ইতিহাস যেন দু’বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। আফ্রিকার পূর্ব-মধ্যাঞ্চলে এ দেশটির প্রাকৃতিক দৃশ্য মানুষকে মুগ্ধ করে। উত্তরে বিশাল হ্রদ লেক ভিক্টোরিয়া ছাড়াও দেশটির অসংখ্য হ্রদ আর নদী সবুজ বনবনানিতে যোগ করে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া রূপ। স্নেহভরে তাই অনেকেই উগান্ডাকে ভাবেন মুক্তা নামে। হাতি, সিংহ, গন্ডার আর কুমির ছাড়াও বুনো প্রাণীদের ঘোরাঘুরি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সে সময়ের কথা, যখন আফ্রিকার মধ্য অঞ্চলে মানুষের পা পড়েনি, লাগেনি হাতের ছোঁয়া।

কিন্তু পূর্ব আফ্রিকায়, তাঞ্জানিয়ার উত্তরে আর কেনিয়ার পশ্চিমে ৯১ হাজার ১শ’ বর্গমাইলের সামান্য কিছু বেশি আয়তনের এ দেশটির জনজীবন, অর্থনীতি আর রাজনীতি চোখ ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো মনমুগ্ধকর নয়। দেশটির উত্তরে সুদান। দক্ষিণ-পশ্চিমে রোয়ান্ডা, পশ্চিমে কঙ্গো। উগান্ডার অধিকাংশ এলাকা উঁচু মালভূমি। দেশটির মোট ভূ-ভাগের প্রায় ১৮ শতাংশজুড়ে আছে জলাভূমি আর খোলা জলাধার। এসব খোলা জলাধারের মধ্যে লেক, ভিক্টোরিয়া ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লেক জর্জ, লেক আলবার্ট, লেক এডোয়ার্ড। দেশটির দক্ষিণে রয়েছে ঘন বন। প্রধান ফসলের মধ্যে রয়েছে- কফি, তুলা, চা, ভুট্টা, বাদাম, কলা, আখ। খনিজসম্পদের মধ্যে দেশটিতে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত ছিল তামা। কিলেমবে খনি থেকে তামা তোলা শুরু হয় ১৯৫৬ সালে। তার পর থেকে তামা হয়ে ওঠে উগান্ডার সবচেয়ে মূল্যবান রফতানি খনিজ সামগ্রী। এছাড়া রয়েছে টিন, কোবাল্ট, ওলফ্রাম, বেরিল ও ক্যাসিটেরাইটও আছে কিছু পরিমাণে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত আজকের উগান্ডা অঞ্চলে একের পর এক এসেছে নানা জনগোষ্ঠী। এমন চলেছে শত শত বছর ধরে। ফলে গড়ে উঠেছিল শক্তিধর কয়েকটি রাজ্য। এমনই এক রাজ্য ছিল রুয়ান্ডা। এ স্বাধীন রাজ্যকে ব্রিটেন ১৮৯৪ সালে বানিয়ে ফেলে আশ্রিত রাজ্য। কালের ধারায় ব্রিটেনের দখল বিস্তৃত হয় উগান্ডার পূর্বাংশ পর্যন্ত। উগান্ডা স্বাধীনতা পেল ১৯৬২ সালে। ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে উগান্ডার মধ্যে থাকা রুয়ান্ডার স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা হলো। স্বাধীন উগান্ডার ড. মিল্টন ওবোটে হলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে ওবোটে ঘোষণা করলেন ‘কমন সেন্স চার্টার’ বা ‘সাধারণ মানুষের সনদ’। এ সনদে দেশের সম্পদ সুষমভাবে বণ্টনের জন্য বর্ধিত প্রচেষ্টা গ্রহণের আহবান জানানো হলো। অনেকে মনে করলেন, ওবোটে বাম দিকে ঝুঁকছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন কলকারখানা জাতীয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হলো। ব্যক্তি মালিকদের কোম্পানিগুলো জাতীয়করণের কর্মসূচি আইনসভায় অনুমোদিত হলো। শুরু হলো উগান্ডার ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার পদচারণা। কতই না রহস্যময় অর্থনীতি আর রাজনীতির সম্পর্ক!

মিল্টন ওবোটেকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা নিলেন জেনারেল ইদি আমিন, ১৯৭১ সালে ইদি আমিনের শাসনকাল ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আর রক্তাক্ত দমন-পীড়নে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে রয়েছে। ইদি আমিনের পতন ঘটল ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে। ক্ষমতায় বসল নানা উপদলে দীর্ণ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট। এ মোর্চার নেতৃত্বে ছিলেন তারা, ইদি আমিনের শাসনকালে যারা ছিলেন প্রবাসে নির্বাসনে। নির্বাচন হলো ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে। সে নির্বাচনে জয়লাভ করল ওবোটের উগান্ডা পিপলস কংগ্রেস। তবে সেনাবাহিনী হয়ে থাকল উগান্ডার রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ শক্তি। সেই সঙ্গে উগান্ডার নানা বিষয়ে শেষ কথা ছিল প্রতিবেশী তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়ান নারায়েরের। কারণ ইদি আমিনকে ক্ষমতার আসন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযানে সামনের সারিতে ছিল তাঞ্জানিয়ার সৈন্যরা। কিছু কাল ১০ হাজার তাঞ্জানীয় সৈন্য উগান্ডাতে অবস্থানও করে।

গৃহযুদ্ধ আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে অন্য দিকে উগান্ডার ফিরে চলা শুরু হয় আশির দশকের শেষ ভাগে। কারণ হানাহানি-রক্তপাতের অস্থিতির পরিবেশে পুঁজি বিনিয়োগ অসম্ভব, বিনিয়োজিত পুঁজি দিয়ে মুনাফা করা অনিশ্চিত, পুঁজি থাকে নিরাপত্তাহীন। তাই দরকার হানাহানি বন্ধ করা, দরকার পুঁজির কাছে গ্রহণযোগ্য শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ। কারণ অস্থিতির হানাহানির পরিবেশে শ্রমকে এক সঙ্গে বেঁধে বাড়তি মেহনত আত্মসাৎ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। যে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা পুঁজিকে করে সমৃদ্ধ; অর্থাৎ পুঁজি আরো ফুলেফেঁপে ওঠে। কানের সঙ্গে যেমন মাথা বা মাথার সঙ্গে যেমন কান থাকে, সেভাবেই পুঁজি ফুলেফেঁপে ওঠার ‘শান্তিপূর্ণ-স্থিতিশীল’ পরিবেশে থাকে দুর্নীতি, জুয়াচুরি, জালিয়াতি, ধাপ্পাবাজি। আর দারিদ্র্য-অনাহারের সব সময়ের পরিচিত চেহারা তো থাকেই।

ঘটনার ধারার দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ইদি আমিন ১৯৭২-৭৩ সালে তাঞ্জানিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়ায়; এর বছর পাঁচেক পরে, ১৯৭৮ সালে তাঞ্জানিয়ায় আক্রমণ চালায় উগান্ডা, লক্ষ্য ছিল তাঞ্জানিয়ার কাগেরা অঞ্চলকে উগান্ডার একীভূত করে নেওয়া; পরের বছর ১৯৭৯ সালে তাঞ্জানিয়া আক্রমণ চালায় উগান্ডায়। এ সময় ইদি আমিনবিরোধী সব পক্ষকে তাঞ্জানিয়া ঐক্যবদ্ধ করে; সে বছরই ইদি আমিন পালিয়ে যায় দেশ থেকে; প্রেসিডেন্ট হিসেবে চেয়ারে বসানো হয় ইউসুফু লুলেকে; কিন্তু অল্পকালের মধ্যে লুলেকে তাড়িয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় গডফ্রে বিনাইসাকে; আবার অল্পকালের মধ্যে ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনী হটিয়ে দেয় বিনাইসাকে; নির্বাচনে মিল্টন ওবোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় ওবোটেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে; প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হয় টিটে ওকেলোকে; পরের বছর ১৯৮৬ সালে ন্যাশনাল রেজিট্যান্স আর্মি বা জাতীয় প্রতিরোধ বাহিনী নামে এক দল বিদ্রোহী রাজধানী কাম্পালা দখল করে ইয়োয়েরি মুসেভেনিকে প্রেসিডেন্ট পদে বসায়।

এই একটি কিন্তু দীর্ঘ বাক্যে প্রায় ১৫ বছরের যে ঘটনা প্রবাহের খুব সংক্ষেপ বিবরণ রয়েছে, তাতে দেশটির যে অবস্থা ফুটে উঠেছে, সে অবস্থায় কোন বিনিয়োগকারী পুঁজি ঢালবেন মাটির সম্পদ আর মানুষের মেহনত আত্মসাৎ করার জন্য? গরু পোষাও তো নিরাপদ নয় এমন অস্থিতিতে, ফসল আবাদের জন্যও তো কিয়ৎকালের স্থিতি দরকার। তখনই মনসদে বসলেন বা বসানো হলো মুসেভেনিকে। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ তেমন খাত ধরেই রইল।

তবে তার আগে দেখা যাক মুসেভেনির শাসনকে। এক বিদ্রোহী বাহিনীর প্রধান হিসেবে ক্ষমতা করায়ত্ত করলেন তিনি। তার পরে ২৫ বছরের বেশি কাল ধরে চলছে তার শাসন। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি জয় লাভ করেছেন। এর আগে ২০০৬ সালের নির্বাচনেও জিতেছিলেন। এ নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট পদে থাকার মেয়াদগত সীমা সরিয়ে ফেলেছেন। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোট জুয়াচুরি হয়েছে বলে মুসেভেনির প্রতিদ্বন্দ্বী অভিযোগ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, মুসেভেনি উগান্ডায় তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীলতা এনেছেন। দেশটিতে ২০০৫ সালে বহুদলীয় ব্যবস্থা আবার চালু করার আগে পর্যন্ত মুসেভিনে রাষ্ট্রটিকে চালিয়েছিলেন এক দলীয় ব্যবস্থায়। তিনি এ যাবৎ মোট চার বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন; ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৬ ও ২০১১ সালে। অর্থাৎ চলছে এক ব্যক্তির একটি শাসন ব্যবস্থা, রয়েছে স্থিতি, পুঁজিবাদী বিশ্ব এই এক ব্যক্তির শাসন নিয়ে কথা বলে না।

হত্যা, অপহরণ, লর্ডস রেজিস্ট্যানস আর্মি নামে সশস্ত্র দলের গেরিলা কার্যক্রম অব্যাহতও রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে কিছু ‘মজার’ ঘটনা। প্রথমে উল্লেখ করা যায় ১৯৯৫ সালে বলবত সংবিধানের কথা। সে সংবিধান রাজনৈতিক দল গঠনকে বৈধ করে; কিন্তু রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে। যে কোনো পাঠকই এ ঘটনার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন তেলসমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলার। সে দেশটিতে শ্যাভেজ সরকার এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমেরিকা-ইউরোপের সরকারগুলো ও মূল ধারার তথ্য মাধ্যম কি বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা-নিন্দার বন্যা বইয়ে দিত না? অথচ উগান্ডার এ খবর ক’বার, কয়টি তথ্যমাধ্যম প্রচার করেছে? এর পর উল্লেখ করা যায় ১৯৯৭ সালের আরেকটি ঘটনা। সে বছর উগান্ডার সৈন্যরা জায়েরে (পরবর্তীকালে দেশটির নাম হয় কঙ্গো) ঢুকে মুবুতু সরকারকে উৎখাত করতে সাহায্য করে। ক্ষমতায় বসানো হয় লরেন্ট কাবিলাকে। পরের বছর উগান্ডা আবার ঢোকে জায়েরে। এবারের প্রবেশ ঘটে কাবিলাকে উৎখাতে সচেষ্ট বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আক্রমণের ও আক্রমণ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। এ দুয়ের মধ্যে এ দুই ঘটনা নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার সরকারগুলো ও মূল ধারার তথ্যমাধ্যমের প্রচারের মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই পাঠকদের মনোযোগ বা দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। সাদ্দামের ক্ষেত্রে সোচ্চার, সক্রিয়, নিন্দামুখর অবস্থান অপরটি যেন চোখের বা জানার আড়ালে রয়ে গেল। এমন ‘মজাদার’ তৃতীয় ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করতে হয় ২০০০ সালের একটি ঘটনা। সে বছর উগান্ডার ভোটাররা বহু দলব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে মুসেভেনি প্রবর্তিত ‘নির্দল’ ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেন। যদি এ ঘটনা ভেনেজুয়েলায় ঘটত? ইউরোপ-আমেরিকার সরকারগুলো ও মূল ধারার তথ্যমাধ্যম সে ঘটনাকে কিভাবে, কতটুকু রং মাখিয়ে, কত জোরালো গলায়, কত রসালো ভঙ্গিতে, কত নিন্দার সুরে প্রচার করত, তা অনুমান করা যায় ভেনেজুয়েলা সম্পর্কে মূল ধারার বর্তমান প্রচার দেখেশুনে। এর পরের ‘মজাদার’ ঘটনা ২০০৫ সালে। আন্তর্জাতিক আদালতে কঙ্গো অভিযোগ করে, উগান্ডা ১৯৯৯ সালে কঙ্গোতে অনুপ্রবেশ, কঙ্গোর নাগরিকদের হত্যা ও কঙ্গোয় লুটপাট করে। উগান্ডা সে অভিযোগ অস্বীকার করে। আদালতে উগান্ডার কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়নি। অথচ একই ধরনের কাজকর্মের দায়ে এ আদালতেই বিচারের উদাহরণ রয়েছে। এসব ঘটনা পাঠককে হয় তো মনে করিয়ে দেবে বিশ্বে বর্তমানে চালু ব্যবস্থার কথা। আর পাঠকের হয় তো মনে পড়বে আমাদের জাতীয় কবির রচিত গানের একটি লাইন : খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে।

কে খেলছে। আগে, একটি দীর্ঘ বাক্যে উগান্ডার প্রায় ১৫ বছরের এত ঘটনা আর পরবর্তীতে কয়েকটি বাক্যে প্রায় ২৫ বছরের শাসনের বিবরণ কি কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরে না? প্রশ্ন কি এটা যে, এত ঘটনা কেন? এত ঘটনার আড়ালে কারা? কেন এত রক্তপাত, হানাহানি, ক্ষমতায় বসানো, ক্ষমতা থেকে সরানো? উগান্ডার সমাজ, রাষ্ট্র এত অস্থির, এত সহিংশ হয়ে ওঠে কেন। আবার স্থিতিশীলতাই ফিরে আসে কিভাবে? এসব কোন সঙ্গীতের সুর? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে আগামীতে। আজ বোধ হয় একটি ঘটনাকে প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে শেষ করা যেতে পারে।

উগান্ডার একটি বার্তা মাধ্যম খবর দেয় : উগান্ডার বিশিষ্ট গায়িকা শেইলা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, স্টেট হাউসে এক অনুষ্ঠানে তাকে দেখেই প্রেসিডেন্ট মুসেভেলি চিনে ফেলেন এবং গান গাইতে অনুরোধ করেন ও এক পর্যায়ে গায়িকাকে প্রেসিডেন্ট কোলে তুলে নেন। সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ‘আই স্যাট অন মুসেভেনিজ ল্যাপ’, ‘মুসেভেনির কোলে বসেছিলাম।’ দেশটির ঘটনাও কি এমন? নিভৃতে কারো কোলে বসে কেউ গাইছে মধুর সুরে গান? দেশবাসীও কি জানেন : কার কোলে কে বসে আছে?

Thursday, November 24, 2011

তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফার ‘খেলা’

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-২০)
তেল-গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার মধ্যে প্রাপ্তি অনেক। আইনগত কাঠামোর মধ্যে, আইনসম্মতভাবে সম্পদ আত্মসাতের মধ্যেও প্রাপ্তি বিপুল। চারধারেই তা ঘটছে। এ বিবরণ প্রায় অফুরন্ত। কেবল তেল কোম্পানির কথাই উল্লেখ করা যাক।

তেলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি কোম্পানি এ বছরের প্রথম ৯ মাসে মুনাফা করেছে ১০২.৮৫ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ২৮৫ কোটি ডলার। এক ডলারকে ৭০ টাকার সমান গণ্য করলে টাকার অঙ্কে মুনাফার এ পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ পাঁচটি কোম্পানি হচ্ছে বিপি বা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, কনোকো-ফিলিপস, শেভরন, এক্সনমবিল ও শেল। এসব কোম্পানির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। অনুমান করা হয় যে, মুনাফার পরিমাণ এ বছর শেষে ১৪০০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে।

বার্তা সংস্থা রয়টার অক্টোবরের শেষ দিকে ‘টোটাল, শেভরন প্রফিটস লিফটেড বাই ফার্ম অয়েল প্রাইম’ (‘তেলের মজবুত দামের ফলে টোটাল, শেভরনের মুনাফা বেড়েছে’) শিরোনামে এক খবরে জানায় : তেল কোম্পানি শেভরন ও টোটাল ২৮ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে অধিকতর মুনাফা অর্জনের কথা জানিয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি কষ্টকর হলেও মুনাফা বেড়েছে। বছরের প্রথম ৯ মাসে এ দুটি কোম্পানি ছাড়াও এক্সনমবিল, শেল ও বিপিরও মুনাফা বৃদ্ধি পায়।

এ বছরের জুলাইয়ে এক খবরে জানা যায় : ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় তিনটি তেল কোম্পানি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলার মুনাফা করে। এর মধ্যে শেল প্রতিদিন মুনাফা করে ৭৫ মিলিয়ন বা সাড়ে সাত কোটি ডলার। এ তিনটি কোম্পানি হচ্ছে শেল, বিপি এবং বিজি।

উল্লেখ করা দরকার যে, শেল ২০০৮ সালে মুনাফা করেছিল ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার সাতশ’ কোটি ডলারের বেশি। এ পরিমাণটিই ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ কোম্পানির এক বছরে সর্বাধিক পরিমাণ মুনাফা। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন যে, এ বছরও শেলের মুনাফার পরিমাণ ২০০৮ সালের সমপরিমাণ হতে পারে বা ছাড়িয়েও যেতে পারে।

তেল কোম্পানিগুলোর বিপুল মুনাফার ঘটনা কেবল কোনো একটি বছরের ঘটনা নয়। এরা অন্যান্য বছরেও চড়া মুনাফা করে থাকে। যেমন ২০০৮ সালের প্রথম ৯ মাসে পাঁচটি সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানির মুনাফা ছিল প্রায় রেকর্ড পরিমাণ। এ পাঁচটি কোম্পানি হচ্ছে বিপি, শেভরন, কনোকো-ফিলিপস, এক্সনমবিল ও শেল। ওই সময়ে তেলের দাম ছিল খুব চড়া। পরবর্তী তিন মাসে দাম কিছুটা পড়লে মুনাফার পরিমাণও কিছুটা কমে। তবে পুরো বছরের হিসাবে ২০০৮ সালে এ পাঁচ কোম্পানির মুনাফা দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার। এ পরিমাণ কেবল ২০০৭ সালের মুনাফার চেয়ে কম। এ পাঁচটি কোম্পানির ২০০৭ সালের মুনাফার পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এ সব তথ্য উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল জে ওয়েইস তার ‘বিগ অয়েল মেড ওভার সিক্স হান্ড্রেড বিলিয়ন ডলার ডিউরিং বুশ ইয়ার্স’ শিরোনামের নিবন্ধে।

তিনি এ সব তথ্য উল্লেখ করে আরো জানান যে, বুশের দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সবচেয়ে বড় পাঁচটি তেল কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬৫৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি ডলারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। অন্যভাবে বলা যায়, এ পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ছয়শ’ কোটি ডলার। এতো বিপুল মুনাফা করার ব্যাপারে অনেকের আপত্তি না থাকলেও কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, এত মুনাফা কিভাবে হয় এবং সে মুনাফা যায় কোথায়? এ প্রশ্ন অনেকেই করেছেন ও করছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের শুনানিতে এ প্রশ্ন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বা আইনসভার তেল মূল্য ও ইন্ধন স্বাধীনতা বিষয়ক বাছাই কমিটির এক শুনানি হয় ২০০৮ সালের প্রথম ভাগে। সেখানে তলব করা হয় এক্সনমবিল, শেল, বিপি, কনোকো-ফিলিপস ও শেভরনের কর্তাদের। সেখানে কংগ্রেস সদস্যরা বা আইন প্রণেতারা তলব করে আনা তেল কর্তাদের কাছে জানতে চান যে, এত বিপুল মুনাফা করা সত্ত্বেও বারবার ব্যবহার করা যায়, এমন জ্বালানি খাতে প্রায় কিছুই বিনিয়োগ করা হচ্ছে না কেন? এ কারণে তাদের তিরস্কারও করা হয়। এসব কোম্পানি যে বছর ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার মুনাফা করে সে বছরেই কর রেয়াত হিসেবে পায় ১৮০০ কোটি ডলার। তেল কর্তাদের এই বিপুল পরিমাণ কর রেয়াত বা কর সুবিধা নেওয়ার যুক্তি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়।

এসব কোম্পানি তাদের বড় কর্তাদের এত বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা দেয় যে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারি না। উদাহরণ দেওয়া যাক। লি রেমন্ড নামে একজন প্রধান নির্বাহী কর্তা ছিলেন এক্সনমবিলে। এই প্রধান নির্বাহী কর্তা পদটিকে ইংরেজিতে চিফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার বা সংক্ষেপে সিইও বলে। লি রেমন্ড চাকরি ছেড়ে যাবেন তাই চাকরি ছেড়ে যাওয়া বাবদ তাকে দেওয়া হলো ৪০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। এ অর্থ কেবল আমাদের মতো দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কাছেও অকল্পনীয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এমানুয়েল ক্লিভার এত অর্থ প্রদান বিষয়ে কোম্পানিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টেফান সাইমনকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। উদাহরণ হিসেবে একটি প্রশ্নের উল্লেখ করা হলো। প্রশ্ন করার শুরুতে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য ক্লিভার বলেন : আমার বাবা সারাজীবন কাজ করেছেন। তিনি কখনোই বছরে ২৫ হাজার ডলারের বেশি আয় করতে পারেননি। বহু বছর তিনি একসঙ্গে তিনটি কাজ করেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাজ করেছেন দুটি। তার চার সন্তানকে তিনি কলেজ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। এখন তার বয়স ৮৬। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাবার মতো অনেক মানুষ আছেন। আগামী শনিবার এমন কয়েক জনের সঙ্গে আমি এক সভায় মিলিত হব। এটা আইনসভা সদস্যের সঙ্গে প্রতি মাসের সভা। সাইমন, লি রেমন্ড এক্সনমবিল থেকে চাকরি ছেড়ে যাওয়া বাবদ যে ৪০ কোটি ডলার পেলেন সে ঘটনাটি এইসব মানুষের কাছে আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এই ৪০ কোটি ডলার মানে দিনে এক লাখ ৪১ হাজার ডলার (প্রায় এক কোটি টাকা)। যে মানুষ কাজ খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন, তাদের আমি কি বলে বোঝাবো যে, রেমন্ড সাহেবের ৪০ কোটি ডলার পাওয়া ঠিক আছে? এইসব মানুষ টিকে থাকার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছেন আর তেল কোম্পানি সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। এ প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছিলেন তেলকর্তা সাইমন সাহেব, তা হাস্যকর।

এরপরে কমিটির অন্যান্য সদস্য নবায়ন করা যায়, এমন জ্বালানি খাতে অতি সামান্য বিনিয়োগ করা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন সাইমন সাহেবকে। সেসব প্রশ্নের জবাবও সন্তোষজনক ছিল না। এসব তথ্য অ্যামি গুডম্যানের এক বেতার অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাও এ বছরের এপ্রিলে তেল কোম্পানিগুলোকে কর দাতাদের অর্থ দিয়ে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানান। এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, কর দাতাদের অর্থ দিয়ে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারটি ঠিক নয়। তিনি এ ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য আইনসভার প্রতি আহবান জানান।

এ ঘটনা থেকে বুঝতে সুবিধা হয় যে, মুনাফার বিপুল অর্থ কোথায় যায়। কেবল এখানেই যায় না। মালিকদের ভোগেও ব্যয় হয় সে অর্থের একাংশ। তবে এটা ধারণা করা ভুল হবে যে, মুনাফার সব অর্থই এভাবে খরচ হয়। আবার এটাও স্পষ্ট যে, এত মুনাফা এবং মুনাফার অর্থ এভাবে ভাগবাটোয়ারা করা অনেকেরই পছন্দ নয়। কারণ কাজটি যুক্তিসঙ্গত নয়। বিশেষ করে, বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও সচ্ছলভাবে সম্মানজনকভাবে চলতে পারেন না তখন হাতেগোনা কিছু লোকের এভাবে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থ নানা উসিলায় হাতিয়ে নেওয়া কোনো যুক্তিতেই টেকে না। আবার সারা পৃথিবীতেই যখন জ্বালানি সংকট, সে সংকট যখন ক্রমাগতভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন তেল পোড়ানোর কারণে পৃথিবীর গরম হাওয়া বাড়ছে ও তাতে মানুষসহ সব প্রাণের অস্তিত্বই হুমকির মুখে, যখন পৃথিবীকে রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের তাগিদ বাড়ছে, সে সময় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণায়, উদ্ভাবনে, ব্যবহারে অর্থ বিনিয়োগ না করে মুনাফার অর্থ বাবু সাহেবরা ভাগবাটোয়ারা করে নেবেন, সেটা যুক্তি বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

এত মুনাফার ‘ব্যাপারটি’ আরো উৎকটরূপে চোখে পড়বে, যদি তা বেকারত্বের হারের পাশাপাশি তুলনা করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর বিভিন্ন প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ইত্যাদি থেকে দেখা যায় যে, সারা পৃথিবীতে বেকার মানুষের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ একদিকে, বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, আরেক দিকে বেড়েছে কয়েকটি কোম্পানির মুনাফা। দুটোই বেড়েছে। একটির মুনাফার বৃদ্ধি, কতিপয় মানুষকে বিলাস, অকল্পনীয় ভোগের সুযোগ দিয়েছে; আরেকটির বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি কোটি কোটি মানুষের জীবনে এনেছে সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ-অনাহার।

বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিণতিতে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, বেকার হয়েছেন। আর তেলের মূল্য বৃদ্ধি মুনাফা বাড়িয়েছে।

মুনাফা ‘অর্জনের’ আরো ‘কাহিনী’ রয়েছে। টিএনএস মিডিয়া ইন্টেলিজেন্স নামে তথ্য মাধ্যম পর্যবেক্ষণ বিষয়ে একটি সংগঠন জানায়, কেবল একটি তেল কোম্পানি ২০০৭ সালে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছিল ১০ কোটি ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা। আবার এ কোম্পানিটি জনমনে ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিজেদের পরিবেশ ‘সচেতন’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সে ধরনেরই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তবে সে ধরনের বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল কোম্পানিটি, তার চেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য দিয়েছিল এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর গরম বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে সবসময় সন্দেহ ছড়াচ্ছে। আচরণটি কি মুনাফার ‘সততা’?

মুনাফা কোথা থেকে আসে এ প্রশ্ন অনেক পুরনো। এ দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ যুগ যুগ ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আমাদের বিশ্বকবি যেমন প্রশ্ন করেছেন আকাশকে যে, মেঘেরা দলবেঁধে কোথায় যায়, সেভাবেই মানুষেরও প্রশ্ন : মুনাফা যায় কোথায়? এ দুটি প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেছে। সে উত্তর দিয়েছে বিজ্ঞান, তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করে। সংক্ষেপে সে উত্তর হচ্ছে : মুনাফা আসে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া মেহনত থেকে আর মুনাফার এক অংশ যায় অল্প কিছু লোকের ভোগে, আরেক অংশ যায় মুনাফা আরো বাড়িয়ে তোলার কাজে। আর মুনাফা করার জন্য তেল কোম্পানি কেবল উৎপাদনে বিনিয়োগ করে না। বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হয় হানাহানি, সংঘাত, সশস্ত্র দল-উপদল তৈরি করার কাজে, রাজনীতিতে অর্থ যোগাতে, ঘুষ দিতে, দালাল বানাতে, কিছু লোককে কিনে নিতে। এ হচ্ছে মুনাফার ‘খেলা’।

Thursday, November 17, 2011

এর পরে স্বৈরাচারীরা শুরু করল লুট

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৯)।। 
লুটপাটের ‘রূপকথার’ যেন শেষ নেই। কারণ যেন শেষ হয় না সেই অর্থনীতি আর সেই রাজনীতির, যা লুটপাট করেই টিকে থাকতে পারে। লুট চলে কখনো খোলাখুলি, আইনের পরোয়া না করে; কখনো তা চলে আইনের কাঠামোর মধ্যে, যখন তাকে লুট বলে চিনতে অসুবিধা হয়। তবে আইনের কাঠামোর মধ্যে বা আইনের আশ্রয়ে থেকেই লুট চলে বেশিরভাগ সময়ে। তখন কেউ যদি সে আইনকে বা আইনের কাঠামোকে বলেন লুটের আইন বা লুটেরার আইন, তা হলে সে অভিধাকে ভুল বলা মুশকিল। এমনই কিছু লুটের দৃষ্টান্ত দেখা যাক।

দেশটির নাম ইকুয়েটরিয়াল গিনি। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে, গ্যাবন ও ক্যামেরনের মাঝখানে দেশটির অবস্থান। আয়তন ১০ হাজার ৮শ’ বর্গমাইলের সামান্য বেশি। স্পেন ছিল দেশটির ঔপনিবেশিক প্রভু। স্বাধীন হয় ১৯৬৮ সালের ১২ অক্টোবর। প্রেসিডেন্ট পদে বসলেন মেসি নগুয়েমা বিয়োগো। তার ১১ বছরের শাসনকে আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে নৃশংস শাসনগুলোর অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। সে শাসন প্রকৃত অর্থে হয়ে ওঠে দুঃশাসন। আর সেই দুঃশাসনে দেশটি হয়ে পড়ে দেউলিয়া। সে শাসন পর্বকে বলা যায় সন্ত্রাসের কাল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সে সময়ে ক্রীতদাস প্রথা আবার চালু করা হয়েছিল; সেনাবাহিনী খুন করেছিল ৫০ হাজার নাগরিককে। এর পরে ১৯৭৯ সালের আগস্টে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বিয়োগো ক্ষমতাচ্যুত হন। তাকে হত্যা করা হয়। তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করলেন তারই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থিওডর নগুয়েমা মোবাসোগো। বিয়োগো ছিলেন মোবাসোগোর চাচা। বিয়োগো নিজেকে দেশটির আজীবন প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন। বিয়োগোর বিরুদ্ধে এ সামরিক অভ্যুত্থানের খবর আগেভাগে জানতেন সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু স্পেনের কর্তারা। তাদের মদদ ছিল সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে।

দেশটির অর্থনীতি কৃষি প্রধান। প্রধান ফসল কোকো, কলা, কফি, পামতেল। সাম্প্রতিক কালে খোঁজ পাওয়া গেল তেল, ইউরেনিয়াম, লোহার। কাঠ আছে প্রচুর। রফতানি করা কাঠের প্রায় সবই যায় স্পেন ও জার্মানিতে। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের সিংহভাগ স্পেনের সঙ্গে। চলতি ধারণা অনুসারে দেশটি গরিব। এ দেশেরই একজন নাম থিওডর নগুয়েমা অবিয়াং মানগু। তিনি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে চাচাকে হত্যা করে প্রেসিডেন্ট পদে বসা থিওডর নগুয়েমার পুত্র।

মানগুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ১১ কোটি ডলার এনেছেন; এ অর্থের ধরনটি সন্দেহজনক; এবং এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন আইনজীবী, ব্যাংকার, ভূসম্পত্তি দালানকোঠা ও হুন্ডি ব্যবসায়ী। মানগু সম্পর্কে  যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি তদন্ত হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ফ্রান্সে। যুক্তরাষ্ট্র আইনসভার এক শুনানি থেকে জানা যায়, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট বা হিসাব খোলা ও সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেনে দেশটির কয়েকজন কর্তাকে সাহায্য করে রিগস ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক। অর্থ পাচার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের আইন ফাঁকি দেওয়ার কাজে তাকে সহায়তা করেন যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন আইনজীবী। কোনো ব্যাংক মানগুর কোনো হিসাবের আসল চরিত্র ধরে ফেললে আরেকটি হিসাব খোলার কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন একজন আইনজীবী। অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে তিনি নানা নামে কয়েকটি কোম্পানি গঠন করেন। চড়া দামের ভূসম্পত্তি কেনাবেচায় তাকে সহায়তা করতেন দু’জন ভূসম্পত্তি ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রে তার কেনা একটি বাড়ির দাম তিন কোটি ডলার। যদি এক ডলারকে ৭০ টাকার সমান গণ্য করা হয়, তা হলে টাকার অংকে বাড়িটির দাম হয় ২১০ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের উল্লেখিত ঘটনা এবং পাচার করা অর্থের পরিমাণ হিসেবে যা উল্লেখিত হয়েছে, তা কেবল চার বছরের, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।

আফ্রিকার আরেক দেশ গ্যাবন। কঙ্গো আর ইকুয়েটরিয়াল গিনির মাঝখানে, আটলান্টিক উপকূলে দেশটির আয়তন এক লাখ ৩ হাজার ৩শ’ বর্গমাইলের কিছু বেশি। সে দেশের সম্পদের মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম, তেল, ম্যাঙ্গানিজ ও কাঠ। দেশটির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স। সে প্রভু প্রত্যক্ষ শাসন ছেড়ে চলে গেলেও এসব ক্ষেত্রে সচরাচর যা ঘটে, অর্থাৎ, নয়া ঔপনিবেশগুলোতে যে ধরন থাকে, গ্যাবনেও তাই রয়েছে। ফ্রান্সের খবরদারি, কর্তৃত্ব রয়েছে ঔপনিবেশিক আমলেরই মতো। সেই সঙ্গে, নতুন করে জুটেছে দেশটির অর্থনৈতিক নীতি ও কার্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ব্যাংকগুলোর প্রভাব।

সে দেশে ৪১ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট ছিলেন ওমর বঙ্গো। তার মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের জুনে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ৬টি সাঁজোয়া যান কেনার এবং যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ছয়টি সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমান সৌদি আরবের কাছ থেকে কিনতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি সংগ্রহের জন্য নিয়োগ করেন যুক্তরাষ্ট্রের এক লবিস্ট বা দেনদরবার কর্তাকে। এ কর্তার নাম জেফরি বিরেল। এ ধরনের কর্তারা ও প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নানাপর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে, নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রায় সব দেশেই এ ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ কাজটি এদের ব্যবসা। কোনো কোনো দেশের রাজধানীতে এদের সংখ্যা হাজার হাজার।

সাঁজোয়া যান ও পরিবহন বিমান কেনায় লাভ অনেকের, কেবল বঙ্গোর নয়। এ লেনদেনের টাকা অনেকেই পাবেন। তবে, টাকা আসবে চূড়ান্ত বিচারে কেবল একটি উৎস থেকে। তা হচ্ছে : দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের সংখ্যা অনেক, যাদের অসন্তোষ-ক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হবে এসব সাঁজোয়া যান। শাসন ব্যবস্থা যখন জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে যায়, তখন এমনই হয়; এমন হয় প্রায় সব জায়গায়।

এই বঙ্গো সাহেব সাঁজোয়া যান ও বিমানগুলো কেনার অংশ হিসেবে গ্যাবন থেকে অর্থ পাঠান যুক্তরাষ্ট্রে। এ অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৮০ লাখ ডলারের বেশি। এ অর্থ পাঠানো হয় একটি আমেরিকান কোম্পানির নামে। কোম্পানিটি গঠন করেন উল্লেখিত লবিস্ট বিরেল সাহেব। এছাড়া কিছু অর্থ সরানো হয় মাল্টায় প্রেসিডেন্ট ওমর বঙ্গোর নামে খোলা একটি বিদেশী মুদ্রা হিসাব থেকে। এটা ছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংকে ওমর বঙ্গোর একজন উপদেষ্টা ও কয়েকজন কনসালট্যান্ট বা পরামর্শকের নামে রাখা হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সরানো হয়। দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ওমর বঙ্গো ১০ কোটি ডলারের বেশি পাচার করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেছেন ভুয়া বিভিন্ন কোম্পানি। ফ্রান্সে তেল নিয়ে এক কেলেঙ্কারিতেও জড়িত ছিলেন ওমর বঙ্গো। দুর্নীতির একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ফ্রান্সে। সেখানেও রয়েছে তার নাম।

তিনি নিজ কন্যা ইয়ামিলি বঙ্গো এমটায়েরকে দেন বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। ইয়ামিলি কিছু অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখেন; আবার কিছু নগদ অর্থ জমা রাখেন সিন্দুকে। এসব ঘটনা ঘটে ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তখন তিনি ছাত্রী, কোনো আয় রোজগার নেই। একটি ব্যাংক তার হিসাব বন্ধ করে দেয়, যখন দেখে যে, সে হিসাবে গ্যাবন থেকে পাঠানো হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৫শ’ ডলার। আরেকটি ব্যাংকও সেটাই করে, যখন দেখে যে, ব্যাংকটির সিন্দুকে তিনি রেখেছেন ১০ লাখ ডলার। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে এনেছিলেন তার বাবা এবং এ কাজে তার বাবা ব্যবহার করেছিলেন কূটনৈতিক সুবিধা। এই কূটনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়নি অর্থ সংক্রান্ত তথ্য। বঙ্গো পরিবারের আরেক সদস্য ইঙ্গো লিন কলিন্স বঙ্গো। তিনি গ্যাবনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলি বঙ্গোর পত্নী। কলিন্স বঙ্গো ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। এর নাম কলিন্স রিভোকেবল ট্রাস্ট। এর পরে ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকটি ব্যাংকে এ ট্রাস্টের নামে খোলা হয় কয়েকটি অ্যাকাউন্ট। পরবর্তী তিন বছরে তিনি এ ট্রাস্টের নামে অন্য দেশ থেকে পাঠানো বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেন। সে অর্থ তিনি ব্যয় করেন নিজের বিলাস বৈভবভরা জীবন ভোগে। এছাড়া ট্রাস্টের তহবিলে জমা করা এ অর্থ এক হিসাব থেকে আরেক হিসাবে এমনভাবে সরানো হয়, যা থেকে লাভবান হন তিনি ও তার স্বামী।

লোকে বলে, তেলের ওপর ভাসছে নাইজেরিয়া। এ ঘটনা সেই নাইজেরিয়ার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আতিকু আবু বকরের চতুর্থ বিবি, মার্কিন নাগরিক জেনিফার ডগলাসকে নিয়ে। জেনিফার ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চার কোটি ডলার নিয়ে আসতে সাহায্য করেন। এসব অর্থ পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। এ অর্থের উৎস, ইত্যাদি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের। এ অর্থ পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ২০০৮ সালে এক দেওয়ানি অভিযোগ দায়ের করে। এতে বলা হয়, ডগলাস বেগম ২০০১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত জার্মানির অন্যতম বিশাল কোম্পানি সিমেন্সের কাছ থেকে ২০ লাখ ডলারেরও বেশি পেয়েছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছেন। তবে সিমেন্স যুক্তরাষ্ট্রে এ সংক্রান্ত ফৌজদারি অভিযোগে দোষ স্বীকার করেছে এবং ঘুষ প্রদান সংক্রান্ত দেওয়ানি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। সেই সঙ্গে, সিমেন্স যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের এ সংক্রান্ত উপ-কমিটিকে বলেছে, সিমেন্স ওই বেগমের আমেরিকান অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে।

আর আবু বকরের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় নাইজেরিয়ায়, ২০০৭ সালে। সে অভিযোগ ছিল পেট্রলিয়াম টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড নিয়ে। এই পেট্রলিয়াম প্রযুক্তি উন্নয়ন তহবিলের চার কোটি ডলারের মধ্যে আড়াই কোটি ডলার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি ব্যাংকে পাঠানো হয়। এ ব্যাংকগুলোতে হিসাব খোলেন বেগম ডগলাস। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো যখন অন্য দেশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ পাঠানো বিষয়ে বেগম ডগলাসকে প্রশ্ন করে, তখন তিনি স্বীকার করেন যে, এ ধরনের অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি বিষয়ে তিনি সামান্যই জানেন। তবে এ অর্থ এসেছে তার স্বামীর কাছ থেকে, সে আভাস তিনি দেন। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি ব্যাংক কোনো একটি হিসাব বন্ধ করে দিলে তার আইনজীবীরা অন্যান্য ব্যাংককে রাজি করিয়েছেন তাদের মক্কেলের নামে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে।

এছাড়া নাইজেরিয়ায় আবু বকরের স্থাপন করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিকে পাঁচ বছর মেয়াদে আবু বকর প্রেরণ করেন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এ অর্থ গ্রহণ করে এবং তা গ্রহণ করে এ তহবিলের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেখায়, এ বিষয়ে প্রশ্ন করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।

এখানে উল্লিখিত তথ্যসমূহ যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের অনুসন্ধান সংক্রান্ত উপ-কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনটি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির। লুটপাটের জগতে এখানে উল্লিখিত ঘটনা মাত্র তিনটি। এমন শত শত ঘটনা রয়েছে। অর্থের পরিমাণের দিক থেকেও এ ঘটনাসমূহ তেমন বেশি নয় লুটপাটের অন্যান্য পরিমাণের তুলনায়। এ তিনটি ঘটনার গুরুত্ব হচ্ছে : ১. এগুলো উদাহরণ, যা লুটপাটের জগতের ব্যাপকতা বুঝতে সাহায্য করে; ২. লুটের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলো ও সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে।

ছিঁচকে চুরি বা পাতি চুরি করা এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব। একাধিক ব্যক্তির দরকার হয় না পাতি চুরি করতে। কিন্তু লুটপাট একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার হয় সঙ্গী-সাথী সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া। এই সঙ্গী-সাথী ইত্যাদি কোনো একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকলে বড় আকারের লুট সম্ভব নয়। এসবের সঙ্গে দরকার অনুকূল পরিবেশ। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সে সমাজে বিভিন্ন অংশের শক্তি, সচেতনতার ও সমবেত থাকার মাত্রা, অবস্থান, বিভিন্ন অংশের মধ্যকার সম্পর্ক, এগুলো মিলে তৈরি হয় পরিবেশ।

ঘটনা তিনটিতে লক্ষণীয় দুটি বিষয়। সে বিষয় দুটি হচ্ছে- ১. লুটের প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখিত হচ্ছে কেবল ব্যক্তি, ২. তবে কাজটির অর্থাৎ লুটের ক্ষেত্রে প্রকাশ হয়ে পড়ছে ব্যাংকের সম্পর্ক এবং আইনের ফাঁকফোকর। দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিরা ধোঁকা দিচ্ছে বা বোকা বানাচ্ছে ব্যাংককে, আইনকে। আবার তা ফাঁসও হয়ে যাচ্ছে যখন প্রতিষ্ঠান প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ লুটের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ব্যক্তির চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে। লুটপাটের বিষয়টি দেখার সময় এ দিকগুলোও দেখা দরকার।

খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে : প্রতিষ্ঠান কখন ও কেন লুট সহ্য করে এবং কখন ও কেন করে না? প্রশ্ন হতে পারে : মাত্র এই তিন চার সাহেব-বিবির মাত্র ক’বছরের লুটের পরিমাণ যদি এত টাকা হয়, তা হলে লুটপাটের জগতে টাকার পরিমাণের হিসাবে কত বড়? আরো প্রশ্ন হতে পারে ইকুয়েটরিয়াল গিনি বা গ্যাবন বা নাইজেরিয়ার সাধারণ মানুষ বা একজন মজুর বা একজন গৃহবধূ বা একজন কৃষক কি খবর রাখেন এ লুটপাটের? তারা কি তুলনা করতে পারেন তাদের আয়ের, সারাজীবনের উপার্জনের সঙ্গে লুট করা অর্থের পরিমাণের? অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের কাছে তথ্য পৌঁছায় না, যারা পড়তে পারেন না, তারা কি জানেন, লুটের জগতের খবর, লুটের পরিমাণ? তারা কি জানেন যে, লুটের এ অর্থ তাদেরই?

Thursday, November 3, 2011

কেবলই দুর্ভোগ কান্না-রক্ত (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৮)

গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের খনিজ সম্পদের প্রসঙ্গ উঠলেই দেশটির হীরা, সোনা আর কোলটানের কথা ওঠে। দেশটির ইন্ধন সম্পদও কম নয়। এ সম্পদ এখন ক্রমান্বয়ে আগ্রহীদের চোখে পড়ছে। দেশটিতে রয়েছে তেল, গ্যাস ও কয়লার উল্লেখযোগ্য মজুদ। এছাড়া পানি বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনাও বিপুল। প্রায় এক লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে দেশটিতে। এ পরিমাণ হচ্ছে বিশ্বে উৎপাদিত জলবিদ্যুতের প্রায় ১৩ শতাংশ। এসবই দেশটির প্রতি আকৃষ্ট করছে মুনাফা সন্ধানকারীদের।

আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের অশোধিত তেলের মজুদ এঙ্গোলার পরেই; অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানীয়। দেশটির অশোধিত তেলের মজুদ ২০০৯ সালের হিসাব অনুসারে ছিল ১৮ কোটি ব্যারেল। তেল ও গ্যাস বিষয়ে দেশটি প্রথমবারের মতো সম্মেলন আয়োজন করে ২০০৮ সালের মধ্য আগস্টে। এ খবর জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার।

দেশটিতে তেল খোঁজার কাজ শুরু হয় গত শতকের ষাটের দশকে। সেখানে উপকূলের কাছে সাগরে তেল তোলা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। ভূ-ভাগে তেল তোলা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। এ তোলার কাজ ১৯৮৬ সালে চলছিল আটটি তেল ক্ষেত্র থেকে। এরপর থেকে তেল আহরণের কাজ বেড়ে চলে। এ ঘটনা ধারার সঙ্গে দেশটিতে হানাহানি-সংঘাত-যুদ্ধের এবং এসব হ্রাস-বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির জ্বালানি জরিপ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয় : কঙ্গোতে তেলের প্রমাণিত মজুদ বিপুল। গ্যাসও তেমন আছে। তেলের ওপর ভিত্তি করেই দেশটির সবল অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে। স্থলভাগে তেল-গ্যাস যা আছে, তাতে হাতের ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। উপকূলের কাছে তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে তেল তুলছে ফ্রান্সের পেরেনকো, জাপানের টেইকোকু, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন টেক্সাকো। স্থলভাগে, উপকূল অঞ্চলের কাছাকাছি জায়গা তেল তুলছে পেরেনকো এবং কঙ্গোর তেল কোম্পানির কোহাইড্রো। আরো ছয়টি ব্লক নির্দিষ্ট করে সেগুলোতে সন্ধান কাজ চালানোর জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার এনারগাল্ফ, যুক্তরাজ্যের সোকো এবং শিওরাস্ট্রিম নামের কোম্পানিকে। মধ্য সমতল অঞ্চলে উগান্ডা সীমান্তের লাগোয়া লেক কিভুতেও তেল রয়েছে। কিন্তু হ্রদের লাগোয়া এলাকায় উগান্ডা এরই মধ্যে ভালো মানের তেল তুলছে। ফলে এখানে বেড়েছে উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতা। কঙ্গোতে তেলসংশ্লিষ্ট নানাপর্যায়ের কাজে জড়িত রয়েছে শেল, ফিনা, টোটাল, এনজেন, কোবিল, কঙ্গো অয়েল ও কোহাইড্রো।

এ দেশটিতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি নথিতে বলা হয় : নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ২৬ ট্রিলিয়ন বা ২৬ লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানগুলো সবল করা ইত্যাদি উদ্যোগ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে। এজন্য দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সুবিধা। এ সুবিধার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ছাড়, মুনাফার ওপর করসহ বিভিন্ন কর রেয়াত, বিদেশী বিনিয়োগ ও সম্পদ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এ দলিলেই বলা হয় : কঙ্গোতে রয়েছে নগর অঞ্চলে অবস্থানরত বিপুল শ্রম। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চ বিদ্যালয় উত্তীর্ণ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক। তবে দক্ষ শ্রমের ঘাটতি রয়েছে। এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পুঁজি আনা-নেওয়া প্রসঙ্গে এ নথিতে বলা হয় : কঙ্গো থেকে পুঁজি রফতানিতে এবং অন্যত্র সরাসরি বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো নীতি নেই। অর্থাৎ  পুঁজির চলাচল অবাধ অনিয়ন্ত্রিত। এরই মধ্যে কঙ্গোতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে দেখা দিয়েছে শেভরন অয়েল (কোম্পানিটির সাবসিডিয়ারি কঙ্গো গাল্ফ অয়েলকে সঙ্গে নিয়ে), সিটি ব্যাংক, টেলেসেল, মবিল। এসব তেল, ব্যাংক আর টেলিফোন কোম্পানির সঙ্গে একইসারিতে রয়েছে বিয়ার তৈরির কোম্পানি ব্র্যালিমা ও ইউনিব্রা, সিগারেট তৈরির কোম্পানি টোবাকঙ্গো/রথম্যান ও বিএটিকঙ্গো, পাইকারি ব্যবসায়ী হাসন গ্রুপ, পাম তেল শোধনের কোম্পানি পিএলসি।

একটি দেশের সম্পদ প্রকৃত অর্থে লুট করার জন্য আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে বলেই দেখা যাচ্ছে। সম্পদ আছে, সে সম্পদ নির্বিঘ্নে লুট করার জন্য রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, এ সংক্রান্ত সব কাজ সুরক্ষার জন্য আছে আইনের আশ্রয়, আছে শ্রম, আছে মুনাফা সরিয়ে নেওয়ার পথে কোনো বাধা না রাখার আশ্বাস। এসবের মাথায় আছে অনুগত রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

কোম্পানিরা আসছে, বিনিয়োগ করছে, বিনিয়োগের জায়গা বাছাই চলছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শুরু হচ্ছে প্রতিযোগিতা। কেবল খেয়াল রাখা হচ্ছে, এই হুড়োহুড়িতে সবেমাত্র দাঁড় করানো কাঠামো যেন হুড়মুড় করে ভেঙে না পড়ে। এক দফায় লুট চলল বিনিয়োগ নিরাপদ করার আইন না মেনে, আক্ষরিকভাবেই লুট। কিন্তু তাতে কিছু বিনিয়োগকারীর অসুবিধা হয়। তাছাড়া ও পথে লুট পুরোমাত্রায় করা যায় না। তাই আয়োজন হয় গৃহযুদ্ধের আগুন নেভানোর। সে কাজে জাতিসংঘের সাহায্যও পাওয়া যায়। জাতিসংঘ শান্তি কায়েমের যে কাজটি করে দেয়, তার খরচ পড়ে কম। এ হিসাবও করেছে বার্তা সংস্থাগুলো। সব ঠিকঠাক চললে, স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে মুনাফা আহরণের হার খারাপ হয় না; গায়েও লেপ্টে থাকে না লুটেরার লেবাস।

কিন্তু পুঁজির প্রতিযোগিতা চলে। স্থিতাবস্থার কাঠামোর মধ্যেই চেষ্টা চলে প্রতিযোগিতার মীমাংসা করার। গোপন থাকে না বহু বিষয়। ফলে খবর বেরোয় : ব্রিটিশ তেল কোম্পানি টাল্লো ও ব্রিটিশ দূতাবাস বিতর্কিত চুক্তি সম্পাদনের চেষ্টা করছে। এ চুক্তি সম্পাদিত হলে কঙ্গো হারাতে পারে ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার। বিতর্কিত এ চুক্তিটি ফাঁস করে দেয় তেল বিষয়ে নজর রাখে এমন একটি সংগঠন। এ সংগঠনের নাম প্ল্যাটফর্ম।

এ কাজে প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ছিল আফ্রিকান ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি গভর্নেন্স। চুক্তিটি হচ্ছে প্রডাকশন শেয়ারিং এগ্রিমেন্ট বা উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি। প্ল্যাটফর্ম এ চুক্তিটি ফাঁস করে দেওয়ার পাশাপাশি একটি বিশ্লেষণও প্রকাশ করে। এ বিশ্লেষণে বলা হয় : অতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করা হয় চুক্তি মারফত। এর খেসারত দেবেন কঙ্গোর গরিব মানুষ। টাল্লোর চুক্তি বহাল হলে যে হাজার কোটি ডলার রাজস্ব সরকার হারাবে, সেটা দেশটির পুরো জাতীয় ঋণের সমান। এ চুক্তিটি সম্পাদনের জন্য টাল্লো এবং কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় ব্রিটিশ দূতাবাস জোর লবিং বা দেনদরবার করছে। চুক্তিটি সম্পাদিত হলে আফ্রিকার সব চেয়ে গরিবদের একাংশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ হস্তান্তরিত হবে ব্রিটিশ ও আইরিশ বিনিয়োগকারীদের কাছে। এ বিশ্লেষণ ছাড়াও প্ল্যাটফর্ম পরিকল্পিত চুক্তিটির কয়েকটি দিক তুলে ধরে, যা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণীয় নয়। যেমন তেল কোম্পানিগুলো ও সশস্ত্র উপদলগুলোর মধ্যে দোস্তি কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে আবার শুরু করবে সম্পদ দখলের লড়াই; প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে ফেলার আইনসম্মত অধিকার প্রদান; পরিবেশের কোনো ক্ষতি হলে দন্ড প্রদানের ব্যবস্থা একটুও নেই এবং চুক্তির এমন একটি ধারা, যা কঙ্গোর পরিবেশ ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাধা দেবে। এগুলো রয়েছে চুক্তির ২১, ২৪, ২৬, ২৭ ও ৩৩ পৃষ্ঠায়।

এমন আরো উদাহরণ পাওয়া যাবে। প্রতিযোগিতায় অনেক সময় স্বচ্ছতা থাকে না। যেমন দেশটির পূর্বাঞ্চলে ১ ও ২ নম্বর ব্লক দেওয়া হলো দুটি কোম্পানিকে। এ দুটি কোম্পানি মিলে গঠন করতে চলেছে স্থানীয় একটি কোম্পানি। এতে দু’কোম্পানির মালিকানা থাকবে ৮৫ শতাংশ আর কঙ্গো রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এতে কঙ্গোর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি কোহাইড্রোর কোনো অংশ নেই। সেই সঙ্গে বিদেশী কোম্পানি দুটিতে বিনিয়োগকারীদের পরিচয় জানানো হচ্ছে না। আবার এ দুটি কোম্পানি শুরু করেছিল একটি ট্রাস্ট। কোম্পানি দুটির একটি হচ্ছে লগ্নি বিনিয়োগকারী, অপরটি হচ্ছে শিল্প বিনিয়োগকারী। জেনেভার যে আইনজীবী এ কোম্পানি দুটির প্রতিনিধি এবং ট্রাস্টটি পরিচালনা করেন, তিনি পাওয়ার অব এটর্নি সংক্রান্ত কাগজপত্র হস্তান্তর করেছেন যাদের কাছে, তাদের আবার কোম্পানি দুটিতে কোনো অংশীদারিত্ব নেই। রয়টারের এক খবর বলা হয়, এ দুটি ব্লকের জন্য চুক্তি করেছে টাল্লো। সঙ্গে আছে হেরিটেজ ও কোহাইড্রো।পুরো ব্যাপারটি হয়ে উঠেছে বড্ড ঘোরপ্যঁাচের।

পুঁজির জগতই এমন। আইনের ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নানা দেওয়া-নেওয়া হয়, যা আইনের হাতে ধরা পড়বে না। আর এমন ঘোরালা-প্যঁাচালো দেওয়া-নেওয়া সহজ হয় অস্বচ্ছতার আবরণে। এ অস্বচ্ছতার আবরণ বিষয়গুলোকে জনসাধারণের চোখের আড়ালে রাখতে সাহায্য করে। একদিকে রাখা হয় ঘোরপ্যাচ, আরেক দিকে অস্বচ্ছতা। ফলে ‘আইনসম্মতভাবে’ লুটের কাজটি হয় সহজ।

এ ব্লক দুটিতে অর্থাৎ ১ আর ২তে ইতালির বড় তেল কোম্পানি এনিরও আগ্রহ রয়েছে। ফলে হয়তো আবার হবে লেনদেন এনির সঙ্গে ওই দু’কোম্পানির, কঙ্গোর তেল প্রবাহিত হবে নল দিয়ে, তেল বিক্রির মুনাফা উঠবে কয়েকজনের ঘরে এবং কঙ্গোর মানুষ এত কান্ডের কিছুই জানবেন না।

কঙ্গোতে স্বার্থ অনেকেরই। তেলের খোঁজ যতই পাওয়া যাচ্ছে, ততই স্বার্থ গভীর হচ্ছে, বাড়ছে আগ্রহ। কেবল প্রধান প্রধান শক্তিধর দেশ নয়, অন্যান্য দেশেরও স্বার্থ রয়েছে। কঙ্গোতে ২৫টি আন্তর্জাতিক খনি কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে কানাডার খনি কোম্পানিগুলোর প্রাধান্য রয়েছে। দেশটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মরক্কোর খনি কোম্পানি। এ তথ্য মার্কেটলাইন বিজিনেস ইনফরমেশন সেন্টারের, এংলোগেল্ডি অশান্তির এবং বিভিন্ন কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনের। এসব কোম্পানির বিনিয়োগ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ লাখ কোটি, লাখ কোটি ডলার। গৃহযুদ্ধের অস্থিরতায় এত বিনিয়োগ সম্ভব ছিল না। হানাহানি সংঘাতের ডামাডোলে সরাসরি লুট সম্ভব। শ্রমকে শৃঙ্খলে বেঁধে সম্পদ তুলে, অতিরিক্ত শ্রম আত্মসাৎ করে মুনাফা ঘরে তুলতে দরকার হয় স্থিতিশীলতা, কাঠামোর মধ্যে আটকে রাখা শান্তি। এ স্থিতিশীলতা, এ শান্তি পুঁজির, মুনাফার, বাড়তি মেহনত আত্মসাতের। মেহনতের প্রসঙ্গ আসছে এ কারণে যে, মেহনত যোগ না হলে মাটির গভীর থেকে কোনো সম্পদ তোলা হতো না। খনির গর্ভ থেকে সম্পদ আহরণে কল বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয়; কিন্তু সে কলও তো চালায় মেহনত, মানুষের মেহনত।

এত অর্থ যেখানে বিনিয়োজিত হয়, সেখানে আরো অর্থের উৎস রয়েছে। আর এত কোম্পানির এত অর্থ সেখানে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রেষারেষি উৎস হিসেবেও কাজ করে। আইনের কাঠামোর মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিযোগিতার, ভাগাভাগির মীমাংসা না হলে সে মীমাংসা হয় আইনের কাঠামোর প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-রীতির বাইরে। তখনই রাজনীতিতে আসে হানাহানি পিছু পিছু আসে রক্তপাত। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে খনির কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা এ বছরের গোড়ার দিকে তা তুলে নেন। ফলে কাজ শুরু হবে খনি থেকে সম্পদ আহরণের; শুরু হবে প্রতিযোগিতা, লেনদেন; তৈরি হবে আগামীর হানাহানি, রক্তপাতের পটভূমি। হয়তো গজিয়ে উঠবে নতুন নতুন বিদ্রোহী গ্রুপ। সব কিছুর আড়ালে থাকবে পুঁজির হাত।

কঙ্গোর ৫ নম্বর ব্লকে উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি (উভাচু) করেছে ডোমিনিয়ন পেট্রোলিয়াম, সঙ্গে আছে সোকো ইন্টারন্যাশনাল ও কোহাইড্রো। এ খবরও বার্তা সংস্থা রয়টারের। উগান্ডা সীমান্তে এ ব্লকে  তেল তোলা নিয়ে উগান্ডার সঙ্গে কঙ্গোর রয়েছে রেষারেষি। কঙ্গোর আটলান্টিক উপকূলে দুটি উভাচু করেছে শিওরস্ট্রিম নামের এক কোম্পানি। এ কোম্পানির প্রধান হচ্ছেন সেনেগালের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি এর আগে কঙ্গোয় শান্তি আলোচনায় সাহায্য করেছিলেন। কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট এক ডিক্রি বলে এ চুক্তির ব্যবস্থা করেন। লেনদেনটি চমৎকার নয় কি?

কঙ্গোয় আরো তেলের ও গ্যাসের খোঁজ চলছে। তেল কোম্পানিগুলো ধারণা করছে ভালো মানের অনেক তেল-গ্যাস পাওয়া যাবে; হয়তো তা হয়ে উঠবে আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি তেল-গ্যাস মজুদগুলোর অন্যতম। ফলে দেশটির আশপাশে দূরদেশী প্রভুর সৈন্যদের আনাগোনার খবরে কেউই অবাক হবেন না। কঙ্গোর মানুষও আশ্চর্যবোধ করবেন না। তেমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো কঙ্গোর জনগণের বিধিলিপি এ মুহূর্তে রচিত হচ্ছে কোনো দূর দেশের রাজধানীতে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তেল কোম্পানির সদর দফতরে, হয়তো কোনো সেনানায়ক ছক তৈরি করছেন সেনা মোতায়েনের। সম্পদ কি তা হলে দুর্ভোগ-রক্ত-কান্না ডেকে আনে?

Thursday, October 27, 2011

কঙ্গোর সংঘাত ও লুটের মাল কোলটান (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৭)

কঙ্গোতে লুটের ‘কাহিনী’ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয় : সেখানে সংঘাতের ধরনটি লোভনীয়। এ কারণে এ সংঘাত বিবদমান সব পক্ষের জন্যই লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। শত্রুরা, বৈরী পক্ষগুলো ব্যবসায়ের শরিক, খনিতে মজুর হিসেবে কাজ করতে হয় বন্দিদের। শত্রুরা একই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অস্ত্র পায়, অস্ত্র বেচাকেনার মধ্যস্থতাকারীরাও একই। ব্যবসা আড়াল করে ফেলেছে নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে। এ ব্যবসা-উদ্যোগে লোকসান হয় কেবল কঙ্গোর জনগণের।

ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সব পাঠকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে কঙ্গোয় লুটের সত্য। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের উপসংহারে আরো নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে : এ সংঘাতের ধরন লোভনীয়। তাই বিভিন্ন দেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডারদেরও এ সংঘাত দরকার। এর ফলে সম্পদ নাগালের মধ্যে আসে, এ কমান্ডাররা উপলব্ধি করেছেন যে, যুদ্ধ নিজেই নিজেকে চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই এ যুদ্ধ অপরাধীদের জাল তৈরি করেছে।

এতে বলা হয় : দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতারা কঙ্গোয় অবস্থানরত সেনাবাহিনীগুলোর সরকারগুলোকে বিভ্রান্তিকর ইঙ্গিত দিয়েছে। এসব উপসংহার স্পষ্টভাবে বলে দেয় কঙ্গোর সম্পদ লুটের সঙ্গে সংঘাতের সম্পর্ক, স্পষ্টভাবে বলে দেয় সম্পদ লুটের সঙ্গে কোন কোন পক্ষ জড়িত। এবং এ মন্তব্য পর্যবেক্ষণ করেন কোনো দলীয় বা কোনো দেশের পক্ষ অনুযায়ী দেশ নয়, তা করেন জাতিসংঘের একদল বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডার মধ্য দিয়ে কঙ্গোর খনিজ সামগ্রী আমদানি করে বিভিন্ন দেশের কোম্পানি। রুয়ান্ডার রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাওয়া আংশিক তথ্য থেকে দেখা যায় এসব কোম্পানি হচ্ছে নিম্নোক্ত দেশগুলোর : বেলজিয়াম, জার্মানি, রুয়ান্ডা, মালয়েশিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে অাঁতাত রয়েছে সরকারের সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের। এতে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাংকের, মন্ত্রণালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়। দেখা যায় যে, লুটের কাজে ব্যবহারের জন্য কোনো কোনো দেশ জাল মার্কিন ডলার ছাপে। প্রতিবেদনে বলা হয় : এ লুটের কাজে রাজনৈতিক বৈধতা যোগায় কোনো কোনো উন্নত দেশ। এতে বিশ্বব্যাংকের নাম উল্লেখ করে ১৮৮ নম্বর প্যারাতে যা বলা হয় তার সারকথা দাঁড়ায় এটাই যে, এ লুটের কথা বিশ্বব্যাংক জানে, বিশ্বব্যাংক জানে এ লুট উগান্ডার ও রুয়ান্ডার অর্থনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ছিল নীরব।

মজার ব্যাপার হচ্ছে লুটের অর্থের বিপুল অংশ ব্যয় হয় অস্ত্র কেনায় এবং অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে লুটের কাজ দ্রুততর করা হয়। এ বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়। লুট থেকে পাওয়া অর্থের শেষ গন্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই গন্তব্য অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও অস্ত্র কোন কোন পন্থায় আসে? প্রতিবেদনে বলা হয় : এটা চলে তিনভাবে। এগুলো হলো : এক. সরাসরি অর্থ দিয়ে কেনা হয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম; দুই. বিনিময়; অর্থাৎ খনিজ সামগ্রীর বিনিময়ে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়; এবং তিন. যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।

জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা এটাও দেখেন যে, সংঘাতে জড়িত দেশগুলোর সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ, প্রকৃত খরচ তার চেয়ে বেশি। কিভাবে আসে এ অর্থ? উত্তর সহজ : লুট।

প্রতিবেদনটির আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে কঙ্গোর এ সংঘাতে লুটে জড়িত কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা। এ ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক নেতা নন; কিন্তু ঘটনার নায়ক বা নায়িকা। এদের একটি তালিকা পেশ করে প্রতিবেদনে বলা হয় : এ তালিকা পরিপূর্ণ নয়। লুটে ও সংঘাতে এ নায়ক-নায়িকাবৃন্দ সরাসরি জড়িত। এদের নাম মেজর জেনারেল সলিম সালেহ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস কাজিনি, কর্নেল টিকামানিয়ার, কর্নেল উতাফায়ার, জনাব খলিল, জনাব আবদুর রহমান এবং এমন আরো।

প্রতিবেদনে এদের কান্ডকারখানার কম-বেশি উল্লেখ করা হয়। মেজর জেনারেল সালেহ ও তার স্ত্রী কহোয়া উগান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বেআইনিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের মূল চরিত্র। সালেহ উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির ছোট ভাই বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তার ডান হাত ব্রি জে কাজিনি। তিনি রক্ষা করেন নিয়মবিসি ও তিবাসিমাকে। আর এ দু’জন রক্ষা করেন তার বাণিজ্য। সে বাণিজ্য হীরা, কাঠ, কফি, সোনার।

এভাবে একের পর এক বিবরণ পড়লে পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, তা রহস্য উপন্যাসকে যেন ম্লান করে দিচ্ছে।

এ প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে এক নারীর নাম। তিনি যেন নায়িকা। তিনি আজিজা কুলসুম গুলাম আলি। (বাংলায় আমরা হয়তো লিখতাম ‘গোলাম আলি’)। মিসেস গুলাম আলির কয়েকটি পাসপোর্ট। তিনি থাকেন কখনো বুকাভুতে, কখনো ব্রাসেলসে, কখনো বা নাইজেরিয়াতে। ব্যাপারটি নির্ভর করে তার কাজের ওপরে। এ মিসেস ইতিপূর্বে বুরুন্ডিতে গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বুরুন্ডিতে একদল ‘বিদ্রোহী’কে অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়েছিলেন। এর পরে, তিনি নতুন জোট গড়ে তোলেন রুয়ান্ডার সরকারের সঙ্গে, হয়ে ওঠেন কিগালি সরকারের বড় মিত্র। মিসেস গুলাম আলি রুয়ান্ডা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সোনা, কোলটান ও ক্যাসিটেরাইট ব্যবসায়ে জড়ান। এর আগে তিনি জড়িয়ে ছিলেন বুরুন্ডির হটুদের সুবিধার্তে অস্ত্র, সোনা ও গজদন্ড চোরাকারবারে। সিগারেট চোরাচালানেও তার নাম শোনা যায়। বেআইনি ব্যবসাকে তিনি আড়াল করতেন তার সিগারেট ফ্যাক্টরি দিয়ে। সে কারখানা আজ লাটে উঠেছে। কোলটান ব্যবসায়ে তার খদ্দেরদের মধ্য রয়েছে স্টার্ক, কোগেকম, সোগেম। বড় দুটি ব্যাংক তার আর্থিক লেনদেনের কিছুটা সামাল দেয়। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা কয়েকবার অনুরোধ জানালেও বেগম গুলাম আলি তাদের সঙ্গে দেখা দেখা করেননি। এ প্রতিবেদন রচনাকালে কোলটান রফতানি ব্যবসায়ের একচেটিয়া আয়োজনের প্রধান হয়ে ওঠেন তিনি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জাল নোটও তৈরি করেন। তিনি শুল্ক সংক্রান্ত কাগজপত্র জাল করেন। তিনি বলেছেন, ‘এ ব্যবসায়ে সবাই এটা করে।’ বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন কোলটান রফতানির কোম্পানিগুলোর মধ্যে জুয়াচুরি ব্যাপক।

এসব কর্মে এক শ্রেণীর ব্যাংকও যুক্ত। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে এদের নাম ও কাজের বিশদ বিবরণ রয়েছে। এতে জড়িত এক শ্রেণীর বিশাল কোম্পানি। এগুলো সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। এ লুটের কাজ সহজ করতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রশাসনিক কাঠামোও সাজানো হয় উপযুক্তভাবে। কখনো ভিন দেশের প্রশাসনিক প্রধানপদে আসীন করা হয় কঙ্গোর লোককে। তার কাজ হবে স্বদেশে লুটের কাজ সংগঠিত করা।

আর শ্রম? সে তো বিশ্বজনীন। শৃঙ্খলিত শ্রমকে নিয়োগ করা হয় পৃথবীর গভীর থেকে সম্পদ তুলে আনতে। শিশু শ্রমও রেহাই পায় না। লুট কতটুকু, কেমন পরিমাণ হয়? জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনেই উত্তর খোঁজা যাক। প্রতিবেদন বলেছে : ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৯৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশী সেনা দলগুলোর দখল করা কঙ্গোর এলাকাগুলো থেকে খনিজ সম্পদ, কৃষিজ ও বনজ সামগ্রী, গবাদিপশু লুটে নিঃশেষ করা হয়েছে; যাকে ইংরেজিতে অভিহিত করা হয়েছে ড্রেইনড অফ। বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা যে দেশই হোক, লুটের ধরন এক। একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য আসে খামার, গুদামে, কারখানায়, ব্যাংকে, তারা আদেশ দেয় দরোজা খুলে দিতে। সেনারা লুটের মাল তোলে গাড়ির পর গাড়িতে। লুটের মাল নিয়ে গাড়ির বহর চলে যায়। কঙ্গোর একটি অঞ্চলে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৯ সালে এপ্রিলের মধ্য ২০০০-৩০০০ টন ক্যাসিটেরাইট ও ১০০০-১৫০০ টন কোলটান লুটে নেওয়া হয়। সৈন্যদের পাহারায় বস্তা বস্তা অর্থ নেওয়া হয়।

দেখা যাচ্ছে, লুটের অাঁতাত অনেক বিস্তৃত, ব্যক্তি মালিক থেকে রাষ্ট্র, ‘বিদ্রোহী’ থেকে ব্যবসায়ী, সেনানায়ক থেকে অস্ত্র নির্মাতা, সবাই আছে এ কাজে মিলেমিশে। এরাই কি সব? এদের আড়ালে কি কেউ নেই। কোন সে সুতো, যা এদের সবাইকে বেঁধে রাখে এক সঙ্গে? সে কি ধনলিপ্সা, লোভ? সে কি ‘আরো আরো চাই, যত পাই, তত চাই?’ স্থানাভাবে সবের বিবরণে না গিয়ে কেবল কোলটানে কান্ডটাই দেখা যাক। এন্টয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ম্যারিজ ২০০২ সালে রাইজ অ্যান্ড ডিক্লাইন অব দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম বিষয়ে সম্মেলনে পেশ করেন প্লান্ডার, ক্রিমিনালাইজেশন অব দ্য স্টেট অ্যান্ড ডিক্লাইন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড সিস্টেম : দ্য কেস অব ডি আর কঙ্গো শিরোনামে প্রবন্ধ। এতে তিনি ছক কেটে দেখান যে, খনি আর নদীর বুক থেকে মজুররা তুলে আনেন কোলটান। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সামরিক চক্রের হাত ঘুরে তা পেঁŠছায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এবং সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর হাতে। সেগুলো পেঁŠছে দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে। সেখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানার ভেতর দিয়ে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো নাম নিয়ে তা হাজির হয় সূক্ষ্ম প্রযুক্তির শিল্পে। এ সামগ্রী প্রক্রিয়ার কারখানা জগতে রয়েছে গোটা বিশেক কাজাখস্তানে, যুক্তরাষ্ট্রে, জার্মানিতে, চীনে, জাপানে। এগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি কারখানা বানাতে পারে ট্যানট্যালাম গুঁড়ো। সে চারটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, জাপানে, জার্মানিতে, চীনে। আর সূক্ষ্ম প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলকাটেল কমপ্যাক, ডেল, এরিকসন, এইচপি, আইবিএম, নকিয়া, সিমেন্স, লুসেন্ট, মটোরোলা। বড় চেনা নাম এগুলো। এই চেনা নামের কোম্পানি সব কোটি কোটি খদ্দেরের কাছে পেঁŠছে দেয় মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গেম বা খেলার ডিজিটাল সামগ্রী।

এসবের মাঝে থাকে পরিবহন, ব্যাংক, রাজনীতি, বিধি, শুল্ক, বিশ্ব শক্তি। ডেনা মন্টেগু ২০০২ সালে স্টোলেন গুডস : কোলটান অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন দ্য ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : রোয়ান্ডা ও উগান্ডাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।

এসবে আরো মিশে থাকে : রক্ত। আরো থাকে : মেহনত, মজুরদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে নেওয়া মেহনত। আর সব শেষে থাকে মুনাফা। কতিপয়ের পকেটে, অ্যাকাউন্টে। সে কতিপয় প্রমোদতরীতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ থেকে দ্বীপে, ক্যারিবিয়ানের সূর্যাস্ত রং মেখে দেয় তাদের চোখে। কোলটানের রক্তাক্ত, নিষ্ঠুর, ‘সুন্দর’ যাত্রা!

কোলটান থেকে কে কত পায়? এ হিসাব করা প্রায় ধাঁধার উত্তর খোঁজার মতো। কারণ, তথ্যগত বিভ্রান্তি বেশি। একজন গবেষক এ সংক্রান্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে অনুমান করেছেন যে, স্থানীয় বেপারী ১০ ডলার পেলে রুয়ান্ডার ব্যবসায়ী পায় ২০০ ডলার, আর পাঁচ-ছয়জন খনিমজুরের একেকটি গ্রুপ পায় সপ্তাহে ৩০ ডলার। অর্থাৎ দিনে একজন পায় ১ ডলারের কম। আহরণের পরে ৩০ কিলোগ্রাম সামগ্রী বস্তায় ভরে হেঁটে হেঁটে তা নেওয়া হয় স্থানীয় ব্যবসায় কেন্দ্রে, গড়ে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে। সোনা, হীরা লুটের ঘটনা আরো নিষ্ঠুর। তবে লুটের ধরন একই। সে বিষয়ে আর আলোকপাত না করে আগামীতে দেখা যাবে আরো লোভনীয় ক্ষেত্রে কেমন ঘটনা ঘটে চলেছে।

Friday, October 21, 2011

যুদ্ধে জড়িত কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি

মবুতুর পরে ক্ষমতায় বসানো হলো লরেন্ট কাবিলাকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ অনুগত মিত্র। কাবিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে, ১৯৯৭ সালে একজন প্রতিনিধি পাঠালেন কানাডার টরেন্টোতে। উদ্দেশ্য : বিনিয়োগ সুযোগ নিয়ে খনি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা। কাবিলার বাহিনী গোমা দখলের পর পরই, ১৯৯৭ সালে, আমেরিকান মিন্যারাল ফিল্ডস (এএমএফ) নামের কোম্পানি কাবিলার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের চুক্তি করে। এ এলাকায় দস্তা, তামা ও কোবাল্ট খনিগুলো থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয় এএমএফকে। এ কোম্পানির প্রধান ছিলেন মাইক ম্যাকমরো। মাইক আবার যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বন্ধু। আর এ চুক্তি সম্পাদনে কাবিলার পক্ষে আলোচনা করেছিলেন কঙ্গোর যে লোকটি, তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে আগেই উল্লেখ করা ‘এ গেম এজ ওল্ড এজ অ্যাম্পায়ার’ বইতে।

ঘটনা, সম্পদ লুটের ঘটনাগুলো খেয়াল করে দেখলে এভাবে বন্ধুত্ব, যোগসাজশ, ইত্যাদি চোখে পড়ে। হানাহানি, হামলা, যুদ্ধ চলতে থাকল। এ সবে সামনাসামনি জড়িয়ে থাকল উগান্ডা, রুয়ান্ডা প্রভৃতি দেশ; আড়ালে রইল বহুজাতিক করপোরেশন (বক), আর বকদের আশ্রয় দেওয়া রাষ্ট্র শক্তিগুলো। উগান্ডা ও রুয়ান্ডা চেয়েছে স্ব স্ব দেশের সীমান্ত বরাবর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে। কাবিলা গোটা দেশ নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছেন। উপরে উল্লেখিত বইতে বলা হয়েছে, কাবিলার সেনাবাহিনী ও বিরোধী কোঙ্গোলিজ র‌্যালি ফর ডেমোক্র্যাসি নামের বাহিনীকে, দু’পক্ষকেই মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে সংঘাত বেড়েছে, দেশটির অস্থিতিশীলতা বেড়েছে; ফলে বিদেশী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার জন্যই সবাই মিলে চেষ্টা চালিয়েছে দেশটিকে স্থিতিহীন রাখার।

রুয়ান্ডা ও উগান্ডার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; রুয়ান্ডার সৈন্যদের ও বিদ্রোহী সশস্ত্র দলগুলোকে যুদ্ধের নানা কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডো সেনারা। রুয়ান্ডা কঙ্গোতে সেনাবাহিনী পাঠানোর আগে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট সফর করেছিলেন পেন্টাগন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর। এমনকি, এ সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল যে, সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে রুয়ান্ডা কঙ্গোয় অভিযান শুরু করার আগেই, ১৯৯৮ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই কঙ্গোতে ঢুকে পড়া রুয়ান্ডার সৈন্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের দেখা গেছে। আগে উল্লিখিত ‘এ গেম এজ ওল্ড এজ অ্যাম্পায়ার’ বইতে এসব তথ্য রয়েছে।

এদিকে, কঙ্গো-রুয়ান্ডা সীমান্তে রুয়ান্ডার সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে দেয় সামরিক বিষয়ে ঠিকাদার কেলগ, ব্রাউন অ্যান্ড রুট নামে কোম্পানি। এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল কোম্পানি হ্যালিবার্টনের সাবসিডিয়ারি। এ ঘাঁটিতে রুয়ান্ডার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আবার, উপগ্রহের মাধ্যমে সংগ্রহ করা মানচিত্র ও ছবি কাবিলাকে যোগান দেয় বেকটেল করপোরেশন। এগুলো কাবিলাকে দেওয়া হতো যাতে মবুতুর সৈন্যদের চলাচলের হালনাগাদ খবর ও অবস্থান কাবিলা জানতে পারেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল কোম্পানি বেকটেলয়ের পরিচালকমন্ডলীতে বা প্রধান পদে যারা আছেন/ছিলেন, তাদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। এদের মধ্যে জর্জ শুলজ, কাসপার ওয়েইনবার্গার প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। আবার, ডিক চেনি এক সময়ে ছিলেন হ্যালিবার্টনের প্রধান। কেলগ, ব্রাউন অ্যান্ড রুটয়ের মালিক আবার হেলিবার্টন, কেইথ হারমন স্নো ‘দ্য ওয়ার দ্যাট ডিড নট মেক দ্য হেডলাইনস : ওভার ফাইভ মিলিয়ন ডেড ইন কঙ্গো’ প্রবন্ধে লিখেছেন : মানবাধিকার বিষয়ে দলনিরপেক্ষ একজন তদন্তকারী দেখেছেন যে, মিলিটারি প্রফেশনাল রিসোর্সেস ইনকরপোরেটেড এবং কেলগ, ব্রাউন অ্যান্ড রুট নামে ব্যক্তি মালিকানাধীন সামরিক কোম্পানি দুটির সঙ্গে পেন্টাগনের সম্পর্ক রয়েছে।

এবার লুটের ছোট্ট একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি। তার ভাই সলিম সালেহ। তিনি তিনটি বিমান ইজারা দিলেন উগান্ডার সামরিক বাহিনীকে। এ বিমানগুলো কঙ্গোতে সৈন্য ও সামগ্রী সরবরাহের কাজে লাগানো হলো। উগান্ডার সেনা কর্তাবৃন্দ, কঙ্গোর বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশে সালেহ নিশ্চিত করলেন যে, ফেরত পথে বিমানগুলো যেন বোঝাই থাকে সোনা, কাঠ, কফি দিয়ে।

আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যাক। রুয়ান্ডায় হীরা খনি নেই। অথচ রুয়ান্ডা ১৯৯৮ সালে ১৬৬ ক্যারেট হীরা রফতানি করে। আর তা ২০০০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৫০০ ক্যারেটে।

আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যাক। পাশ্চাত্যের বিশাল খনি কোম্পানি বারিক গোল্ড করপোরেশন। এটি কানাডীয় কোম্পানি। কঙ্গোর খনি সম্পদে এ কোম্পানির রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। এ কোম্পানির পরিচালকমন্ডলীর পরিচয়? কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মুলরোনে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের উপদেষ্টা ভার্নন জর্ডান। এ কোম্পানির উপদেষ্টাদের একজন হচ্ছেন জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ, যাকে সংক্ষেপে জর্জ ডব্লু বুশ বা জর্জ বুশ নামে পৃথিবীর মানুষ চেনেন।

কঙ্গো থেকে সুবিধা পেয়েছে যেসব কোম্পানি, সেগুলোর অন্যতম কানাডার হেরিটেজ অয়েল অ্যান্ড গ্যাস। উগান্ডা আর রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনী ১৯৯৮ সালে যখন কঙ্গোর মাটিতে পা রাখল, সে সময়েই সেখানে পৌঁছায় হেরিটেজ অয়েল অ্যান্ড গ্যাস। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংক পাঁচ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ডলার কর্জ দেয় কঙ্গোয় রুয়ান্ডা সমর্থিত বিদ্রোহী দলের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। আর, রুয়ান্ডা ও উগান্ডা যখন কঙ্গোয় লুট চালাচ্ছে, সে সময়েই এ দু’দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ছে বলে এ দু’দেশ প্রশংসা পাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের।

উপরে উল্লিখিত তথ্যগুলো পরিবেশিত হয়েছে ইতোমধ্যে উল্লেখ করা এ গেম এজ অ্যান্ড… বইতে। সত্য যে কোথায় কোনটি, তা বুঝতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের তথ্য বিপুল। একের পর এক এসব তথ্য সাজালে সহজেই কয়েকটি বই লেখা যায়। এসব তথ্য যথাযথভাবে সংযুক্ত করলে, এগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক খুঁজে পেলে সত্য আর আড়ালে থাকে না। লুট, হামলা, পেছনে থাকা শক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতির ভালো ভালো কথা, লেনদেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যকার সম্পর্ক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক, ইত্যাদি সত্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। তখন আর বিভ্রান্তি থাকে না এ পৃথিবীর বড় শক্তিদের চেহারা-চরিত্র-বক্তব্য নিয়ে। তবে, এক বিপুল আশ্চর্য তবুও অপেক্ষা করে। সে বিপুল আশ্চর্য হচ্ছে : আজো দেশে দেশে এ শক্তিবর্গের মিত্ররা পরম শ্রদ্ধায় পূজা পান। তারাও ভেবে দেখেন না যে, দেশের সাধারণ মানুষ যেদিন জানতে পারবেন এ পূজনীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে এ শক্তিবর্গের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা, সেদিন সাধারণ মানুষই ধিক্কার দেবেন এ ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে। আর, সাধারণ মানুষ প্রতিদিন তা করেন না, মাঝে মধ্যে করেন। যেমন, আমাদের এ ভূখন্ডেই, আমাদের আজকের বাংলাদেশে, ১৯৪৭ সালের আগে-পরে কতই না শ্রদ্ধা পেতেন মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহ। তাকে তো এ দেশেরই মানুষ ধিক্কার দিয়েছেন, প্রত্যাখ্যান করেছেন, তার কথার প্রতিবাদ করেছেন। কোনো কথাই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখতে পারেনি। একইভাবে, দেশে দেশে লুটের সঙ্গে জড়িত যে রাষ্ট্র শক্তি, তার পরম মিত্র, তার আস্থাভাজন লোককে সাধারণ মানুষ কি গ্রহণ করবেন? ধিক্কারে-নিন্দায় উচ্চারিত হবে সে নাম। কারণ, সাধারণ মানুষ কখনোই দেশের সম্মান ও মর্যাদা বলি দেন না। কঙ্গোতেও তাই হয়েছে। বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্র শোম্বের নাম আজ আর কেউ উচ্চারণ করেন না শ্রদ্ধায়, সে নাম উচ্চারিত হয় ঘৃণায়, ধিক্কারে। মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে আছেন প্যাট্রিস লুমুমবা।

কঙ্গোর দুর্ভোগের শেষ হয় না। কারণ তার সম্পদ কেবল সোনা, হীরা, কোবাল্টে সীমিত নেই। সেখানে আছে তেল। সে তেলের পরিমাণ একেবারে কম নয়। তাই এ তেল নিয়ে প্রতিযোগিতা রয়েছে এবং প্রতিযোগিতা প্রবল। ব্রিটেনের পত্রিকা ফাইন্যানশিয়াল টাইমসের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায় : কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে ৫ নম্বর ব্লক নিয়ে শুরু হয়েছে বিরোধ। এ ব্লকে রয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সেখানে রয়েছে বন, গরিলা, হাতি। এখানে রয়েছে মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো জাতীয় উদ্যান। এ ব্লকটি দেওয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যের দুটি তেল কোম্পানিকে। দেশটির আইন অনুসারে জাতীয় উদ্যানে কেবল বৈজ্ঞানিক কাজ চালানো যায়, তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন করা যায় না। দেশটির ৪১ জন এমপি জাতীয় উদ্যানের সীমানা নতুন করে চিহ্নিত করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রীর কাছে। প্রতিবেশী উগান্ডায় যুক্তরাজ্যের আরেকটি কোম্পানি, তাল্ল অয়েল সন্ধান পেয়েছে আড়াইশ কোটি ব্যারেল তেলের। এর পর থেকেই তেল তোলার জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। এ ব্লকে তেল তোলার জন্য পার্টনারশিপ শেয়ারিং এগ্রিমেন্ট বা উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি করা হয়। এটা খুব গোপন করে রাখা হয়। এ চুক্তি অনুসারে সিগনেচার বোনাস হিসেবে উৎপাদন দেবে ২০ লাখ ডলার, প্রথম উৎপাদন বোনাস হিসেবে দেবে ২০ লাখ ডলার; আর, একটি বার্ষিক কর দেওয়ার পাশাপাশি এক কোটি ব্যারেল তেল কিনবে ৫০ লাখ ডলারে। মুনাফার ওপরে ভাগাভাগি আছে। এ চুক্তি সংশোধন করা হয়। সে সংশোধন অনুসারে কিছু অর্থ আবার সিগনেচার বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়। কত পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে অনুমান করা হয়, এ পরিমাণ পাঁচ লাখ ডলার। এ অর্থ দেওয়া হয় চুক্তিটি প্রেসিডেন্ট অনুমোদন করার কয়েক সপ্তাহ আগে।

এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, তেল কোম্পানিগুলো যে অর্থ দেয়, তার চেয়ে বেশি নিয়ে যায়। তা না হলে এসব কোম্পানি তেল তুলতে আসত না। কারণ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দর্শন ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ নয়।

এ লুটের ‘কাহিনী’ বিশাল। তার ধরন অনেক। ব্যক্তি পর্যায়ে, কোম্পানি পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে, আইনের ও প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায়, আইন ভেঙে লুট চলে। এ লুট এত ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২০০০ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে বেআইনিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বিষয়ে প্রতিবেদন পেশ করতে বলে। জাতিসংঘ মহাসচিব এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করেন তাতে এ লুটের একটি দিক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়।

এ প্রতিবেদন ছয়টি উপসংহারে উপনীত হয়। প্রথম উপসংহারেই বলা হয় : গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে সংঘাত প্রধানত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রাপ্তি, নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য নিয়ে। এ পাঁচটি খনিজ সম্পদ হলো কোলটান, হীরা, তামা, কোবাল্ট ও সোনা। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ এত যে হতবিহবল হয়ে যেতে হয়। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা ও আইনহীনতার প্রেক্ষাপটে এ সম্পদ মুঠো না করার প্রলোভন ঠেকানো কঠিন। দ্বিতীয় উপসংহারে বলা হয় : বিদেশী সেনাবাহিনীগুলো সুব্যবস্থিতভাবে কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করছে। তা লুট করা হচ্ছে। এ নিয়ে গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। এসব চক্রের যোগাযোগ রয়েছে বিশ্বব্যাপী। তৃতীয় উপসংহারের একটি অংশে বলা হয় : কয়েকটি কোম্পানি কঙ্গোতে যুদ্ধে জড়িত। এসব কোম্পানি যুদ্ধে সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছে। এসব কোম্পানি প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে অস্ত্র যুগিয়েছে। অন্য কয়েকটি কোম্পানি দিয়েছে অর্থ। সে অর্থ খরচ হয়েছে অস্ত্র কেনায়। খনিজ সম্পদের ব্যবসা করে যে কোম্পানিগুলো, তারাই দেশটিতে বেআইনিভাবে খনিজ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। লুটের এ কাহিনী আগামীতে আরো তথ্য দেবে।

Thursday, October 13, 2011

কঙ্গো : খুন আর যুদ্ধ

১৯৬০ সালের ৩০ জুন। কঙ্গো স্বাধীন হলো। প্যাট্রিস লুমুমবা প্রধানমন্ত্রী; প্রেসিডেন্ট যোসেফ কাসাভুবু। সময় : ১৯৬০ সালের জুলাই মাস। স্বাধীন কঙ্গোর সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ তৈরি করা হলো, মোশে শোম্বে কঙ্গোর খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ কাটাঙ্গা অঞ্চলকে ঘোষণা করল স্বাধীন। ষড়যন্ত্রকবলিত কঙ্গোর অসহায় মাটিতে আবার পদার্পণ ঘটল বেলজিয়ামের সৈন্যদের। এবারের যুক্তি নতুন। সে নয়া যুক্তি হচ্ছে : বেলজীয় নাগরিকদের ও বেলজীয় খনি স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সময় : ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর। প্রেসিডেন্ট কাবাভুবু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেন লুমুমবাকে। সময় : ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাস। লুমুমবাকে গ্রেফতার করা হলো। সময় : ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। লুমুমবাকে খুন করা হলো। খুন করল সেনাপ্রধান জোসেফ মুবুতুর অনুগত সৈন্যরা।

রাজনীতির, স্পষ্টভাবে বললে বলতে হয়, সম্পদ লুটের রাজনীতির আরেকবার বিজয় ঘটল। বিদায় করে দেওয়া হলো লুটের রাজনীতি প্রতিরোধের আর নবজীবন গড়ার রাজনীতির নায়ককে। কিন্তু কবিতায় যেমন বলা হয়েছে, হাত দিয়ে সূর্যের আলো রোধ করা যায় না, তেমনি সত্য আড়াল করা যায় না। লুমুমবা হত্যার তথ্য কিছু কিছু করে প্রকাশিত হলো। নানা খবরে বলা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও বেলজিয়ামের যোগসাজশে লুমুমবাকে হত্যা করা হয়েছে। লুমুমবাকে হত্যার জন্য দায়ী করা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও বেলজিয়ামকে। এ সংশ্লিষ্ট ঘটনা প্রবাহের একপর্যায়ে রহস্যজনকভাবে ‘নিহত’ হলেন তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব দ্যাগ হ্যামারশোল্ড। এত মিথ্যা প্রচার, ষড়যন্ত্র ও হত্যার মধ্যেও লুমুমবা হয়ে উঠলেন নায়ক, আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকায় নয়া উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান পেলেন প্যাট্রিস লুমুমবা।

কঙ্গোর প্রসঙ্গ উঠলেই লুমুমবার নাম চলে আসে। স্বাধীনতা ঘোষণার অনুষ্ঠানে বেলজিয়ামের রাজা ঔপনিবেশিক শাসন, লুণ্ঠন, নির্যাতন, হত্যার জন্য কোনো অনুতাপ প্রকাশ করলেন না, চাইলেন না ক্ষমা। তিনি কঙ্গোকে উপনিবেশ বানানোর ‘বিচক্ষণতা’র প্রশংসা করলেন। বেলজিয়ামের বদান্যতা ও নানা ‘শুভ’ কাজের স্তূতি গাইলেন। জবাবে অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে লুমুমবা উপবিশেবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে বললেন : বলপ্রয়োগ করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবমাননাকর দাসত্বের অবসান ঘটানোর জন্য সংগ্রাম অবিচ্ছেদ্য, অনিবার্য। আমাদের ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। আমাদের যন্ত্রণা প্রবল। আমরা নিগ্রো তাই সকালে, দুপুরে, রাতে আমাদের মার খেতে হতো, অপমান সইতে হতো। এ নির্মম পরিহাস! আমরা দেখেছি, আমাদের দেশ লুট করে নেওয়া হয়েছে, তা করা হয়েছে আইনের কথা বলে। সে আইন কেবল একটি বিষয়ই স্বীকার করে; তা হচ্ছে শক্তিধরের অধিকার আমরা আইনের নানারূপ দেখেছি। সাদার ক্ষেত্রে এক রকমের আইন, কালো মানুষের ক্ষেত্রে আরেক রকম। আমরা জেনেছি রাজনৈতিক অভিমতের কারণে বন্দিদের নির্মম দুর্ভোগের কথা। তাদের ভাগ্য ছিল মৃত্যুর চেয়েও মন্দ। সেই গুলি চালনার কথা কে ভুলবে, যে ঘটনায় আমাদের এত ভাইয়ের মৃত্যু ঘটেছিল? কে ভুলবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া এত ভাইয়ের কথা, যারা অবিচার, নিপীড়ন, শোষণ-শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাননি? আর আমাদের দমিয়ে রাখার পন্থাই তো ছিল এগুলো।

লুমুমবার ভাষণে রাজা রুষ্ট হলেন। প্রায় ৪১ বছর পরে, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কঙ্গোর নেতা প্যাট্রিস লুমুমবাকে হত্যার জন্য বেলজিয়াম ক্ষমা চায়। কঙ্গোর দৈনিক টেমপেট ডেস ট্রপিকম শিরোনাম লেখে : আততায়ী দিয়ে লুমুমবাকে খুন – ব্রাসেলস অন্তত নিজ দায়িত্ব স্বীকার করছে। লা পটেনশিয়াল পত্রিকা শিরোনাম লেখে : খুন হওয়া মানুষের পরিবার ও কঙ্গোর জনগণের কাছে বেলজিয়াম অপরাধ স্বীকার করছে। লা রেফারেন্স প্লাস শিরোনাম লেখে : বেলজিয়াম আমকস ফরগিভনেস, বেলজিয়াম ক্ষমা চায়।

কিন্তু ইতিহাস ক্ষমা করে না। মানুষ ভোলে না। কঙ্গোর বয়স্ক মানুষের মন থেকে মোছে না তাদের নেতাকে খুনের ঘটনা; ঔপনিবেশিক শাসন আমলে আজকের রাজধানী কিনশাসায় রাতে থাকার জন্য বেলজীয় প্রভুদের কাছ থেকে পারমিট নেওয়ার বিধান; মজুরদের পিঠে বেলজীয় প্রভুদের চাবুকের দগদগে ঘা।

সম্পদ লুট করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র কত গভীর, কত নিষ্ঠুর! আর দ্যাগ হ্যামারশোল্ডের মৃত্যু? সদ্য স্বাধীন কঙ্গোয় গৃহযুদ্ধ যাতে না বাঁধে, সে জন্য সে দেশে ছুটে গিয়েছিলেন সে সময়ের জাতিসংঘ মহাসচিব। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে; ১৯৬১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মারা যান সুইডেনের অভিজাত পরিবার থেকে আসা এ মানুষটি। যিনি শান্তির জন্য কাজ করতেন, বড় শক্তিদের চোখ রাঙানির ধার ধারতেন না, ছোট ছোট দেশের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতেন। সে বিশাল দুর্ঘটনা আজও রহস্যাবৃত। নানা তথ্য থেকে প্রশ্ন দেখা দেয় : তার বিমানটি কি গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছিল? আজ আবার এ প্রশ্ন উঠেছে।

দ্যাগ হ্যামারশোল্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি ‘আমাদের শতাব্দীর সবচেয়ে মহান রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনিই এ যাবত একমাত্র ব্যক্তি, যাকে মৃত্যুর পরে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। আজও তিনি সুইডেনে জাতীয় বীরের সম্মানে অভিষিক্ত। জাতিসংঘের প্রথম নারী আন্ডার সেক্রেটারি ডেম মার্গারেট আনসটি বলেছেন, হ্যামারশোল্ডের কাজের ধরনের কারণে তার সঙ্গে বিরোধ বাধে তাদের, যারা জাতিসংঘকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

কঙ্গোতে বড় প্রশ্ন ছিল : দক্ষিণের কাটাঙ্গা প্রদেশ কে নিয়ন্ত্রণ করবে? প্রদেশটি তামা, ইউরেনিয়াম ও টিন সম্পদে সমৃদ্ধ। শোম্বের বিচ্ছিন্নতাবাদকে মদদ দেয় বেলজিয়াম। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রও মদদ দেয়। কাটাঙ্গায় ছিল এসব দেশের স্বার্থ, সেখানকার খনিতে। আর হ্যামারশোল্ডের সমর্থন ছিল কঙ্গোর নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি। সে সরকার প্যাট্রিস লুমুমবার সরকার। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন জানায়, লুমুমবা সরকারকে। কাটাঙ্গায় নেওয়া হয় অন্য দেশ থেকে ভাড়াটে সৈন্য। প্রভুদের মদদে বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত সে ভাড়াটে বাহিনীর সামনে অসহায় হয়ে পড়ে সেখানে অবস্থানরত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী। হ্যামারশোল্ড চেষ্টা করছিলেন কঙ্গোর কেন্দ্রীয় সরকার আর শোম্বের মধ্যে আলোচনা করে বিরোধ নিষ্পত্তি করাতে। যে রাতে হ্যামারশোল্ডের বিমান রহস্যজনকভাবে ‘বিধ্বস্ত’ হয়, সে রাতে শোম্বের সঙ্গে তার আলোচনায় বসার কথা ছিল। সে ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরে, ১৯৯২ সালে দু’ব্যক্তি ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ানকে চিঠি লিখে জানান, ভাড়াটে সৈন্যরা বিমানটিকে গুলি করেছিল। এ দু’ব্যক্তি হচ্ছেন বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঠিক আগে ও ঠিক পরে কাটাঙ্গায় কর্মরত জাতিসংঘের দু’জন প্রতিনিধি। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের প্রধান ছিলেন ডেজমন্ড টুটু। এ নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বাধীন এ কমিশন ১৯৯৮ সালে আটটি চিঠি প্রকাশ করে। এসব চিঠি থেকে দেখা যায়, ওই বিমানটি নষ্ট করার কাজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তৎকালে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসন ব্যবস্থাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জড়িত ছিল। চার বছর ধরে সুইডেনের সাহায্যকর্মী গোরান বিওর্কডাল গবেষণা করেছেন বিষয়টি নিয়ে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বই লিখেছেন ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ সুসান উইলিয়ামস। বইটির নাম হু কিলড হ্যামারশোল্ড। তারা দু’জনেই এ উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, বিমানটিকে হয়তো গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এসব তথ্য মূল ধারার ব্রিটিশ তথ্য মাধ্যম বিবিসি পরিবেশন করেছে।

কত বিচিত্র, কত রহস্যময়, কত নির্মম, কত ষড়যন্ত্রপূর্ণ সম্পদ লুট করে মুনাফাবাজির জগত। ভাবতে অবাক লাগে, এত ঘটনার পরেও এ পৃথিবীতেই দারিদ্র্য‘বিরোধী’ কত ‘যোদ্ধা’ বিশ্ব প্রভুদের পরম মিত্র! দেশে দেশে এরাই কাজ করে সম্পদলোভীদের স্বার্থ নিরাপদ করতে। আর প্রচার শক্তির কত ক্ষমতা। এ খলনায়করাই হয়ে ওঠেন নায়ক। কঙ্গোতেও একই ধারার নাটকের পুনরাবৃত্তি ঘটল।

সময় তখন ১৯৬৩ সাল। শোম্বে কাটাঙ্গার বিচ্ছিন্নতা অবসানে রাজি হয়ে যায়। কারণ লুটের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই লুমুমবা। এর পরের বছর শোম্বেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন তখনকার প্রেসিডেন্ট কাসাভুবু, যিনি শোম্বেকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরে কাসাভুবু ও শোম্বেকে মসনদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন জোসেফ মুবুতু, এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বহুবার চলা ইতিহাসের প্রতিশোধ যেন!

শুরু হলো মুবুতুর যুগ। তিনি দেশের নাম পাল্টে দিলেন; কঙ্গো হয়ে গেল জায়ের। তিনি নিজের নামও পাল্টালেন, জোসেফ মুবুতু হয়ে গেলেন মুবুতু সেসে সেকো। পাল্টে দেওয়া হলো কাটাঙ্গার নাম, বোধ হয় পাপের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা। তার নাম হলো শাবা। পাল্টে দেওয়া হলো কঙ্গো নদীর নাম। তা হলো জায়ের নদী। কেবল পাল্টাল না সম্পদ লুট আর সে লুটের রাজনীতি। একটি মুবুতুর ৩০ বছরের স্বৈরশাসন জন্ম দেয় একটি শব্দের। তা হলো চৌর্যতন্ত্র। তিনি একদিকে নিজে করলেন লুট। তার প্রিয় সঙ্গীরা করল লুট, তার প্রভুরা করল লুট, আরেক দিকে দেশটিকে বানিয়ে ফেললেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত এঙ্গোলার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোর হামলা ও অন্তর্ঘাত চালানোর স্প্রিংবোর্ড, লাফ দেওয়ার তক্তা। অর্থাৎ মুবুতুর শাসন ছায়ার নিচে আরামে থেকে লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে হামলা করা হতে থাকল এঙ্গোলায়। সেটাও এঙ্গোলাকে লুট করার জন্য নিজ দেশকে এভাবে পরাশক্তির লুটের খেলার ঘুঁটি বানিয়ে মবুতু নিশ্চিত করলেন স্বীয় ‘সু’কর্মের লুটের ও শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। মবুতুর দেশের নাম জায়ের আর দুর্নীতি এক হয়ে উঠল, দুর্নীতির আরেক নাম হলো দুর্নীতি জায়ের, জায়েরের আরেক নাম হলো দুর্নীতি। অনুমান করা হয় যে, কেবল মবুতু চারশ’ কোটি ডলারের সম্পদ লুট করেছেন।

অন্যরা? লুটের প্রভুরা? সে হিসাব কোনো দিন পাওয়া যাবে কিনা, কে জানে? তবু লুট প্রেম থামে না, থামে না প্রভুব প্রেম। এমন প্রভু প্রেমিক বা প্রভুর সেস্নহাস্পদ নানা দেশেই ছড়িয়ে আছে।

লুটের একটি নিয়ম হচ্ছে লুটের সম্পদ মুঠোয় জমা হতে থাকে আর মুঠো শিথিল হয়ে ক্ষমতা পিছলে পড়তে থাকে। মবুতুরও হলো তাই। স্নায়ু যুদ্ধ শেষে তাকে আর দরকার হলো না প্রভুদের। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন।

এর আগে বেলজিয়ামের কাছে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে মবুতুর শাসনাধীন দেশটি। বিচিত্র! এত সম্পদ, অথচ দেশটিকে কর্জ করতে হয় এবং দেশটি কর্জ শোধ করতে পারে না! প্রতিবেশী দেশ রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে গণহত্যা চলে। সে গণহত্যার রেশ ধরে কঙ্গোয় নেমে আসে হানাহানি। আফ্রিকার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধগুলোর একটি আয়োজিত হয় কঙ্গোতে। ঘটনার স্রোত বয়ে চলে, ১৯৯৩ সালে কঙ্গোতে মবুতু সমর্থক ও মবুতুবিরোধী দুটি সরকার গঠিত হয়। রুয়ান্ডার মদদে বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ ১৯৯৭ সালে রাজধানী কিনশাসা দখল করে, তারা ক্ষমতায় বসায় লরেন্ট ডিজায়ার কাবিলাকে। পুনরায় দেশটির নাম হয় গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র।

স্টিভেন হিয়াট সম্পাদিত এ গেম এজ ওল্ড এজ এম্পায়ার : দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব ইকোনোমিক হিট মেন এন্ড দ্য ওয়েব অব গ্লোবাল করাপশন বইতে উল্লেখিত হয়েছে যে, লরেন্ট কাবিলাকে সমর্থন দেয় বুরুন্ডি ও উগান্ডাও। এ দুটি দেশ সৈন্য পাঠিয়েছিল ১৯৯৭ সালে কাবিলার বিদ্রোহী গ্রুপকে মদদ যোগাতে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় মিত্র লরেন্ট কাবিলা ক্ষমতায় বসলেন। এর পরে দেশটিতে নানা ঘটনা আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যুদ্ধে জড়াল উল্লেখিত দেশগুলো ছাড়াও জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, এঙ্গোলা। সঙ্গে রইল প্রভুদের ভাড়া করা নানা সশস্ত্র দল। রুয়ান্ডা ও উগান্ডা কাবিলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদদ দেয়। জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া ও এঙ্গোলা থাকে কাবিলার পক্ষে। সময় তখন ১৯৯৮ সাল। কঙ্গোর মাটিতে শুরু হলো আফ্রিকার ‘প্রথম বিশ্ব’যুদ্ধ। যুদ্ধরত সব পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল কঙ্গোর সম্পদ লুটের উদ্দেশ্যে যুদ্ধকে আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরনো সত্যই যেন আবার উচ্চারিত হলো : লুট আর ভূ-রাজনীতি অনেক সময়ই মিলেমিশে থাকে।