Thursday, August 18, 2011

দুর্দশা নারীদের : ক্ষতি পরিবেশের (তেল-গ্যাস লুণ্ঠন দেশে দেশে-৮)

নাইজেরিয়া আর তেল নিয়ে আলোচনায় যুবকদের প্রসঙ্গ বারবার আসে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির নাইজার বদ্বীপ অঞ্চল সংক্রান্ত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেও প্রসঙ্গটি এসেছে, যা ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে নারীদের প্রসঙ্গটিও স্থান পায়। এতে বলা হয় : তেলসমৃদ্ধ নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে দারিদ্রে্যর বোঝা বেশি বইতে হয় নারীদের। এ বোঝা সবচেয়ে আগে এসে পড়ে তাদেরই ওপর। চাকরি, স্বাস্থ্য, পানি, শিক্ষা, পরিবেশ, নানান ক্ষেত্রে যা কিছু সমস্যা, অপ্রাপ্তি, সংকট, টানাটানি, অভাব সবই আগে চাপে নারীদের ঘাড়ে। বঞ্চনার এত ব্যাপকতা, বিস্তৃতি, গভীরতা তাদের জড়িয়ে ফেলে সংঘাতে।
শেল পেট্রোলিয়াম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির ২০০২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে নারীদের প্রতিবাদের একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। সে ঘটনার বিবরণ সংক্ষেপে হচ্ছে : আগস্টের একদিন বিপুলসংখ্যক নারী ব্যারিকেড তৈরি করেন ওয়্যারিতে এ কোম্পানির কার্যালয়ের গেটের সামনে। কোম্পানি ঠিকাদারের মাধ্যমে গাড়ি ব্যবহার করে। গাড়ি ও চালকদের যোগান দেয় ঠিকাদার। এ চালকদের সঙ্গে ঠিকাদারের বিরোধ হয়। চালকরা এ বিরোধ নিরসনে গেটের সামনে সমবেত হন। তারা নারীদেরও সমবেত করেন। তাদের হটিয়ে দিতে পুলিশ ডাকা হয়। পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে। এক বিবরণে বলা হয়, একজন নারী গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকজন নারীর খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে পরে আরেক অনুসন্ধানে এ বিবরণের সমর্থন পাওয়া যায়নি। চারজন নারী জানান, তাদের প্রহার করা হয়েছে। মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনে বলা হয় : তেল আহরণের এলাকাগুলোতে পতিতাবৃত্তির বিস্তার ঘটে। পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন এইচআইভি/এইডসে।
পরিবেশ : দারিদ্রে্যর সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তবে কেবল গরিব দেশগুলোতেই পরিবেশ সমস্যা আছে তা নয়, ধনী দেশগুলোতেও পরিবেশ সমস্যা রয়েছে। নাইজেরিয়াকে যেদিক থেকেই গণ্য করা হোক, সেখানেও পরিবেশের সমস্যা রয়েছে। এ লেখায় নাইজেরিয়ার সার্বিক পরিবেশ সমস্যার ওপর আলোকপাত না করে তেল সম্পদ নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে, নাইজার অঞ্চলের পরিবেশ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্যা, পলি জমে জলপ্রবাহ পথ বন্ধ হওয়া, নদী তীর ও বেলাভূমি ভাঙন, বসত গড়ে তোলা ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজের উপযুক্ত জমির অভাব ইত্যাদি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে তেল আহরণ সংশ্লিষ্ট পরিবেশ সমস্যাগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। ওলোইবিরিতে ১৯৫৮ সালে প্রথম বারেরমতো তেল আহরণ শুরু হলো, তারপর থেকে খনন করা হয়েছে এক হাজার ৪৮১টিরও বেশি তেলকূপ, গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫৯টি তেল ক্ষেত্র, সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি পাইপলাইন বা তেল নল ও ফ্লো লাইন বা প্রবাহ নল পাতা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে ২৭৫টি ফ্লো স্টেশন বা প্রবাহকেন্দ্র। এগুলো করেছে ১৩টি তেল কোম্পানি। তেল উৎপাদনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তেল উৎপাদনের পরিবেশগত প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও বৃদ্ধি পায়। নাইজার অঞ্চলের পাঁচ শতাংশ জমি রয়েছে তেল শিল্পের হাতে। সংখ্যার বিচারে এ পরিমাণ জমি কম হলেও তার পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ব্যাপক ও সমগ্র অঞ্চলজুড়ে। তেল আহরণের ফলে পরিবেশের যেসব ক্ষতি হয়, সেগুলোর কয়েকটি চোখে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, এ সবের মধ্যে রয়েছে মাটি, ভূপৃষ্ঠের ও ভূগর্ভের জল, বাতাস দূষিত হয়ে পড়া। কিন্তু এগুলো ছাড়াও প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পড়ে আর্থসামাজিক অবস্থার ওপরে।
চলাচলের জন্য সময় যাতে কম লাগে এবং সহজে তেল ক্ষেত্রগুলোতে ও স্থাপনাগুলোতে যাওয়া যায় সে উদ্দেশ্যে তেল কোম্পানিগুলো খনন করে খাল। এসব খাল দিয়ে মিঠা পানির এলাকায় ঢুকে পড়ে নোনা পানি। ফলে ধ্বংস হয় মিঠা পানি এলাকার প্রতিবেশ। নতুন নতুন এলাকায় ঢোকা সহজ হয়ে ওঠায় বনের গাছ বেআইনিভাবে কাটা বৃদ্ধি পায়। তেল কোম্পানিগুলো কাটা খাল, নদী ইত্যাদি জলপথের নাব্যতা বজায় রাখতে এগুলো অবিরাম ড্রেজিং করে বা পলি ইত্যাদি সরায়। সরিয়ে নেওয়া পলি, মাটি, কাদা ফেলা হয় দুই তীরে। এতে এসব জমির জলপ্রবাহ বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়, বাধা পায় পানির অবাধ প্রবাহ, তৈরি হয় ছোট ছোট জলাশয় বা পুকুর। ভাটিতেও প্রতিবেশের ক্ষতি হয়।
তেল উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও বেড়ে চলে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কখনো তেল ছড়িয়ে পড়ে দুর্ঘটনাবশত, কখনো স্থানীয় লোকদের ইচ্ছাকৃত কাজের ফলে। সরকার আর তেল কোম্পানিগুলোর কাজের প্রতিবাদ হিসেবে জনসাধারণ এ ধরনের অন্তর্ঘাত চালান।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৮১৭টি। এতে আনুমানিক ৩০ লাখ ব্যারেল তেল নষ্ট হয়েছে। এ তেলের ৭০ ভাগের বেশি উদ্ধার করা যায়নি। ছড়িয়ে পড়া তেলের ছয় ভাগ স্থলভাগে, ২৫ ভাগ জলাভূমিতে আর ৬৯ ভাগ সাগর তীরের কাছে পরিবেশ-প্রতিবেশে।
শেল পেট্রোলিয়াম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির ২০০৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩শ’র বেশি। তেল ছড়িয়ে পড়ার পরিবেশগত প্রভাব প্রতিক্রিয়া বহুল আলোচিত বিষয়। জলাভূমি, বনাঞ্চল ইত্যাদি জায়গায় তেল ছড়িয়ে পড়লে বন ধ্বংস হয়, গাছপালা, মাছ, পাখিসহ নানা প্রাণী মারা যায়। খাদ্যে বিষক্রিয়াও ঘটে। এসব বক্তব্য উল্লেখ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালের ১ আগস্ট অনডো অঙ্গরাজ্যে সমুদ্র তট বরাবর উবালে কেরেরের কাছে তেল কোম্পানি শেভরনের এওয়ান তেল ক্ষেত্রে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে ছয়টির বেশি বসত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় মাছপ্রাপ্তির এলাকাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এসব এলাকার বাসিন্দাদের আয়ের উৎস মাছ ধরা। তাই নিজেদের দুর্ভোগের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে জনসাধারণ অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আকুরেতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘন ঘন ঘটতে থাকা এবং তেলশিল্প সংশ্লিষ্ট নেতিবাচক পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া জনমনে উদ্বেগ তৈরি করে। তা জনাসাধারণকে করে তোলে বিক্ষুব্ধ।
নাইজেরিয়ায় তেলের প্রসঙ্গ উঠলে দেশটিতে গ্যাসের নানা দিকও এসে পড়ে। আগামীতে সেই গ্যাস প্রসঙ্গ।

No comments:

Post a Comment