এত দুর্ভোগ-দুর্গতি যে কঙ্গোর, সেই
কঙ্গো সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে ১২০০ সালে। পর্তুগিজ নাবিক দিয়েগো কাও ১৪৮২ সালে
আসেন কঙ্গো। তিনিই ছিলেন কঙ্গোয় পদার্পণকারী প্রথম ইউরোপীয়। কঙ্গোর রাজার
সঙ্গে পর্তুগালের সম্পর্ক স্থাপিত হয় সে পদার্পণের মধ্য দিয়ে। এর প্রায়
সোয়াশ’ বছর পরে শুরু হয় দাস বাণিজ্য, ষোড়শ শতকে ইংরেজ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ও
ফরাসি বণিকরা আরম্ভ করে মানুষ নিয়ে সে ব্যবসা। তারা সঙ্গে নেয় স্থানীয়
সহযোগীদের; দালা, মধ্যস্বত্বভোগীদের। এ বাণিজ্য চলে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত।
বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড
কঙ্গোকে উপনিবেশ বানানোর মতলবে গঠন করলেন ব্যক্তিগত ব্যবসা উদ্যোগ; সময় তখন
১৮৭০-এর দশক। দেশটি হয়ে পড়ে রাজা লিওপোল্ডের জমিদারি। শুরু হলো কঙ্গোকে
বেলজিয়ামের উপনিবেশকরণ। এর আগেই শুরু হয়েছে আফ্রিকার বিপুল সম্পদ লুট করে
নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা। রাবারের
চাহিদা বেড়েছে বিপুলভাবে। আর কঙ্গোতে তখন ছিল অনেক রাবার গাছ। তাই
বেলজিয়াম রাজের ‘মহতী উদ্যোগ’ কঙ্গোতে। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি নির্দিষ্ট
পরিমাণ রাবার উৎপাদিত হতো, ততক্ষণ পুরুষ কর্মীদের পরিবারগুলোকে আটকে রাখা
হতো। যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাবার উৎপাদন করতে পারত না, তাদের দু’হাত কেটে
ফেলা হতো। আরো, আরো রাবারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের যে দাবি, তা
প্রতিরোধ করত যারা, তাদেরও ভাগ্যে জুটত দু’হাত কেটে ফেলার ‘পুরস্কার’। এর
সঙ্গে ছিল অনাহার, অতি শ্রমে শরীর ভেঙে পড়া, রোগ। এসব আর হত্যা মিলে
কঙ্গোতে সে যাত্রা মারা যায় এক কোটি মানুষ। রবার্ট ও’ব্রায়ান এবং মার্ক
উইলিয়ামের গ্লোবাল পলিটিক্যাল ইকোনমি : ইভোলিউশন অ্যান্ড ডায়নামিক্স বইতে এ
তথ্য উল্লেখিত হয়েছে। রবার্ট ও মার্ক আরো লিখেছেন, রাজা লিওপোল্ড যখন
কঙ্গো লুট করে চলেছেন, সে সময়ই, বেলজীয় সাম্রাজ্য আর রাবারপতিদের স্বার্থ
রক্ষায় সব ‘রাবার চর’ সক্রিয়ভাবে চালাচ্ছে গণহত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার।
বার্লিনে ১৮৮৪-৮৫ সালে ইউরোপীয়
শক্তিবর্গের সম্মেলনে কঙ্গো অববাহিকায় রাজা লিওপোল্ডের দাবি স্বীকার করে
নেওয়া হয়। এ সম্মেলন আহবান করেছিলেন বিসমার্ক। আফ্রিকার মধ্যাঞ্চল নিয়ে
ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছিল, তা দূর করাই ছিল এ ১৫ দেশ
সম্মেলনের উদ্দেশ্য। কঙ্গোয় বেলজীয় ও ফরাসি লিপ্সা মেনে নিতে পারছিল না
ব্রিটিশ ও পর্তুগিজ শক্তি। আবার পূর্ব আফ্রিকা ও ক্যামেরুন অঞ্চলে জার্মান
সম্প্রসারণও তারা মানতে পারছিল না। তাই উত্তেজনা। এ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
বেলজিয়াম রাজ ১৮৮৫ সালে কঙ্গো ফ্রি স্টেট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তিনি
হলেন সে ফ্রি স্টেটের প্রধান। কঙ্গোর মানুষ, যাদের রক্তে, শ্রমে এ
সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি, তারা নিজ দেশে রইলেন পদানত। সাম্রাজ্য-শক্তির কি
পরিহাস! সাম্রাজ্য শক্তি এভাবেই সব কালে, সব দেশে স্বনির্মিত ‘সত্য’
জবরদস্ত চাপিয়ে দিয়েছে। তবু সাম্রাজ্যের ক্ষুধা মেটে না। রক্ত ঝরতে থাকে
বেলজীয় শক্তিমানরা ১৮৯১-৯২ সালে কাতাঙ্গা দখল করে। এর আগেই, বার্লিন
সম্মেলনে কঙ্গো ও নাইজার নদীতে অবাধ চলাচলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে,
নির্ধারিত হয়েছে প্রভাবাধীন এলাকা। এ সবই করা হয়েছে উপনিবেশ বানানোর
হুড়োহুড়ি যাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের মধ্যে যুদ্ধ না বাধিয়ে দেয় সে
উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ শান্তি বজায় রাখতে হবে লুটের জন্য। লুটেরারা
‘শান্তিপ্রিয়’ কেন হয়, তাদের চাওয়া ‘শাস্তি’ কেমন, চলাচলের অবাধ অধিকার কেন
দরকার, এসব স্পষ্ট হয়ে যায় এ ঘটনার মধ্য দিয়ে। এ ঘটনা আরো দেখিয়ে দেয় :
দেশ এক দেশবাসীর, দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে প্রভুরা। এ ঘটনা একটি নয়,
সাম্রাজ্যগুলোর ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেক। আবার সাম্রাজ্য কেন এমন আচরণ করে,
সাম্রাজ্য হয় কিভাবে, কোন শক্তি কাজ করে সাম্রাজ্যের মধ্যে যা সাম্রাজ্যকে
নিয়ে যায় অসংখ্য মানুষের রক্ত আর শ্রম আত্মসাৎ করতে, সে বিষয়গুলোও বুঝতে
পারা দরকার লুট, হত্যার ইতিহাস বুঝতে পারার জন্য। আজ অবশ্য এ দ্বন্দ্বের
কথা অনেকেই অস্বীকার করতে চান হাল্কাচালে বলা চটকদার কথা দিয়ে। ফলে অজানা
রয়ে যায় লুটের ইতিহাস। কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন (দশ লাখে এক মিলিয়ন) মানুষকে
ক্রীতদাস বানানোর ঘটনা কি অস্বীকার করা যায়? যায় কি ধন-সম্পদ লিপ্সার।
এ অমানবিক ঘটনা অস্বীকার করা? অন্য
আরেক দেশের রাজার জমিদারি হয়ে উঠল এক দেশ! চলতে থাকল মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে
দাস বানানো। কেন? গুটিকয় লোকের ভোগের জন্য আরো আরো সম্পদ চাই, সে জন্য।
কঙ্গোকে অঙ্গীভূত করে নেয় বেলজিয়াম ১৯০৮ সালে। প্রতিবাদ জানান কঙ্গোর
মানুষ। সে প্রতিবাদ দমনে রাজা লিওপোল্ডের চরেরা গণহারে, নির্বিচারে চালায়
খুন, হত্যা, নির্যাতন।
ইতিহাসের তথ্য বলে : রাজা লিওপোল্ডের
কঙ্গো জমিদারিতে কঙ্গোর মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হয় হত্যা করা হয়েছে, নতুবা
তারা অন্যের জন্য সম্পদ তৈরিতে বাধ্য হয়ে কাজ করতে করতে মারা গেছেন, এখানে
রয়েছে দ্বন্দ্ব : কতিপয়ের সম্পদ আর অগণিতের মেহনত। অর্থাৎ অগণিত সাধারণ
মানুষের মেহনতে তৈরি হয় যে সম্পদ, তা যায় কয়েক লোকের ভোগে। এ দ্বন্দ্ব আজ
অস্বীকার করে নতুন পথ খোঁজেন কেউ কেউ। কিন্তু অস্বীকার করলেই তো আর
দ্বন্দ্ব মিলিয়ে যায় না। তা চলতেই থাকে। যিনি সে দ্বন্দ্ব অস্বীকার করেন,
তিনি কেবল অপেক্ষা করেন বোকা হওয়ার মুহূর্তটির জন্য। কঙ্গোতেও হলো তাই।
স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হলো। রক্তাক্ত
সে সংগ্রাম। সে লড়াইতে দেশটি ক্ষত-বিক্ষত, কঙ্গো খন্ড খন্ড হওয়ার অবস্থা।
উপনিবেশটির ওপর সাম্রাজ্যবাদী প্রভু বেলজিয়াম নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে।
অবশেষে ১৯৬০ সালে কঙ্গো স্বাধীনতা অর্জন করে। দেশটির নেতা হিসেবে আবির্ভূত
হন প্যাট্রিস লুমুমবা। শুরু হয় আরেক রক্তাক্ত অধ্যায়ের। চক্রান্ত আর
হত্যাকান্ডে পূর্ণ সে অধ্যায়। সে অধ্যায়তেও নাটের গুরু ধনশালীরা, তাদের
মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো আর এদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত শক্তিধর
রাষ্ট্রগুলো।
No comments:
Post a Comment