Thursday, November 17, 2011

এর পরে স্বৈরাচারীরা শুরু করল লুট

(তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-১৯)।। 
লুটপাটের ‘রূপকথার’ যেন শেষ নেই। কারণ যেন শেষ হয় না সেই অর্থনীতি আর সেই রাজনীতির, যা লুটপাট করেই টিকে থাকতে পারে। লুট চলে কখনো খোলাখুলি, আইনের পরোয়া না করে; কখনো তা চলে আইনের কাঠামোর মধ্যে, যখন তাকে লুট বলে চিনতে অসুবিধা হয়। তবে আইনের কাঠামোর মধ্যে বা আইনের আশ্রয়ে থেকেই লুট চলে বেশিরভাগ সময়ে। তখন কেউ যদি সে আইনকে বা আইনের কাঠামোকে বলেন লুটের আইন বা লুটেরার আইন, তা হলে সে অভিধাকে ভুল বলা মুশকিল। এমনই কিছু লুটের দৃষ্টান্ত দেখা যাক।

দেশটির নাম ইকুয়েটরিয়াল গিনি। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে, গ্যাবন ও ক্যামেরনের মাঝখানে দেশটির অবস্থান। আয়তন ১০ হাজার ৮শ’ বর্গমাইলের সামান্য বেশি। স্পেন ছিল দেশটির ঔপনিবেশিক প্রভু। স্বাধীন হয় ১৯৬৮ সালের ১২ অক্টোবর। প্রেসিডেন্ট পদে বসলেন মেসি নগুয়েমা বিয়োগো। তার ১১ বছরের শাসনকে আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে নৃশংস শাসনগুলোর অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। সে শাসন প্রকৃত অর্থে হয়ে ওঠে দুঃশাসন। আর সেই দুঃশাসনে দেশটি হয়ে পড়ে দেউলিয়া। সে শাসন পর্বকে বলা যায় সন্ত্রাসের কাল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সে সময়ে ক্রীতদাস প্রথা আবার চালু করা হয়েছিল; সেনাবাহিনী খুন করেছিল ৫০ হাজার নাগরিককে। এর পরে ১৯৭৯ সালের আগস্টে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বিয়োগো ক্ষমতাচ্যুত হন। তাকে হত্যা করা হয়। তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করলেন তারই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থিওডর নগুয়েমা মোবাসোগো। বিয়োগো ছিলেন মোবাসোগোর চাচা। বিয়োগো নিজেকে দেশটির আজীবন প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন। বিয়োগোর বিরুদ্ধে এ সামরিক অভ্যুত্থানের খবর আগেভাগে জানতেন সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু স্পেনের কর্তারা। তাদের মদদ ছিল সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে।

দেশটির অর্থনীতি কৃষি প্রধান। প্রধান ফসল কোকো, কলা, কফি, পামতেল। সাম্প্রতিক কালে খোঁজ পাওয়া গেল তেল, ইউরেনিয়াম, লোহার। কাঠ আছে প্রচুর। রফতানি করা কাঠের প্রায় সবই যায় স্পেন ও জার্মানিতে। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের সিংহভাগ স্পেনের সঙ্গে। চলতি ধারণা অনুসারে দেশটি গরিব। এ দেশেরই একজন নাম থিওডর নগুয়েমা অবিয়াং মানগু। তিনি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে চাচাকে হত্যা করে প্রেসিডেন্ট পদে বসা থিওডর নগুয়েমার পুত্র।

মানগুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ১১ কোটি ডলার এনেছেন; এ অর্থের ধরনটি সন্দেহজনক; এবং এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন আইনজীবী, ব্যাংকার, ভূসম্পত্তি দালানকোঠা ও হুন্ডি ব্যবসায়ী। মানগু সম্পর্কে  যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি তদন্ত হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ফ্রান্সে। যুক্তরাষ্ট্র আইনসভার এক শুনানি থেকে জানা যায়, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট বা হিসাব খোলা ও সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেনে দেশটির কয়েকজন কর্তাকে সাহায্য করে রিগস ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক। অর্থ পাচার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের আইন ফাঁকি দেওয়ার কাজে তাকে সহায়তা করেন যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন আইনজীবী। কোনো ব্যাংক মানগুর কোনো হিসাবের আসল চরিত্র ধরে ফেললে আরেকটি হিসাব খোলার কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন একজন আইনজীবী। অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে তিনি নানা নামে কয়েকটি কোম্পানি গঠন করেন। চড়া দামের ভূসম্পত্তি কেনাবেচায় তাকে সহায়তা করতেন দু’জন ভূসম্পত্তি ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রে তার কেনা একটি বাড়ির দাম তিন কোটি ডলার। যদি এক ডলারকে ৭০ টাকার সমান গণ্য করা হয়, তা হলে টাকার অংকে বাড়িটির দাম হয় ২১০ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের উল্লেখিত ঘটনা এবং পাচার করা অর্থের পরিমাণ হিসেবে যা উল্লেখিত হয়েছে, তা কেবল চার বছরের, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।

আফ্রিকার আরেক দেশ গ্যাবন। কঙ্গো আর ইকুয়েটরিয়াল গিনির মাঝখানে, আটলান্টিক উপকূলে দেশটির আয়তন এক লাখ ৩ হাজার ৩শ’ বর্গমাইলের কিছু বেশি। সে দেশের সম্পদের মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম, তেল, ম্যাঙ্গানিজ ও কাঠ। দেশটির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স। সে প্রভু প্রত্যক্ষ শাসন ছেড়ে চলে গেলেও এসব ক্ষেত্রে সচরাচর যা ঘটে, অর্থাৎ, নয়া ঔপনিবেশগুলোতে যে ধরন থাকে, গ্যাবনেও তাই রয়েছে। ফ্রান্সের খবরদারি, কর্তৃত্ব রয়েছে ঔপনিবেশিক আমলেরই মতো। সেই সঙ্গে, নতুন করে জুটেছে দেশটির অর্থনৈতিক নীতি ও কার্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ব্যাংকগুলোর প্রভাব।

সে দেশে ৪১ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট ছিলেন ওমর বঙ্গো। তার মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের জুনে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ৬টি সাঁজোয়া যান কেনার এবং যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ছয়টি সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমান সৌদি আরবের কাছ থেকে কিনতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি সংগ্রহের জন্য নিয়োগ করেন যুক্তরাষ্ট্রের এক লবিস্ট বা দেনদরবার কর্তাকে। এ কর্তার নাম জেফরি বিরেল। এ ধরনের কর্তারা ও প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নানাপর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে, নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রায় সব দেশেই এ ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ কাজটি এদের ব্যবসা। কোনো কোনো দেশের রাজধানীতে এদের সংখ্যা হাজার হাজার।

সাঁজোয়া যান ও পরিবহন বিমান কেনায় লাভ অনেকের, কেবল বঙ্গোর নয়। এ লেনদেনের টাকা অনেকেই পাবেন। তবে, টাকা আসবে চূড়ান্ত বিচারে কেবল একটি উৎস থেকে। তা হচ্ছে : দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের সংখ্যা অনেক, যাদের অসন্তোষ-ক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হবে এসব সাঁজোয়া যান। শাসন ব্যবস্থা যখন জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে যায়, তখন এমনই হয়; এমন হয় প্রায় সব জায়গায়।

এই বঙ্গো সাহেব সাঁজোয়া যান ও বিমানগুলো কেনার অংশ হিসেবে গ্যাবন থেকে অর্থ পাঠান যুক্তরাষ্ট্রে। এ অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৮০ লাখ ডলারের বেশি। এ অর্থ পাঠানো হয় একটি আমেরিকান কোম্পানির নামে। কোম্পানিটি গঠন করেন উল্লেখিত লবিস্ট বিরেল সাহেব। এছাড়া কিছু অর্থ সরানো হয় মাল্টায় প্রেসিডেন্ট ওমর বঙ্গোর নামে খোলা একটি বিদেশী মুদ্রা হিসাব থেকে। এটা ছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংকে ওমর বঙ্গোর একজন উপদেষ্টা ও কয়েকজন কনসালট্যান্ট বা পরামর্শকের নামে রাখা হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সরানো হয়। দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ওমর বঙ্গো ১০ কোটি ডলারের বেশি পাচার করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেছেন ভুয়া বিভিন্ন কোম্পানি। ফ্রান্সে তেল নিয়ে এক কেলেঙ্কারিতেও জড়িত ছিলেন ওমর বঙ্গো। দুর্নীতির একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ফ্রান্সে। সেখানেও রয়েছে তার নাম।

তিনি নিজ কন্যা ইয়ামিলি বঙ্গো এমটায়েরকে দেন বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। ইয়ামিলি কিছু অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখেন; আবার কিছু নগদ অর্থ জমা রাখেন সিন্দুকে। এসব ঘটনা ঘটে ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তখন তিনি ছাত্রী, কোনো আয় রোজগার নেই। একটি ব্যাংক তার হিসাব বন্ধ করে দেয়, যখন দেখে যে, সে হিসাবে গ্যাবন থেকে পাঠানো হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৫শ’ ডলার। আরেকটি ব্যাংকও সেটাই করে, যখন দেখে যে, ব্যাংকটির সিন্দুকে তিনি রেখেছেন ১০ লাখ ডলার। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে এনেছিলেন তার বাবা এবং এ কাজে তার বাবা ব্যবহার করেছিলেন কূটনৈতিক সুবিধা। এই কূটনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়নি অর্থ সংক্রান্ত তথ্য। বঙ্গো পরিবারের আরেক সদস্য ইঙ্গো লিন কলিন্স বঙ্গো। তিনি গ্যাবনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলি বঙ্গোর পত্নী। কলিন্স বঙ্গো ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। এর নাম কলিন্স রিভোকেবল ট্রাস্ট। এর পরে ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকটি ব্যাংকে এ ট্রাস্টের নামে খোলা হয় কয়েকটি অ্যাকাউন্ট। পরবর্তী তিন বছরে তিনি এ ট্রাস্টের নামে অন্য দেশ থেকে পাঠানো বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেন। সে অর্থ তিনি ব্যয় করেন নিজের বিলাস বৈভবভরা জীবন ভোগে। এছাড়া ট্রাস্টের তহবিলে জমা করা এ অর্থ এক হিসাব থেকে আরেক হিসাবে এমনভাবে সরানো হয়, যা থেকে লাভবান হন তিনি ও তার স্বামী।

লোকে বলে, তেলের ওপর ভাসছে নাইজেরিয়া। এ ঘটনা সেই নাইজেরিয়ার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আতিকু আবু বকরের চতুর্থ বিবি, মার্কিন নাগরিক জেনিফার ডগলাসকে নিয়ে। জেনিফার ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চার কোটি ডলার নিয়ে আসতে সাহায্য করেন। এসব অর্থ পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। এ অর্থের উৎস, ইত্যাদি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের। এ অর্থ পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংকে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ২০০৮ সালে এক দেওয়ানি অভিযোগ দায়ের করে। এতে বলা হয়, ডগলাস বেগম ২০০১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত জার্মানির অন্যতম বিশাল কোম্পানি সিমেন্সের কাছ থেকে ২০ লাখ ডলারেরও বেশি পেয়েছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছেন। তবে সিমেন্স যুক্তরাষ্ট্রে এ সংক্রান্ত ফৌজদারি অভিযোগে দোষ স্বীকার করেছে এবং ঘুষ প্রদান সংক্রান্ত দেওয়ানি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। সেই সঙ্গে, সিমেন্স যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের এ সংক্রান্ত উপ-কমিটিকে বলেছে, সিমেন্স ওই বেগমের আমেরিকান অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে।

আর আবু বকরের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় নাইজেরিয়ায়, ২০০৭ সালে। সে অভিযোগ ছিল পেট্রলিয়াম টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড নিয়ে। এই পেট্রলিয়াম প্রযুক্তি উন্নয়ন তহবিলের চার কোটি ডলারের মধ্যে আড়াই কোটি ডলার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি ব্যাংকে পাঠানো হয়। এ ব্যাংকগুলোতে হিসাব খোলেন বেগম ডগলাস। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো যখন অন্য দেশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ পাঠানো বিষয়ে বেগম ডগলাসকে প্রশ্ন করে, তখন তিনি স্বীকার করেন যে, এ ধরনের অর্থ প্রেরণ পদ্ধতি বিষয়ে তিনি সামান্যই জানেন। তবে এ অর্থ এসেছে তার স্বামীর কাছ থেকে, সে আভাস তিনি দেন। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি ব্যাংক কোনো একটি হিসাব বন্ধ করে দিলে তার আইনজীবীরা অন্যান্য ব্যাংককে রাজি করিয়েছেন তাদের মক্কেলের নামে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে।

এছাড়া নাইজেরিয়ায় আবু বকরের স্থাপন করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিকে পাঁচ বছর মেয়াদে আবু বকর প্রেরণ করেন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এ অর্থ গ্রহণ করে এবং তা গ্রহণ করে এ তহবিলের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেখায়, এ বিষয়ে প্রশ্ন করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।

এখানে উল্লিখিত তথ্যসমূহ যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের অনুসন্ধান সংক্রান্ত উপ-কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনটি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির। লুটপাটের জগতে এখানে উল্লিখিত ঘটনা মাত্র তিনটি। এমন শত শত ঘটনা রয়েছে। অর্থের পরিমাণের দিক থেকেও এ ঘটনাসমূহ তেমন বেশি নয় লুটপাটের অন্যান্য পরিমাণের তুলনায়। এ তিনটি ঘটনার গুরুত্ব হচ্ছে : ১. এগুলো উদাহরণ, যা লুটপাটের জগতের ব্যাপকতা বুঝতে সাহায্য করে; ২. লুটের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলো ও সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে।

ছিঁচকে চুরি বা পাতি চুরি করা এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব। একাধিক ব্যক্তির দরকার হয় না পাতি চুরি করতে। কিন্তু লুটপাট একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার হয় সঙ্গী-সাথী সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া। এই সঙ্গী-সাথী ইত্যাদি কোনো একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকলে বড় আকারের লুট সম্ভব নয়। এসবের সঙ্গে দরকার অনুকূল পরিবেশ। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সে সমাজে বিভিন্ন অংশের শক্তি, সচেতনতার ও সমবেত থাকার মাত্রা, অবস্থান, বিভিন্ন অংশের মধ্যকার সম্পর্ক, এগুলো মিলে তৈরি হয় পরিবেশ।

ঘটনা তিনটিতে লক্ষণীয় দুটি বিষয়। সে বিষয় দুটি হচ্ছে- ১. লুটের প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখিত হচ্ছে কেবল ব্যক্তি, ২. তবে কাজটির অর্থাৎ লুটের ক্ষেত্রে প্রকাশ হয়ে পড়ছে ব্যাংকের সম্পর্ক এবং আইনের ফাঁকফোকর। দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিরা ধোঁকা দিচ্ছে বা বোকা বানাচ্ছে ব্যাংককে, আইনকে। আবার তা ফাঁসও হয়ে যাচ্ছে যখন প্রতিষ্ঠান প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ লুটের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ব্যক্তির চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে। লুটপাটের বিষয়টি দেখার সময় এ দিকগুলোও দেখা দরকার।

খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে : প্রতিষ্ঠান কখন ও কেন লুট সহ্য করে এবং কখন ও কেন করে না? প্রশ্ন হতে পারে : মাত্র এই তিন চার সাহেব-বিবির মাত্র ক’বছরের লুটের পরিমাণ যদি এত টাকা হয়, তা হলে লুটপাটের জগতে টাকার পরিমাণের হিসাবে কত বড়? আরো প্রশ্ন হতে পারে ইকুয়েটরিয়াল গিনি বা গ্যাবন বা নাইজেরিয়ার সাধারণ মানুষ বা একজন মজুর বা একজন গৃহবধূ বা একজন কৃষক কি খবর রাখেন এ লুটপাটের? তারা কি তুলনা করতে পারেন তাদের আয়ের, সারাজীবনের উপার্জনের সঙ্গে লুট করা অর্থের পরিমাণের? অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের কাছে তথ্য পৌঁছায় না, যারা পড়তে পারেন না, তারা কি জানেন, লুটের জগতের খবর, লুটের পরিমাণ? তারা কি জানেন যে, লুটের এ অর্থ তাদেরই?

No comments:

Post a Comment