Thursday, August 4, 2011

অস্ত্র আর সংঘাত যে দেশে বাস্তবতা (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-৬)

এত তেল সম্পদের মধ্যেও হানাহানি-সংঘাত যেন নাইজেরিয়ার ‘স্বাভাবিক’ বাস্তবতা। ট্রেড অ্যান্ড পলিটিক্স ইন দ্য নাইজার ডেল্টা এইটিন থার্টি টু এইটিন এইটি ফাইভ বইতে কেও ডাইক জানান, নাইজার বদ্বীপে অধিকাংশ শহর গড়ে ওঠে ১৪৫০ সাল থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে, ইউরোপীয় বাণিজ্যের পর্বে। পামঅয়েল বাণিজ্যের কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা বা ফড়িয়ারা হয়ে ওঠে একটি শক্তিধর শ্রেণী। কালক্রমে এদের ও স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় সে সময় নাইজার বদ্বীপ শাসনের জন্য ভারপ্রাপ্ত রয়্যাল নাইজার কোম্পানির। তা বিদ্রোহে রূপ নেয়। কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার নাইজেরিয়া সরাসরি শাসনের দায়িত্ব নেয়। ঔপনিবেশিক-পূর্ব ও গোটা ঔপনিবেশিক, এ দুই পর্বজুড়ে নাইজার বদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষি ও মাছ।
ভি আলমিয়েসেইঘা তার থটস অন ফেডারেলিজম, সাউথ-সাউথ অ্যান্ড রিসোর্স কন্ট্রোল বইতে বিশ্ব ব্যাংকের ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লিখেছেন : প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয় যে, কৃষিক্ষেত্রে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কাঠ হয়ে ওঠে এক বিশাল পণ্য। সে সময় উৎপাদিত হতো পামঅয়েল, নারকেল শাঁস, রাবার, কোকো ও কাঠ। এসব পণ্য উৎপাদিত ও রফতানি করে উপার্জিত হতো বিদেশী মুদ্রা। ইউনাইটেড আফ্রিকান কোম্পানির সাবসিডিয়ারি আফ্রিকান টিম্বার অ্যান্ড প্লাইউড কোম্পানি কাঠ প্রক্রিয়া করার বিশাল কারখানা স্থাপন করে সাপেলে নামের জায়গায়। সেটাই ছিল সে সময় আফ্রিকায় এ ধরনের বৃহত্তম কারখানা। নাইজেরিয়া ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিল বিশ্বের বৃহত্তম পামঅয়েল উৎপাদক, নাইজেরিয়ায় পামঅয়েল উৎপাদন দেখেই মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ নাইজেরিয়া থেকে পামঅয়েল উৎপাদন শেখে। আজ মালয়েশিয়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পামঅয়েল উৎপাদক দেশ, আর, শীর্ষস্থানীয় পামঅয়েল রফতানিকারক দেশগুলোর তালিকায় নাইজেরিয়ার নাম মুছে গেছে। এ তথ্য জানায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন।
এই প্রতিবেদনেই বলা হয় : পামঅয়েল উৎপাদনের অবস্থা আজ নাইজেরিয়ায় এমন স্তরে নেমেছে যে, বহু পামগাছ থেকে তেল আর আহরণই করা হয় না, নতুন পামগাছও লাগানো হয় খুব কম। রাবার আবাদ যেন পুরনো দিনের ছায়া, নদীর পানি আর মাটিকে তেল এমনভাবে দূষিত করেছে যে, ফসল আর মাছপ্রাপ্তিও গেছে কমে।
এতে আরো বলা হয় : মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে সহিংস রাজনৈতিক সংঘাত ষাটের দশকে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা যায়নি। ফলে ধসে পড়ে স্বাধীন নাইজেরিয়ার প্রথম সরকার। সেটা ১৯৬৬ সালের ঘটনা। নাইজেরিয়ায় ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে যে গৃহযুদ্ধ, তা সারা দেশে বিস্তার ঘটায় ক্ষুদ্র অস্ত্রের, বিরোধ মীমাংসায় অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। নাইজার বদ্বীপ অঞ্চল সংঘাত দীর্ণ হয়ে ওঠে নববইয়ের দশক থেকে। সংঘাত চলে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, সম্প্রদায়ের মধ্যে, জাতিগত ক্ষেত্রে, তেল কোম্পানির ও জনবসতের মধ্যে। তেল সার্ভিস কোম্পানি আরকোর সঙ্গে বিরোধ দেখা হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। সে বিরোধ গড়িয়ে চলে; একপর্যায়ে তা স্থানীয় বাসিন্দাদের দুই বিবদমান দলে বিভক্ত করে।
ওজেবি ওজোর লেখা দ্য নাইজার ডেল্টা ম্যানেজিং রিসোর্সেস অ্যান্ড কনফ্লিক্টস বইতে বলা হয়েছে : তরুণদের মধ্যে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, মিলিয়ন মিলিয়ন (দশ লাখে এক মিলিয়ন) নায়রা (নাইজেরীয় মুদ্রা) দামের সম্পত্তি ধ্বংস হয়, বন্দুক হাতে কিশোররা হয়ে ওঠে সশস্ত্র ডাকাত, চাঁদাবাজ।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির উপরোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘নেমবে যুদ্ধ’ নামে এক ধরনের সংঘাত দেখা দেয়। শেল, এগিপ, প্রভৃতি কোম্পানি নেমবেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ প্রদান কন্ট্রাক্ট বা ঠিকা কাজ দেওয়া ও চাকরি দেওয়ার চুক্তি করে। সচরাচর যেমন ঘটে, সেভাবেই গোত্র বা সমাজপ্রধান প্রাপ্ত সুবিধার বেশিরভাগ রেখে দেয় নিজের ভাগে। বেশিরভাগ অর্থ নেয় তারা। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পায় অধিকাংশ ঠিকা কাজ। এমনকি সর্দার বা প্রধানদের সুপারিশ পেলেই চাকরি পাওয়া যেত। যে যুবকরা এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ল, তারা নববইয়ের দশকে সংগঠিত হলো এ লেনদেনের মধ্যে ঢোকার জন্য। তারা তেলকর্মীদের হয়রানি করা, জিম্মি হিসেবে আটক রাখা, তেল প্রবাহ কেন্দ্র দখল করা এবং এ ধরনের নানা কাজ শুরু করল। তেল কোম্পানিগুলো যাতে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ও পয়সাকড়ি দেয়, সেই উদ্দেশ্যে তারা এসব কাজ শুরু করে। প্রাপ্ত পয়সাকড়ির পরিমাণ এত বেশি যে এ যুবকরা আরো ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে পড়ে এবং প্রতিটি ছোট দল আলাদা আলাদাভাবে দাবি জানাতে থাকে। দেখা দেয় প্রতিদ্বন্দ্বী সব গ্যাং বা দল। উদ্ভব ঘটে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের চাঁদাবাজ দল সব। এরাও তরুণ। তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এরাও চাঁদা দাবি করতে থাকে। একবার, প্রথম প্রজন্মের চাঁদাবাজরা গেছে চাঁদার অর্থ আদায়ে অঙ্গরাজ্যের সদরে; সে সময় নেমবেতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের আরেকটি দল। সমাজের সবাই ২০০০ সালে এ অবস্থা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত নেমবেতে চলতে থাকে সন্ত্রাসের রাজত্ব। ফল দাঁড়ায় জানমালের বিপুল ক্ষতি।
সংঘাতের বিবরণ দিয়ে এ প্রতিবেদনে বলা হয় : বিভিন্ন গোত্রের বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সবসময় সহিংস রূপ নেয় না। কোনো কোনো বিরোধ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। মামলার রায় পছন্দসই না হলে বিরোধ রূপ নেয় সহিংসতায়। কখনো একই সম্প্রদায়ের বা গোত্রের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এধরনের সংঘাত সত্তরের দশক, বিশেষ করে নববইয়ের দশক থেকে বেড়েছে। সংঘাতের অন্যতম বিষয় জমি। কারণ, প্রতি খন্ড জমিই হয় তেল আহরণ নয় এ আবাদ বা দালানকোঠা তৈরির জন্য মূল্যবান। সংঘাতে গোটা সম্প্রদায়, গোত্র বা বসত ধ্বংস হয়ে গেছে, এমন একাধিক উদাহরণ রয়েছে। সংঘাতের বহু বছর পরে কোনো কোনো জায়গায় গিয়ে কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে যে, সেখানে এক সময় একটি শহর ছিল, আর সে শহরে ছিল কয়েক হাজার মানুষের বাস। সংঘাতের আরেকটি কারণ তেলের অর্থের ভাগাভাগি। উন্নয়ন কার্যক্রমের ভাগাভাগি, রাজনৈতিক প্রাধান্য, প্রভৃতি বিষয়ও সংঘাতের কারণ হয়ে ওঠে।
মানব উন্নয়নবিষয়ক এ প্রতিবেদনে তেল কোম্পানিগুলো ও বসত বা জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্কও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয় : তেল সংক্রান্ত কার্যক্রমের পরিণতি নিয়ে সার্বিকভাবে কমিউনিটি বা বসত বা সম্প্রদায়গুলো অসন্তুষ্ট। এ অসন্তোষ প্রকাশ পায় বিভিন্ন রূপে। এসবের মধ্যে থাকে তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভ, তেল কোম্পানিগুলোর কাজে অবরোধ, তেলের পাইপে ও স্থাপনায় অন্তর্ঘাত চালানো, তেল কর্মীদের জিম্মি নেওয়া। কোনো কোনো গ্রুপ সনদ, দাবিনামা বা ঘোষণা প্রণয়ন করেছে। বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কোনো কোনো গ্রুপ। নিজেদের দাবিগুলো ব্যক্ত করার জন্যই এগুলো প্রণীত হয়েছে। এমন একটি ঘোষণার নাম কাইয়ামা ডিক্লারেশন বা কাইয়ামা ঘোষণা। এটি প্রণয়ন করেছে নাইজার বদ্বীপের যুবকরা। এতে রয়েছে ‘আমাদের সম্পদ আমরা চাই কেন? তার ১০০টি কারণ।’ ওরোন বিল অব রাইটস নামের একটি ঘোষণায় আকওয়া ইবোম অঙ্গরাজ্যের ওরোন জনগোষ্ঠী নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেছে। আবার, ওয়ারি একর্ড নামের ঘোষণায় বা রাজনৈতিক দলিলে ডেল্টা অঙ্গরাজ্যের ইটসেকিরি জনগোষ্ঠী তাদের এলাকায় তেল উৎপাদন থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার উপায়গুলো সন্ধান করেছে। রিভার অঙ্গরাজ্যের ওগোনি জনগোষ্ঠী ওগোনি বিল অব রাইটস নামের রাজনৈতিক দলিলে তাদের এলাকায় তেলসম্পদ আহরণের ফলে তৈরি হওয়া পরিবেশ অবক্ষয়, অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।
এসব মাত্র কয়েকটি। এসব ঘোষণা বা কর্মসূচি বা রাজনৈতিক/সামাজিক/পরিবেশগত দলিল থেকে স্পষ্ট হয় যে, তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জনসাধারণের বিরোধ নাইজেরিয়ার বাস্তবতার তেল-বাস্তবতার অন্যতম প্রধান বিষয়। আর, এ তেল বাস্তবতা তৈরি হয়েছে প্রাপ্য সুবিধা না পাওয়া, পরিবেশের ক্ষতি, নিজেদের ভাগ্যের ওপর অন্যের নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি নানা সমস্যা থেকে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির এ প্রতিবেদনে বলা হয় : তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা যে এলাকা থেকে তেল নিয়ে যায়, সে এলাকাকে যথেষ্ট সহায়তা করে না। তারা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থা, সড়ক, বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি অবকাঠামো পর্যাপ্তভাবে দেয় না। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বিশেষ করে একটি কোম্পানির নাম উল্লিখিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে তেল কোম্পানিগুলোর কাজের কারণে পতিতাবৃত্তির বিস্তার ঘটেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে : জমি হারিয়ে যায় তেল আহরণের কাছে। এর পাশাপাশি, তেলকর্মীদের অনুপ্রবেশ বাড়িয়ে তোলে জীবনধারণের ব্যয়। তেল কোম্পানিতে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা দরকার, স্থানীয় মানুষের তা না থাকায় তারা চাকরি পান না, পেলেও কায়িক মেহনতের ও কম বেতনের কাজ। তারা পড়েন মর্যাদাহীন অবস্থায়। আন্দোলনকারীরা বলেছেন, এটা করা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে, স্থানীয় মানুষকে বাইরে রাখার জন্য। প্রধান প্রধান কোনো তেল কোম্পানিরই সদর দফতর বদ্বীপ অঞ্চলে নয়। সংঘাতের আরো কারণ রয়েছে। সেসব আগামীতে। নাইজেরিয়ায় তেল নিয়ে যা হয়েছে, তা যে ফলাফল বয়ে এনেছে, সেটা গভীরভাবে দেখার বিষয়। এ কারণেই নাইজেরিয়ার তেল ও সংশ্লিষ্ট নানাদিক দেখা দরকার। তা একটু দীর্ঘ হতে পারে। তবে তা দরকার।

No comments:

Post a Comment