লিবিয়ার যুদ্ধের খবর কারো অজানা নয়। এ
যুদ্ধের বিভীষিকা আর ভয়াবহতার খবর ও ছবি সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়, টিভির
পর্দায়। এ বিবরণ আবার দেওয়ার দরকার পড়ে না। লিবিয়ার এ যুদ্ধ চালাচ্ছে উত্তর
আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা বা ন্যাটো নামের সামরিক জোট। মূলধারার সংবাদ
মাধ্যমের বহু খবরে, তথ্যে, ছবিতে ন্যাটো নেতাদের ভাষ্যে, বক্তব্যে, দাবিতে এ
নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। অনেক তথ্য আড়াল করে, অনেক তথ্য বিকৃত করে,
তথ্য অতিরঞ্জন করে বানোয়াট তথ্য প্রচার করে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের বিপুল
অংশ লিবিয়ায় ন্যাটোর চালানো যুদ্ধকে দেখাতে চাচ্ছে ‘গণতন্ত্রের লড়াই’,
‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ হিসেবে। কিন্তু এত কিছুর পরেও সত্য প্রকাশিত হচ্ছে। সে
সত্য বলছে লিবিয়ায় যুদ্ধ চালাচ্ছে ন্যাটো।
ন্যাটো কেন এ যুদ্ধ করছে আর এ যুদ্ধের
ধরন-ধারণ-চরিত্র কেমন- কি, তা বুঝতে পারা সহজ হবে নিচে উল্লেখ করা
তথ্যগুলোর দিকে খেয়াল দিলে। এসব তথ্য যথাসম্ভব সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১. ইন্ধন বিষয়ক সাময়িকী পেট্রোলিয়াম
ইকোনমিস্ট এ বছরের ২৭ এপ্রিল একটি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম হিসেবে লেখে :
দ্য ওয়ার ফর লিবিয়াজ অয়েল অর্থাৎ লিবিয়ার তেলের জন্য যুদ্ধ। এ সংবাদ
প্রতিবেদনটি পাঠান ডেরেক ব্রোয়ার, গাদ্দাফিবিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চল
থেকে।
২. রাশিয়া টুডেতে ২ এপ্রিল ২০১১
তারিখে সাংবাদিক সুসান লিনডরের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল :
ওয়ার ফর লিবিয়ান অয়েল প্ল্যানড লং এগো, নো ওয়ান কেয়ারস এবাউট পিপল অর্থাৎ
লিবিয়ার তেলের জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা অাঁটা হয়েছে বহু আগে, জনগণের কথা কেউ
ভাবে না।
সাংবাদিক লরেন নানা দেশে
যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি মনে করেন না যে, মানবিক
কারণে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। তার যুক্তি : মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ
করা হলে, লিবীয় জনগণের কথা ভাবা হলে, এ হানাহানি অনেক আগে থেমে যেত।
৩. রাশিয়া টুডেতেই ৪ এপ্রিল আরেকটি
সংবাদের শিরোনাম ছিল : ইললিগ্যাল ওয়ার ইন লিবিয়া ইজ সিআইএ রান, মিডিয়া শিলস
কভার ফর ওবামা! হুইসব্লোয়ার সুসান লিনডর, লিবিয়ার বেআইনি যুদ্ধ সিআইএ
চালাচ্ছে, ওবামাকে আড়াল করছে সংবাদ মাধ্যম, তথ্য ফাঁস করছেন সুসান লিনডর।
এভাবে আরো সংবাদ-প্রতিবেদনের উল্লেখ
করা যায়, যেগুলোতে একই ধরনের তথ্য, যুক্তি ও বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত খবরের কাগজ টেলিগ্রাফে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে কেউই
বলবেন না যে, তা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বা যুক্তরাজ্যবিরোধী বা
ন্যাটোবিরোধীদের দ্বারা রচিত। এ পত্রিকার ২২ আগস্ট ২০১১ তারিখের সংখ্যায়
গর্ডন রেনার, টমাস হার্ডিং ও ডানকান গার্ডহ্যামের লেখা সংবাদ প্রতিবেদনের
শিরোনাম লিবিয়া : সিক্রেট রোল প্লেড বাই ব্রিটেন ক্রিয়েটিং পাথ টু দ্য ফল
অব ত্রিপোলি, লিবিয়া : গোপনে ব্রিটেনের ভূমিকা ত্রিপোলি পতনের পথ রচনা
করছে। উল্লেখ করতে হয় যে, সংবাদ-প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরে বিষয়টি আর গোপন
থাকেনি।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় : সামরিক ও
গোয়েন্দা কর্তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধীদের সাহায্য
করছেন। রাজধানী ত্রিপোলিতে সমন্বিতভাবে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা প্রণয়নে
তাদের এ সাহায্য অনুযায়ী রাজকীয় বিমান বাহিনী অর্থাৎ ব্রিটিশ বিমান বাহিনী
২০ আগস্ট সকালে আক্রমণ জোরদার করে। এটি ছিল আগেভাগে করা পরিকল্পনার অংশ।
গাদ্দাফিবিরোধীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতে এ বিমান হামলা জোরদার করা হয়।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় :
গাদ্দাফিবিরোধীদের ঘাঁটি বেনগাজিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্তারা
গাদ্দাফিবিরোধী জোটের করা রণপরিকল্পনা আরো ধারালো বা ঘষামাজা করেন। এ
পরিকল্পনার ব্যাপারে ১০ সপ্তাহ বা আড়াই মাস আগে মতৈক্য হয়। ব্রিটিশ
বিশ্লেষকরা গাদ্দাফিবিরোধী নেতাদের অবিরাম রণকৌশলগত হালনাগাদ
বুদ্ধি-পরামর্শ দেন। এ পরামর্শের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ত্রিপোলির ভেতরে নতুন
করে ব্যাপক লোকজনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা। সেটাই হবে বিদ্রোহী লড়িয়েদের
ত্রিপোলির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা। ত্রিপোলিতে গাদ্দাফিবিরোধী লোকেরা মাথা
চাড়া দেয় ২০ আগস্ট রাতে। আর রাজধানী ত্রিপোলি দখলের লড়াইয়ের প্রথম পর্ব
শুরু হয় এর কয়েক ঘণ্টা আগে, ইংরেজ বিমান বাহিনীর টর্নেডো জিআরফোর বিমানের
হামলার মধ্য দিয়ে। এগুলো হামলা চালায় ত্রিপোলির দক্ষিণ-পশ্চিমে যোগাযোগের
প্রধান স্থাপনাগুলোতে। ওইদিন সকালে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে এমনভাবে
পরিচালিত বোমা পেভওয়ে ফোর ফেলা হয় একটি গোয়েন্দা কেন্দ্রে। এর পরে বিমান
আক্রমণ চালানো হয় ট্যাংকের ওপরে, কামানে, কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল বা
নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনায়। এদিকে ত্রিপোলির ভেতরে গাদ্দাফিবিরোধীদের
সংকেত দেওয়া হয় মাথাচাড়া দেওয়ার জন্য। সংকেত ছিল গাদ্দাফিবিরোধী জোট প্রধান
জলিলের একটি বক্তৃতা সম্প্রচার করা। জলিলের বক্তৃতাটি সম্প্রচার করে
কাতারে স্থাপিত টিভি কেন্দ্র লিবিয়া টিভি। এটি সম্প্রচারিত হয় ওইদিন
বিকেলে। রাত ৮টা নাগাদ একদল গাদ্দাফিবিরোধীদের লড়িয়ে সুযোগ বুঝে নগর
কেন্দ্রে বেন নবি মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নেয়, মসজিদের মাইকে তারা স্লোগান দেয়,
শুরু হয় অপারেশন মারমেড ডন (এ পর্যায়ের সাংকেতিক নাম)।
এতে বলা হয়, এর আগে ত্রিপোলির ৩০ মাইল
দূরে লড়াইতে গাদ্দাফি ত্রিপোলি থেকে সৈন্য পাঠান। হয় তো গাদ্দাফির
পরিকল্পনা ছিল সে যুদ্ধ শেষ হলে সেনাদের আবার বিন্যস্ত করা হবে, সজ্জিত করা
হবে অস্ত্রে, যেমন প্রতিটি বড় লড়াইয়ের পরে তিনি করেছেন। কিন্তু সে লড়াইতে
ব্যস্ত থাকার সময়েই ইংরেজ বিমানবাহিনীর টর্নেডো ও টাইফুন বিমানগুলো
ত্রিপোলিতে আগে থেকে বাছাই করে রাখা লক্ষ্যবস্ত্তগুলোতে একের পর এক আঘাত
করে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। ইংরেজ বিমান বাহিনীর ও সঙ্গী দেশগুলোর বিমান
বাহিনীর বিমানগুলো ২১ আগস্ট ত্রিপোলিতে ৪৬ বার আঘাত হানে (অর্থাৎ প্রায়
প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর চলে এ বিমান হামলা)। এসব হামলায় ব্যবহার করা হয়
ভূমিতে আক্রমণ চালানোর ক্ষেপণাস্ত্র ব্রিমস্টোন। এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো
বেসামরিক এলাকায় অবিশ্বাস্য নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে। গাদ্দাফির
বাংকারের ওপরে রাতভর আঘাত হানে বিমান। টর্নেডো বিমানগুলোতে যে উন্নত
ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা রয়েছে তা দিয়ে বিমান উড্ডয়ন অবস্থায়ই লক্ষ্যবস্ত্ত
চিহ্নিত করে আঘাত হানতে পারে। এ ব্যবস্থাকে বলে ডায়নামিক টার্গেটিং।
গাদ্দাফির কয়েকটি নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল ফাঁকা
স্কুলভবনে বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে। সেগুলোতে আঘাত হানা হয়। ফলে সৈন্যদের
নির্দেশনা দেওয়ার সামর্থ্য নষ্ট হয়ে যায়।
টেলিগ্রাফেরই খবরে বলা হয়, ব্রিটেন
গাদ্দাফিবিরোধীদের সাজসরঞ্জামে সজ্জিত করেছে। এ খবরের সত্যতা সমর্থন করেছেন
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। এসব সাজসরঞ্জামের মধ্যে ছিল
টেলিযোগাযোগের উন্নত সরঞ্জাম, গোলাগুলি থেকে দেহ রক্ষায় ১ হাজার সেট বর্ম,
রাতে অন্ধকারে দেখার ক্ষমতাবিশিষ্ট চশমা। গাদ্দাফিবিরোধীদের হাত থেকে
ত্রিপোলি রক্ষার জন্য গাদ্দাফি একের পর এক আহবান জানান রাজধানীবাসীর প্রতি।
বেতার ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বেতারে তার সে কণ্ঠস্বর শোনা যায়
ভাঙা ভাঙা, মাঝে থাকে অন্যান্য শব্দ। তিনি নিজের কোনো ভিডিও ছবিও দেখাতে
পারেননি। এর ফল দাঁড়ায় : গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধে হার
হয়েছে ভেবে অনেক সৈন্য যেখানে ছিল সেখানেই রণপোশাক ছেড়ে সরে যায়। এ খবরও
ইংরেজ পত্রিকা টেলিগ্রাফের। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার
সরকারি বাসভবনে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসেন। আর বাসভবনের
সামনে এসে সাংবাদিকদের কাছে লিবিয়ায় ঘটনাধারার জন্য রাজকীয় বিমান বাহিনীর
বৈমানিকদের ‘অবিশ্বাস্য সাহসিকতা, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠা’র প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন : ‘এটা আমাদের বিপ্লব নয়। তবে আমরা পালন করেছি আমাদের ভূমিকা। সে
জন্য আমরা গর্ববোধ করতে পারি।’ কোন অস্ত্রের বিপরীতে কোন অস্ত্র, কোন
রণসজ্জার মোকাবিলায় কোন রণসজ্জা, কত সমর শক্তির বিপরীতে কত সমর শক্তি, সে
বিচার পাঠক করবেন। সাহসিকতার তুলনা-প্রশংসা ইত্যাদিও পাঠক বিবেচনা করবেন।
আর পাঠক বুঝবেন কেমন সে বিপ্লব, যাতে গর্ববোধ নিয়ে অংশ নেয় এ মহাশক্তিধররা
একসঙ্গে জোটবেধে। সে কি বিপ্লব, নাকি স্বার্থ হাসিলের যুদ্ধ, যার গায়ে
লেবেল মারা মানবিক হস্তক্ষেপ।
এ মহাশক্তিধরদের মদদের খবর আসে
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির মাধ্যমে। বিবিসির ৪ জুন, ২০১১ তারিখে লিবিয়ার
পশ্চিামাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের তৎপরতা বিষয়ক খবরে বলা
হয় : এলাকার আকাশে ন্যাটোর বিমানগুলো চক্কর দিচ্ছে। সে শব্দ কানে আসে
বিবিসি সংবাদদাতার। সেখানকার এক বাসিন্দা বলেন, ন্যাটো হামলা চালানোয় আমরা
খুব খুশি। বিবিসির সংবাদদাতা জানান : আইন সেজালাতে গাদ্দাফি বাহিনীর
অবস্থানে ন্যাটো বিমানগুলো হামলা চালিয়েছে। সেখানকার এক বাসিন্দা বিবিসি
সংবাদদাতাকে বলেন : আমরা নির্ভর করি আমাদের সাহস আর ন্যাটোর ওপরে। পাঠকের
বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কার ওপরে ভর করে কার সাহস! আর ন্যাটোর উন্নত
অস্ত্র বহরের বিবরণ সংক্ষেপে বলার নয়। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর যে গোয়েন্দা
বিমান লিবিয়ার আকাশে চক্কর দিয়ে দিয়ে সদাসর্বদা নজর রেখেছে, তথ্য সংগ্রহ
করেছে, তাতে চড়ে লিবিয়ার আকাশে ঘুরে বিবরণ দিয়েছেন বিবিসির প্রতিরক্ষা
বিষয়ক সংবাদদাতা ক্যারোলিন উইয়্যাট। সেনটিন্যাল আরওয়ান নামের এ বিমানের
রাডার সরঞ্জাম কয়েক মিনিটে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা স্ক্যান করতে
পারে, অর্থাৎ তন্ন তন্ন করে দেখে নিতে পারে। ভূমধ্যসাগরের ওপর তীরে
সাইপ্রাস থেকে যাত্রা করে এ বিমান লিবিয়ার আকাশে পৌঁছায় কয়েক ঘণ্টায়। তার
পরে প্রায় সাত মাইল ওপর থেকে রাডারের সাহায্যে ছবি তোলা হয় এ ধরনের পাঁচটি
বিমান, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদির জন্য যুক্তরাজ্যের করদাতাদের ১০ বছরে
খরচ হয়েছে ১ বিলিয়ন বা ১শ’ কোটি পাউন্ড। এ একটি তথ্যই দেখিয়ে দেয় যুদ্ধের
বিশাল আয়োজন, বিপুল ব্যয়।
বিবিসিরই ২২ আগস্ট ২০১১ তারিখের খবরে
বলা হয়, বিমান হামলা জোরদার করার ফলে নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ
স্থানগুলো সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ মজুদখানা, বিশেষ করে বাব আল আজিজিয়া
নামের প্রেসিডেন্ট বাসভবন চত্বর ধ্বংস হওয়ার খবর ন্যাটো সমর্থন করেছে। কেবল
যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র নয়, ফ্রান্সও গাদ্দাফিবিরোধীদের সশস্ত্র করে
তোলে। বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা জনাথন মারকাসের ২৯
জুন ২০১১ তারিখের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় : লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে নফুসা
পার্বত্য অঞ্চলে গাবিদের অস্ত্র যোগাচ্ছে ফরাসি সামরিক বাহিনী। প্যারাশুটের
সাহায্যে বিমান থেকে গাদ্দাফিবিরোধীদের অবস্থানে ফেলা হচ্ছে অস্ত্র। এসব
অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এসল্ট রাইফেল, মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার। লা ফিগারো
পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় : হয়তো ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মিলানও
দেওয়া হচ্ছে তাদের। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের অস্ত্র দিচ্ছে
কাতার এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। এ ধরনের কিছু অস্ত্র আবার
বিমানে করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে গাদ্দাফিবিরোধীদের
কাছে।
পাঠক হয়তো অবাক হচ্ছেন,
অস্ত্রশস্ত্রের এ ‘কারবারে’ ফ্রান্সের নাম শুনে। কারণ কোনো কোনো পাঠক হয়তো
ভাবছেন, এ দেশটিই কতো দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্প-নাটক, নাচে কতোই সহায়তা
যোগায়, এ দেশটির বেসামরিক সেরা পদকে ভূষিত করা হয় সত্যজিৎ রায়কে। এখানে সে
বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে সংক্ষেপ উত্তর হবে : একেই বলে রাজনীতি! আর
রাজনীতির গোড়া হচ্ছে অর্থনীতি। তবে আমাদের দেশের কোনো কোনো কলাম লেখক
আক্ষেপের সুরে লিখে ফেলেন অর্থনীতির মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেছে। তারা বোঝাতে
চান, এ দুটো আলাদা। তেমনভাবে দেখলেই ঘটনা বুঝতে সমস্যা হয়। যাই হোক, ফিরে
যাই লিবিয়ার ন্যাটোর চালানো যুদ্ধের প্রসঙ্গে। ন্যাটোর লিবিয়া যুদ্ধের মোট
খরচের হিসাব এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি। এ নিয়ে ভবিষ্যতে মজার মজার খবর
বেরুবে বলে ধারণা করা যায়।
তবে বিবিসি ২৭ জুন ২০১১ তারিখে জানায়,
লিবিয়ায় সামরিক অভিযানে মার্চ থেকে যুক্তরাজ্যের খরচ হয়েছে ২৬ কোটি
পাউন্ড। এ খরচের মধ্যে ছিল বিমান, ইত্যাদির সার্ভিসিং, জ্বালানি, ক্রু ও
প্রশিক্ষণ, অবচয়, ইত্যাদি। পার্লামেন্ট, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ, প্রতিরক্ষা
মন্ত্রণালয়, ইত্যাদি সূত্রের বরাত দিয়ে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে
অপারেশনাল খরচ ধরা হয়েছে ১২ কোটি পাউন্ড। এ খরচের মধ্যে রয়েছে ইটালিতে ১২টি
টর্নেডো ও ছয়টি টাইফুন জঙ্গি বিমান ও সেগুলোর বৈমানিক এবং অন্যান্য কর্মী ও
ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাখার খরচ। বিশ্লেষকরা
জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ডুবোজাহাজ ট্রায়াম্প থেকে ১৫টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র
ছুড়েছে লিবিয়ায়। সেখানে ইংরেজ বিমান সেনারা ছুড়েছে শত শত পেডওয়ে ও
ব্রিমস্টোনসহ নানা ধরনের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র। একটি ব্রিমস্টোন
ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ১ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড, একটি স্টর্ম শ্যাডো
ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ৭৮ লাখ ৯০ হাজার পাউন্ড, একটি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের দাম
৮ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১১ লাখ পাউন্ড। একটি পেভওয়ে গাইডেড বোমার দাম ২ লাখ
২০ হাজার পাউন্ড, ট্রায়াম্প ডুবোজাহাজের প্রতিদিনের অপারেশন বা পরিচালন
ব্যয় ২ লাখ পাউন্ড, রণতরী কাম্বারল্যান্ডের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ ৯০ হাজার
পাউন্ড, টাইফুন যুদ্ধ বিমানের উড্ডয়নকালীন প্রতি ঘণ্টার খরচ ৭০ হাজার
পাউন্ড, অ্যাপাচে হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে ৪২ হাজার পাউন্ড, টর্নেডো
যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার পাউন্ড, ডিসি ১০ বিমানের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার
পাউন্ড, সেন্ট্রি বিমানের ক্ষেত্রে ৩৩ হাজার পাউন্ড, সেন্টিনেল বিমানের
ক্ষেত্রে ২৫ হাজার পাউন্ড।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা যায়, কেন
এত যুদ্ধ, কেন এত খরচ। আরো অনেক দেশেও তো গণতন্ত্রের সংকট রয়েছে, চলছে
নিপীড়ন। অনেক জায়গাতেই আছে মানবিক সংকট। সে সব দেশে এ ধরনের কোনো হামলা
করেনি ন্যাটো বা ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ। তা হলে লিবিয়ায় কেন তা করা হলো? অথচ
লিবিয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সুসম্পর্ক ছিল। সে তথ্যও ফাঁস করেছে
যুক্তরাজ্যের পত্রিকা। এ ব্যাপারে তথ্যসমৃদ্ধ বইও প্রকাশিত হয়েছে। ইতালির
সঙ্গে গাদ্দাফির ছিল সুসম্পর্ক। ইতালির কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে
অর্থ যোগান দিয়েছিলেন গাদ্দাফি। এমন তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপে
বেআইনিভাবে মানুষ যাতে না ঢুকতে পারে সে চেষ্টা চালায় ইউরোপের দেশগুলো।
ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে ইতালি। আর ইতালির এ কাজে সহযোগী
ছিলেন গাদ্দাফি। বেআইনিভাবে ইতালিগামী মানুষকে আটক করার কাজে ইতালির সহযোগী
হয়ে ওঠেন গাদ্দাফি। লিবিয়ার ভেতরে বিরোধীদের ওপর নজরদারি করতে এবং
বিরোধীদের দমন-পীড়ন চালাতে যন্ত্রপাতি দিয়ে গাদ্দাফিকে সাহায্য করেছে
পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ। তাহলে আজ এসব দেশ গাদ্দাফির প্রতি অসন্তুষ্ট কেন?
ঘটনাবলী খেয়াল করলে দেখা যাবে যে,
লিবিয়ায় ন্যাটোর সাম্প্রতিক হামলার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। এ কারণগুলোর
একটি হচ্ছে লিবিয়ার তেল, যা এ লেখার গোড়ার দিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে।
লিবিয়ায় তেলের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই আজকের এ যুদ্ধের অন্যতম
কারণ।
No comments:
Post a Comment