Thursday, July 28, 2011

তেলের আগুনে পুড়ছে নাইজেরিয়ার মানুষ (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশ-৫)

যে দেশটির তেল নিয়ে রাজনীতির এত জটিল খেলা তেল কোম্পানি আর অন্যান্য দেশের, সেই নাইজেরিয়ার অবস্থা কেমন? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য দেখা যেতে পারে বিশ্ব শান্তি সূচকে নাইজেরিয়ার অবস্থান কোথায়? এ সূচক অনুযায়ী ২০১১ সালে নাইজেরিয়ার অবস্থান ছিল ১৪২তম। ইন্সটিটিউট অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস ১৫৩টি দেশের অবস্থান নির্ণয় করে এ সূচকের সাহায্যে। মোট ২৩টি গুণগত ও সংখ্যাগত সূচক দিয়ে ১৫৩টি দেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয় প্রতি বছর। সমাজে সহিংসতা আছে নাকি নেই, সেটা যাচাই করার কাজে ব্যবহৃত হয় এ সূচক, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় গ্লোবাল পিস ইনডেক্স বা জিপিআই। এ অবস্থান নির্ণয়ে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে থাকে একটি রাষ্ট্রের সামরিক ব্যয়, রাষ্ট্রটি মানবাধিকার কতটা মেনে চলে ইত্যাদি। জিপিআই অনুসারে নাইজেরিয়ার অবস্থান হয় জিম্বাবুয়ে ও শাদের পরে।

এরই পাশাপাশি দেখা যেতে পারে গণতন্ত্র সূচকে নাইজেরিয়ার অবস্থান। এ সূচক অনুসারে ২০১০ সালে নাইজেরিয়ার অবস্থান ছিল ১২৩তম। ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে এ সূচক ব্যবহার করে ১৬৬টি দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা পরিমাপ করে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন, ভোটারদের নিরাপত্তা, বিদেশী শক্তি বা সরকারের প্রভাব, রাষ্ট্রের নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়। ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স বা গণতন্ত্র সূচক ২০১০ প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ২৬ মে। এর আগের গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করা হয়েছিল ২০০৮ সালে।

এবার দেখা যাক এ দেশটিতে সংঘাতের ‘ছবি’টি কেমন? একেবারে সংক্ষেপে তা হচ্ছে :

১. তিন বছরে তেল সংশ্লিষ্ট বা তেল সৃষ্ট সংঘাতে সেখানে নিহতের সংখ্যা ৫৩ হাজার। অর্থাৎ তেল সংশ্লিষ্ট ঘটনায় বছরে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অর্থাৎ মাসে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। অর্থাৎ দিনে প্রায় ৫০ জন মানুষ। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় দু’জন মানুষ মারা যান বা মারা হয় সে দেশে। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। বাস্ত্তচ্যুত হয়েছেন হাজার হাজার নারী-শিশু-বৃদ্ধ-অসুস্থ মানুষ।

২. কোনো কোনো পরিসংখ্যান বলে, সে দেশের ৭০ ভাগ মানুষকে দারিদ্র্যরেখার নিচে জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে ব্যবস্থাটি। আবার কোনো কোনো পরিসংখ্যান বলে এ হার প্রায় ৩৭ ভাগ। জাতিসংঘের দারিদ্র্য সূচকের হিসাব অনুসারে এ দেশটির অবস্থান সবচেয়ে গরিব দেশ হিসেবে কোনো কোনো বছরে দাঁড়ায় ২৫তম।

৩. মরণরোগ এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের হিসাবের দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতের পরে নাইজেরিয়ার স্থান। এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২০০৫ সালে ছিল ২৯ লাখ। এদের মধ্যে ৫৫ ভাগ ছিলেন নারী। এইডস এতিম বলা যায় যে শিশুদের তাদের সংখ্যা সে সময় ছিল প্রায় ১০ লাখ।

৪. ইউনিসেফের হিসাব অনুসারে পৃথিবীতে অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুর সংখ্যা কমপক্ষে সাড়ে ১৪ কোটি। এদের মধ্যে কেবল নাইজেরিয়াতেই রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ।

ওপরের এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে রবি ভবানীর ২০০৮ সালে লেখা রিসোর্স স্কার্স সিটি অ্যান্ড এবানড্যান্স : অয়েল, ডেমোক্র্যাটাইজেশন অ্যান্ড কনফ্লিক্ট ইন দ্য নাইজার ডেল্টা দ্য হিউম্যান ফেস অব রিসোর্স কনফ্লিক্ট ইউনিসেফ ও বিবিসিসহ বিভিন্ন নিবন্ধ/সংবাদ মাধ্যম/আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশনা/খবর থেকে।

এ অবস্থা যে দেশটির, সে দেশ আফ্রিকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তেল উৎপাদক ও রফতানিকারক। দেশটির রাজস্বের প্রায় ৪০ ভাগ আসে তেল থেকে। ফলে দেশের গোটা অর্থনীতি হয়ে পড়েছে তেলনির্ভর। এর পরিণতিতে অর্থনীতি যে রোগে আক্রান্ত হয়, তার নাম ডাচ ডিজিজ বা ওলন্দাজ রোগ। এ রোগে এক পাশে কাৎ হয়ে পড়ে অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতির অন্যান্য অংশ হয়ে পড়ে বলহীন, যায় শুকিয়ে, কেবল তেলসিক্ত অশংটুকু হতে থাকে স্ফীত, তেল চকচকে। একে কেন্দ্র করে দেখা দেয় টানাটানি, উত্তেজনা। চালাক-চতুর ধুরন্ধর লোকেরা, ওপর মহলে হাত আছে এমন ফন্দিবাজরা বা মহাজনরা হাতিয়ে নিতে থাকে সব। তাদের চলাচল, বেশভূষা, গাড়ি-বাড়ি, শানশওকত, খাওয়া-দাওয়া, হাবভাব-ভঙ্গি, আচরণ, কথাবার্তায় যা প্রকাশ পায় তা উদ্ধত্য, বলদর্পী। সবাইকে পদানত করে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ধারাই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজে। রাজনীতি সমাজের, অর্থনীতির অংশ হওয়ায় ওলন্দাজ রোগের অপচ্ছায়া পড়ে রাজনীতিতে। সাধারণ যারা, যারা গরিব, কম আয় করা মানুষ হয়ে পড়েন কোণঠাসা। তাদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনী তোলে না রাজনীতিতে, সমাজে। মিথ্যাচার আর ভন্ডামির পাশাপাশি বেড়ে চলে বঞ্চনা, বৈষম্য, ধনী-গরিব বিভেদ। তৈরি হয় সংঘাতের পটভূমি।

এ অবস্থা অন্যান্য দেশেও দেখা গিয়েছিল/গেছে। সব ক্ষেত্রে তেলের পয়সার রোগ নয়। কোথাও তা হয় বিদেশী সাহায্য লুট করে নেওয়া পয়সায়। আবার কোথাও কাপড় সেলাই করা পয়সা, কোথাও মানুষ রফতানি করা পয়সা, কোথাও ব্যাংক ও অন্যান্য বাজার থেকে লুটে নেওয়া জনসাধারণের পয়সায়।

নাইজেরিয়ায় দেখা গেল তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে তেল কোম্পানিগুলো। এরা বিদেশী। দেশের মানুষ সবসময়ই দেখতে পাচ্ছেন তেল থেকে যে পয়সা আসে, তা তাদের ভাগ্যে জোটে না, সে তেল তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরায় না, তৈরি হয় ক্ষোভ, অসন্তোষ, ক্রোধ, তা অনেক ক্ষেত্রে চরমে রূপ নেয়। প্রাণ ধারনের শেষ উপায় হিসেবে কেউ কেউ তেল চুরি করেন, কেউ করেন অপহরণ, ক্রোধ প্রকাশে কেউ চালান অন্তর্ঘাত। সেই সঙ্গে থাকে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা, যে প্রতিযোগিতা কোম্পানিগুলো আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিষ্পত্তি করতে পারে না; আর তা পারে না বলেই এসব কোম্পানি তখন গড়ে তোলে/উস্কে দেয়/মদদ দেয় সশস্ত্র সংগঠন/সংগঠনগুলোক। একদিকে, অব্যবস্থাপনা-লুট-দুর্নীতি-পুকুর চুরি, আরেকদিকে দারিদ্র্য-ক্ষোভ, ছিচকে চুরি বাড়িয়ে তোলে সংঘাত। এ যেন খনি থেকে তেল তোলার সময় উপজাত হিসেবে বেরিয়ে আসা বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া আগুনের বিশাল শিখা। নাইজেরিয়ার নাইজার বদ্বীপে এমন শিখা, আক্ষরিক অর্থেই, অনেক জ্বলতে দেখা যায়।

এমনি এক শিখা জ্বলছিল সত্তরের দশক থেকে ইতালীয় তেল কোম্পানি এগিপের মালিকানাধীন তেলকূপের মাথায়। দিন-রাত পোড়ে গ্যাস, মাঝে-মধ্যে তেল ছিটকে পড়ে পাশের গ্রাম আকারাউলুতে, আর সে কূপের নাম অশি। সেই অশির শিখায় পুড়ে যায় আকারাউলুর কিশোর ভাগোগো জোয়েলের বাহু। জোয়েল তখন বাবার সঙ্গে মাছ ধরছিল। সে গ্রামের ১৭শ’ পরিবারকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, অর্থনৈতিক কল্যাণ আসবে তাদের জীবনে, এ তেলের বিনিময়ে। এ তথ্য দিয়েছে নাইজেরিয়ার তেল সংক্রান্ত একটি কেস স্টাডি।

এ অবস্থা যে ছবি ফুটিয়ে তোলে, তা হচ্ছে শোষণের, লুটের, আর এসবের সাথী সংঘাত, দারিদ্র্য, বৈষম্যের। তাই, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির নাইজার ডেল্টা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বা নাইজার বদ্বীপ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ২০০৬ সালে বলা হয় : চারপাশে প্রাচুর্য। আর তারই মধ্যে স্থানীয় অধিবাসীরা ভুগছেন দারিদ্রে্য, দুর্দশায়। এ কারণেই সেদেশে অনেকে তেল ও গ্যাসকে অভিশাপ হিসেবে গণ্য করেন, তেল গ্যাসকে মনে করেন দুধারী তলোয়ার।

এতে বলা হয়, তেলের দাম যখন বাড়তে বাড়তে সবকিছু ফাটিয়ে দিচ্ছে, তখনো নাইজেরিয়ায় মানুষের আয়ু কমছে। যে অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ যোগায়, সে অঞ্চলটির মানুষের ইন্ধন প্রাপ্যতা শোচনীয়। এ বদ্বীপ অঞ্চল প্রতি দিন ২০ লাখ ব্যারেলের বেশি অশোধিত তেল উৎপাদন করলেও এ অঞ্চলেই জ্বালানি আমদানি করতে হয়। যে অঞ্চলটি নাইজেরিয়ার অন্যান্য স্থানে বিশাল সব অবকাঠামো উন্নয়নে আর আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে ব্যয়বহুল শান্তিরক্ষা কাজে অর্থ যোগায়, সে অঞ্চলটিতে সড়ক নেই বললেই চলে। অথচ এ বদ্বীপ অঞ্চলই নাইজেরিয়ার বিদেশী মুদ্রা আয়ের ৮০ ভাগ ও সরকারি রাজস্বের প্রায় ৭০ ভাগ যোগায়।

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে পানি সরবরাহ ও টেলিযোগাযোগসহ অবকাঠামো ও সামাজিকসেবা পাওয়া যায় না; যতটুকু আছে, তার মান খারাপ।

এ প্রতিবেদন তৈরির জন্য সে অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে আলাপকালে একজন বলেন, এখানে জলের কলে পানি ছিল এক সময়ে। সেটা ২০ বছর আগে, আমরা এখন মূলত নদীর পানি পান করি।

এ অঞ্চলের বাসিন্দারা পানি সংগ্রহ করে নদী, হ্রদ, পুকুর থেকে। মাটির গভীরে নল বসিয়ে জল তোলা হলে, তা কিনতে হয়। বেকারত্বও ব্যাপক। অথচ এ বদ্বীপ অঞ্চলটিই প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির কাছে আকর্ষণীয়। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে শেল, শেভরন, মবিল, এল্ফ, এগিপ, টেক্সাকো। আরো কোম্পানি রয়েছে। পল্লী অঞ্চলের অনেক মানুষের কাছেই পরিবহন ও যোগাযোগ দুর্ভোগের উৎস হিসেবে গণ্য। মোটরসাইকেলে যাতায়াতের খরচ চড়া। তাই তাদের অনেকে হেঁটে পাড়ি দেন দীর্ঘপথ।

এমন বিবরণী জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির উপরোক্ত প্রতিবেদনে রয়েছে। আর এমন বিবরণ সে দেশে অনেক। তাই, তেল-গ্যাস আহরণ হলেই তা দূর করবে দারিদ্র্য, এ কথা যে সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়, নাইজেরিয়া তার প্রমাণ।

No comments:

Post a Comment